মিলান কুন্দেরার কবিতা : মলয় রায়চৌধুরী

মিলান কুন্দেরার কবিতা  : মলয় রায়চৌধুরী

.

এক

.

মিলান কুন্দেরার ( জন্ম ১৯২৯ )সাহিত্যকর্ম আলোচনার সময়ে তাঁর কবিতার আলোচনা হয় না, কেননা কুন্দেরা চাননি যে তাঁর স্তালিনভক্তির সময়কার রচনাগুলো আবার প্রকাশিত হোক । তাঁর কাব্যগ্রন্হ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে ।‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ এবং আরও দুটি   কবিতার বই কুন্দেরা লিখেছিলেন যখন উনি একজন ঘোর স্তালিনিস্ত কমিউনিস্ট কর্মী, কলকাতায় লোকে যাকে বলে ‘পার্টি করা’।১৯৫৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য লাস্ট মে’ উৎসর্গ করেন নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়া কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব জুলিয়াস ফুচিককে। আঠারো বছর বয়সে, তিনি  চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন । ১৯৮৪ সালে, তিনি বলেছিলেন যে “কমিউনিজম আমাকে স্ত্রাভিনস্কি , পিকাসো এবং পরাবাস্তববাদের মতোই বিমোহিত করেছিল ।  মিলান কুন্দেরা সেই প্রজন্মের তরুণ চেকদের অন্তর্ভুক্ত যারা ১৯৪৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিজমের আগমনকে উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ১৯৬০-এর দশকের সংস্কারবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, যা ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ বসন্তে; পরিণত হয়েছিল। সেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরাজয়ের পর, তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী হয়ে ওঠেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মিলান কুন্দেরার মতন পশ্চিম ইউরোপে নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন।

.

 কেন এত  চেকোস্লোভাক তাদের প্রথম যৌবনে দিকে স্তালিনবাদী কমিউনিজমকে এত প্রবলভাবে গ্রহণ করেছিল? জেদেনেক ম্লিনার,  ১৯৬৮ সালের  চেকোস্লোভাক কমিউনিস্ট পার্টি অ্যাকশন প্রোগ্রামের লেখক এবং ১৯৫০-এর দশকে মস্কোতে মিখাইল গর্বাচেভের এক সময়ের সহকর্মী, তাঁর স্মৃতিকথায় এটি  স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :-

.

 “আমি ১৯৪৬ সালের বসন্তে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম, তখন আমার বয়স ষোল বছরও হয়নি । এইভাবে আমি চেকোস্লোভাক কমিউনিস্টদের প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত যারা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় বিশের কোঠায় ছিল, যখন কমিউনিস্ট সর্বগ্রাসী একনায়কত্ব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছিল, আর আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেই প্রজন্মের প্রেক্ষিতে অদ্ভুত। আমার প্রজন্ম সেই সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনাগুলো নিয়ে  রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়েছিল; একই সময়ে আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না ।  আমাদের একমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল যুদ্ধের বছরগুলো আর চেকোস্লোভাকিয়ার নাৎসি দখল, এবং এই সময়ে বলতে গেলে আমরা  শিশু ছিলাম। এর প্রধান ফলাফলগুলির মধ্যে একটা ছিল বিশ্বকে কালো-সাদায় দেখা, একদিকে শত্রু আর অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ। ব্যাপারটা হয় এদিকে নয়তো ওদিকের মতন। কোনও মাঝামাঝি জায়গা ছিল না। এইভাবে আমাদের মগজে যে ভাবনা গড়ে ওঠে তা হল  এই ধারণা যে বিজয় মানে একদিককে মান্যতা দেয়া আর অন্যটির ধ্বংস হওয়া। আমরা আমাদের আদিম মৌলবাদের মোকাবিলায় ব্যবহৃত যেকোনও যুক্তিকে কাপুরুষতা  বলে মনে করতুম। আমরা ছিলুম যুদ্ধের সন্তান যারা আসলে কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ  করেনি কিন্তু  আমাদের যুদ্ধকালীন মানসিকতাকে সেই প্রথম যুদ্ধোত্তর বছরগুলোয় বয়ে নিয়ে গেছি। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির আগে আর তার পরে বেশ কয়েক বছর ধরে, আমাদের সমাজতন্ত্রের ধারণাটা স্তালিনবাদীদের পুরানো প্রজন্মের তুলনায় আরও বেশি আদিম এবং একতরফা ছিল , যারা অতোকিছু সত্ত্বেও, বছরের পর বছর ধরে স্তালিনবাদে ছোটখাটো সমন্বয় করেছিল।

.

সেই সময়ে চেকোস্লোভাকিয়ায় ম্লিন্যার এবং কুন্দেরা ছাড়াও  আরও উল্লেখযোগ্য  তরুণ স্তালিনবাদী ছিলেন, যেমন, লেখক এবং সাংবাদিক লুডভিক ভাকুলিক (জন্ম ১৯২৬ ),  একজন উদ্যমী এবং সক্রিয় সাংবাদিক, যিনি আশেপাশের অনেকের মতো  যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন তার সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করেন এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন।. ভাকুলিকের পরীক্ষামূলক উপন্যাস ‘সেকিরা’ (দ্য অ্যাক্স, ১৯৬৬) একটি  “মোহভঙ্গের উপন্যাস”, যা চেকোস্লোভাকদের কমিউনিজম নিয়ে পরীক্ষায় ১৯৬০এর দশকের  দশকের গোড়ার দিকে হয়েছিল তা উপস্হাপন করে । পরবর্তীকালে, তাঁর অনেক সহকর্মীর মতো, ভাকুলিক ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের সংস্কার আন্দোলনের একজন প্রধান নায়ক এবং ১৯৬৮ সালের আগস্টে ওয়ারশ চুক্তি আক্রমণের পরে একজন ভিন্নমতের লেখক হয়ে ওঠেন। কবি পাভেল কোহাউট, যিনি ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশাল জনতার কাছে তাঁর রাজনৈতিক কবিতা আবৃত্তি করতেন, স্তালিনবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনিও ভাকুলিক এবং অন্যদের মতো একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। ইহুদি লেখক ইভান ক্লিমা এবং আর্নোস্ট লুস্টিগ  প্রাথমিকভাবে স্তালিনিবাদী কমিউনিজমের সমর্থক হয়ে ওঠেন কারণ তাঁরা ছিলেন শৈশবে নাৎসি বন্দী শিবিরে সময় কাটানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ফসল। লুস্টিগকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, “আপনি কীভাবে স্ট্যালিনবাদকে সমর্থন করতেন?” তখন তিনি শুধু মাথা নেড়ে একটা হতাশ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে “সেই অভিজ্ঞতা” যার নেই তার কাছে এরকম অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা যায় না ।

.

ফিলিপ রথকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্দেরা বলেছেন, “একনায়কতন্ত্র কেবলমাত্র নরক নয়, বরং একই সঙ্গে স্বর্গের স্বপ্ন – পৃথিবীর প্রাচীন কল্পনা যেখানে সবাই একই সাধারণ ইচ্ছা ও বিশ্বাস নিয়ে শান্তিতে বাসচ করবে। একজনের সঙ্গে আর একজনের কোনও গোপনতা থাকবে না । আঁদ্রে ব্রেতঁও এই স্বর্গের কথা কল্পনা করেন, যখন তিনি বলেন সেই কাচের বাড়ির কথা যেখানে তিনি বাস করার স্বপ্ন দেখেছিলেন । যদি একনায়কতন্ত্র এই আর্কিটাইপগুলো ব্যবহার না করত – যেগুলো আমাদের চিত্তের ও সব ধর্মের গভীরে শেকড় গেড়ে আছে – তাহলে তা কখনই এত লোককে আকর্ষিত করতে পারত না, বিশেযত এর সাকার অভ্যূদ্যয়ের পপথম মপর্বে। যখনই স্বর্গের স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিতে শুরু করল, তখন যেকোনো ভাবেই হোক, এখানে সেখানে কিছু লোক দেখা গেল যারা এর প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল, সুতরাং স্বর্গের শাসকরা বাধ্য হল ইডেনের বাইরে একটা কয়েদখানা বানাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কয়েদখানা বড়ো হতে থাকলো, যখন কিনা পাশের স্বর্গটি আরও ক্ষুদ্র ও জৌলুসবিহীন হতে থাকলো ।”

.

স্তালিনবাদী সময়ে রুশ সাম্রাজ্যবাদ যখন চেকোস্লোভাকিয়ায়  মানুষের কণ্ঠরোধ করছে, যখন একজন ব্যক্তিমানুষ কী ভাববে বা কী লিখবে, তাও নিয়ন্ত্রণ করছে কমিউনিস্ট পার্টি, তখন মিলান কুন্দেরা মগজে তৈরি করতে আরম্ভ করলেন ব্যক্তি মানুষের প্রতিরোধ। তাঁর কবিতা স্তালিনবাদ থেকে ক্রমশ এগিয়ে গেছে ব্যক্তির স্বাধীনতার দিকে যার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৫০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন । যে যুবতীর সঙ্গে সেক্স করছিলেন তাকে বেফাঁস পার্টিবিরোধী কথা বলে ফ্যালেন। পরবর্তীকালে উপন্যাসে তিনি তাই লিখেছেন যে ভালোবাসা আর সেক্স সম্পূর্ণ আলাদা । ফলে, যেমন যৌনতাকে তিনি তাঁর উপন্যাসের এক প্রয়োজনীয় সন্দর্ভ করে তুলছেন ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’-এ, তেমনই রাজনীতি মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে এই যৌনতার মধ্যেও। একদিকে তিনি ‘আইডেন্টিটি’ , ‘ইগনোরেন্স’, ‘দ্য জোক’-ইত্যাদি উপন্যাসে তৈরি করেছেন  শ্লেষাত্মক রাজনৈতিক সন্দর্ভ আর অন্যদিকে যৌনতার এক বিকল্প ভাষ্য যা অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্ভব নয়।বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা চেকোসলোভাকিয়ায় তাঁর কবিজীবন থেকে পাওয়া। The Unbearable Lightness of Being উপন্যাসে, টমাসের একাধিক নারীর সঙ্গে সঙ্গম সম্পর্কে কুন্দেরা বলেছেন, যৌনতার সঙ্গে ভালোবাসার কোনই সম্পর্ক নেই, এবং দ্বিতীয়ত, একজন মানুষকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনার, বা একজন মানুষের অতি নিগুঢ় “আই” বা “বিয়িং” কে চেনার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গম। শীৎকার, সাবমিসিভনেস, এবং রাগমোচনের মুহূর্তে অস্ফূট সাড়া –  ভিন্ন ভিন্ন নারী-পুরুষের একইরকম হয় না।

.

দুই

.

 “কমিউনিস্টরা সর্বদা তাদের পার্টির জন্য সবচেয়ে আদর্শবাদী, সবচেয়ে সাহসী এবং সবচেয়ে উত্সাহী লোকদের নিয়োগ করার চেষ্টা করেছিল,” বলেছেন হেদা কোভালিওভা,  রুডলফ মার্গোলিয়াসের বিধবা স্ত্রী , যিনি  কমিউনিস্ট বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, আর ১৯৫২ সালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন ।  প্রকৃতপক্ষে, কুন্ডেরা নিজেও ১৯৫০  এর দশকের গোড়ার দিকে তরুণ চেক কমিউনিস্টদের আদর্শবাদের এইভাবে প্রশংসা করেছিলেন:

.

 “সুতরাং কমিউনিস্টরা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রক্তপাত বা সহিংসতা ছাড়াই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, আর জাতির  প্রায় অর্ধেক তাকে উল্লসিত অভিবাদন করেছিল। এবং এখন দয়া করে মনে রাখবেন: যে অর্ধেক উল্লাস করেছিল, তারা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গতিশীল, আরও বুদ্ধিমান, আরও ভাল। হ্যাঁ। আপনি যা চান বলুন, কমিউনিস্টরা আরও বুদ্ধিমান ছিল। তাদের একটি প্রভাবশালী প্রোগ্রাম ছিল। একটি সম্পূর্ণ নতুন বিশ্বের  পরিকল্পনা ছিল যেখানে সবাই সমান জায়গা পাবে। তারা দ্রুত তাদের স্বপ্ন, সকলের জন্য ন্যায়বিচারের সেই দীপ্তিকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে দিলো,  সকলের জন্য এক স্বপ্নময় বিশ্ব। কিন্তু স্বপটা যেহেতু সকলের জন্য  তাই যারা দেশত্যাগ করার চেষ্টা করেছিল তারা নিজেদের সেই স্বপ্নের অস্বীকারকারী হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। বিদেশে যাওয়ার বদলে তাদের জেলে পুরে দেয়া হয়েছিল । আর তারপরে এই তরুণ, বুদ্ধিমান এবং র‌্যাডিক্যাল যুবকেরা হঠাৎ করেই এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় ভুগতে লাগল যে পৃথিবীতে এমন একটি কর্মকাণ্ড  পাঠানো হয়েছে যা তার নিজস্ব নিয়মে চলা আরম্ভ করেছে , আর যে ধারণার উপর ভিত্তি করে কর্মকাণ্ড হবার কথা ছিল তাকে পাত্তা দেয়া হয়নি। যারা এই ধারণা তৈরি করেছিল তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। সেই যুবক ও বুদ্ধিমান লোকেরা নিজেদের কাজকেই বর্জন  করতে শুরু করল , তারা এটিকে অমান্য করতে শুরু করল, এটিকে তিরস্কার করতে লাগল, এটিকে অনুসরণ করা ছেড়ে দিল, এটিকে তাড়াবার জন্য উঠেপড়ে লাগল। আমি যদি সেই প্রতিভাধর এবং র‌্যাডিক্যাল প্রজন্মকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখি, তবে আমি তার নাম দেবো ‘ইন পারসুট অফ অ্যারান্ট অ্যাক্ট বলব।” 

.

 এই সাহিত্যিক নির্যাস থেকে আর মিলান কুন্দেরার  অন্যান্য অনেক রচনা থেকে, এটা স্পষ্ট যে, যেমন আরও অনেক চেকোস্লোভাক বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে স্তালিনবাদী ছিলেন, তাঁদের মতনই, কুন্দেরা  গভীরভাবে আঘাত পেয়েছিলেন, একথা বিশ্বাস করে যে, কমিউনিস্ট ইউটোপিয়া সম্ভব।তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁদের প্রজন্মকে প্রতারিত করা হয়েছিল । আরেকজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট, পেটর পিথার্ট, বহু বছর পরে তাঁর ভিন্নমত সম্পর্কে যুক্তি দিয়েছিলেন যে তাঁদের আদর্শকে স্তালিনবাদী শাসনের দ্বারা যৌবনে ব্যবহার করা হয়েছিল এই  ভাবনার ফলে তাঁদের অপরাধবোধের অনুভূতি  কমিউনিস্ট সংস্কার আন্দোলনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে চেকোস্লোভাকিয়া এবং ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ বসন্ত’ এই কমিউনিস্টদের জন্য ছিল একটি “আত্ম-শুদ্ধিকরণ প্ররোচনা” । ১৯৬৮ সালে  প্রকাশিত মিলান কুন্দেরার মতামতের  সঙ্গে একমত হয়ে  পিথার্ট জানিয়েছেন যে, ১৯৬৮ সালের আগস্টের ওয়ারশ চুক্তি-ভিত্তিক আক্রমণ  প্রাক্তন তরুণ স্স্তালিনবাদীদের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিয়েছিল, যারা  ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে সংস্কারবাদী কমিউনিস্ট ছিল আর বুঝতে পেরেছিল যে তাদের দেশকে সোভিয়েত উপনিবেশে পরিণত করতে তারাই কিনা  সাহায্য করেছিল। স্তালিনবাদী কমিউনিজমকে সমর্থন করার জন্য  কুন্দেরার নিজেকে  যথেষ্ট বোকা মনে হয়েছিল।  পরবর্তীকালে আর সেই  অনুশোচনা  তাঁকে ‘প্রতিবন্ধী মানবিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ তত্ত্ব’ তৈরিতে সাহায্য করেছিল । শাসকদের হাত ফসকে বেরোনো কর্মকাণ্ডের অপ্রত্যাশিত পরিণতি থেকে মানবজীবনে যে কী ঘটতে পারে তা ভালোভাবে টের পেয়েছিলেন তিনি।এই থিমগুলো কুন্দেরার অনেক পরিণত লেখার কাজে পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তাঁর অল্প বয়সের অভিজ্ঞতা তাঁর পরিণত সৃজনশীল লেখার জন্য একটি অপরিহার্য প্রেরণায় পরিণত হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের উপলব্ধির ঘাটতিগুলির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা । একই সময়ে, তিনি স্পষ্টতই স্তালিনবাদী কমিউনিজমের প্রতি তাঁর যৌবনের উদ্দীপনা সম্পর্কে পরে গভীরভাবে বিব্রত বোধ করেছেন আর বিভিন্ন উপায়ে তা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। যেমন সেই সময়ে লেখা তাঁর কবিতা । বস্তুত কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন অনুতপ্ত কুন্দেরা।

.

অস্বাভাবিকভাবে,   অরওয়েলিয়ান মনোভাব প্রদর্শন করে, কুন্দেরা,  চেক আভাঁ-গার্দ   লেখক ভ্লাদিস্লাভ ভানচুরা উমেনি রোমানুর  উপন্যাসগুলোর মার্কসবাদী সাহিত্য বিশ্লেষণকে “মুছে ফেলার” চেষ্টা করেছেন ( সেই বিশ্লেষণ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ নামে)। তার জায়গায় একই নামে একটি ভিন্ন  প্রবন্ধ সংকলনে অন্তভূর্ক্ত করেছেন মিলান কুন্দেরা, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ বইতে।  কমিউনিস্ট থাকাকালীন , কুন্দেরা তিন খণ্ড গীতিকবিতা রচনা ও প্রকাশ করেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে তাঁর পরবর্তী রচনাগুলোতে তিনি গীতিকবিতা এবং গীতিকার কবিদের আক্রমণ করেছেন। তিনি ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ (Směšné lásky) প্রকাশের আগেকার তাঁর সমস্ত কাজের প্রকাশনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই যুক্তিতে যে সুরকারদের মতো, লেখকরা তাদের কাজগুলোর কোনটা প্রকাশ করা উচিত এবং কোনটা বন্ধ করা উচিত তা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ অধিকারী। যেহেতু তাঁর প্রাক ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ ( Směšné lásky ) রচনাগুলো পশ্চিমা ভাষায় প্রকাশিত হয়নি, তাই কুন্দেরার  সাহিত্যিক আত্মনির্মাণে তা বেশ ভালোভাবে কাজ করেছে। কুন্দেরার যুক্তি হলো , সম্পাদকদের লেখকের ব্যক্তিত্বকে সম্মান করা উচিত। এখানে, আরেকবার, একটি রাজনৈতিক প্রেরণা একটি  ‘সাহিত্য তত্ত্ব সৃষ্টির’ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। কুন্দেরা দাবী করেছেন যে একজন লেখক নিজের কাজকে কেমনভাবে ব্যবহার করেন তা নির্ধারণ করার অধিকার তার আছে। তিনি বলেছেন : – “”নান্দনিক ইচ্ছা শুধুমাত্র একজন লেখক যা লিখেছেন তার দ্বারা নির্ধারিত হয় না বরং তিনি যা মুছে দিয়েছেন তার দ্বারাও হয়৷ একটি অনুচ্ছেদ মুছে ফেলার জন্য এটি লেখার চেয়ে আরও বেশি প্রতিভা, জ্ঞান  এবং সৃজনশীল শক্তির প্রয়োজন৷ তাই, লেখক যা মুছেছেন তাকে  প্রকাশ করাটা হবে সেন্সর হিসাবে ধর্ষণ।”

.

কুন্দেরা তাঁর জীবন সম্পর্কে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার তথ্যও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি সাংবাদিকদের অবিশ্বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত , কুন্দেরার রচনাগুলোর পাশ্চাত্য সংস্করণে,  “মান্যতাপ্রাপ্ত জীবনী” শুধুমাত্র একটি বাক্যে গুটোনো থাকতো : “মিলান কুন্দেরা ১৯২৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সে বসবাস করছেন।” ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ম্যাকইওয়ানকে দেয়া  এক সাক্ষাত্কারে, কুন্দেরা বলেছিলেন: “আমরা ক্রমাগত আমাদের নিজস্ব জীবনী লিখি এবং ক্রমাগত বিষয়গুলিকে নতুন অর্থ দিই৷ এই অর্থে ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা হয় — প্রকৃতপক্ষে, অরওয়েলিয়ান অর্থে – তা মোটেও অমানবিক নয়। উল্টে, এটি খুব মানবিক।”

.

কুন্দেরা তার নিজের জীবনকে কিংবদন্তি হিসেবে বর্ণনা করেন।  ফিলিপ রথকে দেয়া  এক  সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন: “তারপর তারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাসটিকেট  করেছিল। আমি শ্রমিকদের সঙ্গে থাকতাম। সেই সময়ে, আমি একটা ছোট-শহরের ক্যাবারেতে  জ্যাজব্যান্ডে ট্রাম্পেট বাজাতাম। আমি পিয়ানো আর ট্রাম্পেট বাজাতাম। তারপর  আমি কবিতা লিখতে শুরু করি,  আমি ছবি আঁকতে শুরু করি । এগুলো সবই বাজে তথ্য । আমার প্রথম কাজ যা উল্লেখ করার মতো মূল্যবান তা হলো একটা ছোট গল্প, সেটা আমার  ত্রিশ বছর বয়সে লেখা, ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ বইয়ের প্রথম গল্প। এই গল্প লেখা  থেকেই আমার লেখক জীবন শুরু হয়। আমি তুলনামূলকভাবে অপরিচিত চেক বুদ্ধিজীবী হিসাবে আমার জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছিলুম।”  

.

খ্যাতনামা নেতৃস্থানীয় চেক সাহিত্য সমালোচক মিলান ইয়ুংম্যান বলেছেন যে কুন্দেরার এই বিবৃতিগুলো বাস্তবতার বিকৃতি, ওগুলো স্রেফ কিৎশ । তিনি লিখেছেন, “১৯৫০ এবং ১৯৬০র দশকে যারা মিলান কুন্দেরাকে চিনতেন তাঁরা এই গল্পে  তাঁকে  চিনতে পারবেন না। তবে এই  নির্বাচিত তুচ্ছ তথ্য সত্য হলেও, আত্মপ্রতিকৃতিটি এমনভাবে গড়া হয়েছে যে কুন্দেরার আসল চেহারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। চেক ইতিহাসের বিগত কয়েক দশকের একজন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে কুন্দেরার ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই চাপা দেওয়া হয়েছে। কুন্ডেরার জন্য এটি বৈশিষ্ট্য যে তাঁর প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে  তিনি প্রথমবার সাহিত্যে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকেই বেশ জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এমনকি তার প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ ( Člověk, zahrada širá অর্থাৎ Man, a Wide Garden, ১৯৫৩ ) আবেগপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দেয় এবং তাঁর তৃতীয় কবিতার সংকলন ‘স্বগতসংলাপ’ ( Monology  অর্থাৎ Monologues, ১৯৫৭ ) তৎকালীন চেক সাহিত্যের অঞ্চল জুড়ে ঝড়ের মতন ছড়িয়ে পড়েছিল।  এই অতি সাধারণ কবিতাগুলো পড়ার সময় এখনকার পাঠক ভাবতে পারেন  যে এগুলোতে এত উদ্দীপক কী ছিল আর কেনই বা কবিতাগুলো শিল্পের একটি ব্যতিক্রমী কাজের তকমা পেয়েছে। এথেকে কেবল প্রমাণ হয় যে সেই সময়ে চেক কবিতার মান কত করুণ ছিল। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে, কুন্দেরার নাম অত্যন্ত সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল আর অনেক বয়স্ক এবং আরও উল্লেখযোগ্য লেখকদের আড়াল করে দিয়েছিল।তরুণ কবি শীঘ্রই বুঝে গিয়েছিলেন যে একজন সেলিব্রেটির মতো আচরণ করতে হলে কী করা দরকার  , তিনি তরুণ সাহিত্যের একজন সুসন্তান হয়ে দেখা দিয়ে ছিলেন, তাঁর ভাগ্যনক্ষত্র স্থায়ীভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এবং লেখক যা কিছু লিখছিলেন, তা কবিতা হোক বা সাংবাদিকতা, তাঁকে আরও বেশি সমাদরের সাথে স্বাগত জানানো হচ্ছিল। কুন্দেরা ছিলেন  অনুপ্রেরণাদানকারী লেখকদের মধ্যে একজন, যারা তাদের সমালোচনামূলক মনোভাবের দ্বারা চেক সংস্কৃতিতে নতুন গতিশীলতা এনেছিলেন, ইতিহাস থেকে পাঠ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে সাহিত্যে কতটা বন্ধ্যা [স্টালিনবাদী] গোঁড়ামি ছিল এবং  প্রয়োজন ছিল তার আগল ভেঙ্গে সাহিত্যকে নতুন বৈশিষ্ট্য দেওয়ার। ‘টেস্টামেন্টস বিট্রেড’-এ, ফ্রানৎস কাফকার রচনার আলোচনায়, কুন্দেরা বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য সমালোচকদের দায়ী করেছিলন যে তাঁরা সাহিত্যিক কাজকে সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা না করে জীবনী প্রসঙ্গে উল্লেখ করে । যেহেতু স্তালিনবাদী কমিউনিজমের সাথে ঘনিষ্ঠতা কুন্দেরার জন্য এমন একটা  আঘাতে পরিণত হয়েছে যে তিনি তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মে এই ট্রমাকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, তাই অবশ্যই কুন্দেরার পরিণত কাজগুলোকে তাঁর প্রাথমিক, স্তালিনবাদী লেখালিখির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা দরকারী অথচ কুন্দেরা সেগুলোকে চাপা দিতে কম কসুর করেননি।

.

তিন

.

যদিও কুন্দেরার প্রথম কাব্যসংকলন ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এই সংকলনে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকের কবিতাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যখন লেখকের বয়স ছিল কুড়ি বছর। এইভাবে সংগ্রহটিকে বলা যেতে পারে তরুণ বয়সের কাজ । চেকোস্লোভাকিয়ার নতুন স্তালিনবাদী শাসনব্যবস্থা তরুণ প্রজন্মের  অপরিণত এবং নমনীয় সদস্যদের শক্তি এবং উদ্দীপনাকে কতটা ব্যবহার করতে প্রস্তুত ছিল তা বইটার কবিতাগুলো পড়লে টের পাওয়া যায় বলে মনে হয়। স্পষ্টতই ১৯৪৮  সালে স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট দখলের পরের সময়কালে  তরুণ চেক কমিউনিস্টরা কতোটা প্রভাবিত হয়েছিল সেই  অনুভূতি কুন্দেরা রা তাঁর পরিণত রচনায় এইভাবে আলোচনা করেছেন: “এটি  ছিল নেশার মতন। আমরা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছিলুম  এবং আমরা ঘটনাগুলোর বাঁকবদল করছিলুম। আমরা ভেবেছিলুম আমাদের হাত ইতিহাসের স্টিয়ারিং রয়েছে।”
.

সম্ভবত বলা যেতে পারে যে ইউরোপ-আমেরিকায়,  তার তরুণ সমর্থকদের আদর্শকে কাজে লাগানোর জন্য ওইভাবে উঠেপড়ে লাগতো না। যে প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদকরা তরুণ কুন্দেরার এই ক প্রচেষ্টা জমা দিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে অনুশীলনের  সুপারিশ করতেন। অন্যদিকে, চেকোস্লোভাকিয়ায় স্তালিনবাদী শাসন প্রবর্তনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত সাহিত্যের  মান এতটাই নেমে গিয়েছিল যে তরুণ কুন্দেরাকে  পেশাদার এবং নিরপেক্ষ পরামর্শ দেওয়ার জন্য হয়তো সরকারী সাহিত্য বৃত্তে কেউ ছিল না। এবং, সম্ভবত, চেক সাহিত্যের সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, তাঁর কবিতাগুলো সত্যিই ভাল মনে হয়েছিল।’মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান’ ( Člověk, zahrada širá) -সংকলনের রিভিউগুলো  সাহিত্যের ওপর সরকারি মানদণ্ড অত্যন্ত নিম্নমানের সাক্ষ্য দেয়।

.

এছাড়াও আরও কিছু দিক বিবেচনা করার আছে।এখনকার আলোচকদের মতে, এই কবিতাগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও, সেকালের স্তালিনপন্হী সমালোচকদের দ্বারা এগুলি বিতর্কিত, উদ্দীপক, বিদ্রোহী এবং আইকনোক্লাস্টিক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে এটা আশ্চর্যের  নয় যে ফ্রান্সে যাবার পর কুন্দেরা তাঁর কাব্যিক আত্মপ্রকাশের নিম্নমানের দ্বারা বিব্রত বোধ করতেন আর এই কবিতাগুলোতে একজন যুবক হিসাবে  উপলব্ধির যে অভাব পাওয়া যায় সে সম্পর্কে সচেতন হন। এ এক এমন মনঃস্হিতি যা তিনি তাঁর পরবর্তী লেখায় বারবার তুলে ধরেছেন । কুন্দেরার  ‘ইগনোরেন্স’ (২০০২), উপন্যাসে জোসেফ, একটি কাল্পনিক চরিত্র, নির্বাসন থেকে তার জন্মভূমি চেক প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাবার পর, একটা ডায়েরি আবিষ্কার করে যা সে “কমিউনিজমের প্রাথমিক বছরগুলোতে” একজন যুবক হিসেবে লিখতো।

.

তিনি যে ব্যক্তি ছিলেন তার দ্বারা তিনি আতঙ্কিত:

.

“জোসেফ ভার্জিন ছেলেটাকে বোঝার চেষ্টা করে, নিজেকে তার চামড়া পরিয়ে রাখার প্রয়াস করে, কিন্তু সে তা করতে পারে না । সেই আবেগপ্রবণতা যা মর্ষকামের সাথে মিশ্রিত, পুরো ব্যাপারটা তার এখনকার রুচি আর তার প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সে  ডায়েরির একটা ফাঁকা পাতা ছিঁড়ে ফেলে ,  পেন্সিল নিয়ে, একটা বাক্য কপি করে,  ‘আমি তার দুঃখে আহ্লাদিত।’ জোসেফ দীর্ঘ সময় ধরে দুটি হাতের লেখা নিয়ে চিন্তা করে : অনেক আগেকারটা কিছুটা আনাড়ি, কিন্তু অক্ষরগুলো আজকের মতো একই আকারের, যার সাদৃশ্য বেশ বিরক্তিকর, ব্যাপারটা তাকে বিরক্ত করে,  হতবাক করে। কীভাবে এমন দুটি এলিয়েন, এমন দুই বিপরীত প্রাণীর,  হাতের লেখা একই রকম হতে পারে? কী সেই সাধারণ অন্তরপ্রকৃতি যা তাকে এবং নাকের এই ছোট্ট পোঁটাকে এক করে তোলে?”

.

একই রকম বিব্রতকর অনুভূতি, যখন নিজের অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে, যা কুন্দেরার উপন্যাস (নিহা স্মিচু আ জাপোমনি ) ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ এর একটি প্রধান বিষয়বস্তু, যেখানে ভিন্নমতাবলম্বী মিরেক তার  প্রেমপত্রগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে বিশ বছর  আগে লেখা তার প্রথম প্রেমিকার কাছ থেকে, আর নিজের অতীত মুছে ফেলার চেষ্টায় সেগুলোকে আঁস্তাকুড়ের আবর্জনায় ফেলে দিতে চায় – কেননা সে চিঠিগুলোকে বেদনাদায়ক আর বিব্রতকর মনে করে।কুন্দেরা এখন তার তরুণ বয়সের কবিতা সম্পর্কে এরকমটাই অনুভব করেন। আবেগ, অনেকসময়ে অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ, অবশ্যই তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে উপস্থিত । তবু , সমস্ত প্যাথোসের মধ্যে, ‘মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান’ (Člověk, zahrada širá)-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল কুন্দেরার আন্তরিকতা এবং সত্যে ওপর জোর দেওয়া। বইটা পোলেমিক, আনুষ্ঠানিক আর স্তালিনবাদী প্রোপোগাণ্ডার কবিতার সংকলন ।

.

কুন্দেরা “সৌকরোমা ড্রামাটা” বা ‘ব্যক্তিগত নাটক’ শিরোনামের অংশের নীতিবাক্যে তাঁর পাঠকদের কাছে প্রচার করেছেন:

.

“…সাধারণভাবে শান্তি সম্পর্কে,

সাধারণভাবে কাজ সম্পর্কে

সাধারণভাবে পার্টি সম্পর্কে,

কবি, এই মামুলিপনা বাদ দাও!

মানুষের কথা বলো!”

.

( “Polemické verše”) অর্থাৎ ‘পোলেমিক কবিতা’-র প্রস্তাবনায়   কুন্দেরা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদিও শেষ লাইনের ব্যাথোস (“মানুষ একটি অসীম বাগান”) প্রায় পার্টির পোস্টার, কলকাতায় বামপন্হীদের দেয়াল লিখনের মতন:

.

“আপনাকে  ওরা পেরেক মেরে ঝোলাতে চায়

ক্লিশের ক্রুশকাঠে,

হাঁক পাড়ুন, চিৎকার করে বলুন: মানুষ

একটি অন্তহীন বাগান!”

.

সংকলনটি কুন্দেরার তিনটি “অভিপ্রায় ঘোষণা” দিয়ে শুরু হয়, তিনটি ছোট কবিতার মাধ্যমে, যেখানে কবি তাঁর দ্রোহের এবং  প্রামাণিক, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চেক আলোচকদের মতে,  কুন্দেরা তাঁর কবিতাকে সমসাময়িক আনুষ্ঠানিক কবিতার বিরুদ্ধে একটি বিতর্ক হিসেবে উপস্হাপন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর “বিদ্রোহ” পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সেই সময় থেকেই তিনি দোটানায় ভুগতে আরম্ভ করেন। চেক আলোচকদের মতে, তার রূপকগুলো আনাড়ি (“কবিতায় কৃমি”) এবং আজকের পাঠক মনে করেন যে তাঁর কবিতাগুলোতে  ব্যক্তিবাদী বিরোধের সীমা আছে। জারোস্লাভ হাশেক, যিনি ‘আইনের সীমার মধ্যে একটি পার্টি অফ মডারেট প্রগ্রেসের বিদ্রূপাত্মক প্রতিষ্ঠাতা’ বলেছেন যে , যা শাসকের অনুমোদিত নয় তাকে কুন্দেরা  অতিক্রম করেননি। তার বিদ্রোহ পোশাকি । তিনি যত বিতর্কিত চিন্তাই প্রকাশ করুক না কেন, স্তালিন এবং কমিউনিজমের প্রতি তার উৎসাহী সমর্থন দ্বারা সেগুলোতে সর্বদা ভারসাম্যহীন বজায় রেখেছিলেন। জারোস্লাভ হাশেক বলেছেন যে, একজনকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে অনেক সত্যিকারের কবি যেমন জান জাহরাদনিচেক, ভ্যাক্লাভ রেনচ, জোসে পালিভেক  স্তালিনের শ্রম শিবিরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন যখন কুন্দেরা ‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ প্রকাশ করেন:

.

“কবি যাই বলুক না কেন সে নিজের সম্পর্কেই গায়।

একজন কবি যে আন্তরিক নয়

তার কবিতায় কৃমি থাকে।

আমি কীবোর্ডে আমার গান বাজাই

আমার দুর্দশার।

আর তাই আমি যেভাবে গান করি সেভাবেই গাই।

আমি অন্য কোনো উপায়ে এটা করব না।”

.

কুন্দেরা কবিতাগুলোতে অনুমান করেছেন যে একজন সৃজনশীল শিল্পীকে অবশ্যই “ব্যক্তিমানুষের আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে হবে”। তাঁর পরিচিতিমূলক কবিতাগুলোর আনুষ্ঠানিক দিকগুলো আদিম:

.

“একজন ডুবুরি কবি

মানুষের গভীরে ডুব দেয়

তার জন্য একমাত্র উপায় হলো খুঁজে বের করা

যুদ্ধে যাবার জন্য তার তলোয়ার।

যারা মনগড়া কবি

তাদের তলোয়ার শব্দের বাষ্প দিয়ে গড়া

এমন কবিদের কবিতা টিকবে না

এমনকি প্রথম হাতাহাতিও টিকবে না।”

.

সমসাময়িক রাজনৈতিক মতামতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, কুন্দেরা কবিতা এবং সাহিত্যকে সাধারণভাবে একটি “সামরিক সংগ্রাম” হিসাবে দেখেছিলেন। তিনটি উত্সর্গীকৃত কবিতার শেষটিতে, তিনি নিজেকে   উৎসাহিত করার  আবেদন জানিয়েছেন, যাতে তিনি যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য দেরি না করে ফেলেন।

.

“ওহে, দ্রুত চলো,

হৃদয়, তুমি আমার জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি,

যাতে যুদ্ধের এক সপ্তাহ পর

আমার মাঠের তূরী না বেজে ওঠে!

বুকের মধ্যে সংকুচিত আমার গান,

তোমরা আমার পাঁজর ছিঁড়ে ফেলো,

যাতে যুদ্ধ

আমাকে ছাড়া জয়ী না হয় !”

.

কবিতাগুলো আবেগগত ব্যক্তিত্বাদ, ব্যক্তিগত সমর্পণের দাবি, এবং সময়ের আদর্শগত অনুষঙ্গের একটি অদ্ভুত মিশ্রণ –- এগুলো একই সাথে সঙ্গতিবাদী এবং অ-সঙ্গতিবাদী। কুন্দেরা রুক্ষ, কাটা-কাটা, অপ্রত্যাশিত, উত্তেজক, পথচলতি অভিব্যক্তি এবং  রূপক ব্যবহার করেছেন। কবিতার লক্ষ্য স্পষ্টতই নজির তৈরি করা । কুন্দেরা বোঝাচ্ছেন যে তিনি একজন কমিউনিস্ট হিসেবে গর্বিত, “অন্য কোনও পথ থাকতে পারে না”। তিনি সাহিত্যের পরিশীলিত শব্দাবলী প্রয়োগের বদলে আবেগ জাগানো গ্রাম্য শব্দে জোর দেওয়ার জন্য কথোপকথন, প্রাচীন বা উপভাষা থেকে অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এই ধরনের কিছু শৈলীগত অনিয়মকে সেই সময়ের সমালোচক ভাকলাভ ম্যুলার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছিলেন : চেক সাহিত্যে স্তালিনবাদীদের  নৈমিত্তিক, অনানুষ্ঠানিক, চিহ্নিত, অ-সাহিত্যিক ভাষা নিয়ে সমস্যা ছিল। ভাকলাভ ম্যুলার বলেছেন: “”প্রতীকবাদী মালারমেস্কে সংজ্ঞা বলছে যে একটি কবিতার সৌন্দর্য নির্ভর করে আনন্দদায়কভাবে উত্তেজনাপূর্ণ বা ইন্দ্রিয়, আবেগ বা কল্পনাকে জাগিয়ে তোলার ক্রিয়ায় নিহিত ইঙ্গিতময়তায়,  আর তা শব্দের আদর্শিক রূপগুলোকে মুছে ফেলার মাধ্যমে অর্জন করা হয়। এই বক্তব্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নন্দনতত্ত্বের নীতি অনুসারে ক্ষমার অযোগ্য নৈরাজ্য। স্তালিন নিজে মনে করতেন, ভাষা ‘একটি মাধ্যম যা মানুষ যোগাযোগ করতে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া অর্জনের জন্য ব্যবহার করে’। সুতরাং ভাষার সবসময় (এমনকি শিল্পের কাজে) একটি যোগাযোগমূলক ভূমিকা রয়েছে। তাই পাঠকের মগজে ঢোকার পথ খুঁজে বের করতে হলে প্রতিটি কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রাথমিক চাহিদা যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে, তা হলো আদর্শগত অস্পষ্টতা বর্জন।

.

চার

.

অল্পবয়সী হলেও,  কুন্দেরা জানতেন কীভাবে মাঝে মাঝে একটা স্তবক লিখতে হয় যা বেশ সমসাময়িক। “সেই দিন ব্রনোতে” কবিতায় তিনি বেশ সফলভাবে একটি অলস, ভ্যাপসা, গ্রীষ্মের রবিবার বিকেলের পরিবেশকে তুলে ধরেছেন:

.

“এবং একটি ট্রেন দূর থেকে ছুটে এল এবং আপনার মনে হল

ছায়ায় কোথাও বসার জন্য বেঞ্চ খুঁজে পাওয়া।

আপনার সামান্য অলস শরীরকে বিশ্রাম দিতে

কিছু না ভেবে, আপনার আইসক্রিম চাটবার ইচ্ছা হলো”

.

১৯৫০ দশকের  চেক সাহিত্য বিশেষজ্ঞ মিশাল বাউয়ার উল্লেখ করেছেন যে কুন্দেরার কবিতার শৈলী  রাশিয়ান বিপ্লবী কবিতার অনুবাদ এবং স্তালিনবাদী যুগের চেক সংবাদপত্রের লিখনভঙ্গিমা দ্বারা প্রভাবিত । সেকালের কবিতার প্রেক্ষাপটে কুন্দেরার সাধারণ কবিতাগুলোকে, অতএব, মনে করা হতো

অসাধারণ বিপ্লবী এবং বিদ্রোহী। সংকলনটি পাঁচটি পর্বে বিভাজিত। কুন্দেরার অনেক প্রধান থিম, যা তাঁর পরিণত কাজে বিকশিত হয়েছে, সেগুলো প্রথম যৌবনে লেখা কবিতার এই সংকলনে একটি গোপন ভাষ্যে উপস্থিত।

.

 প্রাথমিকভাবে (জেলেন্ মেহো ডোমোভা) অর্থাৎ ‘আমার বাড়ির সবুজ’ শিরোনামের প্রথম বিভাগে কুন্দেরা  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করেছেন স্তালিনবাদী মতাদর্শ এবং তাকে মানবিক করার চেষ্টা করেছেন। এই পদ্ধতিতে, উষ্ণ আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক এবং বাড়ির পরিবেশের ঘনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কুন্দেরা তাঁর স্থানীয় মোরাভিয়া, ব্রনো শহর এবং এর বাসিন্দাদের সম্পর্কে লিখে মার্কসবাদকে আবেগগতভাবে মানবিক করার প্রয়াসে লিখেছিলেন, যে, তিনিও একজন “চেক সমষ্টির সদস্য” ,যাদের সঙ্গে  তিনি  একাত্ম অনুভব করেন। তিনি  চেক পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে শান্তি ও সান্ত্বনার প্রতীক হিসেবে উপস্হাপন করেছিলেন।  কমিউনিজম হল  সেই সময়কার কুন্দেরার জন্য সমস্ত প্রধান মূল্যবোধের গ্যারান্টি, যা  আরামদায়ক, আনন্দদায়ক,  এবং চেকদের জন্য  নিরাপদ আশ্রয় । যেমন, এই বিভাগের একটি কবিতায়, একজন বৃদ্ধ মহিলা নতুন স্তালিনবাদী শাসনের ফলে বেশ বিভ্রান্ত। তিনি কমিউনিস্ট যুগের রাজনৈতিক পরিভাষা বোঝেন না। কিন্তু কবিতার শেষে, তিনি খুশি, কারণ তাঁর নাতি, যার গলায় লাল স্কার্ফ ,  একজন তরুণ অগ্রগামী, তাঁকে জড়িয়ে  তাঁর হাত ধরে। কুন্দেরা যুক্তি দেখান যে কমিউনিস্ট মতবাদ মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হবে যদি এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক প্রক্রিয়ায়  মানবিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত যোগ করা হয় । 

.

“হায় ভগবান, ব্যাপারটা কেমন বোকামি

পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সময় গণনা!

জীবন কি এর চেয়ে দ্রুত দূরে সরে যায় না

এমনকি যখন তুমকি একে এক-এক বছর দিয়ে গোনো ?

কোন সে শিখা যাতে দুঃখ গলে যায়?

ভাল, নিশ্চয়, প্রেমের শিখায় গলে যায় ।

ছেলেটা বুড়িকে জড়িয়ে ধরে

আর তাকে যেতে দিতে চায় না।

ছেলেটা তার হাত ধরে। বুড়ি হঠাৎ খুশি

আর মাঠে দুজনে মিলে  আনন্দে গল্পগুজব করে।

আর বুড়ি হঠাৎ ছেলেটার লাল স্কার্ফ পছন্দ করে,

বুড়ি আর কোনো কিছুতেই বিরক্ত হয় না।”

.

একইভাবে তিনি (Toho dne v Brně ) অর্থাৎ ‘ব্রনোতে একটি দিন’ কবিতায় কমিউনিস্ট মতাদর্শকে মানবিক করেছেন, যেখানে একটি মনোরম, গরমের দিনে তাঁর অন্তরঙ্গ, পরিচিত পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে তিনি স্থানীয় এক ফ্ল্যাট থেকে একটি ছেলের কন্ঠে ‘ইনটারন্যাশানাল’ গানটি শুনতে  পান। 

.

“ঠিক আছে, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের অবশ্যই এগোতে হবে!

দ্রুত, আমি আমার পদক্ষেপ দৃঢ করি আর বিশ্রাম নিই!

আর আমি হাসছিলুম, ওহ, জীবন, আমি হাসছি …

আর ছেলেটি  গান গাইতে থাকে, গাইতে থাকে, গাইতে থাকে।”

.

‘একটি খ্রিসমাস স্বীকারোক্তি’  ( “Vánoční vyznání “) কবিতায় কুন্দেরা তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা এবং বেঁধে-বেঁধে থাকাকে কমিউনিস্ট সমষ্টিবাদের  সমতুল্য হিসেবে উপস্হাপন করেছেন। কবিতাটিতে তিনি ঐতিহাসিকভাবে শপথ করেছেন যে তিনি আর কখনও “ব্যক্তিবাদী” হবেন না:

.

“আমি এখন জানি এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা

নিজের মধ্যে নিজের মতো বেঁচে থাকা।

এটা আমাকে ধাক্কা মেরে জাগায়!

আমি বাড়িতে আছি!

দুঃখ,  আমাকে চূর্ণ, বিচূর্ণ করো !

আমার কমরেডরা, আমি কখনই তোমাদের ছাড়া থাকব না

তোমাদের ছাড়া আমি আর কোনো কাজ করব না।”

.

এই থিমটি পরে কুন্দেরা পরিণত বয়সের উপন্যাস ‘দ্য জোক’-এ বিশ্লেষণ করেন। ‘দ্য জোক’-এর প্রধান দ্বন্দ্ব হলো এই চিন্তা যে স্তালিনবাদী শাসন মানুষকে ব্যক্তিবাদী হওয়ার অধিকার দিতে চায় না। ‘দ্য জোক’ উপন্যাসে কুন্দেরা লিখেছেন:

.

 “যারা আনন্দ করতে চায়নি তাদের সন্দেহ করা হয়েছে কেননা তারা আসলে শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ে বিলাপ করছে বা ( তারা সমান অপরাধী)  নিজেদের দুঃখকে ব্যক্তিগত স্তরে প্রকাশ করছে ।  আমি দাবি করেছিলুম যে আমার সহকর্মীরা আমাকে প্রমাণ করে দেখাক কেন আমি একজন ব্যক্তিবাদী। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে তারা বলবে, ‘কারণ তুমি একজন ব্যক্তির মতো আচরণ কর।” ‘আমি কীভাবে প্রকাশ করব?’ ‘তোমার অদ্ভুত ধরনের হাসি আছে।’ ‘আর যদি প্রকাশ করি? এভাবেই তো আমি আমার আনন্দ প্রকাশ করি।’ ‘না, তুমি এমনভাবে হাসো যেন তুমি ব্যক্তিগতভাবে কেবল নিজের কথা ভাবছ।’

.

‘আমার বাড়ির সবুজ’ ( Zeleň mého domova )  কবিতায় কুন্দেরা তাঁর নতুন বান্ধবীকে তাঁর বাড়ি  ব্রনো অঞ্চলের সৌন্দর্য এবং পরিপার্শ্বের কথা বলেছেন :

.

‘এটা আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট হৃদয়’

আমি বিড়বিড় করে বলবো,

‘…এবং যদি তুমি এটা পছন্দ না করো,

আমি নিঃস্বের মতো তোমার সামনে দাঁড়াতাম

কারণ আমার আত্মা,

শোন প্রিয়তমা,

বোনা হয়

শুধুমাত্র এই পাহাড় এবং বাগানের ফিতে দিয়ে।”

.

তিনি আশা করেন “তাঁর নারী” তাঁর এই মূল্যবোধগুলোকে মান্যতা দেবে :

.

আর তারপর, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরবে

আর ক্রিকেট খেলা শুরু হবে

আর বাঁধন যা আমার হৃদয়কে  জাপটে ধরে

ভেঙ্গে যাবে…”

.
সেই সময়ে কুন্দেরা দৃঢ়ভাবে  বিশ্বাস করেছিলেন যে পুরুষের “সংগ্রাম”-এ মহিলাদের ভূমিকা  গৌণ। নারীর কেবল সহায়কের ভূমিকা পালন করা উচিত — নারীর উচিত পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসগুলো সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা । কুন্দেরা ফ্রান্সে যাবার পরও  ব্রনোর সাথে খুব আবেগপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কমিউনিজমের পতনের পরও থেকে তিনি লুকিয়ে নিজের শহরে বেড়াতে যেতেন। পরবর্তী বছরগুলোতে, তাঁর জন্মভূমির সাথে নিজের বন্ধন মানসিকভাবে অস্বীকারের মাধ্যমে নিজেকে পাঠক ও আলোচকদের সামনে তুলে ধরেছেন । যখন  স্তালিনবিরোধী চেক সমালোচকরা ১৯৮০-এর দশকে ফ্রান্সে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসগুলো সম্পর্কে উদাসীন ছিল, তখন তিনি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন আর সাম্যবাদের পতনের পর চেকোস্লোভাকিয়ায় এই উপন্যাসগুলো প্রকাশের অনুমতি দেননি।

.

জীবনের নেতিবাচক দিকগুলো, যেমন তাঁর বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, কুন্দেরার অন্তরঙ্গ মোরাভিয় অভিজ্ঞতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ,  প্রাসঙ্গিক কবিতায় কুন্দেরা “না, ওহ, তুমি কালো মিছিল” লোকগানের কাব্যিকতা ব্যবহার করেছিলেন । আরামদায়ক, অন্তরঙ্গ এবং সান্ত্বনাদায়ক চেক কমিউনিস্ট সমাজে বসবাসের অভিজ্ঞতা, নাৎসি দখলের মর্মান্তিক স্মৃতি এবং সেইসাথে কোরিয়ান যুদ্ধের বর্তমান বিদেশী ভয়াবহতাকে হারিয়ে আর মুছে দিতে পারে। “Tři braši u pěti jabloní ‘পাঁচটি আপেল গাছের কাছে তিনটি বন্ধু’ কবিতায়  বাগানের মাটি খুঁড়ে শ্রমিকরা একটা মরচে-পড়া  জার্মান বেয়নেট খুঁজে পায়৷ জিনিসটা বিগত, “পুঁজিবাদী” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্রমার ক্ষতকে মনে করিয়ে দেয় :

.

“হায় ভগবান, ও হঠাৎ অনুভব করে

যে ধাতুখণ্ড ও হাতে ধরে আছে

খাপ থেকে বের করা ধাতু ভেতরে ঢুকে যায় 

তুষার-সাদা মানুষের চামড়া ফুঁড়ে

রক্তে জবজব করছে তার হাত

আর পাঁজরের ফাটলে”

.

মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, কুন্দেরা স্তালিনবাদের অধীনে সমসাময়িক পরিস্থিতির সুখী বাস্তবতার ওপর জোর দেওয়ার জন্য এই ইমেজগুলো ব্যবহার করেছিলেন। আর তা করার সময়, তিনি  চেকদের কাছে পরিচিত লোকগানের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে  তাঁর পরীক্ষিত  নীতিটি ব্যবহার করেছিলেন:

.

“তারপর সে তার বন্ধুদের দিকে তাকাল।

বন্ধুরা তাকে দেখে হাসল।

মাঠের পাঁচটা আপেল গাছে বসে

ফিঞ্চ পাখিরা গান গাইতে লাগলো ।”

.

আবার, মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতা ব্যবহার করে, বাড়িতে “সূর্যালোকের পরিস্থিতি”র সঙ্গে বিদেশের “মন্দ” অবস্হার বৈপরীত্য প্রকাশ করেছিলেন কুন্দেরা : মানুষ স্তালিনবাদের অধীনে সুখী জীবন উপভোগ করছে। স্পেনের একজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, যিনি এখন আরামে চেকোস্লোভাকিয়ায় তাঁর বাগানের দেখাশোনা করছেন, তিনি এই ভেবে বিমর্ষ  যে কোরিয়ায় এখনও একটি নৃশংস যুদ্ধ চলছে। তবু বিদেশী মন্দের ভয়কে জয় করা যাবে আরামদায়ক, ঘরোয়া, যৌথ অভিজ্ঞতার ইতিবাচক প্রভাব দিয়ে ।

.

“যুদ্ধ?

ভয় পেও না, ছোট খুকি।

পাহাড়ের কোলে কামানের নলে

মরচে পড়ে গেছে

একটা ছেলে বসে আছে তার ওপর,

আর চিৎকার করে বলছে : হেঁইয়ো ঘোড়া!

ছুটে চল ঘোড়া হেঁইয়ো।”

.

কুন্দেরার পরবর্তী সাহিত্য ও সৃজনশীল বিকাশের কথা বিবেচনা করার সময় ‘ব্যক্তিগত নাটক’ পর্বটি উল্লেখযোগ্য। “এটা প্রেম নয়” কবিতায় কুন্দেরা নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তার একটি প্রাথমিক মনোভঙ্গী প্রকাশ করেছিলেন। পুরুষ, কুন্দেরার উপলব্ধিতে, একজন যোদ্ধা, আর নারীর উচিত তাকে সান্ত্বনা দেওয়া, তার কথা শোনা, তার কাজে তাকে সমর্থন করা এবং তার প্রতিটি প্রয়োজন মেটানো। “এটা প্রেম নয়” কবিতায় দলীয় কর্মকর্তার স্ত্রী স্পষ্টতই এই “আদর্শ” মেনে চলেন না । তাই  পুরুষটি হতাশ কারণ নারীরা সহজাতভাবে বোকা এবং পুরুষের “সংগ্রাম” বুঝতে পারে না:

.

“মা, তুমি  আমাকে সেখানে পাবে না,

স্মৃতির সেই গহ্বরে।

এখানে আমি, সংগ্রামের মাঝখানে,

ঝড়বৃষ্টি ঘিরে আছে আমাকে।.

মা আমার সাথে এসো,

আমি কোথায় যাচ্ছি তা দেখো।

পেছনে ফেরার স্বপ্ন দেখো না,

আমার সাথে স্বপ্ন দ্যাখো,

সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন !”

.

“১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে  একজন বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতা  কুন্দেরার জীবনের ভিত টলিয়ে দেয় । কুন্দেরার সাথে মনিকা গাজদোসোভা, একজন গোঁড়া কমিউনিস্ট যুবতীর সম্পর্ক ছিল। যুবতীটি ছিলেন স্লোভাক  আর  স্ক্রিপ্ট-লেখার বিষয়ে পড়তেন। এক রাতে যখন তাঁরা যৌনতায় লিপ্ত, কুন্দেরা  সমাজতান্ত্রিক শক-কর্মীদের অঙ্গীকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবমাননাকর কিছু মন্তব্য বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায় ! যুবতীটি  কর্তৃপক্ষের কাছে কুন্দেরার মতামত পৌঁছে দেন আর বিশ্ববিদ্যালয় কুন্দেরাকে রাস্টিকেট  করতে চায়,” একথা বলেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক ভোজেচ জাসনি, কুন্ডেরার সঙ্গে যিনি ১৯৫০-এর দশকে প্রাগের ফিল্ম একাডেমিতে পড়তেন।   ‘দ্য জোক’ উপন্যাসে কুন্দেরার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে,  যেখানে প্রধান চরিত্র লুডভিক জাহান তরুণ, মতাদর্শগত ভাবে অন্ধ স্তালিনবাদী মার্কেতাকে প্রণয় নিবেদন করার জন্য বৃথা চেষ্টা করে এবং যৌন হতাশা থেকে তাকে একটা ক্রুদ্ধ পোস্টকার্ড পাঠায় যা জানাজানি হবার ফলে কুন্দেরাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় আর তাকে  পেনাল ইউনিটে পাঠানো হয় যেখানে তাকে খনিতে কাজ করতে হতো।

.

এই থিমকে একটু অন্যভাবে উপস্হাপন করেছেন ‘এডুয়ার্ড এবং ঈশ্বর’ গল্পে।  এডুয়ার্ড নামের যুবক অ্যালিসকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, যে কিনা একজন ধর্মান্ধ ক্যাথলিক যুবতী। অ্যালিস মনে করে এডুয়ার্ড  ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের  কারণে  রাজনৈতিক শহীদ হয়ে গেছে । কিন্তু এডুয়ার্ড আগ্রহ হারিয়ে ফেলে  কারণ তার অতিরঞ্জিত নকল ধার্মিকতা ছিল অ্যালিসকে ফুসলিয়ে বিছানায় তোলার জন্য কিন্তু দুজনের  চূড়ান্ত যৌনমিলনের সময়ে নায়ক বুঝতে পারল যে মেয়েটা বিছানায় শীতল আর তার ছলচাতুরি করে অ্যালিসকে  পাওয়া বিফল ।

.

ফ্রান্সে যাবার পর ওলগা কার্লেসিলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কুন্দেরা বলেছিলেন, “যে বিপদটা আমাদের আশঙ্কিত করে, তা হল সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক ক্ষমতা। খোমেইনি, মাও, স্তালিন – তাঁরা কি ডান অথবা বামপন্হী ? সর্বগ্রাসিতা ( Totalitarianism ) ডান বা বাম কিছুই নয়, দুটোই তাঁদের সাম্রাজ্যের ভেতরেই বিলীন হতে থাকে। আমি কোনোদিনই ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলাম না, কিন্তু চেক ক্যাথলিকদের স্তালিনের সন্র্রাসে নিগৃহীত হতে দেখে তাদের জন্য আমি গভীর একাত্মতা বোধ করি। তাঁদের ( আস্তিকদের ) থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতা গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের প্রশ্নে। কিন্তু তা গৌণ হয়ে যায় এবং তাইই ( মানে, ঈশ্বরবিশ্বাস ) আবার আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে । প্রাগে ওরা সোশ্যালিস্ট আর যাজকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল।এভাবে ফাঁসিপ্রাপ্তদের ভাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল । একারণে ডান ও বামের এককাট্টা লড়াই আমার কাছে সেকেলে মনে হয়, খুবই আঞ্চলিক মনে হয়। রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করাকে আমি ঘৃণা করি। যদিও রাজনীতি ব্যাপারটা  প্রদর্শনী হিসেবে আমাকে মোহাবিষ্ট করে । প্রাচ্যে একটি ট্র্যাজিক ও মৃতকল্প প্রদর্শনী জার পাশ্চাত্যে বৌদ্ধিক দিক থেকে বন্ধ্যা ও কৌতুকসঞ্চারি প্রদর্শনী হিসেবে দেখি ।”

.

পাঁচ

.

“পোলেমিক ভার্স” বিভাগে দুটি বেশ সাহসী, বিতর্কিত কবিতা রয়েছে, যেগুলো সম্ভবত কুন্দেরাকে সমস্যায় ফেলেছিল, যদিও তাদের অস্বাভাবিকতা আমাদের অবাক করে, যখন আমরা আজ সেগুলো বিশ্লেষণ করি। সম্ভবত এই কারণেই তাদের  বাকি দুটি বিভাগে রাখা হয়েছে: From the Horizon of an Individual to the Horizon of All এবং The Grand March । কুন্দেরা গ্র্যাণ্ড মার্চের ধারণাকে ব্যঙ্গ করেছেন। সমষ্টিবাদের চাপ আর নাৎসিবাদের অধীনে এবং সমসাময়িক সময়ে “পশ্চিমা পুঁজিবাদের” অধীনে শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সম্পর্কে  তাঁর পরিণত উপন্যাসে ফিরে ভেবেছেন কুন্দেরা। পোলেমিক ভার্সের  কবিতাগুলোয় প্রায়শই লোকসঙ্গীত ব্যবহার করেছেন তাদের কালাতীত  করার প্রয়াসে। এই  কবিতাগুলোর মধ্যে একটি হল “ইটালস্কা (ইতালি থেকে)” যেখানে  একজন নির্যাতিত ইতালীয় শ্রমিককে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে আর জেলখানায় সে স্তালিনের স্বপ্ন দেখছে কেননা তা শ্রমিকটিকে শক্তি যোগাচ্ছে আর তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে। চেক আলোচকদের মতে,যুদ্ধের সময়কার চেক ‘সর্বহারা’কবি জিরি ওল্কার (১৯০০-১৯২৪), প্রভাব আছে এই পর্বের কবিতায়:

.

“স্তালিনের সাথে দেখা করতে সেখানে উড়ে যাও,

আমার স্বপ্ন, আমার পাখি,

স্তালিনের সাথে দেখা করতে সেখানে উড়ে যাও,

আমার আগুন-পাখি!

স্তালিনের জমি

আমাদের শক্তির কূপ।

ওহ, পান করো, পাখি, পান করো

সেই গভীর কূপ থেকে,

আর তারপর নিজের জ্বলন্ত পালক দিয়ে

আকাশ জ্বালিয়ে দাও!

কোষগুলো খুলে গেলে,

একজন শক্তিশালী, তরুণ কর্মী আবির্ভূত হবে।

তার চোখের গভীর থেকে

ক্রেমলিনের জানালার রশ্মি জ্বলে উঠবে।

আমি তাকে দেখি,  এখন  সে সামনের সারিতে হাঁটছে

পার্টি আবার  ঢোল পিটিয়ে  হরতাল শুরু করেছে

বিক্ষোভের শ্লোগানে তার আওয়াজ শুনতে পাই

অবন্তী পোপলো! – আবার, আরেকবার যুদ্ধ করতে!”

.

পরবর্তীতে, কুন্ডেরা তার উপন্যাস ‘দ্য জোক’ এ ইতালীয় কমিউনিস্ট কর্মীদের প্রতি তাঁর প্রথম দিকের প্রশংসা প্রকাশ করেন আর হেলেনার চরিত্রটি তৈরি করে, একজন স্তালিনবাদী যার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং যিনি নিজেকে ১৯৬০-এর দশকের উদারপন্থী জগতে খুঁজে পান:

.

“…পাভেল ক্রাশের সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, এবং আমি তাকে সাধারণ হাববে তার নিজস্ব কিছু চিৎকার করতে শুনেছি, অন্যরকম কিছু, এবং যখন আমি তার ঠোঁটের দিকে তাকালাম, আমি বুঝতে পারলাম সে গান গাইছে, বা বরং চিৎকার করছে, একটি গান, তিনি আমাদের তাকে শোনার এবং তার সাথে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তিনি একটি ইতালীয় বিপ্লবী গান গাইছিলেন যা আমাদের রেপার্টরিতে ছিল এবং সেই সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল: অবন্তি পোপোলো, আ লা রিসকোসা, বান্দিয়েরা রোসা, বান্দিয়েরা রোসা… এটি ছিল পাভেল সব মিলিয়ে, একা একা মনের কাছে পৌঁছে তিনি কখনই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাকে আবেগের কাছে পেতে হয়েছিল, এটা কি চমৎকার ছিল না, আমি ভেবেছিলাম, একটি ইতালীয় বিপ্লবী গানের সাথে প্রাগের স্কোয়ারে ইতালীয় শ্রমিক আন্দোলনের নেতাকে অভিবাদন জানাচ্ছি, আমি টোগলিয়াত্তির জন্য আরও কিছু চেয়েছিলাম যেভাবে আমি ছিলাম সেভাবে সরানো হোক, তাই আমি যতটা সম্ভব জোরে পাভেলের সাথে যোগ দিয়েছিলাম, এবং অন্যরা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং অন্যরা এবং অন্যরা, শেষ পর্যন্ত পুরো দলটি গান গাইছিল…”

.

বান্দিয়েরা রোসা ‘ ( “লাল পতাকা” এর জন্য ইতালীয় ), যাকে প্রায়শই শুরুর শব্দের পরে অবন্তি পোপোলোও বলা হয় ; কমিউনিস্ট এবং সমাজতান্ত্রিক উৎসের ইতালীয় কর্মীদের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় গান , ইতালীয় শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত গান। এটি লাল পতাকাকে মহিমান্বিত করে, সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতীক গানটি ১৯০৮ সালে কার্লো তুজি লিখেছিলেন। ইতালিয় ভাষায় গানটা এরকম:

.

অবন্তি পোপোলো, আল্লা রিসকোসা,

বান্দিয়েরা রোসা, বান্দিয়েরা রোসা।

অবন্তি পোপোলো, আল্লা রিসকোসা,

বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা।

বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা

বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা

বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা

গানটা বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম :

এগিয়ে যাও মানুষ, মুক্তির দিকে

লাল পতাকা, লাল পতাকা

এগিয়ে যাও মানুষ, মুক্তির দিকে

লাল পতাকা বিজয়ী হবে।

লাল পতাকা বিজয়ী হবে,

লাল পতাকা বিজয়ী হবে,

লাল পতাকা বিজয়ী হবে।

.

স্তালিনবাদমুক্ত জীবনে কুন্দেরা হেলেনাকে একটি ধ্বংসাত্মক, গীতিময় আবেগপ্রবণতার রূপক হিসাবে উপস্হাপন করেছেন। নিষ্ঠুর উপহাসের মাধ্যমে কুন্দেরা অতীতের এই বিশেষ ভূত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য  অবশেষে হেলেনাকে  এমন একটি দৃশ্যে ধ্বংস করেছিলেন যেখানে হেলেনা মনে করছে যে সে আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু আদপে সে নিজেকে জোলাপ নিয়ে অবিরাম হেগে চলেছে । করেছেন, তাই তিনি একটি অপ্রতিরোধ্য ডায়রিয়ায় ভুগছেন। দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা লক্ষণীয় এবং যা স্পষ্টতই কুন্ডেরার প্রথম দিকের কবিতার সাথে সম্পর্কিত। হেলেনা যে দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয় সেই দৃশ্যে পাভেল জেমানেক “মৌলিক” হওয়ার জন্য কঠোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার “মৌলিকতা” কঠোরভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, এটি এক সীমাবদ্ধতা । “মৌলিকতা”-র  পুরো খেলাটা ভণ্ডামির ছোবল। অন্য প্রতর্ক  হলো: কুন্দেরা তরুণ স্তালিনবাদীদের প্রতিক্রিয়া দেখে আতঙ্কিত —- তারা অস্বাভাবিকতার জন্য উৎসাহী। হেলেনার চরিত্র থেকে পাওয়া কুন্দেরার কাব্যিক প্রচেষ্টার সাথে সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে হয়।

.

“তুমি, কনস্ট্যান্টিন, কখনও বিশ্বাস করোনি” কবিতাটি কনস্ট্যান্টিন বিবলের স্মৃতিতে উত্সর্গীকৃত। এই কবিতায় স্তালিনবাদী কমিউনিজমের নিপীড়ক প্রবণতার বিরুদ্ধে কুন্দেরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন:

.

“তুমি, কনস্ট্যান্টিন, কখনও বিশ্বাস করোনি

যে একজন কমিউনিস্ট তেমন লোযে মানুষকে অপছন্দ করে,

সেই ভয়ঙ্কর পুরোহিতরা,

যারা নিজেদের মার্কসবাদে বন্দী করে রেখেছে ঠান্ডা দুর্গের মতো।

তাদের স্লোগান এবং আদেশের হিমায়িত নিঃশ্বাসে

তারা আনন্দের  শিখা যা জ্বলতে শুরু করেছিল তা নিভিয়ে দিয়েছে। 

তারা সেইসব কবিতা আর ছবিতে শেকল বেঁধে দিয়েছে 

যাদের কেশর অবাধে বাতাসে উড়ছিলো।.

কেউ যদি সাম্যবাদে বেশি কিছু দেখতে পায়, 

তারা সাথে সাথে তাকে একটি বিপথগামীর খোলোসে পুরে দেবে।

তুমি তা  জানতে, কনস্ট্যান্টিন:

জীবন আর কবিতার শত্রু এক।

যারা সমাজতন্ত্রকে আতিথ্যহীন মরুভূমিতে পরিণত করতে চায়

তারা প্রথমে  কবিতার কোঁচকানো বিনুনিকে কেটে ফেলবে।”

.

কনস্ট্যান্টিন বিবল (১৮৯৮ – ১৯৫১ ) ছিলেন একজন চেক আভাঁ-গার্দ কবি, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, যিনি চেকোস্লোভাকিয়ায় স্তালিনবাদী শাসনকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু কাব্যিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ১৯৫১ সালের নভেম্বরে তিনি আত্মহত্যা করেন।

আলোচক জেড, কে, স্লাবি মনে করেন যে “কুন্দেরার বিতর্কিত কবিতাগুলো , ১৯৫২ সালে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়েছিল, তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং প্রশাসনের দ্বারা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের সমর্থনে আর প্রশাসনের বিরুদ্ধে লেখা। এমন এক সাহিত্যে যেখানে ভাষার মূল অর্থ প্রচারের কর্মকাণ্ডের ফলে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের আরেক স্তালিনবাদী সমালোচক, জারোস্লাভ জানো, স্ল্যাবের ব্যাখ্যায় এবং কুন্ডেরার সমালোচনায় “সেই ভয়ঙ্কর যাজক,/যারা মার্কসবাদে নিজেদের ঠাণ্ডা দুর্গের মতো আটকে রেখেছে” সম্পর্কে সঠিকভাবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আর হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে কবিতাটায়, ” উচ্চতর, ব্যক্তিবাদী, এমনকি নৈরাজ্যবাদী না হলেও, দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য ছায়া রয়েছে।” কুন্দেরার বিতর্কিত কবিতাগুলি তার পরিপক্ক সাহিত্যশৈলীর আরেকটি  বৈশিষ্ট্যের পূর্বাভাস দেয়, যেমন উপন্যাসে আর প্রবন্ধে  পাঠকদের কাছে বক্তৃতা দেওয়ার প্রবণতা।

.

“কমরেডগণ, লোকটি তার পিঠে তুলে নিয়ে যাচ্ছে

একটা বস্তা : দু:খ, সন্দেহ এবং খারাপ অভ্যাস

সে কিন্তু নিজে থেকে  শত্রু নয়।

হয়তো এত ভারী বস্তা নিয়েও এমন একজন মানুষ

আনন্দের  সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করবে 

কমরেডগণ, যে মানুষ আনন্দের সাথে একা চড়াই পার হয়

বন আর খেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যায়

সে মোটেই একজন ব্যক্তিবাদী নয়।

তার সমস্ত সমালোচকদের একত্রিত করার চেয়ে

হয়তো এমন একাকী একজন লোক

সমালোচনা করার জন্য, নিষ্ঠুর রাজদণ্ড নিয়ে অপেক্ষারত লোকেদের তুলনায়

মানুষদের বেশি পছন্দ করে

তার প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ অনুসরণ করুন

আমরা আমাদের বন্ধুর প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ দেখছি।

অন্যথায় তারা ভীরু হয়ে পড়বে

এবং তারা পিছিয়ে পড়বে।”

.

কার্লোস ফুয়েন্তেসকে লেখা  মিলান কুন্দেরার এই চিঠি থেকে সেই সময়ের আভাঁ-গার্দ সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা হবে

.

প্রিয় কার্লোস, 

.

আজ আপনার জন্মদিন এবং এ বছর আমারও বার্ষিকী, ৭০-এ পা রাখার; আপনিও ৭০-এ পা রেখেছেন; আমরা, আজ থেকে ৩০ বছর আগে, প্রাগে, প্রথমবারের মতো দেখা করেছি। প্রাগে আপনি এসেছিলেন রুশ আগ্রাসনের মাত্র কয়েক মাস পর, এসেছিলেন হুলিও কোর্তাসার আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে; এসেছিলেন আমাদের পক্ষে কথা বলতে, চেক লেখকদের জন্য আপনাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে।

.

তার কয়েক বছর পর, প্রাগ ছেড়ে আমি ফ্রান্সে চলে আসি, তখন আপনি ফ্রান্সে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। এখানেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়, বারবার দেখা হয়, কথা হয়; আমরা বন্ধুর মতো সম্পর্কিত হয়ে পড়ি। আমি ছিলাম মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ এক বিক্ষুব্ধ নির্বাসিত লেখক। তখন আপনি আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাকে সমর্থন করেছেন এবং অন্যান্য চেক বন্ধুকেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। বহু বহু দিন আমার স্ত্রী ভেরা আর আমি মেক্সিকো দূতাবাসে আপনার অতিথি হয়েছি, একসঙ্গে আমরা রাত্রি যাপনও করেছি (তখন আমরা প্যারিসে থাকতাম না)। সকালের নাশতার টেবিলের আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে কার্লোস, সেখানে আমরা রাজনীতি নিয়ে খুব কমই কথা বলেছি আর অবিরাম কথা বলেছি কেবল উপন্যাস নিয়ে, আর আমাদের সেসব কথা কোনো দিনও শেষ হয়নি! 

.

ঠিক তখনই কিন্তু আমি মধ্য ইউরোপ-সংক্রান্ত (সেন্ট্রাল ইউরোপ) ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করি, একটা ঘোর তৈরি হয়; বিষয়টি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত (রাশিয়ার দখলদারিত্ব কিংবা অপহরণ) কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণটি বোধ হয় এটিই যে, মধ্য ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা নির্দিষ্টতা, যা সেই মধ্যযুগ থেকে আজও অস্তিত্বমান। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়, একটা সংস্কৃতি কিংবা নিয়তি। একজন হাঙ্গেরিয়ান কিংবা একজন চেকের কাছে ইউরোপের কী অর্থ? হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটি-সমৃদ্ধ অংশে বাস করেছে। ইতিহাসের প্রতিটি পরতে তাদের অবদান আছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের কাছে একটি আধ্যাত্মিক ধারণা। আর আমরা দিনের পর দিন এই নিয়ে কথা বলেছি, কীভাবে অসাধারণ এক মিল মধ্য ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার ভেতর, উভয়ই বারোকরীতির দ্বারা গভীরভাবে চিহ্নিত, একজন লেখকের জন্য যা ম্যাজিক্যাল এবং কল্পনাবিস্তারি স্বপ্নের জাল। অবশ্য ফরাসিদের কাছে তা বিজাতীয়। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে ফ্রান্সে স্যুররিয়ালিজমের জন্ম কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আসলে স্যুররিয়ালিজম শিল্প হিসেবে নয়, আদর্শ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল ফ্রান্সে। আমরা, আপনি আর আমি—বিশ্বের এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে আরেকটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পেয়েছি: মধ্য ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা বিশ শতকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি বিস্তৃত নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে—প্রুস্ত-পরবর্তী উপন্যাসে এবং সেই উপন্যাসের নতুন নন্দনতাত্ত্বিক আলো-হাওয়ায়। প্রথমত, দশের, বিশের এবং তিরিশের দশকে মধ্য ইউরোপে একটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ এসেছিল—কাফকা, মুসিল, ব্রখ এবং গোমব্রোভিজ; তারপর, ষাটের লাতিন আমেরিকায় আরেকটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ দেখা গিয়েছিল।

.

শিল্পের আধুনিকতা আর উপন্যাস—আমি এ দুটি বিষয় নিয়েই বেশির ভাগ সময় ভেবেছি, নিজেকে গড়ে নিয়েছি। অনুগত থেকেছি। আভঁ-গার্দ  চিন্তাভাবনা উপন্যাসের শিল্পকে সব সময়ই আধুনিকতার বাইরে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, উপন্যাসকে এমন কিছু বিবেচনা করেছে, যার সময় অতিবাহিত হয়েছে; পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আভঁ-গার্দ যখন তাদের নিজস্ব ঔপন্যাসিক আধুনিকতা তৈরি এবং ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিল, তখন তারা বিশুদ্ধ নেতিবাচকতার পথ অনুসরণ করেই এটি করেছিল: উপন্যাস, চরিত্র, প্লট, গল্প এবং (সম্ভব হলে) বিরাম চিহ্ন ছাড়া। ফলে উপন্যাসগুলো গর্ব করে নিজেদের অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে ঘোষণা করেছে। 

.

বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। আধুনিক কবিতা কিন্তু কখনোই নিজেকে কবিতাবিরোধী বলে দাবি করেনি। শার্ল বোদলেয়ারের হাত ধরে কাব্যিক আধুনিকতা (পোয়েটিক মডার্নিজম) আমূলভাবে কবিতার এসেন্সের কাছে যেতে চেয়েছে। কবিতা কেবল কবিতাই হবে। 

.

আমি এই নিয়ে কিছুটা ভেবেওছি। আধুনিক উপন্যাসকে আমি অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে নয় বরং অতি উপন্যাস বা অত্যধিক উপন্যাস (আলট্রা নভেল) হিসেবে কল্পনা করেছি। অতি উপন্যাস সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করে, যা শুধু উপন্যাস করতে পারে। অতি উপন্যাস জীবনের সমস্ত অবহেলিত এবং বিস্মৃত সম্ভাবনাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে, উপন্যাসের শিল্প তার চার শতাব্দীর ইতহাসে যা করে এসেছে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়েছে। 

.

২৫ বছর আগে আপনার ‘তেরা নস্ত্রা’ পড়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি একটি অতি উপন্যাসই পড়েছিলাম। আপনার বইটি প্রমাণ করেছে যে এই এই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব আছে, এই এই জিনিসগুলো থাকতে পারে। 

.

আর তার ১৫ বছর পর আপনার ‘ক্রিস্টোফার এখনো জন্মায়নি’ উপন্যাসেও সেই একই জাদু খুঁজে পেয়েছি: সমস্ত আকর্ষণীয় সম্মোহন এবং নতুনত্বসহ উপন্যাসের দুর্দান্ত আধুনিকতা।

.

উষ্ণ আলিঙ্গন, কার্লোস!

.

মিলান কুন্দেরা

Posted in Uncategorized | Tagged , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

হাংরি আন্দোলন, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, বিট জেনারেশান: আন্দোলনগুলোর পার্থক্য : 

মলয় রায়চৌধুরী

১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশিত হওয়ামাত্র দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি হালকামেধা পত্রিকাসহ অমৃত, দৈনিক বসুমতী, দৈনিক যুগান্তর-এর মতন বহুগ্রাহ্য পত্রিকার পাশাপাশি বাংলা ভাষাসাহিত্যের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক হাংরি, অ্যাংরি এবং বিট, তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে এমনভাবে উল্লেখ ও উপস্হাপন করতেন, যেন এই তিনটি একই প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতানকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন । পত্র পত্রিকার লেখক ও সাংবাদিকরা ক্রেতা সুড়সুড়ির কথা মাথায় রেখে এই ধরণের মন্তব্য করতেন, কেননা অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিটদের সম্পর্কে বহুবিধ গুলগল্প ততদিনে পৃথিবীময় চারিয়ে দিতে সফল হয়েছিল ইউরোপ আমেরিকার ক্ষমতার মিডিয়ে, যখন কিনা বঙ্গসংস্কৃতির মাঝে আচমকা এসে-পড়া হাংরি আন্দোলনকে মূর্ততা দেবার জন্য বাঙালির ইতিহাস থেকে কোনো সমান্তরাল ঘটনা তাঁরা দ্রুত খুঁজে পাননি ।

প্রশ্ন হল যে বাংলা ভাষাসাহিত্যের বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরা, কয়েকজন তখনই পিএচ ডি করে ফেলেছিলেন, তাঁরা কেন হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে একই জ্ঞান পরিমণ্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, চিন্তার আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষণী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্হাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্ণাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্কবিন্যাসের অনুষঙ্গ, অভিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়িতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্হানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্ণায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্হনা, দেশজ অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টি পীড়াপূঞ্জ, ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত করে ফেললেন ? যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে করছিলেন, তাঁদের কথা আমি বাদ দিচ্ছি । তাঁরা ইচ্ছে করে গুলিয়ে দিচ্ছিলেন ।

সবাই যে হাংরি, অ্যাংরি, বিট সাহিত্যকৃতি ও সমাজব্যবস্হার পাঠকৃতিকে ইচ্ছে করে একই কাউন্টারডিসকোর্স প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন, তা কিন্তু নয় । অনেকে অমনটা অনুমান করে নিচ্ছিলেন । যাঁরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট টেক্টগুলোকে একই জিনিস ভেবেছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে সীমিত পরিসরের বিশেষজ্ঞতা ; অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন । যাকে বলা হয় মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ, তা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে । যার দরুণ ব্যক্তি মানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে । যে সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তিদের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি । প্রতিস্ব-বিশেষের টেক্সট কেন অমনভাবে দৃষ্টির গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্বপীড়ন ঘটাচ্ছে, তার চাপে টেক্সট গঠনে মনস্তাত্বিক ও ভাষাতাত্বিক আদরা  কীভাবে পাল্টাচ্ছে, আর তার আখ্যান-ঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তা করার বদলে নিজের ভালোলাগা নামক একটি সাবজেকটিভ খপ্পরে তাঁরা নিজেরাই পড়েগিয়েছিলেন । যে-কোনো টেক্সট একটি কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল । কৌমনিরপেক্ষ টেক্সট অসম্ভব । যে সমস্ত বিদ্যায়তনিক আলোচক এক নিঃশ্বাসে হাংরি-অ্যাংরি-বিট ডিসকোর্সগুলোকে মগজে পুরে নিয়ে তাদের সমরূপতা দেবার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা প্রকারান্তরে প্রতিটি টেক্সটকে কৌমনিরপেক্ষ বলে অনুমান করে নিচ্ছিলেন ।

যে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে একই ব্যাপার বলে মনে করছিলেন, সমস্যাটি ছিল তাঁদের নিজের স্তরে । তাঁরা যে-যার নিজের প্রতিস্বগঠনের প্রেক্ষাবিন্দুগুলো খতিয়ে দেখা দরকার মনে করেননি । প্রথমত তাঁরা অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা সমস্যাহীন, সাহিত্য সম্পর্কিত সমস্যাহীন তো বটেই, যখন কিনা জীবনের প্রত্যেকটি এলাকায়, প্রত্যেকেরই, বহু সমস্যা থেকে যায় সমাধানহীন ও সংকটদীর্ণ । দ্বিতীয়ত, তাঁদের সবায়ের শিক্ষাদীক্ষা, যেহেতু ইংরেজরা সবে বিদায় হয়েছিল মাত্র দেড় দশক আগে, ঘটেছিল ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ঘেরাটোপে, যে-গ্রেকোরোমান ও ঔপনিবেশিক সাহিত্যতন্ত্রটি দেশজ অজস্রতার প্রস্তাবনা সামলাতে অক্ষম । সাম্রাজ্যবাদ প্রতিটি উপনিবেশে তার হেলেনিক মননবিশ্বের স্টিমরোলার চালিয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিল বিদ্যায়তনের প্রতিনিধিদের । এনারা ছিলেন এনলাইটেনমেন্টের আদরায় নির্মিত ব্যক্তিএকক । ফলত অনুমিত প্রজ্ঞাপ্রাপ্তিকে ঠাউরেছেন সর্বোচ্চ, ঠিক যেমনটা নেটিভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবতেন বিলিতি সায়েবরা । নেটিভ যে সত্যিই সাহিত্য-ঐতিহ্যহীন নেটিভ হতে পারে, তার যে থাকতে পারে অসমন্বিত নেটিভত্বের আত্মাভিমান, তার যে এনলাইটেনমেন্ট নিষ্কৃতির ছটফটানি তাকে ম্যাকলে সায়েবের বাঁধন ছিঁড়তে বাধ্য করতে পারে, তা তাঁরা ভেবে উঠতে পারেননি ।                                                               

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সুবে বাংলায় এসে, তাদের হেলেনিক মননবিশ্বটির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও প্রসার এমনভাবে করেছিল যে, তদানীন্তন অনির্মিত নেটিভ, এবং ব্রটিশরা জাঁকিয়ে বসার পর নির্মিত প্রতিস্বের বাঙালি ব্যক্তিএকক, এনলাইটেনমেন্টের আদরায় প্রবেশ করে, আবিষ্কার করেছিল যে, নতুন গড়ে ওঠা ভাবকল্প অনুযায়ী, বঙ্গসমাজের মানব-ব্যবস্হাটি প্রকৃতপক্ষে অপলকা, অনিশ্চিত সম্ভাবনাযুক্ত, এবং নির্ভরযোগ্য ভিত্তির অভাবদ্বারা চিহ্ণিত । পশ্চিম ইউরোপের কাছে এই বোধটি, যা আদপে শীতভূখণ্ডের মূল্যবোধপ্রসূত, প্রথম ধাক্কায় অভাবনীয় ঠেকলেও, তাকে সামলাবার জন্য তারা নানা রকম কায়দা উদ্ভাবনের প্রয়োজন বোধ করেছিল, যার মাধ্যমে, সমাজকে আঁটোসাঁটো, বাধ্যতামূলক, ও নির্ভরযোগ্য বনেদের ওপর দাঁড় করানো যায়, এবং সমাজসদস্যদের একরূপতা দেয়া যায় । তাঁদের এই ভাবনাপ্রকল্পে অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে চিহ্ণিত করা হয়েছিল শত্রুবাধা হিসাবে, আর শৃঙ্খলাবিন্যাসকে চিহ্ণিত করা হয়েছিল কর্তব্যরূপে । ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা যে-যে উপনিবেশে আধিপত্য বসিয়েছিল, সেসব ভূখণ্ডের নেটিভদের প্রত্যক্ষ করার পর, তাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা, হীনতা, দীনতা, অনাচার, অনিয়ম, খামখেয়াল, বৈভিন্ন্য, বহুত্ব ইত্যাদি, যে ব্যাপারগুলো খ্রিস্টধর্মী চেতনায় বেমানান আর অসহ্য ঠেকেছিল । তারা সত্যিই বিশ্বাস করত  যে, সবাইকে পিটিয়ে নিজেদের প্রতিবিম্ব বানানো যাবে । যে সমস্ত বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে পিটিয়ে নিজেদের মস্তিষ্কে একরূপতা দিচ্ছিলেন, তাঁরা নিজেরা যে ওপরে উল্লিখিত প্রতিবিম্ব, তা খেয়াল করছিলেন না । তাঁদের ভাবনায় কুলোচ্ছিল না, যে, একদল তরতাজা নেটিভ কোনো শর্তে এই ভাবকল্পে প্রতিবিম্বিত হতে রাজি নয়, ভূখণ্ড ও পরিবার পরিসরের স্বতোজাত প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করতে রাজি নয় । বিদ্যায়তনিক আলোচকরা অনুমান করে নিয়েছিলেন, যে, কার্যের কারণ থাকতেই হবে ।

বিদ্যায়তনিক আলোচকরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তনতন্ত্রের বিরোধিতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ । তাঁদের ভাবনায় মতবিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন । মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার  বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যেকোনো আদল ও আদরাকে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধিতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে; সাহিত্যকৃতি হলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হলে রাষ্ট্রের অবয়বে । ওই প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে, যারা মতবিরোধিতার দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে তারা অন্যরকম, তারা প্রান্তিক, তারা সত্যের মালিক নয়, তারা অজ্ঞান । বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতা ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে, যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব । অজ্ঞানের চিন্তাচেতনাকে মেরামত করে, অতএব, পরিবর্তনের দায় সত্য মালিকের । বিদ্যায়তনিক আলোচকরা যে কাজটি করতে চাইছিলেন, তা হল অবুঝ-অজ্ঞান হাংরি আন্দোলনকে মেরামত করে প্রতিবিম্বের উপযোগী করে তুলতে । আর এই মেরামতির কাজে নেমে তাঁরা ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিট জেনারেশানকেও মেরামত করতে চেয়েছিলেন ।

দুই

গ্রেট ব্রিটেনে, ১৯৫৩ সাল থেকে কয়েকজন লেখক, নাট্যকার ও কবি অ্যাংরি ইয়াং ম্যান রূপে চিহ্ণিত হন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য অ্যালান সিলিটো, জন ব্রেইন, জন অসবর্ন, কলিন উইলসন, জন ওয়েইন, উইলিয়াম কুপার, ফিলিপ লারকিন, বিল নটন, এ. আলভারেজ, আইরিস মারডক, টম ম্যাশলার, লিণ্ডসে অ্যাণ্ডারসন, কেনেথ টাইনান, স্টুয়ার্ট হলরয়েড, ডরিস লেসিং, বিল হপকিন্স এবং কিংসলে অ্যামিস । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কথাটা চালু হয় যখন জন ওয়েইন ১৯৫৩ সালে তাঁর হারি অন ডাউন রচনাটি বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান । জন ওয়েইনের ব্যবস্হাপনায় পরের বছর পঠিত হয় কিংসলে অ্যামিস লিখিত লাকি জিম এবং ফিলিপ লারকিনের কবিতা, যেগুলো বিবিসিতে আলোচনাকালে এ. আলভারেজ অ্যাংরি ইয়াং ম্যান সম্পর্কে একটি রূপরেখা গড়ার চেষ্টা করেন ।  ১৯৫৬ সালে জন অসবর্নের লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার প্রকাশিত ও মঞ্চে অভিনীত হলে, বিদ্বৎসমাজ অ্যাংরি ইয়াং ম্যান শব্দবন্ধটি সাহিত্যগোষ্ঠীকে চিহ্ণিত করার জন্য প্রয়োগ করা আরম্ভ করেন, যদিও গোষ্ঠী বলতে যা বোঝায়, সেভাবে এনারা সবাই কোনো আড্ডায় বা কর্মকাণ্ডে একত্রিত হতেন না ।

লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার নিয়ে চলচিত্র হল, এবং কাহিনির কেন্দ্রচরিত্র জিমি পোর্টারের ভূমিকায় রিচার্ড বার্টন অভিনয় করলেন, ব্রিটেনের নিম্নবর্গের জনগণ একাত্মবোধ করলেন জিমি পোর্টারের সঙ্গে, এবং অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কথাটা সাংবাদিকদের ও জনগণের মধ্যে প্রচলিত হল । তবে, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান বলতে ঠিক কী ধরণের ভাবনাচিন্তা বোঝায়, তার একটা মোটামুটি ধারণা দেবার চেষ্টা ১৯৭৫ সালে টম ম্যাশলার করেছিলেন । তাঁর সম্পাদিত ডিক্লেয়ারেশান্স নামের সংকলনে, কিন্তু তাতে লেখা দিয়েছিলেন কেবল জন অসবর্ন, লিণ্ডসে অ্যাণ্ডারসন, কেনেথ টাইনান, স্টুয়ার্ট হলরয়েড, ডরিস লেসিং, কলিন উইলসন, বিল হপকিন্স এবং জন ওয়েইন । যাঁরা লেখা দেননি তাঁদের কাছে, তাঁদের রচনাবলীকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য অ্যাংরি ইয়াং ম্যান লেবেলটা সংকীর্ণ ঠেকেছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাহিল ব্রিটেনের স্বর্ণডিম্ব প্রসবকারী ভারতীয় উপনিবেশ হাতছাড়া হবার পর ব্রিটিশ যুবসমাজ যে  Zeitgeist ( দিব্যাংশু মিশ্র এর বাংলা করেছেন যুগরুচি, যুগাত্মা, যুগধর্ম, যুগচৈতন্য )  দ্বারা  আক্রান্ত হয়েছিল, ঠিক সেই ব্যাপারটাকেই ধরার চেষ্টা করেছিলেন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান নাট্যকার, কবি ও ঔপন্যাসিকরা, যে যুগচৈতন্য ছিল আচমকা সাম্রাজ্যবাদী দ্যুতি ফুরিয়ে-আসা ব্রিটেনের কন্ঠরোধকারী আত্মপ্রসাদ । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর হয়নি, কেননা তখন তাঁরা কিশোর, অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাঁদের তাঁরা জয়দ্ধনি দিয়েছেন তাঁরা যুদ্ধফেরত খোঁড়া, নুলো, অন্ধ, কানা, বিকলাঙ্গ মহানায়ক । সারা ব্রিটেন তখন ছেয়ে গেছে ঘরকুনো মহানায়কে, যারা যুদ্ধ লড়ে ফিরেছে বা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে লাথি খেয়ে ফিরেছে । প্রাক-বিশ্বযুদ্ধ নিশ্চয়তার পৌঁরুষের জায়গায় তখন দেখা দিয়েছে একটি নপুংসক ব্রিটেন ।  ব্রিটেনের ওই আর্থরাজনৈতিক গরিমার অবসানের কালখণ্ডে যুবসমাজ ও শ্রমিকশ্রেণির মাঝে দেখা দিল ক্রোধ, নৈরাশ্য পরাজয়বোধ ও ক্ষিপ্ততার মিশেল । সমাজের এই রোগটিকে পোষ মানাতে গিয়ে ব্রিটিশ নাগরিক নিজের মানসিক অশান্তি ডেকে আনছিল । ১৯৫৬ সালে সুয়েজখালকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ল্যাজেগোবরে অবস্হার পর, মুখ চূণ হয়ে গেল একটি সাম্রাজ্যবাদী প্রতাপে আপ্লুত ব্রিটিশ নাগরিকদের । সেসময়ের ব্রিটেনের সংস্কৃতি ছিল পুরুষালি, তাই চোটটা ছিল মোক্ষম । চাকরি-বাকরিতে নারীসমাজকে রাজনৈতিকভাবে হীনম্মন্য করে তোলা হচ্ছিল । ন্যাশানাল সার্ভিস জন্ম দিয়েছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের । আমেরিকায় জো ম্যাককার্থি ‘কমিউনিস্ট’ চিহ্ণিত করে যাকে-তাকে হেনস্হা করার যে-আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তার প্রভাব অনুপ্রবেশ করতে পেরেছিল ব্রিটিশ সমাজব্যবস্হাতেও । জোসেফ রেমণ্ড ম্যাককার্থি নামের এই রিপাবলিকান সদস্য ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সময়ে জাল দলিল-দস্তাবেজের সাহায্যে বহু রাজনীতিক, লেখক, চলচ্চিত্রশিল্পী, সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সমাজসেবককে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য প্রমাণ করে ভয়ংকর রক্ষণশীল ফ্যাসিবাদী আবহ গড়ে তুলেছিলেন, যাঁর জালজোচ্চুরি শেষাবধি ধরে ফেলেন আইজেনহাওয়ার, কিন্তু ততদিনে জনজীবনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে । স্বভাবতই অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা ছিলেন দক্ষিণপন্হী, এবং অনেকে নিজেদের কেন্দ্রের ডানদিকে বলে অভিহিত করতেন । পরবর্তীকালের আলোচকরা তাঁদের অনেককে, বিশেষ করে অসবর্ন আর কিংসলে অ্যামিসকে, চিহ্ণিত করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিকরূপে ।

জন অসবর্ন, জন ব্রেইন, কিংসলে অ্যামিস এবং জন ওয়েইন, প্রথাগত সাহিত্যের কেন্দ্রচরিত্র থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে জন্ম দিলেন এক ভিন্ন নায়কের, যাকে বলা হল দি অ্যান্টি হিরো, যে লোকটা সদাসর্বদা পাঁচিল-ঘেরা সমাজব্যবস্হার সঙ্গে কারণে-অকারণে সংঘর্ষে লিপ্ত, বিশেষ করে চার্চ ও এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে । এসট্যাবলিশমেন্ট  ভাবকল্পটির বহুল প্রয়োগ সর্বপ্রথম অ্যাংরি ইয়ং ম্যান লেখকদের রচনায় দেখা গিয়েছিল । অ্যান্টি হিরো লোকটি নিজেরই জটপাকানো প্রেম, শ্রেণি ও যৌনতার অনুভব-অভিজ্ঞতায় তিতিবিরক্ত । আগের প্রজন্মের সৌম্যকান্তি, শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান, মার্জিত, বাকপটু, শব্দচয়নে অব্যর্থ, প্রেমে পাগল, যন্ত্রণা ভোগরত, অপরিবর্তনীয় রাজনৈতিক আদর্শে সপর্মিত এবং আত্মকেন্দ্রিক নায়কদের সঙ্গে কোনো মিল রইল না অ্যান্টি হিরোর । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান লেখকদের মতনই, যার সঙ্গে প্রথমবার শোয় তাকেই বিয়ে করে না অ্যান্টি হিরো । তারা অনেক শোয়াশুয়ি করে, এবং তখনও তারা যার সঙ্গে শুচ্ছে বা শুয়েছে তার সঙ্গে রাগ-ঝগড়াঝাঁটি করে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কেন্দ্রচরিত্রটিও অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, দগদগে, অপরিমার্জিত, ঝগড়াটে, তিলে খচ্চর, অনেক সময়ে সমকামী, এমনকি বহুদিন স্নানহীন, যে কিনা সমাজ এবং বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে অক্ষম — গররাজি তো বটেই ।

জন ওয়েইন কৃত কেন্দ্রচরিত্র চার্লস লুমলে, পড়াশোনা শেষ করার পর জানালার শার্সি পোঁছার চাকরি বেছে নেয় । কিংসলে অ্যামিস কৃত কেন্দ্রচরিত্র জিম ডিকসন একজন অধ্যাপক, নিজের ঊর্ধতন অধ্যাপকের সঙ্গে, প্রেমিকার সঙ্গে, সহানুভূতিশীল শুভার্থীদের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে । জন ব্রেইনের কেন্দ্রচরিত্র জো ল্যাম্পটন প্রেমিকাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজের ওপরতলায় ওঠে, আর মালিকের জামাই এবং উত্তরাধিকারী হয় নানারকম চাল চেলে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের অন্যতম জন অসবর্ন লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার ছাড়াও লিখেছিলেন দি এনটারটেইনার ( ১৯৫৭ ), ইনঅ্যাডমিসিবল এভিডেন্স ( ১৯৬৪ ), আ প্যাট্রিয়ট ফর মি ( ১৯৬৫ ), লুথার ( ১৯৬১ ), দি হোটেল ইন অ্যামস্টারডম ( ১৯৬৮ ) নাটক, এবং এ বেটার ক্লাস অব পার্সন ( ১৯২৯-৫৬ ) ও অলমোস্ট আ জেন্টলম্যান ( ১৯৫৫-৫৬ ) শিরোনামে দুটি আত্মজীবনী । তাঁর আত্মজীবনী পড়ে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ভাবকল্পটির যে-প্রেক্ষাপ্রতিস্ব গড়ে ওঠে, তা হল কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণির সদস্য না হবার উদবেগ, সমকামী ও উভকামী যৌনতা নিওয়ে গলদঘর্ম যৌবন, এবং ব্রিটিশ সমাজব্যবস্হায় কোনোরকম ক্ষমতা উপভোগ না-করতে পারার গ্লানি । সে-সময়ে ব্রিটিশ সরকার প্রচার করছিল যে, ‘এত ভালো দিনকাল আর কখনও আমাদের ছিল না ।’

লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার এবং তার সমসাময়িক এই ধরণের নাটকগুলোর নামকরণ হয় ‘কিচেন সিং ড্রামা’, কেন না তা প্রথমবার মঞ্চের ওপর সরাসরি উপস্হাপন করেছিল শ্রমিক শ্রেণির নিখুঁত, রাখঢাকহীন, খাঁটি, ঝাঁঝালো, ধাক্কাদেয়া জীবনযাত্রা, যার সঙ্গে দর্শকরা পরিচিত ছিল বলে একাত্ম হতে পারছিল । তার আগে মঞ্চগুলোয় রাজত্ব করত পলায়নী প্রবৃত্তির নাটক, যেগুলোয় দেখা যেত কাচের জানালা খুলে টেনিস খেলার সঙ্গিনী খুঁজছে বোকা-বোকা নায়ক । অসবর্ন এবং অন্যান্য অ্যাংরি ইয়াং ম্যান নাট্যকাররা যে সেসময়ে সামনের সারির দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, নাটকগুলো বেশ সিরিয়াস হওয়া সত্ত্বেও, তা এইজন্য যে, নাটকগুলো ছিল এক ধরণের প্রচ্ছন্ন ইশারা যে, মানুষের চরিত্রে আছে বিপরীত শক্তির যুগপৎ বিদ্যমানতা । তাঁদের নাটক ও উপন্যাসের দর্শক-পাঠক গ্রাহীতার আরেকটি কারণ হল ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত ব্রিটেনে লেবার পার্টির শাসন, যে দলটি সম্পদ সৃষ্টির চেয়ে সম্পদ বন্টনে অধিকতর গুরুত্ব দিলেও, নিম্নবর্গের কাছে অতিরিক্ত সম্পদ পৌঁছোচ্ছিল না । তারপর ১৯৫১ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত কনজারভেটিভ দল এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত লেবার দল একই নীতি বজায় রেখেছিল, যাকে ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচার এসে জলাঞ্জলি দেন । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের চোখে প্রাক-থ্যাচারের সরকারই মূলত এসটভাবলিশমেন্ট হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছিল । ১৯৭৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় এসে যখন নীতির পরিবর্তন ঘটাল, এবং সরকারে থেকে গেল টানা আঠারো বছর, বৌদ্ধিক হাতিয়ার হিসাবে ক্রমে-ক্রমে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছিল অ্যাংরি ইয়াং ম্যান পাঠকৃতিগুলো ।

অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা তাঁদের নাটক-উপন্যাসের কেন্দ্রচরিত্রে, ফিলিপ লারকিন তাঁর কবিতায়, নিজেদের পার্সোনা চাপিয়ে দিতে কসুর করেননি, এবং সেগুলোর অনেকটাই কল্পিত । অধিকাংশ ক্ষেত্রে, জন অসবর্নের ক্ষেত্রে তো বটেই , পার্সোনাটি মাইসোজিনিস্ট বা স্ত্রীদ্বেষী । সবাই কেমন ভাবে বেঁচে আছে, লেখক হিসাবে তা চিন্তা করার পরিবর্তে তাঁরা জানিয়ে গেছেন ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ । তাঁদের পাঠকৃতিতে ফলত খোঁচার মতন থেকে গেছে বদমেজাজ, রুক্ষতা, ঈর্ষা, সঞ্চিত বিদ্বেষ, হিংসুটে ঘৃণা, ইত্যাদি যা ব্যক্তিজীবনের প্রাণচাঞ্চল্যকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে ।

অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মধ্যে একমাত্র কলিন ইলসন চেষ্টা করেছিলেন তাঁর প্রজন্মের প্রতিস্ব নির্মাণের উপাদান ও লক্ষণগুলোর কার্যকারণের সামাজিক-দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে বের করার । যদিও তিনি কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন, তিনি আজও প্রাসঙ্গিক ও পঠিত তাঁর ‘দি আউটসাইডার’ প্রবন্ধগ্রন্হের জন্য । ব্রিটিস সংস্কৃতি অবিনির্মাণ করে আরও অনেকগুলো গ্রন্হ তিনি পরে লিখেছিলেন । প্রথম দিকের অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মতন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ কলিন উইলসনের হয়নি । তিনি প্রকৃতই নিম্নবর্গ শ্রমিক পরিবারের সন্তান, এবং ‘দি আউটসাইডার’ প্রকাশিত হবার আগে বেশ কঠিন জীবন কাটাতে হয়েছে । এই জীবনসংঘর্ষ নিয়ে তিনি ‘অ্যাড্রিফ্ট ইন সোহো’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । তবে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মধ্যে এই ধরণের জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা বহুচর্চিত উপন্যাসটি হল অ্যালান সিলিওট রচিত ‘দি লোনলিনেস অব দি লং ডিসটভান্স রানার’ উপন্যাস । মদ খাবার ব্রিটিশ ঐতিহ্যের বাইরে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা নেশাভাঙ করতেন না । ব্রিটিশ পোশাকের চিরাচরিত অনুশাসন মেনে চলতেন তাঁরা ।

কলিন উইলসন রচিত ‘দি আউটসাইডার’ গ্রন্হটি প্রকাশিত হবার পর অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পাঠকৃতি, যেগুলো প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মোহমুক্তির ব্রিটিশ ফসল, দার্শনিক ব্যাখ্যা পেল । ব্যাখ্যার অতীত এক বিদকুটে জগতে ব্যক্তিমানুষ নিজেকে তাতে প্রবিষ্ট হিসাবে আবিষ্কার করে, যখন কিনা তার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ইচ্ছেমতন যাচাই-বাছাই করে নিজের করণীয় কাজগুলো নির্ণয় করে । এই বক্তব্য থেকে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পাঠকৃতির সাধারণীকরণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হল এউ উপাদানগুলোর গুরুত্ব : ব্রিটীস ব্যক্তিমানুষ, যাচাই-বাছাই করার অভিজ্ঞতা, বিশ্বজগত সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত বোঝাপড়ার অবর্তমানতা, এবং ব্যক্তিজীবনের অসামঞ্জস্য -অযৌক্তিকতা-হাস্যকরতা-অসম্ভাব্যতাকে কেন্দ্র করে এক ধরণের বোধ, যাকে বলা যায় আতঙ্ক । আতঙ্কের এই বোধকে সামাল দেবার জন্য প্রয়োজন হয় ক্রোধ, বদমেজাজ, রুক্ষতা, ক্ষোভ, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, কুচুটেপনা, হিংসুটেভাব, ঘৃণা ইত্যাদি ।

বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবুকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, গ্রেট ব্রিটেনে যেমন আলফ্রেড টেনিসন, ফ্রান্সে রেজি দেব্রে, পশ্চিমবঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কয়েকজন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, মার্গারেট থ্যাচারের কৃপায়, প্রতিষ্ঠানের প্রবক্তায় রূপান্তরিত হন । কিংসলে অ্যামিস পান নাইটহুড, রানি এলিজাবেথের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলে, রানি তাঁর রাজ-তলোয়ার অ্যামিসের মাথায় ছুঁইয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠানের সেবক ঘোষণা করেন, ঠিন যেমন একশো ত্রিশ বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল টেনিসনের ক্ষেত্রে । জন ওয়েইন হয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার অধ্যাপক । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পর সংঘবদ্ধভাবে আর কোনো সাহিত্যিক আন্দোলন সম্ভব হয়নি ইউনাইটেড কিংডামে ।

তিন

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ধনাতক, বিত্তশালী পরিবারের ছেলে, গদ্যলেখক উইলিয়াম বারোজ যখন নিউ ইয়র্কে ছিলেন তখন তাঁর মেস-বাড়ির বন্ধু, হার্বার্ট হাংকে নামে এক ছিঁচকে চোর ও ঠগের মুখে ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম ‘বিট’ শব্দটি শোনেন । হাংকে বারোজকে হেরোইনের নেশা করতে শিখিয়েছিলেন । বারোজ হাংকেকে শিখিয়েছিলেন লিখতে । আরেকজন উঠতি গদ্যলেখক, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যা।য় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র জ্যাক কেরুয়াকের যাতায়াত ছিল উইলিয়াম বারোজের কাছে । হাংকের কথাবার্তায় বারংবার ‘বিট’ শব্দটির উল্লেখ শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে শব্দটির অর্থ হল মনমরা অবজ্ঞা । তাঁর মনে হয়েছিল ‘বিট’  অভিধাটিতে রয়েছে এমনই এক গভীর পরোক্ষ বৈশিষ্ট্য যা রহস্যময় এবং আধ্যাত্মিক, অনেকটা হারমান মেলভিলের গল্পের আদি মার্কিন ননকনফরমিস্ট বার্টলবি নামের মুসাবিদকারীর চরিত্রে যে বৈশিষ্ট্য ছিল । কেরুয়াকের বন্ধু, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, কবি যশোপ্রার্থী, অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন বিট শব্দটি হাংকের কথাবার্তায় এবং টাইমস স্কোয়ারের দুষ্কৃতিদের কথোপকথনে শোনেন তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ওই অঞ্চলে বিট শব্দটির অর্থ হল পরিশ্রান্ত, ঘুমহীন, সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, ইন্দ্রিয়তাড়িত, রাস্তাছাপ, সন্মানের অযোগ্য, খেইহীন এবং আত্মনির্ভর মানুষের অবস্হা ।

গিন্সবার্গের সঙ্গে ওই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন আরেকজন কবি যশোপ্রার্থী, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লুসিয়েন কার, যিনি গিন্সবার্গকে উইলিয়াম ব্লেক ও জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর কবিতা ও জীবনী পড়তে দেন, এবং পরিচয় করান বেনজেড্রিন ও মারিহুয়ানা নেশার সঙ্গে, যাতে ওই কবিদের মতন তাঁরাও কবিতা লেখার এক নবীনতম দিব্যদৃষ্টি পান । কেরুয়াকের সঙ্গে পরিচয় ছিল আরেকজন উঠতি লেখকের, তাঁর নাম জন ক্লেলান হোমস, যিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক বাঁকবদলগুলো পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসতেন । তাঁদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যাকে বলা হত লস্ট জেনারেশান, তার থেকে তাঁদের প্রজন্মের পার্থক্য কী, হোমসের এই প্রশ্নের জবাবে কেরুয়াক বলেছিলেন যে, তাঁদের নিজের প্রজন্মে রয়েছে অস্হির অনুসন্ধানস্পৃহা, বাস্তবের প্রতি ভিন্ন মনোভাব, উচ্ছ্বসিত চাঞ্চল্য, যাবতীয় ফর্ম সম্পর্কে ক্লান্তি, সমাজের নিয়ম-নিষেধ সম্পর্কে বিরক্তি, যা এক ধরণের অলক্ষিত কারবার । কেরুয়াক বলেছিলেন যে তাঁদের প্রজন্মে লোকদেখানো ব্যাপার নেই, তাঁরা ‘বিট জেনারেশান’ ।

মার্কিন লস্ট জেনারেশান বলতে বোঝাত সেই সব লেখকদের যাঁরা স্বদেশের প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রক্ষণশীলতা, ধর্মের গোঁড়অমি, নীতিবাগীশদের বক্তৃতা, মদ্যনিষেধ, সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীনতা এবং ‘বোকা রাষ্ট্রপতিদের’ এড়াবার জন্যে প্যারি শহরে গিয়ে বসবাস করতেন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, কে বোয়েল, রবার্ট ম্যাকঅ্যালমন, হেনরি মিলার প্রমুখ । এফ স্কট ফিটজেরাল্ড বলেছিলেন যে, তাঁদের পরের প্রজন্ম গড়ে উঠেছে আগের প্রজন্মের উন্মাদ ও উন্মার্গগামীদের কারণে । জন ক্লেলন হোমস বিট জেনারেশান কথাটা প্রয়োগ করা আরম্ভ করেন উপরে উল্লিখিত উইলিয়াম বারোজের আড্ডার লেখকদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হঠাৎ শীতযুদ্ধের আবহে আটকে পড়ার ফলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে চাইছে । এই প্রজন্ম, ব্যাখ্যা করলেন হোমস, চিরাচরিত মধ্যবিত্ত ভোগবাদের সঙ্গে আপোস করতে চায় না, বশ্যতা স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু প্রথাগত শর্তাবলীর প্রতি অক্ষমতা সত্ত্বেও মূল্যবোধে বিশ্বাস করতে চায় । বিট জেনারেশানের খ্যাতির দরুণ পরে যখন আমেরিকা জুড়ে বহু সাহিত্য যশোপ্রার্থী নিজেদের বিট ঘোষণা করতে লাগলেন, তখন ১৯৫৮ সালে এসকোয়ার পত্রিকায় ( দি ফিলজফি অব দি বিট জেনারেশান ) এবং ১৯৫৯ সালে প্লেবয় পত্রিকায় ( দি অরিজিন্স অব দি বিট জেনারেশান ) কেরুয়াক বলতে বাধ্য হন যে বিট জেনারেশান বলতে পাঁচ-ছয় জনের একটি নিউক্লিয়াস বোঝায়, এবং চারিদিকে যে ‘জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্ট’ দেখা যাচ্ছে, তাদের বোঝায় না ।

বারোজ-কেরুয়াক-গিন্সবার্গকে নকল করে আমেরিকায় যেসব উঠতি লেখকরা উদয় হচ্ছিল, স্যান ফ্রানসিসকো ক্রনিকল ১৯৫৮ সালে রাশিয়ার ছাড়া স্পুটনিকের আদলে তাদের নামকরণ করল  বিটনিক । লুক ম্যাগাজিন বিট জেনারেশানের সদস্যদের জন্যে একটা পার্টি দিলে, তাতে হাজির হয়েছিল দাড়িগোঁফঅলা বিদকুটে পোশাকের আড়াইশো বিটনিক যুবক-যুবতী । এসব দেখেশুনে হোমস লিখলেন যে বিটনিকরা আর গণমাধ্যম মিলে বিট জেনারেশানের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনকে খেলো, ধোঁয়াটে, হাস্যকর আর বুদ্ধিহীন করে দিয়েছে ।  বিটনিকদের আবির্ভাবের পর গিন্সবার্গ ছাড়া বাদবাকি সবাই বিট অভিধায় চিহ্ণিত হতে অস্বীকার করতেন । ওভাবে চিহ্ণিত হবার ভয়ে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে বিভিন্ন শহরে চলে যান তাঁরা । বিট জেনারেশান আদপে সাহিত্যিকদের একটা ছোটো গোষ্ঠী হলেও, গণমাধ্যমের প্রচারে বোহেমিয়ান সাহিত্যিকরা, বা উল্টোপাল্টা হাবভাব করতে এমন শিল্পী ও কবি, সবাই বিট তকমা পেতে শুরু করেছিল ।

জাপানে আণবিক বোমা ফেলার পর, এবং নানারকমভাবে কমিউনিস্ট আতঙ্ক সৃষ্টি করে বামপন্হী মতামতকে দ্বিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কুড়ি বছর যেভাবে আমেরিকায় লেখক-কবি-শিল্পীদের কোনঠাসা করা হয়েছিল, যে, নিজেদের স্বাধীন লেখালিখির জন্যে বিদেশে পালিয়ে না গিয়ে খোদ আমেরিকায় বসে যুব সম্পদায়েরব মননবৃত্তিতে যে বিদার ঘটে, তারই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নান্দনিক ফসল হল বিট প্রতিসন্দর্ভ, কাউন্টার কালচার । অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছেন যে, সে সময়ে যুবসম্প্রদায় বাধ্য হয়ে মনে মনে গোপন নায়কদের রোল মডেল করে নেয়া আরম্ভ করেছিল । যেমন পপ সঙ্গীতকার চার্লি পার্কার ও ডিজি গিলেসপি, ফরাসি ভিশনারি কবি আর্তুর র‌্যাঁবো, ওয়েলসের মদ্যপ কবি ও অভিকারিক ডিলান টমাস, ফরাসি ইনসেনডিয়ারি কবি-নাট্যকার আতোয়াঁ আর্তো, আত্মনির্বাসিত কবি-ঔপন্যাসিক ডি, এচ লরেন্স, ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানার্কিস্ট কবি কেনেথ রেক্সরথ প্রমুখ । লস্ট জেনারেশানের কবি-লেখকরা যেমন বাড়ি ছেড়ে প্যারি মহানগরীতে পালিয়েছিলেন, তেমনি বিট জেনারেশানের নিউক্লিয়াস সাহিত্যিকরা, অর্থাৎ উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্যারি স্নাইডার, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, গ্রেগরি কোরসো, জন ক্লেলন হোমস, মাইকেল ম্যাকক্লুর, ফিলিপ হোয়ালেন, ডায়না ডিপ্রাইমা, লেরয় জোনস ( আমিরি বারাকা ) প্রমুখ, ছোটো ছোটো শহর ও গ্রাম থেকে পালিয়ে জড়ো হয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক ও সানফ্রানসিসকো মহানগরীতে।

বিট অভিধাটি আশ্রয় করে প্রাগুক্ত সাহিত্যিকদের পক্ষে, প্রথম দিকে, নিজেদের সংজ্ঞায়িত করতে সুবিধা হয়েছিল । পাঠকদের কাছেও তাঁদের পাঠকৃতির বৈশিষ্ট্য পৌঁছে দেবার জন্যে কাজে দিয়েছিল বিট অভিধাটি । হোমস বলেছেন যে, পাঠকের কাছে বিট সাহিত্য পৌঁছে গিয়েছিল সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাতের প্রগাঢ় আকর্ষণ নিয়ে, পৌঁছে দিয়েছিল একরকম বিকল্প ইমেজ, পৌঁছে দিয়েছিল নবীন মার্কিনী অপ্রতিরোধ্য যুবাচরিত্রর ছবি, যার সঙ্গে পূর্বসূরীদের মিল বলতে আদি আমেরিকান বাধাবন্ধনহীনতা । লস্ট জেনারেশানের সাহিত্যিকরা আমেরিকানদের চোখের আড়ালে প্যারি মহানগরীতে বসে বোহেমিয়ান জীবন কাটাবার ফলে মার্কিন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারেননি । বিট জেনারেশানের বিপুল প্রভাব দেখা দিল আমেরিকার সংস্কৃতিতে । প্রথমে আবির্ভুত হল বিটনিকরা, যাদের প্রভাবে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময়ে দেখা দিল হিপিরা, যাদের প্রভাবে দেখা দিল পাংকরা । নেশা করায়, যৌনজীবনে, পোশাকে, জীবনযাপনে, লেখায়, আঁকায়, কবিতা পাঠে, রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের বিরোধীতায়, গ্রন্হ প্রকাশে, ধর্মাচরণে, খাওয়াদাওয়ায় প্রতিফলিত হল বিট জেনারেশানের বাধাবন্ধনহীনতা । বামপন্হী মতামত প্রকাশের জন্যে, মার্কিন সংস্কৃতির একেবারে মাঝখানে, কায়দা করে তাঁরা গড়ে ফেললেন এমনই একটি পরিসর, যে, তাঁদের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অবদানকে গ্রহণ করতে বাধ্য হল আমেরিকার মূলস্রোত ।

পর পর কয়েকটি গ্রন্হের প্রকাশ মার্কিন গণমাধ্যমকে আকর্ষণ করেছিল বিট সাহিত্যের প্রতি । সেগুলো হল অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ( ১৯৫৬ ), জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দি রোড’ ( ১৯৫৭ ), গ্রেগরি কোরসোর ‘বম্ব’, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির ‘কোনি আইল্যাণ্ড অব দি মাইন্ড’ ( ১৯৫৮ ) এবং উলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯ ) । এই সময় পরিসরে, আমেরিকায় আগে যা হয়নি, ঘটল লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ । বিটদের রচনা, অথবা বিটদের মতন সাহিত্যকৃতিতে, ছেয়ে গেল আমেরিকা জুড়ে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় । হাউল, অন দি রোড এবং নেকেড লাঞ্চ কী ভাবে রচিত হয়েছে, সে-সম্পর্কিত মিথ, যা গড়ে তুলতে বিটরা নিজেরাই সচেষ্ট ছিলেন, তা গণমাধ্যমের সাহায্যে  ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় । হাউল দীর্ঘ কবিতাটি রচিত হয়েছিল নেশার ঘোরে । অন দি রোড উপন্যাস একটানা টাইপ করা হয়েছিল কাগজের পাকানো বাণ্ডিলে । নেকেড লাঞ্চ লেখা হয়েছিল লিখিত বাক্যকে কাঁচি দিয়ে কেটে আর জুড়ে । “আগেকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে তাঁদের কাজ কী ভাবে লেখা হয়েছে”, গ্রেগরি কোরসো বললেন, “কেবল তাতেই সীমিত নয় ; তাতে আনা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তির মিশ্রণ, বিলম্বিত ও দ্রুত বাক্যের মিশেল, কাটাছাঁটা পরাবাস্তব রূপকল্প, নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ না-দেয়া বাক্য, উপর্যুপরি ক্রিয়াপদ প্রয়োগ, শব্দবন্ধের ঝাঁপাই, ঝুলে যাওয়া ছন্দ, ঠাণ্ডামেজাজ-গরমমেজাজের চালাচালি, আর সর্বোপরি, রচনাকারের আত্মা ।”

উপরোক্ত তিনটি বইতে লেখকরা অন্যান্য বিটদের প্রসঙ্গ এনেছেন, এবং সেই সূত্রে খোলাখুলি বয়ান করেছেন পুরুষ সমকাম, যে-ব্যাপারটি তার আগে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বা ইশারায় বলা হতো । বিট লেখিকারা, ডায়না ডিপ্রাইমা, ক্যারল বার্জ ও মার্গারেট র‌্যানডাল ছাড়া, লেখকদের প্রচারের আলোয় প্রেমিকা বা স্ত্রী হিসেবে চাপা পড়ে গেছেন অনেকে, যেমন ক্যারলিন ক্যাসডি, বনি ব্রেমজার, হেটি জোন্স প্রমুখ । লেসবিয়ান উপস্হিতি পাওয়া যায় বিটনিক ও হিপিদের প্রজন্ম থেকে । চূড়ান্ত ভোগবাদী সমাজে, বিট ভাষ্যকাররা পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রথানুগত পারিবারিক জীবনকে এড়াবার জন্যে নেশা এবং পুরুষে-পুরুষে সম্পর্কে জরুরি ছিল । রসায়নবিদ টিমথি লিয়ারির দিশানির্দেশে সমস্তরকম নেশা তাঁরা করেছেন, এমনকী এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মাদক নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যখনই তাঁরা সেসব দেশে গেছেন । বিটদের সাহিত্য ও জীবনযাপনকে সেকারণে বলা হয়েছিল মার্কিন ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রথম সর্বব্যাপী যুদ্ধ । তারপরই শুরু হয় নাগরিক অধিকার আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, যৌন স্বাধীনতার আন্দোলন, বিদ্যায়তনিক আধিপত্য-বিরোধী আন্দোলন, রক মিউজিকের আন্দোলন, যা অকল্পনীয় ছিল বিট জেনারেশানের আগে । পুলিটজার পুরস্কার পাবার পর গ্যারি স্নাইডার বলেছিলেন, ” বিট হল মনের এক বিশেষ অবস্হা, আর সেই মানসিক অবস্হায় আমি কিছুকাল ছিলুম”। আর কোনো বিট কোনো পুরস্কার পাননি, কেননা সুযোগ পেলেই তাঁরা কলমে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছেন সমাজ অধিপতিদের । তবে মৃত্যুর পর তাঁদের পাণ্ডুলিপি-নথিপত্র কোটি-কোটি ডলারে কিনেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় । গিন্সবার্গ জীবিতকালেই এক মিলিয়ন ডলারে তাঁর সংগ্রহের চিঠিপত্র ও বই ইত্যাদি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বিক্রি করেছিলেন ।

বিট জেনারেশান আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর আমেরিকা জুড়ে যখন বিটনিক আর হিপিদের আবির্ভাব হল, তখন ১৯৬০ সালে, বিটদের নিয়ে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল : সেমোর ক্রিম সম্পাদিত দ্য বিটস, এলিয়াস উইলেঞ্জ সম্পাদিত দি বিট সিন, এবং স্ট্যানলি ফিশার সম্পাদিত বিট ইস্ট কোস্ট : অ্যান অ্যানথলজি অব রিবেলিয়ান ।  বিট লেখকদের পরিত্যক্ত গ্রিনিচ ভিলেজের পথা পথে ঘুরে স্ট্যানলি ফিশার বিটনিকদের জিগ্যেস করেছিলেন যে বিট বলতে তারা কী বোঝে । তিনি দেখলেন যে প্রত্যেকের সংজ্ঞা আলাদা । মোটামুটি যে মিল তিনি পেলেন তা হল ১) জেদি বেপরোয়াভাব যা তাবৎ রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ফর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করে ; ২ ) সহজ প্রবৃত্তির দ্বারা প্রাপ্ত ভাবকল্প যা ব্যক্তিগত মনোভঙ্গী গড়ে দ্যায় অথচ যাকে ব্যক্ত করার জন্য কোনোও শব্দ নেই, এবং ৩ ) অত্যন্ত ক্লান্ত মানুষ, ভালোভাবে বেঁচে থাকার আগেই যে লোকটা ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত । অর্থাৎ পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশানে বিগত পাঁচ-সাত বছর বিট বলতে আত্মার পরিশীলন বিষয়ক যে বক্তৃতাগুলো কেরুয়াক দিয়েছিলেন, তা হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল ।

প্রথম দিকে সাহিত্য-শাসকরা বিট জেনারেশানকে পাত্তা দেননি । কিন্তু গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ছাপার জন্যে প্রকাশক লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির বিরুদ্ধে শুল্ক দপতর মামলা করায় যে হইচই হল, তার ফলে বিট জেনারেশানের লেখক-কবিদের বইপত্র প্রচুর বিক্রি আরম্ভ হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও, তখন তাঁদের টনক নড়ল । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির বইয়ের দোকানকে কেন্দ্র করে একদল সুশিক্ষিত তরুণ আলোচক একত্রিত হয়েছিলেন, যাঁরা বিট সাহিত্যের সময়ানুগ আলোচনা করতে লাগলেন, যুবা পাঠকদের কাছে স্পষ্ট করতে লাগলেন বিট জেনারেশান কেন ও কীভাবে আক্রমণ করছে ভোগবাদী সমাজকে, পুঁজিবাদকে, মিলিটারি-ঔদ্যৌগিক স্বার্থকে, রেসিজমকে, পরিবেশ দূষণকারীদের ; কেন ও কী ভাবে বিট সাহিত্য সামাজিক, যৌন, রাজনৈতিক ও ধার্মিক মূল্যবোধকে ক্ষতিকর বলে দোষারোপ করছে ।

উইলিয়াম বারোজ বলেছেন যে, বিট জেনারেশান যে কমিউনিস্ট পার্টির চেয়েও পরাক্রমী, আর অপরিবর্তনীয় ঝড় তুলে ফেলেছে, তা বিটরা নিজেরা টের পাবার আগেই বুঝে ফেলেছিল মার্কিন রক্ষণশীলরা । বিটরা, তিনি বললেন, আমেরিকার বুকে মোক্ষম সময়ে হাজির হয়েছে, যখন দেশে-দেশে বুদ্ধিজীবিরা আমেরিকার বিট কন্ঠস্বর শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল , কেননা শিল্পী-সাহিত্যিকরাই পরিবর্তনের স্হপতি, তাঁরাই প্রভাবিত করেন জীবনশৈলী, এবং উপলব্ধির ধরণ-ধারণ, চৌহদ্দি ও অভিমুখ । ধর্ম নিয়েও ভাবনাচিন্তা করেছেন বিটরা । ইহুদি অ্যালেন গিন্সবার্গ গ্রহণ করেছিলেন তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম । কৃষ্ণাঙ্গ লেরয় জোনস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আমিরি বারাকা হন । খ্রিস্টান গ্যারি স্নাইডার গ্রহণ করেন জেন বৌদ্ধধর্ম ।

চার

ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান এবং আমেরিকার বিট জেনারেশানের যে কোনো মিল নেই তা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে, এমনকী শ্বেতাঙ্গ হহোয়া সত্ত্বেও তাঁদের ধর্মাচরণেও মিল নেই । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের ওই শ্বেতাঙ্গ হবার মিলটুকুও নেই । লেখালিখি শুরু করার বেশ কিছু পরে লেখক-বিশেষের ক্ষেত্রে অ্যাংরি এবং বিট অভিধা প্রয়োগ হয়েছিল, তাদের বলা হয়েছিল আন্দোলন । পক্ষান্তরে, ১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম হাংরি বুলেটিনটি ছিল কবিতার ম্যানিফেস্টো, অর্থাৎ আবির্ভাবমাত্রেই, হাংরি নিজেকে আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা করেছিল । পাটনায় বাংলা ছাপাবার সুবিধা না থাকায়, ম্যানিফেস্টোটি মলয় রায়চৌধুরী ইংরেজিতে লিখেছিলেন, এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, অ্যাংরি ও বিটদের থেকে তা ছিল একেবারে আলাদা প্রতিসন্দর্ভ ।

এই ইশতাহারটি আরেকবার ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশের সময়ে শেষ প্যারাটি পরিবর্তন করে একটি অতিরিক্ত প্যারা সংযোজন করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । ম্যানিফেস্টোটি এরকম : Poetry around us, these days, has been cryptic, short hand, cautiously glamourous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.

Poetry is not the caging of belches within form. It should convey the brutal sound of breaking values and starking tremors of the rebellious soul of the artist himself, with words stripped of their usual meaning, and used contrapuntally. It must invent a new language which would incorporate everything at once, speak to all the senses in one. Poetry should be able to follow music in the it possesses of evoking a state of mind, and to present images not as wrappers but as ravishograms.

এই ইশতাহারটি ১৯৬৩ সালে আরেকবার মুদ্রিত হয়েছিল এবং সেটিতে হাংরি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সবায়ের নাম ছাপা হবেছিল । এর পর হাংরি আন্দোলনকারীরা ধর্ম, ছোটোগল্প, সমালোচনা-পদ্ধতি, রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস, উদ্দেশ্য, অশ্লীলতা, স্বাধীনতা, আন্দোলন, পেইনটিং ইত্যাদি বিষয়ে ম্যানিফেস্টো পপকাশ করেন, যা অ্যাংরি ও বিটসহ পৃথিবীর কোনো আন্দোলনে কখনও করা হয়নি । ১৯৬১ সালে আন্দোলন আরম্ভ করার সময়ে হাংরি নিউক্লিয়াসটিতে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরী । তাঁরা ইংরাজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম  বাক্যটি থেকে হাংরি শব্দটি এই জন্যে চয়ন করেছিলেন যে, উত্তরঔপনিবেশিক  স্বাধীন ও সমৃদ্ধ ভারতের স্বপ্ন ততদিনে টকে পচতে শুরু করেছিল । জার্মান দার্শনিক ওসওয়াল্ড স্পেংলার ( ১৯৮০-১৯৩৬) এর  দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট  গ্রন্হ থেকে নিউক্লিয়াস সদস্যদের কাছে মলয় রায়চৌধুরী ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, স্পেংলারের মতে, ইতিহাস কেবল একটিমাত্র রেখা বরাবর এগোয় না, তা বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; স্পেংলারের মতে হেগেলের এই তর্কটি ভুল যে, ইতিহাস যুক্তিসংগতভাবে এগোয় ; তাঁর মতে ইতিহাস হল জৈবপ্রক্রিয়া, কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগে থাকতে বলা যায় না ; একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে সংস্কৃতিটি নির্বিচারে যা পায় তা-ই খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন যে, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । লক্ষনীয় যে অ্যাংরি এবং বিট অভিধা দুটির মতন হাংরি শব্দটি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নয় বা আচমকা পাওয়া নয় । হাংরি শব্দটি তার গভীর দার্শনিক দ্যোতনার জন্যে আরম্ভসূত্রেই গৃহীত হয়েছিল । এও স্পষ্ট হবে গিয়ে থাকবে যে অ্যাংরি, বিট ও হাংরি অভিধা তিনটির আন্দোলনীয় মর্মার্থে সাদৃশ্য ছিল না ।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে অ্যাংরি, বিট ও হাংরি, তিনটি আন্দোলনেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিসর দেয়া হয়েছে । তা হয়েছে বটে, কিন্তু এরা যাদের আক্রমণ করেছে তারা চরিত্রগতভাবে একই ক্ষমতাকেন্দ্র নয় । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হাংরি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমুখ ছিল নিঃসন্দেহে, যে কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আন্দোলন ত্যাগ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের অঙ্গাঙ্গী করে নিয়েছিলেন পরবর্তিকালে । বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর, প্রফুল্ল সেন মুখছমন্ত্রীত্বে আসীন হলে, সুবিমল বসাক যখন হাংরি আন্দোলনে যোগ দিলেন, তখন সুবিমল-দেবী-মলয়ের ( হাংরি ট্রৌইকা নামে খ্যাত ) দ্বারা রাষ্ট্র-পুঁজি-বিশ্ববিদ্যালয়-সংবাদ মাধ্যম-সাহিত্যসংস্কৃতি শাসক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা পদ্ধতিতে আক্রান্ত হল, যার কয়েকটি পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন সাহিত্য-সম্পর্কহীন কার্যকলাপ, অসামাজিক ও অশালীন উদ্ভট ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি । তা সম্ভবত এইজন্য যে, ঔপনিবেশিক মননবিশ্বের আদরা হুবহু বজায় ছিল প্রতিষ্ঠানের মহলগুলোয়, এবং তখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ঠিক মতন পরিচিত হয়নি ঘেরাও, ধর্না, অবরোধ, রেল রোকো, গেটসভা, মোড়মিটিং ইত্যাদি ছোটো-ছোটো কাউন্টার ডিসকোর্সের সঙ্গে । তারপর নকশাল আন্দোলন আরম্ভ হতে প্রতিষ্ঠানের বোলতি বন্ধ হয়ে গেল ।

অ্যাংরি ও বিটরা হাংরি আন্দোলনকারীদের মতন সরাসরি প্রতিষ্ঠানবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন না । হাংরি আন্দোলনকারীরা কাজে ও লেখায় অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের রাগ, বদমেজাজ, রুক্ষতা, ক্ষোভ, বিদ্বষ ইত্যাদি ছিল না । হাংরি আন্দোলন ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে যাবার পর সুভাষ ঘোষ-এর যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট, শীর্ষ অভিযান, সাবিত্রীবালা, ৫ আইন, মানুষ নামের লীলা বইগুলোতে যা আছে তা হল শিকড়হীনতার উদবেগ, ফালতু বোধ করার অসন্মান, একঘরে হবার আতঙ্ক । দেবী রায়-এর মানুষ মানুষ, দেবী রায়ের কবিতা, ভ্রূকুটির বিরুদ্ধে একা, উন্মাদ শহর, এই সেই তোমার দেশ,  পুতুল নাচের গান, সর্বহারা তবু অহঙ্কার  বইগুলোয় আছে নিম্নবর্গে অবস্হানজনিত উপেক্ষার প্রতিরোধ, আছে সমাজ-প্রত্যাখ্যাত হবার পীড়া, অস্বীকৃতির ছটফটানি । বস্তুত কী ভয়ংকর বর্ণজাঁতিকলে পিষে গেলে একজন লোক এফিডেভিট করে তার নাম-পদবি পালটাতে বাধ্য হয় তা অ্যাংরি ও বিট ভাবনাদর্শন প্রয়োগ করে বোঝা সম্ভব নয় । দেবী রায়-এর প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া । সুবিমল বসাকের কবিতা-পুস্তিকা হাবিজাবি আর বকবকানি মূলত প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্লেষ, এবং যে-রাজনীতিকরা স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেরাই শেষমেশ অধঃপতনের গাড্ডায় পড়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে তীব্র ব্যঙ্গে পরিপূর্ণ । এই শ্লেষ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ত্রিদিব মিত্রের হত্যাকাণ্ড এবং ঘুলঘুলি কবিতা-পুস্তিকাতেও ছিল ।

অ্যাংরি ধাঁচের ক্রোধ হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রকাশ করেননি । ক্ষমতা ও প্রতাপের স্বরূপ উন্মোচনে যে পদক্ষেপগুলো হাংরি আন্দোলনকারীরা নিচ্ছিলেন, টেবিলের ওপরে তুলে দেয়া বিদ্যাসাগরের চটিপরা পায়ের মতন, সে কাজগুলো উল্টে ক্রুদ্ধ করে তলেছিল প্রতিষ্ঠানের বোড়ে-ঘোড়া-হাতি-উট-মন্তীদের, অ্যাংরি ওল্ড মেনদের । আধিপত্যের বিরুদ্ধে এরকম নিরবচ্ছিন্ন অভিযান বিটরাও শানাননি । অ্যাংরি রা সবাই ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক । বিটদের মধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গ ছাড়া সবাই ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক । যে কোনো বুদ্ধিজীবির সততার পরীক্ষা হয় ক্ষমতাপ্রতাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্হী রাজনৈতিক মতামত এবং বিটদের কেবলমাত্র মার্কিন রাজনীতিকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ থেকে একেবারে আলাদা ছিল হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক মতামত ।

অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিট জেনারেশানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠেনি । কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল । তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মূলত সেকারণেই। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের কারণেই মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের এই অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্ণিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুঁটিনাটি খবর সংগ্রহ করেছিল, এবং তাঁদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল খুলে ফেলেছিল, যেগুলো সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী লালবাজার পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স টেবিলের ওপরে দেখেছিলেন যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দপতর, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারাল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্হ আধিকারিকদের নিয়ে গঠিত ইনভেসটিগেটিং বোর্ড সমীর ও মলয়কে জেরা করেছিল ।

সমীর ও মলয়ের জেরার পর, অ্যাডভোকেট জেনারালের পরামর্শে, রাষ্ট্রযন্ত্রটি মলয়ের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলা করে, তাঁর প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার  কবিতাটির জন্য, এবং অন্তর্ঘাতের অভিযোগ তুলে নিয়ে অন্য সবাইকে রেহাই দ্যায় । এই ধরণের মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি অ্যাংরি ও বিটদের । অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল কাব্যগ্রন্হটির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল শুল্ক বিভাগ । অশ্লীলতার মকদ্দমার আগে থাকতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভে ও জীবন যাপনে যৌনতার অভিযোগ উঠেছিল, কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান আর বিটদের মতন কেউই সমকামী ছিলেন না । সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষ একটি ছোট্ট ঘরে দুজনে থাকতেন এবং পরে মেসবাড়িতেও একই ঘরে দুজনে থাকতেন বলে তাঁদের সম্পর্কে অমন অপপ্রচার করা হয়েছিল । হাংরি বুলেটিনে সুবিমল বসাকের আঁকা  কয়েকটি স্কেচের কারণে, যেগুলো প্রথম দর্শনে কেউই বুঝতে পারেননি—লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ও কার্ল ওয়েসনারও পারেননি — হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রতিসন্দর্ভে যৌনতার অভিযোগ উঠেছিল । এটা ঠিক যে, হাংরি আন্দোলনকারীরা নারীকেন্দ্রিক যৌনহুল্লোড়ে অংশগ্রহণ করেছেন, কলকাতায়, বেনারসে, নেপালে । এ-ও ঠিক যে যাঁর সঙ্গে প্রথমবার শুয়েছেন, তাঁকেই বিয়ে করার প্রথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা । কিন্তু তাঁরা এসব ব্যাপারে বঙ্গসমাজে পায়োনিয়ার ছিলেন না । সুতরাং অ্যাংরি ও বিটদের সঙ্গে তাঁদের এ-ব্যাপারে এক গোত্রে ফেলা ভুল হবে ।

অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা মাদক নিতেন না । বিটরা নিতেন । প্রধানত উইলিয়াম বারোজ ও অ্যালেন গিন্সবার্গ, এবং নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন জ্যাক কেরুয়াক, যা তাঁরা নিতেন তাঁদের লেখালিখিকে বিশেষ আদল-আদরা দেবার অভিপ্রায়ে । হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউই মাদকাসক্ত ছিলেন না, এমনকী ফালগুনী রায় ও নন । সুভাষ ঘোষ দিশি মদ খেতেন বটে, কিন্তু তা লেখার জন্য নয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মদ খাওয়া শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের আফিম খাবার মতন লেখার আউটপুট বৃদ্ধির জন্য ছিল না । সুভাষ মদ খেতেন কথোপকথনের আগল ভাঙার জন্য । বাসুদেব দাশগুপ্ত, ত্রিদিব মিত্র, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায় প্রমুখ, এল এস ডি, হেরোয়িন, মেসকালিন, অ্যামফিটেমাইন ইত্যাদি রাসায়নিক মাদক ট্রাই করেও দ্যাখেননি । হাংরি আন্দোলনের সময়ে শম্ভু রক্ষিত এখনকার মতন মদ খেতেন না । শৈলেশ্বর ঘোষ গাঁজা ফুঁকতে ভালোবাসতেন, তাঁর স্কুল-রাজনীতির টেনশান কাটাবার জন্য । হাংরি আন্দোলনে রাসায়নিক মাদকের পরিচয় করিয়েছিলেন করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ও অনিল করঞ্জাই, বেনারসের দুই পেইনটার । বিটদের প্রতিসন্দর্ভে মাদকের বিশেষ পরিসর ছিল । হাংরিদের একেবারেই ছিল না । অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, কিন্তু সিগারেট পর্যন্ত খেতেন না । সমীর ও মলয়ের ছোটোবেলা কেটেছিল বিহারি অন্ত্যজ পাড়া ইমলিতলায়, যেখানের বাসিন্দাদের সকালের ব্রেকফাস্ট ছিল তাড়ি ; পাড়ার তাবৎ অনুষ্ঠানে তাড়ি ও সোমরস পরিবেশিত হতো ।

ধর্ম সম্পর্কিত প্রতিসন্দর্ভে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিট জেনারেশানের যে অমিল ছিল, তার চেয়েও বেশি অমিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ছিল অ্যাংরি ও বিট কাউন্টার ডিসকোর্সের । ইস্ট কোস্ট ও ওয়েস্ট কোস্ট , উভয় এলাকাতেই বিট জেনারেশানের পত্রপত্রিকায় হাংরি ইশতাহারগুলো প্রকাশিত হলেও, ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারটি তাঁরা প্রকাশ করেননি, তা সে সম্পাদক ইহুদি অথবা খ্রিস্টান, শ্বেতাঙ্গ অথবা কৃষ্ণাঙ্গ, পুরুষ অথবা নারী, যা-ই হোন, অর্থাৎ এই প্রতিসন্দর্ভের সাথে তাঁদের ঘোর বিরোধ দেখা দিয়েছিল, যদিও যে যার নিজের আরকাইভে তা সংরক্ষণের জন্য দান করে গেছেন । অ্যাংরিরা ধর্মে সমর্পিত ছিলেন, একেশ্বরবাদী ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ব্রিটিশ চার্চের বড়ো বেশি হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন । বিটদের, ইহুদি হোন বাখ্রিস্টান, সমস্যা ছিল একেশ্বরবাদের, যার উৎস সম্ভবত মার্কিন দেশে রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসন, যে কারণে সবাই আকৃষ্ট হয়েছেন বৌদ্ধধর্মের কোনো না কোনো শাখার প্রতি । হাংরি আন্দোলনের সময়ে ইশতাহারটি থেকে, এবং আন্দোলনকারীদের তখনকার জীবনযাত্রা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁরা ধর্ম সম্পর্কে বিরক্ত, আগ্রহহীন বা তার বাইরের বাসিন্দা । সুবো আচার্য অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য হয়েছিলেন হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর ; দেবী রায় রামকৃষ্ণ আশ্রমের দিকে ঝুঁকে ছিলেন হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর । বলা চলে যে, আন্দোলনকারীদের জীবনে হিন্দু ধর্মের উপস্হিতি ছিল স্রেফ যে যার পারিবারিক প্যালিম্পসেট । ডক্টর বিষ্ণু দেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন যে তিনি ইন্সটিংকটিভলি হিন্দু, আচার-আচরণে নয় ।

কোনো কোনো আলোচক বিষয়টিকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণের প্রয়াস করেছেন । তাঁরা বলেছেন যে, জনাকয় লেখককে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান চিহ্ণিত করলেও, তাঁরা প্রকৃত অর্থে গোষ্ঠী ছিলেন না ; তাঁদের আপাতদৃষ্টিতে আসঞ্জনশীল মনে হবার কারণ তাঁরা সবাই খ্রিস্টধর্মী ও ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ । ক্রোধ প্রকাশ ব্যতীত তাঁদের নিজেদের মধ্যে আর কোনো মিল ছিল না । তাঁদের ক্রোধের উৎস ছিল ব্রিটেনে, বিশ্বযুদ্ধের কারণে, পুঁজিকাঠামোর রূপান্তর । উপনিবেশের সহায়তায় আবির্ভূত শিল্পবিপ্লবের চরিত্রে অকস্মাৎ মিলিটারি বাঁকবদল ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটেন । ফলত তার পুরোনো আধিপত্যবাদী পুঁজি তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, যা শেষাবধি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিতে ।

বিশ্বযুদ্ধের কারণে সর্বাধিক লাভ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের । যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইউরোপে কোনো দেশের পক্ষে আর পুঁজির নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না । সুযোগের ফাঁকটি চুকিয়ে নিজের শিল্পদ্যোগকে কাজে লাগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কমিউনিজম ভীতির দামামা বাজিয়ে শীতযুদ্ধ নামের আবহটি তারা এই জন্য সৃষ্টি করেছিল, যাতে সোভিয়েত রাষ্ট্র ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো মিলিটারি উদ্যোগে আটকে থাকে এবং সিভিল উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে না পারে । বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা বিশ্বপুঁজির নেতা হয়ে ওঠে । বিট জেনারেশান ওই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্হার ফসল । বেশির ভাগ বিট কোনো চাকরি-বাকরি করতেন না । তাঁরা ধনী বাবা-মায়ের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন । খ্যাতিপ্রাপ্তির পরে তাঁদের বই, বক্তৃতা, আবৃত্তি, সাক্ষাৎকার, রেডিওটক, টিভিটক, ক্যাসেট ইত্যাদি সবকিছু তাঁরা বিক্রি আরম্ভ করেন । বিটরা হেলাফেলার মার্কিনী পোশাক পরা চল করেছিলেন যা পরে হিপিরা নকল করা আরম্ভ করেছিল । হাংরি আন্দোলনকারীরা সকলেই সাধারণ পোশাক পরতেন, কোনো বদল ঘটেনি তাঁদের পারিবারিক পোশাক ঐতিহ্যে ।বিট জেনারেশানের আসঞ্জনশীলতার উৎস হল মার্কিন পুঁজিবাদের রমরমা, যার প্রশ্রয়ে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের আয়ে দিব্বি বোহেমিয়ান আয়েস করতে পারতেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা এসেছিলেন অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে । সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী থাকতেন ইমলিতলা নামের বস্তিতে । দেবী রায় থাকতেন হাওড়ার বস্তিতে । শক্তি চট্টোপাধ্যায় থাকতেন উল্টোডাঙার বস্তিতে । সুবিমল বসাক থাকতেন পাটনার কুখ্যাত দুরুক্ষি গলিতে । সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকতেন ।

হাংরি আন্দোলনের উৎসের কারণ দ্বিমুখী । একদিকে স্বাধীণ ভারতবর্ষে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতীয় পুঁজির নবরূপায়ণ, এবং অপরদিকে দেশভাগে পশ্চিমবাংলার পুঁজিকাঠামোয় তীব্র আঘাত ; প্রথমত পাটখেতগুলো পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হবার ফলে চটকলগুলোর ক্রমঅসুস্হতা, যা আর সারেনি, এবং দ্বিতীয়ত, অকস্মাৎ লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন, যা#দের জীবনে সৎমূল্যবোধ ও নীতি-ঐতিহ্যের পরিসর ছিল অসম্ভব, যে রোগ থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর বেরিয়ে আসতে পাএনি । হাংরি আন্দোলনে তাই দুটি সমান্তরাল চিন্তাধারা বইতে দেখা গিয়েছিল । একটি ধারা তাঁদের যাঁরা দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবাংলায় এলেন । অপর ধারাটি তাঁদের যাঁরা দেশভাগের আগে থাকতে ভারতের বস্তি এলাকায় বসবাস করতেন । এই দুটি ধারাতেও বিভাজন ছিল বর্গের, বর্ণের, সামাজিক পৃষ্ঠপটের, পারিবারিক ঐতিহ্যের, পঠনপাঠনের, বাড়ির কথ্যবুলির, নিবাসগৃহের, পরিবেশের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, নিজস্ব আয়ের, এবং আরও বেশকিছু প্রতিস্ব-নির্মাণ উপাদানের । হিন্দি ভাষার কবি রাজকমল চৌধুরী বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা একটি কোহেসিভ গোষ্ঠী নয় এবং গোষ্ঠীটি কোহেসিভ নয় বলেই আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছিল, মাত্র পাঁচ বছরের সময় পরিসরে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক এসট্যাবলিশমেন্টকে ।

১৯৬২ সালে সম্প্রতি  পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে লেখার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই তিনটি প্রতিসন্দর্ভের বৈভিন্ন্য এভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন : “বিদেশে সাহিত্যকেন্দ্রে যেসব আন্দোলন বর্তমানে হচ্ছে, কোনটি বিট জেনারেশান, অ্যাংরি বা সোভিয়েত রাশিয়াতেও সমপর্যায়ী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বাংলাদেশেও কোনো অনুক্ত বা অপরিষ্কার আন্দোলন ঘটে গিয়ে থাকে, তবে তা আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশে ‘ক্ষুধা সংক্রান্ত’ আন্দোলনই হওয়া সম্ভব । ওদিকে ওদেশে সামাজিক অবস্হা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে । আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত । যে-কোনো রূপের বা রসের ক্ষুধাই একে বলতে হবে । কোনো রূপ বা কোনো রসই এতে বাদ নেই, বাদ দেওয়া সম্ভব নয় । একে যদি বিট বা অ্যাংরি দ্বারা প্রভাবিত বলার চেষ্টা হয় তবে ভুল বলা হবে । কারণ এ-আন্দোলনের মূলকথা সর্বগ্রাস।”

এই রচনাটির জন্য হাংরি, অ্যাংরি ও বিট প্রতিসন্দর্ভের বৈভিন্ন্য নির্দেশ করে অরবিন্দ প্রধান এই তালিকাটি তৈরি করেছেন :

হাংরি………………………..অ্যাংরি……………………বিট

খেদ………………………….ক্রোধ………………………উন্মাদনা

সাতরঙা……………………রঙহীন……………………একরঙা

হিন্দু অথচ আগ্রহহীন…….প্রটেস্ট্যান্ট………………..ইহুদি,খ্রিস্টান,বৌদ্ধ,মুসলমান

ব্যক্তিক নেশা………………মদ্যপ………………………মাদকাসক্ত

অনির্বাচিত মানবস্বভাব..স্বাভাবিক মানবস্বভাব..নির্বাচিত মানবস্বভাব

দক্ষযজ্ঞ……………………দক্ষতা………………………দক্ষবিরোধ

অপ্রত্যাশিত……………..প্রত্যাশাহীন………………..প্রত্যাশিত

ইউনিসেক্সুয়াল…………হোমোসেক্সুয়াল……………..হেটেরোসেক্সুয়াল

অনুস্তর…………………উচ্চস্তর………………………..সর্বস্তর

কালোমানুষ…………..ধলামানুষ……………………..মিশ্রমানুষ

বহুস্বর………………..একস্বর…………………………..দ্বিস্বর

যৌগিকরূপ………….একরূপ…………………………..বহুরূপ

প্রান্তিক………………..কেন্দ্রিক…………………………কেন্দ্রবিরোধী

বহুপরত সংস্কৃতি….একপরত সংস্কৃতি……………দুইপরত সংস্কৃতি

ভঙ্গুর আত্মপরিচয়…কেলাসিত আত্মপরিচয়……নির্মিত আত্মপরিচয়

স্হানিকতা…………..কালানুক্রমিকতা…………..অনুক্রমবর্জিত কাল

সংজ্ঞা দখল…………সংজ্ঞা অনুসরণ…………….সংজ্ঞা নির্মাণ

ম্যান…………………ব্যাটম্যান……………………..স্পাইডারম্যান

পরিপূরকের ঔচিত্য…বৈপরীত্যের বিপন্নতা…..স্বয়ম্ভূ

দুই সীমালঙ্ঘন…….সীমারক্ষা…………………….নিম্ন সীমালঙ্ঘন

মুক্তধারার সৃষ্টি…..বাঁধভাঙার দুঃখ…………….মুক্তধারার খোঁজ

হাংরি আন্দোলন বহুকাল আগে ফুরিয়ে গেছে । যাঁরা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই হাংরি অভিধা দ্বারা আর সীমায়ীত নন । কিন্তু তার পর থেকে প্রায়ই এদিক-সেদিক এখান-ওখান থেকে হঠাৎ-হঠাৎ অতিতরুণরা, যাঁরা দেশভাগের উদ্বাস্তু পরিবারপ্রসূত, নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে ফ্যালেন, তার কারণ বঙ্গসমাজের পুঁজিকাঠামোটি, মারাঠি-গুজরাতি-কর্ণাটকি-পাঞ্জাবি সমাজের তুলনায়, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে । তরুণ কবিরা আজও মলয় রায়চৌধুরীকে অনুরোধ করেন আন্দোলনটি আরেকবার তার আগুন নিয়ে সমাজের বুকে আবির্ভাব হোক, এবং তিনি নেতৃত্ব দিন । হাংরি আন্দোলন যে রণন সৃষ্টি করে দিয়েছিল তাতে ওই অতিতরুণরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন, একথা জেনে যে বর্তমান বঙ্গীয় অবস্হায় কোনো সাহিত্য আন্দোলন আর সম্ভব নয় । তার কারণ হাংরি ছিল একটা জ্ঞান-পরিসর, প্রতিসন্দর্ভের জ্ঞান-পরিসর, যা অ্যাংরি ও বিট পরিসর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

হাংরি যুগ : মলয় রায়চৌধুরীর বই

 

ভূমিকা

অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, ‘কল্লোল যুগ’ বইতে লিখেছেন : “কল্লোল” উঠে যাবার পর কুড়ি বছর চলে গেছে । আরো কত বছর চলে যাবে, কিন্ত ওরকমটি আর “ন ভূতো! ন ভাবী”। দৃশ্য বা বিষয়ের, পরিবর্তন হবে দিনে-দিনে, কিন্তু যে যৌবন-দীপ্তিতে বাংলা সাহিত্য একদিন আলোকিত হয়েছিল তার লয়-ক্ষয-ব্যয় নেই–সত্যের মত তা, সর্বাবস্থায়ই সত্য থাকবে। যারা একদিন সেই আলোক- সভাতলে একত্র হয়েছিল, তারা আজ বিচিত্র জীবনিয়মে পরম্পর-বিচ্ছিন্ন, প্রতিপুরণে না হয়ে হয়তো। বা প্রতিযোগিতায় ব্যাপৃত –তবু সন্দেহ কি, সব তারা এক জপমালার গুটি, এক মহাকাশে গ্রহতারা। যে যার নিজের ধান্দায় ঘুরছে বটে, কিন্তু সব এক মন্ত্রে বাঁধা, এক ছন্দে অন্বর্তিত। এক তত্বাতীত সত্য-সমুদ্রের কল্পোল একেক জন | বাহু  বিভিন্ন, আসলে একত্র । কর্ম নানা, আনন্দ এক। স্পর্শ নানা, অনুভূতি এক। তেমনি সবঘাটে এক আকাশ, সর্বপীঠে এক দেবতা, সর্বদেহে এক অধিষ্ঠান। “একো দেবঃ সবভূতেষু গুড়; সর্বব্যাপী সর্বভূতীস্তরাত্মা।” তাই সর্বত্র মহামিলন। ভেদ নেই, হ্বৈত নেই, তারতম্য নেই, সবার এক সনাতনের উপাসন!।” 

.

অচিন্ত্য সেনগুপ্ত কল্লোল সাহিত্যপত্রের সময়কালকে ‘কল্লোল যুগ’ হিসেবে চিহ্ণিত করে উপন্যাসের আঙ্গিকে বইটি লেখার পর তাঁদের কালখণ্ডকে ‘কল্লোল যুগ’ বলা আরম্ভ হয়েছিল  । কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ছয় বছরের কাল-পরিধিতে বাংলা সাহিত্যে তাঁরা আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন আর স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত হয়েছিলেন, পুলিশের নেকনজরে পড়েছিলেন,  যেমনভাবে হাংরি যুগের কবি-লেখক-চিত্রকররা হয়েছেন ।’কল্লোল’ পত্রিকার আবহে সমসাময়িক আরও কিছু পত্রিকা হলো—কবিতা, প্রগতি, উত্তরা, কালিকলম, পূর্বাশা ইত্যাদি।  অচিন্ত্য সেনগুপ্তের বইটি সম্ভবত প্রকাশকের অনুরোধে উপন্যাসের আঙ্গিকে লেখা । 

.

আমি উপন্যাসের আঙ্গিকে ‘হাংরি যুগ’ লেখার প্রয়াস করছি বটে, তবে এই আন্দোলন একটিমাত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শহরের ঘটনা নয়, তাই চেষ্টা করব সমগ্র যুগকে একটি পরিসরে তুলে আনার। হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেক বই আছে, কিন্তু এর আগে সেই বিস্তৃত কালখণ্ডের যুবক-যুবতীদের কর্মকাণ্ডকে ‘হাংরি যুগ’ হিসাবে চিহ্ণিত করে কোনো বই লেখা হয়নি । যে বইগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক । যদি হাংরি কর্মকাণ্ডকে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ধরা হয়, যাকে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত বলেছেন বাংলা সাহিত্য একদিন  “যৌবন-দীপ্তিতে  আলোকিত হয়েছিল তার লয়-ক্ষয-ব্যয় নেই–সত্যের মতো  তা সক্রিয় ছিল”, তা্হলে সম্পূর্ণ ও ব্যাপক ‘হাংরি যুগ’-এর কথা বলা হবে না । ১৯৬৭-এর পরেও হাংরি আন্দোলন সক্রিয় ছিল বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর  পত্রিকার মাধ্যমে, যেমন প্রতিদ্বন্দী, চিহ্ণ, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, ফুঃ, ঋত্বিক, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র, ক্ষুধার্ত সময়, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবোট, কুরুক্ষেত্র, পাগলা ঘোড়া, দ্রোহ, বিকল্প, দন্দশূক, সময়সূত্র, যুদ্ধযাত্রা, মন্বন্তর, এখন এই রকম, অনার্য, পাখি সব করে রব ইত্যাদি,  এবং  আশির দশকের শেষ পর্যন্ত কলকাতাসহ উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার তরুণ কবি-লেখকরা সেই যুগকে করে তোলেন মহামিলন-ক্ষেত্র ।

.

‘কল্লোল’-এর তুলনায় হাংরি যুগে বহু তরুণ দেখা দিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,  সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই,  করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অলোক গোস্বামী, মলয় মজুমদার, রাজা সরকার, কিশোর সাহা, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কুশল বাগচী, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিকাশ সরকার, নির্মল হালদার, সূর্য মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি রায়, অরুণেশ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ রাউত, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, সুনীতা ঘোষ,  রবীন দত্ত, সেলিম মুস্তফা, রবিউল, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সাত্বিক নন্দী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, স্বপন চক্রবর্তী, সুবীর মুখোপাধ্যায়, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, নির্মল হালদার, সৈকত রক্ষিত, রবীন্দ্র মল্লিক, বিজন রায়, স্বপন মুখোপাধ্যায়  প্রমুখ । এই কবি ও লেখকদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি । তাঁদের মধ্যে অনেকে   পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না । সবায়ের মাঝে যোগসূত্র গড়ে তোলার প্রয়াস করব “হাংরি যুগ”-এর পরিসরে ।  তাছাড়া, কয়েকজন আমার অবদানকে অস্বীকার করার জন্য  ‘হাংরি’ ভাবকল্পটিকে  নিজের-নিজের  ভাবনার মোড়কে উপস্হাপন করতে চেয়েছেন ও মূল ভাবকল্প সম্পর্কে পড়াশোনা না থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আমার কথাগুলোই অন্যভাবে বলেছেন । অনেকে ভেবেছিলেন ‘হাংরি টাইম’ মানে ‘আমরা খেতে পাচ্ছি না’, যদিও তাঁরা ভালো চাকরি বা শিক্ষকতা করতেন, ফ্ল্যাটের বা বাড়ির মালিক ছিলেন ।  যুগ হিসেবে তাতে হাংরি কালখণ্ডের হেরফের হয় না ।

.

‘যুগ’ অভিধাটি ব্যবহার করায় আপত্তি থাকা উচিত নয় । যুগ সাধারণত সময়ের বয়স নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। ঋগ্বেদে, যুগ জন্মকে বোঝায়, দীর্ঘ সময়কাল, খুব সংক্ষিপ্ত সময়কাল বা সংযোজক। মহাভারতে, যুগ ও কল্প (ব্রহ্মার এক দিন) শব্দগুলি পরস্পর বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সৃষ্টি ও ধ্বংসের চক্রকে বর্ণনা করার জন্য। সূর্যসিদ্ধান্ত ও ভগবদ্গীতা অনুসারে, “যুগ” ও “বয়স” নামগুলি সাধারণত চতুর্যুগ (কৃতযুগ বা সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ) বা “চারটি যুগচক্র” কে নির্দেশ করে । আমি হাংরির বিভিন্ন পত্রিকা গোষ্ঠীর সাহিত্য ও ছবি আঁকার  সময়ের বয়সকে চিহ্ণিত করছি ‘যুগ’ শব্দটি দিয়ে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত, ঠিক যেমন কল্লোল পত্রিকার সময়কে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত  বলেছেন ‘কল্লোল যুগ”।

হাংরি যুগ : প্রস্তাবনা : সন্দীপ দত্ত

বীজেশ সাহা সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ১ জুন ২০২২ সংখ্যায় ‘পাঁচ ছয় দশকের কিছু পত্রিকা-কথা’ প্রবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার  সন্দীপ দত্ত, যাঁর লাইব্রেরিতে ভারতের ও বিদেশের নানা ভাষার লেখক-গবেষকরা পুরোনো বই-পত্রিকার খোঁজে যান, তিনি লিখেছেন :“বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে হাংরি প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের মাধ্যমে যার সূচনা । স্রষ্টা, নেতৃত্ব ও সম্পাদক যথাক্রমে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায় । পত্রিকার চিন্তনভূমি পাটনা হলেও তার প্রকাশ স্হান ছিল ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া ; হারাধন ধাড়া বা দেবী রায়ের ঠিকানা । যদিও ছাপা হয়েছিল পাটনা থেকে ।

“মলয় রায়চৌধুরী তখন ২২ বছরের তরুণ, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ।কবি জিওফ্রে চসারের ( ১৯৩৯ – ১৪০০ ) In The Sowre Hungry Tyme পড়ে মলয় Hungry শব্দের অভিঘাতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । হাংরির পরিকল্পনা তখন থেকেই । সময়ের প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ । সদ্য স্বাধীন দেশ । দেশভাগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় । দারিদ্র, ক্ষুধা, নিরন্ন মানুষ । বাংলা কবিতার হালও খুব খারাপ । ৩০ – ৪০-এর গতানুগতিক কবিতা নির্জীব হচ্ছে । ৫০-এর কবিরা সবে নিজেদের প্রকাশ করছে । নিজস্বভূমি আবিষ্কার হয়নি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় এলেন পাটনায় । মলয় শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন । প্রথম বুলেটিনে কবিতা বিষয়ক একটি ইশতাহার ইংরেজিতে ছাপা হলো । 

“১৯৬২ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলায় প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশ পায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ পায় । এইসব বুলেটিনে প্রকাশের কোনো তারিখ থাকতো না । নানা রঙের কাগজে, এমনকি মলাটের বাদামি কাগজেও  বেরোতো এক সপ্তাহে ২৪টি আবার কখনও বছরে একটি হয়তো ।

“হাংরি সূচনাকালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র চারজন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী । এরপর একে একে যুক্ত হন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, অরুণেশ ঘোষ, সুবো আচার্য প্রমুখ । 

“ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার ও প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখালিখিতে নতুন আবিষ্কারই প্রকৃত সাহসী ও মৌলিক পথ মানতো হাংরিরা । কৃত্তিবাস বা শতভিষা গোষ্ঠী হাংরি আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেনি । প্রবীণ সাহিত্যকাররাও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন হাংরিদের সম্পর্কে । সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে হাংরি গোষ্ঠী । 

“অথচ সর্বভারতীয় ভাষায় বরেণ্য হয়েছিল এই আন্দোলন । হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি তরুণ লেখকরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল । অন্য ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় প্রভাব পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের । মারাঠি ভাষার লেখক অশোক সাহানে, দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলটকর প্রমুখ, তেলেগু ভাষায় নিখিলেশ্বর, নগ্নমুনি, জ্বলামুখী প্রমুখ । হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ হাংরি লেখকদের মূল্যায়ন করেন । 

“বহির্বিশ্বেও হাংরি আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ।

“১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হাংরি জেনারেশনের একটি বুলেটিনকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগে মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয় । ৪৮ শঙ্কর হালদার লেন, আহিরিটোলা, কলকাতা- ৫ থেকে ওই সংখ্যায় দশজন লেখক ও প্রকাশক সমীর রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায় । লেখক তালিকায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ও সুবো আচার্য । এই বুলেটিনেই প্রকাশ পায় মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ।

“এই কবিতাকে কেন্দ্র করে অশ্লীল রচনার দায়ে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার প্রেস সেকশনের সাব ইন্সপেক্টর কালীকিঙ্কর দাস অভিযোগ আনলেন । শুরু হলো ধড়পাকড় । ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা হলো ৬ জনকে । মামলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে । দীর্ঘ দিন মামলা চলল । ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয় । এই ১৯৬৫ সালেই হাংরি আন্দোলনের ইতি ঘটে । এই বছরেই ২৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর সাজা হয় । পরে, ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে পিটিশন দ্বারা মামলা করার ভিত্তিতে, তাঁকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দেয়া হয় ।

“আন্দোলনের কথা পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের TIME পত্রিকায় । এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা বিদেশে প্রচারিত হলো । প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি জেনারেশনের এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে একটি দীঘস্হায়ী ছাপ রেখে গেল ।”

এক : একজনকে খুঁজে পেলুম

সালটা ১৯৬১ । অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হয়ে চাকরি করছি পাটনায়।১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ‘ইতিহাসের দর্শন’ যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে। ইতিহাসের দর্শন নিয়ে  প্রবন্ধ  আর ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে একটা বই লেখার সময়ে পরিচিত হয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের সমাজভাবনায় আর মেলাবার চেষ্টা করেছিলুম দেশভাগ-পরবর্তী ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবাংলার সঙ্গে ।  সেই সময়ে, দেশভাগের পর, পশ্চিম বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু শরণার্থীর ভিড়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বরাজের স্বপ্নকে চুরমার করে আরম্ভ হয়েছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির  খেলা। স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে। 

— আমরা এই অবস্হার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি । দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে বলেছিলুম।

—কেমন করে আওয়াজ তুলব ? আমাদের তো কেউই চেনে না ।

—আমরা লিফলেট ছাপিয়ে আমাদের বক্তব্য রাখব আর পাবলিকের মাঝে বিলোবো ।

—চাইবাসায় আমার নিমডির বাসায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় এখনও আছে, ওকে তবু লোকে চেনে। সঙ্গে আনবো, ওকে তোর আইডিওয়াটা এক্সপ্লেন করিস।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমি চিনতুম চাইবাসায় কয়েকবার গিয়ে ; দাদার বাসায় থাকতো । শক্তির উপন্যাস ‘কুয়োতলার’ পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার খুবই ভালো লেএছিল । চিনতুম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুকে, যারা প্রায়ই চাইবাসায় এসে দাদার বাসায় থাকতো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সিটি কলেজে পড়ার সময়েও পাটনায় এসেছে ; দাদা পাটনাই দিশি মদ ঠররা খাইয়ে সুনীলকে এমন মাতাল করে দিয়েছিল যে রাতভর বারান্দার নালিতে বমি করেছিল ; মা পাতিলেবুর শরবত খাইয়ে সামলেছিলেন ।

১৯৬১ সালে একটা পত্রিকায় হারাধন ধাড়া নামে একজনের চিঠি পড়লুম, ছোটোগল্প সম্পর্কে লিখেছে । ঠিকানা দেয়া ছিল ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া । ধাড়া পদবিটা আকর্ষণ করেছিল। বাবাকে জিগ্যেস করে জানতে পারলুম ওরা মাহিষ্য, মানে কৃষিপ্রধান  সম্প্রদায় । ‘কল্লোল’, ‘কবিতা’ বা তার পরের দশকগুলোতে কৃষক কবি-লেখকের কথা শুনিনি বলে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল । একটা পোস্টকার্ড লিখে পাটনা থেকে গেলুম ওর বাড়ি । হাওড়ার একটা সরু প্রায়ান্ধকার গলি দিয়ে পৌঁছোলুম ২৩৯ নেতাজি সুভাষ রোড । বেশ কয়েকটা পরিবার থাকে উঠোনের চারিদিকের চালাঘরে, তার একটায় হারাধন ধাড়া থাকে ভাই আর মা-বাবার সঙ্গে । একটাই ঘর, মাঝখানে পালঙ্ক, মেঝেয় আর খাটের তলায় বই আর পত্রিকা   । হারাধন বেশ ফর্সা গোলগাল, কৃষক পরিবারের সদস্য বলতে যে মাসকুলার বডি বোঝায়, তেমন নয় । 

 হাংরি নামের  আন্দোলন আরম্ভ করার ব্যাপারটা আলোচনা করলুম, চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ আর স্পেংলারের দর্শন খোলোশা করলুম ওর কাছে । হারাধনকে বোঝালুম  ‘হাংরি’ শব্দটা পেয়েছি ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘In Swore Hungry Tyme’ বাক্য থেকে। আর আন্দোলনের তাত্বিক বনেদ হলো দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West’ বইটার কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য । 

—হাংরি মানে জানি, কিন্তু ইংরেজ কবির লেখা থেকে কেন ? জিগ্যেস করল হারাধন।

বললুম, এই হাংরি শব্দটা খাওয়ার নয়, সময়ের, খারাপ সময়ের । 

—অনেকে ক্ষুধার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে। ভাববে হাংরি মানে ক্ষুধার্ত।ভাববে আমরা খেতে পাচ্ছি না বলে-বলে লেখালিখি করতে হবে । চোখ কুঁচকে বলল হারাধন ।

—আমি তাই চসারের ‘হাংরি টাইম’ শব্দবন্ধের কথা বলছি ; ভারত আর বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, দেশভাগের পর  একটা খারাপ সময়ের আবর্তে পড়েছে ; সমাজ , সংস্কৃতি , রাজনীতি , ধর্ম , মানুষে-মানুষে সম্পর্ক , জাতিপ্রথা বলো, আমরা উত্তরঔপনিবেশিক ঘুর্ণিতে পাক খাচ্ছি । মানে, এসট্যাবলিশমেন্ট নামের অক্টোপাস বা ক্ষমতার পীঠস্হানগুলো সব কয়টা আঁকশি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। আমরা পীঠস্হানগুলোর সব কটা আঁকশিকে আঘাত করব।

বললুম, বাঙালির সমাজে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, সমাজ,শিল্প ও সাহিত্যের  আন্দোলন শুরু করব আমরা, তার নাম হবে হাংরি  বা হাংরিয়ালিস্ট  । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটাকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধ বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে গ্রাহ্য হবে যেভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি শংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো  হয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেব আমরা ।

স্পেঙ্গলারের বক্তব্য ব্যাখ্যা করলুম : কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটা সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না| যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটা নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটা সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।

—বাংলার হালত দেখে ভালোই বুঝতে পেরেছি তোমার কথাগুলো । কমিউনিস্টরা এই ব্যাপারটা বুঝতে চায় না ।

—দেখতেই পাচ্ছো, উনিশ শতকের পর বাঙালির সমাজ কোথায় পৌঁচেছে। বললুম আমি।

—জানি, আমি কিছুদিন আগে পর্যন্ত চায়ের ঠেকে কাজ করতাম । সম্প্রতি পোস্ট অফিসে চাকরি পেয়েছি । আমি নিজের নাম বদলে দেবী রায় রাখতে চাই । এফিডেভিট করছি । কিন্তু আমাকে কী করতে হবে ?

—তুমি আমার সঙ্গে পাটনায় চলো । দাদা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চাইবাসা থেকে নিয়ে আসবে। চারজনে মিলে একটা প্ল্যান তৈরি করব ।  নানা ব্যাপারে লিফলেট ছাপিয়ে তোমাকে পাঠাবো, তুমি কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের মাঝে বিলি করবে । যারা যোগ দিতে চায়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা যোগাড় করবে । আমি আর দাদা খরচের দিকটা দেখব।

হারাধন রাজি, ওর বাড়ির ঠিকানাটা ব্যবহার করতেও রাজি । তবে মন খারাপের ব্যাপার হলো যে নামটা পালটে ফেলছে । হারাধন ধাড়া নামের জন্য সাহিত্যজগতে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, তাই নামটা বদলে দেবী রায় করতে চায় । আমি প্রস্তাব দিলুম, প্রকাশক হিসাবে হারাধন ধাড়া নামটা থাকুক আর সম্পাদক হিসাবে দেবী রায় । 

হারাধনের বন্ধুবৃত্ত ছিল না তখন কেননা আমাকে দেখে হারাধনের মায়েরও ভালো লেগেছিল। আমার বিষয়ে অনেক কথা জিগ্যেস করলেন । বললেনও যে হারাধন সবায়ের সঙ্গে মিশতে চায় না ।

—এবার দেখবেন, লোকে যেচে এসে মিশবে । বলেছিলুম হারাধনের মাকে ।

ট্রেনে করে পাটনায় যাবার সময়ে দেখলুম দেবী রায় বেশ সহজে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে পারে যা আমি একেবারেই পারতুম না ।

তার আগের এক অভিজ্ঞতার কথা বলি ।দাদা তখন সিটি কলেজে পড়ছে । মামার বাড়ি পাণিহাটি থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে শিয়ালদহ হয়ে স্টেশন থেকে হেঁটে কলেজে যেতো । আমি উত্তরপাড়ায় গেলে কোন্নগর থেকে নৌকো করে পাণিহাটিতে যেতুম। পাণিহাটি থেকে দাদার সঙ্গে কলকাতায় যাবার সময়ে শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তুদের অবস্হা দেখে দাদাকে জিগ্যেস করেছিলুম, এনারা এই ভাবে কতোদিন রয়েছেন ? দাদা বলেছিল, কলকাতায় এনাদের কেউ নেই, টাকাকড়িও নেই, তাই শিয়ালদা  স্টেশন চত্বরে থাকা ছাড়া আর অন্য উপায় নেই। রোজ এতো পরিবার পালিয়ে আসছে যে স্টেশন প্ল্যাটফর্ম ছাপিয়ে,  স্টেশনের সামনে খোলা চত্বরে চটের ছাউনি দিয়ে, এরা ঝড়, জল আর রোদে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে । শুনে,  মনখারাপ পুষে চুপ করে রইলুম। আর যাইনি শিয়ালদহ হয়ে দাদার কলেজে। দাদাও উত্তরপাড়ার আদিবাড়িতে চলে এসেছিল । দাদার কলেজের বন্ধুরা আড্ডা মারতে আসতো উত্তরপাড়ার খণ্ডহর হয়ে যাওয়া জমিদারবাড়িতে । দাদা বেছে নিয়েছিল চিলেকোঠার ঘর, সিগারেট ফোঁকার সুবিধার জন্য ।

আমি দেবী রায়কে নিয়ে পাটনায় পৌঁছোবার পর দাদা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এলো। আমি চসার আর স্পেংলারের আইডিয়াটা ব্যাখ্যা করলুম । শক্তি বেশ মন দিয়ে শুনলো । শক্তির নাম নেতা হিসেবে, দেবী রায়ের নাম সম্পাদক হিসেবে আর স্রষ্টার নাম থাকবে আমার । পরে  টের পেয়েছিলুম যে এইভাবে প্রথম লিফলেটেই নামগুলো ছাপানো বোকামি হয়ে গিয়েছিল । 

শক্তি চট্টোপাধ্যায় আইডিয়াটা শুনে বলল, সুনীলকে না জানিয়ে আন্দোলন করা কি উচিত ?

—কৃত্তিবাস পত্রিকা তো কোনো আন্দোলন নয়, ওটা বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার পাশাপাশি একটা আলাদা প্ল্যাটফর্ম । কৃত্তিবাস পত্রিকায় তো আমি লিখেছি । আমার একটা কবিতার বই বেরোবার কথা কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে । আর দাদা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’ বইটা নিজের মাইনের টাকায় ছাপিয়ে দিয়েছে । কৃত্তিবাস ছাপাবার খরচও দেয় মাঝে-মধ্যে।

—সমীর বোঝাক সুনীলকে, ও তো কলেজের বন্ধু । তোমাদের উত্তরপাড়ার বাড়িতে আড্ডা মারতে যেতো। খাবার আইডিয়াটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে । সুনীল কিন্তু চটে যেতে পারে । সন্দীপন আর উৎপলের সঙ্গে মাঝে সুনীলের তর্কাতর্কি হয়েছিল কৃত্তিবাস নিয়ে ; ওদের মনে হয়েছে সুনীল ওদের কনট্রোল করতে চাইছে । সমীর জানে ব্যাপারটা । উৎপল একটা আলাদা পত্রিকা বের করতে চায়।

—হ্যাঁ, সুনীলের আপত্তির কারণ নেই । কৃত্তিবাস তরুণদের কবিতা লেখার প্ল্যাটফর্ম । আন্দোলন নয়। মলয় বলছে টোটাল আন্দোলনের কথা, এসট্যাবলিশমেন্টের কথা, ক্ষমতার পীঠস্হানগুলোকে আক্রমণের কথা । 

—আপনি কতোকাল প্রেম করছেন, প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখছেন, বিয়ে করে ফেলুন এবার। আমি বললুম শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ।

—বুঝেছি, সমীরের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি বলে তোমার আঁতে লাগছে । বলল শক্তি ।

—আরে ওর সঙ্গে সুধীরবাবু বিয়ে দিতে রাজি হবেন না, চালচুলো নেই, মুখ থেকে ভুরভুর করে মহুয়া মদের গন্ধ বেরোয়, আগে একটা চাকরি পাক, তারপর । বলল দাদা ।

—হ্যাঁ, ততোদিন সমীরই ভরসা ।

—হাংরি বুলেটিনে দেবার জন্যে ও একটা কবিতা লিখে দেবীকে দেবে কলকাতায়।দেবী রায় হাংরি বুলেটিনে ছাপাতে পারবে । দেবীকে কিছু টাকা দিলে দাদা ।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটাই হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত প্রথম কবিতা, তখন ভারত আক্রমণ করেছে চীন । প্রথম ভারত-চীন যুদ্ধ ভারত চীনের মধ্যে ১৯৬২ সালে সংঘটিত একটি যুদ্ধ। সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবী করে, এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে চীনজয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয়, যুদ্ধের পর ভারত সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ভারতের শান্তিবাদী বিদেশনীতিও কিছু পরিমাণে পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাজ্য ভারতকে সমর্থন করে, অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মিত্রতা বাড়াতে সচেষ্ট  |

একটি ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত আর পরখ করেছিল
জ্যোত্স্নায় ছড়ানো ধানগাছগুলি, ধানের গোড়ায় শুদ্ধ জলভরা মাখনের মতো
মাটির সাবলিলতার চিকণ-ফাঁপানো ধান, ধানগুলি ভাত হতে পারে ?
নির্বাক দেবতা কথা বলতে পারে
লোহা গলতে পারে
কাঠের ভূভাগ পারে চিৎ হতে নারীদের মতো ?
তবু সে ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত।
ভালোবেসে দেখেছিল, বহুতর দর্শন জীবনে
জীবন ছেড়েও কতো’ গাঁজায় আক্রান্ত হয়ে কতো
জীবনেও ধান ছাড়া, নারী ছাড়া, জ্যোত্স্নাটুকু ছাড়া ওপরে কি যেন আছে !
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পান্থ-নির্যাতনে
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পরিব্রজাতার
সবারই ওপরে আছেন ভগবান মানুষের হয়ে
ভিখারি ছেলেটিকে দুটি ভাত দেবার ব্যস্ততায়
ভিখারির ভালো ছেলে ছাড়া ছিল বহু মন্দ ছেলে
তারা ভালোবাসা নিয়ে মাখামাখি করেনি কখনো
তারাও তো বেঁচে আছে তারাও তো আছে অনাবিল
আমলকির মতো কত ভলো ধরণের ফলই পৃথিবীতে আছে
ভিখারির ভালো ছেলে মন্দ ছেলে ঝরে গেছে ভিখারিমাতার পেট থেকে

অপরূপ উলোটপালট হয়ে পৃথিবীতে ঘটনা এখন জীবনের শান্তি, মুক্তি, বিষণ্ণতা

প্রভৃতি যুদ্ধের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকে

যেকোনো প্রকারে যুদ্ধ বন্ধ করো

ওদের পেটের ছেলে – বোমাগুলি খসাতে হবে না

ওদের পেটের মেয়ে – বোমাগুলি মরে যাক পেটে

বছর বছর হোক প্রাণঘাতী বিবাহবার্ষিকী

ক্রুশ্চভ-কেনেডি নাই প্রসূতি হবে কী কোনো দিন ?

তবে বন্ধ করো হিংসা মেগাটন যুদ্ধ অগ্ন্যুৎপাত

নতুবা ক্ষুধার্ত খাবে ছিঁড়ে মাংস প্রয়োজনমত ।

উপদ্রুত ভারতের সীমান্তের তুষারহায়নার দল থেকে

ধর্মহীনতার লাল ঝাণ্ডা নিয়ে কেবল দেহের খোঁড়া ক্ষুধা নিয়ে

এবং তুষার হায়নার চোখে নারীর কপোল খাওয়া ক্ষুধা আঁকা দেখে 

মুখ্যমন্ত্রী, পাঠিয়ে দাও একদল ক্ষুধার্ত কবিকে

তারা লিখতে জানেও না, গিলতে জানে অলৌকিকভাবে

সমগ্র সীমান্ত খেয়ে কফিহাউসে করবে আলোচনা

আধুনিক গল্পে জপ পদ্যে হয়তো খুব ভেদাভেদ নাই

বাংলাদেশে বিয়ে হয় ৩টে  –  ৩০-এ

জ্যোতিবাবুকেই দাও বেন্টিক স্ট্রিটের চর্মমালা

সৌমিত্র কেমন করলো অভিনয় চীনা-অভিযানে 

কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না

যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে ? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে

তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক, মুখ্যমন্ত্রী সেন ?

— আমার মা ঘরের পরদা সরিয়ে খেতে ডাকলেন, “ওই ঘরে আসন পেতে খেতে দিয়েছি।” মা জানতেন যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাসায় থাকেন আর শীলার সঙ্গে প্রেম করেন ।পাটনায় তখন ডাইনিঙ টেবিল ছিল না ।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বোধহয় ব্যাপারটা ঠাহর করতে অসুবিধা হচ্ছিল । তাই রাতের খাবারের আগে যখন মদ খাওয়া চলছিল, আমি বললুম, স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় ।  হাংরি হবে কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, আর হাংরি  সাহিত্যকৃতি হবে কাউন্টার ডিসকোর্স

—বুঝেছি, বুঝেছি, বলে মাথা নাড়ল শক্তি ।

আমি তবু বোঝানো বজায় রাখলুম ।

—-ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; ;কল্লোল’, ‘কবিতা’ , ‘কৃত্তিবাস’ যে নবায়ন এনেছে সে কাজগুলো  কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো  যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, আর তাঁদের মনোবীজে অনুমিত রয়েছে যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটা একক, নিটোল ও সমন্বিত ।” 

—জানি, জানি । বলল শক্তি ।

আমি তবুও বলা বজায় রাখলুম, কেননা বললে পরে দেখেছি নিজেকে ঝালিয়ে নেয়া যায়।

—-ওই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে  সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, আর স্থানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । 

—হ্যাঁ, কারেক্ট । দাদা বলল ।

—ওই ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কবিতা আর কৃত্তিবাস পত্রিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে আর প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে ‘শতভিষা’ গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি ‘কৃত্তিবাস’ও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, যদিন ঔপনিবেশিক-তন্ত্রের আগেকার প্রাক-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষ্যণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় । 

—বুঝেছি, বুঝেছি, তোমাকে অতো বক্তৃতা দিতে হবে না, কলেজে তো অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলে, গেলেই পারতে, বলল শক্তি ।

চাইবাসায় দাদা ট্যুরে গেলে শক্তিকে নিজের শশুরবাড়িতে রেখে যেতো । একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শক্তির  খোঁজে চাইবাসায়  পৌঁছে অবাক হয়ে বলে, “তুই এখানে ইস্টিশান পুঁতে ফেলেছিস?”  প্রেমিকা কলেজে পড়তে গেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ফিরে আসার রাস্তায় কোনো গাছতলায় দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ অপেক্ষা করত।

 পাটনায় দেবী রায় আরও কয়েক দিন থেকে গেল । আমার ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ বইটার পাণ্ডুলিপি আর উনিশ হাজার টাকা শক্তিকে দিলুম বইটা কলকাতায় ছাপাবার জন্য । বইটা এমনভাবে ছাপিয়েছিল যে শেষে চটে গিয়ে শক্তির উল্টোডাঙা বাসার সামনে ডাঁই করে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলুম । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদাকে বলেছিল যে, তুই আর লোক পেলি না । তালপাতা প্রকাশনী থেকে ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে যাতে হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেকের চিঠি আছে, আমার চিঠির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । শক্তির সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল সেই থেকে । আর শক্তিও ভাবলো যে ওর প্রেমিকার সঙ্গে বিয়েতে বাগড়া দিয়েছি আমি আর দাদা । 

দুই : হাংরি ইশতাহার

পাটনায় এক পাতার বুলেটিন ছাপিয়ে দেবী রায়কে পাঠাবো এরকম প্ল্যান ঘা খেলো কেননা বাংলা প্রেস পেলুম না । অগত্যা ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইংরেজিতে লিফলেট ছাপিয়ে দেবীকে গোছা করে পাঠালুম । লিফলেটে যা ছাপানো হয়েছিল :

 ‘ প্রথম ইংরেজি ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১)’ Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestuous hunger.  Poetry is an activity of the narcissistic spirit. Naturally, we have discarded the blankety-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not resurrect itself in an orgasmic flow, but words come up bubbling in an artificial muddle. In the prosed-rhyme of those born-old half-literates, you must fail to find that scream of desperation of a thing wanting to be man, the man wanting to be spirit. Poetry of the younger generation too has died in the dressing room, as most of the younger prosed-rhyme writers, afraid of the satanism, the vomitous horror, the self-elected crucifixion of the artist that makes a man a poet, fled away to hide in the hairs. Poetry from Achintya to Ananda and from Alokeranjan to Indraneel, has been cryptic, short-hand, cautiously glamorous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.’ 

কয়েকজন আলোচক প্রশ্ন তুলেছেন যে লিফলেটগুলোতে তারিখ দেয়া নেই কেন । তারিখ দেয়া নেই কেননা সাহিত্য পত্রিকা হিসাবে কোনো লিফলেট প্রকাশিত হয়নি । যাই হোক, দেবী রায় জানালো যে লিফলেট বিলি করার পর অনেকে যোগ দিতে চাইছে, ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজখবর করছে । আমি এবার দেবী রায়কে বাংলায় লেখা ম্যাটার আর টাকা পাঠিয়ে দিতে লাগলুম, যাতে ওখানেই ছাপিয়ে নিতে পারে ।  লিফলেটগুলো এরকম ছিল : 

 প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১)’  কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয় , অতিপ্রজ অন্ধবল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন এমনভাবে আবির্ভূত যে, জীবনের কোনো অর্থ বের প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানবিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা, কারণ কবিতা ব্যতীত কী আছে আর জীবনে । মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে । কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয় । কবিতা থাকা সত্ত্বেও, অসহ্য মানবজীবনের সমস্তপ্রকার অসম্বদ্ধতা । অন্তর জগতের নিষ্ঠুর বিদ্রোহে, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তিতে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হয় কবিতা । উঃ, তবধ মানবজীবন কেনএমন নিষ্প্রভ । হয়তো, কবিতা এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে যাঁরা অভ্যস্ত তাদের অপ্রয়োজনীয় অস্তিত্ব এই সঙ্কটের নিয়ন্ত্রক । কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মৌহমুক্তির প্রতি ভয়ংকর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খঙাচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । এমনকি প্রত্যাখ্যাত পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের পথরূপেও কবিতার ব্যবহার এখন হাস্যকর । ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতারবর্বরতার মথ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধতার মথ্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তরজগতের গুপ্তধন । কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায় । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নূ বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে ‘সচেতনভাবে বিহ্বল’ হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । শখ করে, ভেবে-ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তূ কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনিপারম্পর্ষে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তিরশক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে।”

      মুক্তি বিষয়ক ১৪-বিন্দু ইশতাহার (১৯৬২) ১.আমার সম্পূর্ণ অহং-এর খাঁটি আবিষ্কার । ২. কবিতা চলাকালীন আমাকে এবং আমার সমস্ত কিছুকে যতরকমভাবে পারা যায় উপস্হিত করা । ৩. কবিতায় আমাকেঠিক সেই মুহূর্তে আটক করে ফাঁস করা যখন আমি কোনো না কোনো কারণে ফেটে পড়েছি, আর আমার ভেতর দিকতা বেরিয়ে পড়েছে । ৪. নিজস্ব অহং দিয়ে প্রতিটি মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ, তারপর স্বিকার আধবা প্রত্যাখ্যান । ৫. সমস্তকিছুকে বস্তু মনে করে আরম্ভ, এবং প্রত্যেকটিকে নাড়িয়ে দেখে নেওয়া যে তা প্রাণবন্ত কি না । ৬. সামনে এসে পড়া ব্যাপারকে হুবহু গ্রহণ না করে তার প্রত্যেকটি দীক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা । ৭. পদ্যছন্দ ও গদ্যছন্দ উভয়েরই অবলুপ্তি ঘটিয়ে একটা সহজসরল নিজস্ব শৈলীর ব্যবহার যা ধাঁ করে ঢুকে যাবে যাকে জানানো হচ্ছে তার মেজাজে । ৮. কথা বলার সময়ে যে ধরন, মাপ আর ওজনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, কবিতাতেও অবিকল তাই । ৯. কথা বলার সময়ে শব্দের ভেতরে যে ধ্রণের ধ্বনি পুরে দেয়া হয়, কবিতাকে সেই ধ্বনিতে আরও চাঁচাছোলা করে উদ্‌ঘাটন করা । ১০. পাশাপাশি দুটি শব্দের এতাবতকালের আঁতাত ধাক্কা দিয়ে ভেঙে দেয়া এবং তদ্বারা অসবর্ণ ও অবৈধ শব্দ এবং বাক্য তৈরি । ১১. কবিতায় আজ পর্যন্ত ব্যবহৃত সমস্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান, আর বাইরের কোনো রকম ঘুষ না নিয়ে কবিতাকে নিজেই মৌলিক হতে দেয়া । ১২. কবিতাই মানুষের সর্বশেষ ধর্ম, সে ব্যপারটা খোলাখুলি স্বীকার করা । ১৩. তীরের মতো বয়ানে অতিষ্ঠ অস্তিত্ব, বিবমিষা, বিরাগ আগাগোড়া তীব্রভাবে জানানো । ১৪. অন্তিম প্রাতিস্বিকতা ।

   ‘রাজনীতি বিষয়ক ইশতাহার (১৯৬৩)’  ১.প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের আত্মাকে রাজনীতিমুক্ত করা হবে । ২. প্রাতিস্বিক মানুষকে বোঝানো হবে যে অস্তিত্ব প্রাক-রাজনৈতিক । ৩. ইতিহাস দিয়ে বোঝানো হবে যে, রাজনীতি আহ্বান করে আঁস্তাকুড়ের মানুষকে, তার সেবার জন্যে টানে নান্দনিক ফালতুদের । ৪. এটা খোলসা করে দেয়া হবে যে গান্ধীর মৃত্যুর পর এলিট ও রাজনীতিকের মধ্যে তুলনা অসম্ভব । ৫. এই মতামত ঘোষণা করা হবে যে রাজনৈতিক তত্ব নামের সমস্ত বিদগ্ধ বলাৎকর্ম আসলে জঘন্য দায়িত্বহিনতা থেকে চাগিয়ে ওঠা মারাত্মক এবং মোহিনী জোচ্চুরি । ৬. বেশ্যার মৃতদেহ এবং গর্দভের লেজের মাঝামাঝি কোথাও সেই স্থানটা দেখিয়ে দেয়া হবে যেটা বর্তমান সমাজে একজন রাজনীতিকের । ৭. কখনও একজন রাজনীতিককে শ্রদ্ধা করা হবে না তা সে যেকোনো প্রজাতি বা অবয়বী হোক না কেন । ৮. কখনো রাজনীতি ধেকে পালানো হবে না এবং সেই সঙ্গে আমাদের কান্তি-অস্তিত্ব থেকে পালাতে দেয়া হবে না রাজনীতিকে । ৯. রাজনৈতিক বিশ্বাশের চেহারা পালটে দেয়া হবে ।

রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে তখনকার ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রে  প্রধান সম্পাদকীয়, লেখা হয়েছিল, , ১৯ জুলাই ১৯৬৪ তারিখে  ; হাংরি আন্দোলন মামলা রুজু হবার আগে । শিরোনাম : ‘আর মিছিলের শহর নয়’ 

“বাংলাদেশে দলাদলিতে দীর্ণ বিশ্বাসহীন রাজনীতি আজ নিজের মস্তক চর্বণ করিতে ব্যস্ত । এই আবহাওয়ার জন্যই কি সমাজে এক ধরণের নিরাশাবাদ জন্মলাভ করিতেছে, যার চেহারা ড্রেনপাইপ মস্তানি, যার আওয়াজ রাস্তার রোমিওদের শিস এবং সাহিত্যের ‘ক্ষুৎকাতরতার’ মধ্যে ভয়াবহভাবে প্রকাশ পাইতেছে ? কাজেই ইহা আশ্চর্য নয়, এই সব বিকৃতির উপাসকরা যারা ‘হাংরি জেনারেশন’ নাম ধারণ করিয়াছে, তারা পরম শ্রদ্ধাহীন অবজ্ঞায় ‘গণিকার মৃতদেহ ও গর্দভের লেজের মাঝে কোথাও’ রাজনীতিকদের স্হান নির্দেশ করিতে চাহিতেছে । কলিকাতার ক্ষুধার্ত ছেলেরা এই ধিক্কার দিতেছে এবং আত্মধিক্কারের মধ্যে বন্দী হইতেছে, ইহা কি বন্ধ্যা রাজনীতিকদের প্রায়শ্চিত্ত অথবা অসুস্হ সমাজের অভিশাপ ?”

যারা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছিল তাদের নাম এক পিঠে আর অন্য পিঠে নিজের লেখা ছাপিয়ে পাঠাচ্ছিলুম দেবী রায়কে । দেবী জানালো যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী প্রমুখের লেখা পাওয়া গেছে । তাই পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করতে হবে। আমি টাকা পাঠিয়ে দিলুম । সেটা ছিল দশ নম্বর বুলেটিন, তাতে বিনয় মজুমদারের ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতাটা ছাপা হয়েছিল: 

একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় দুবে গেল – এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হলো ফল ।

বিপন্ন মরাল ওড়ে, আবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে;

সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু

এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য তুমি… তুমি…

কিম্বা,দ্যাখ,ইতস্তত অসুস্হ বৃক্ষেরা

পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী

দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে

তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে

চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা

সেই সংখ্যাতেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিল্প ও কার্তুজ’ শিরোনামে এই কবিতাটা প্রকাশিত হয়েছিল : 

দুঃসাহসী কেউ নেই যে সে পেচ্ছাব করবে মুখে

জানে কামড়ে দেবো, জানে অঙ্গহানি হলে বুদ্ধদেব

কে পুনর্গঠিত করবে, পাগলা রামকিংকর বেইজ ছাড়া?

জীবনেই একবার শিল্পঅনুরাগিনীর কাছে

ন্যাংটার উদ্বৃত্ত অংশ হাতড়ে বলেছিলুম, কী ভাবো

শিল্পই যথেষ্ট! কেন কার্তুজ লটকানো হল দেহে ?

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৩ সালের একটা চিঠিতে দেবী রায়কে এই নির্দেশ দিলেন বুলেটিনে তাঁর লেখা ছাপার ব্যাপারে 

মির্জাপুর, ৫ অক্টোবর ১৯৬৩

প্রিয় হারাধনবাবু

হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম। প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট — এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব। প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন। ছাপালে সবকটি একসঙ্গে ছাপাতে হবে — নইলে খাপছাড়া লাগবে। ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে, দরকার পড়লে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন।

‘অমৃত’তে আমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল, দেখেছেন? নইলে পাবলিশারের কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যস্হা করেন তো খুশী হই। ওই বিজ্ঞাপনটাই দেশে বেরোবার কথা আছে — যদি বেরোয় তার প্রুফটা কাইন্ডলি দেখে দেবেন। আনন্দবাজারে লেখকদের লেখকদের কোনো বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন।

সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব। আরো একমাস থাকবো বা ততোধিক। সহজে যাব না। শরীর ভালো। ছোটোগল্পে আবার লেখা দিতে পারলাম না, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন।

আগামি সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাবো। তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর, — এই ঠিকানায় দেবেন। ‘আক্রমন’ বানান কী? ‘ন’ না ‘ণ’?

লেখাটা প্রকাশ হবার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে। অনেক বাদ দিয়ে, খুব নরম করে, সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই।

হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, তার কী হল? ৫ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন।

কমাগুলো ভেবেচিন্তে দিয়েছি, ওইগুলোই আসল জিনিস যেন থাকে।

শেষের তারিখটা যেখানে আছে, ওখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন।

‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো?

সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি।

ইতি

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

বুলেটিন ছাপিয়ে বিলি করার জন্য অনেকে নানা কথা বলেছেন । নন্দিনী ধর, যিনি হাংরি কবিতাকে বলেছেন ‘পোঁদ পোঁছার কবিতা’, তিনি ‘আয়নানগর’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৯ সংখ্যায় লিখেছেন, একথা মেনে নিতে আমার কোনো অসুবিধে নেই যে হাংরি আন্দোলনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল এক ধরনের বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ তার ছাপ রেখে গেছে একধরনের বাজারবিমুখীনতায়, একধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড ছোট পত্রিকা ইস্তেহার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। বলা যেতে পারে, হাংরি আন্দোলন একধরনের বিকল্প ছাপাখানার সংস্কৃতি আন্দোলন। সে বিকল্প সংস্কৃতি এক দিক থেকে একগুঁয়ে, জেদী। বাজারের বাইরেই তার মূল কেন্দ্রবিন্দু, বসবাস। আজ যখন আমি নিজে লেখালেখি করি, পত্রিকা করি, ছোটপত্রিকার রাজনৈতিক সাহিত্যিক ভূমিকা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি, তখন তো সেই বিকল্প ছাপাখানার ইতিহাসের দিকেই তাকাই অনুপ্রেরণার জন্য, শেখার জন্য। না, সেখানে শুধু হাংরি নয়, আছে হাংরি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক অনেক বিকল্প ছাপাখানা ও বিকল্প গণমাধ্যম প্রয়াস। কিন্তু, আরো একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠির সাথে সাথে, হাংরি গোষ্ঠীও যে আমার অন্যতম পূর্বসুরী, একথা আমার মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই।”

বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ ছিল হাংরি যুগের জলবিভাজক গল্প । এই প্রসঙ্গে অজিত রায় লিখেছে, বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’  তেষট্টিতে  ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়। গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে। শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না। এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়। বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।‘রন্ধনশালার’ হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়। খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে। 

১৯৬৩ সালেই উৎপলকুমার বসু ঠিকুজির আদলে একটা লম্বা কাগজে ওনার ‘পোপের সমাধি’ কবিতাটা ছাপিয়ে নিজেই বিলি করলেন 

[VERA PAPA MORTUUS EST]

A Hungry Generation message on the death of Pope John XXIII

লাল হলুদ কাচের জানালার দিকে তাকিয়ে

সেদিন অকস্মাৎ

বিকেলের অপরিচ্ছন্ন মুহূর্তে আমি

জটিলতাহীন

সূর্যরশ্মির দিকে চোখ মেলে

‘পোপের সাম্রাজ্য আর

তাঁর অসুখের

রহস্যময় স্হিতিস্হাপকতা’

আঙুলে একটি বড়

গ্লোব পৃথিবীর

বর্তুল পরিধি দেখিয়ে

আমি কলকাতায় তোমাকে বলেছিলাম

‘পোপের সাম্রাজ্য

আর তাঁর অসুখের রহস্যময় বীজাণুর স্হিতিস্হাপকতা

কতখানি দেখা যাক ।’

বীজাণুর সঙ্গে তুমি চাও না কি যুদ্ধ হোক ?

অন্তত আমি তা চাই না

কারণ সে যুদ্ধ যদি ধর্মযুদ্ধ না হয় তাহলে

কুরুক্ষেত্রে কার মুখব্যাদানের অন্ধকারে

আমি ছোট পৃথিবীর গ্লোবের প্রতিচ্ছায়া দেখে

হতচকিতের মতো

কৌরবের খেলার পুতুল হব ?

নাড়া দিয়ে ভিতরের

বীজাণুর, সন্ত্রাসের, সিকি-আধুলির শব্দ,

গড়াগড়ি তোমাকে শোনাব ?

অন্য বহু পুরুষের মতো এই সাতাশ আটাশ

বছরের খিন্ন জীবনের কেবলই

ঝিল্লি শিরা অন্ত্রবহুল

ঐকান্তিক শরীরের প্রেমে

বারবার নেমে এসে

আমাদের দ্বিধা হল কেন ?

যথার্থ মাতাল, পাপী,

ধর্মজ্ঞানী, সাধু ও চোরের সঙ্গে মাখামাখি হল না তেমন ।

নৌকোয় বেশিদূর বেড়ানো হল না

ভালোবাসা জোরালো হল না–

খালপারে বিবাদ হল না–

পাঠক, এখন, রোমের চত্বর থেকে

দূর জানালায় চোখ রেখে

দেখা গেল দ্যুতি নিভে যায়

ক্যাথলিক মিশনের কাছে

আমি ভারতের অপুষ্টির জন্য

গুঁড়ো দুধ চাইব আয়াসে

ঊনচল্লিশ পোপের মৃত্যুর পর কূটজ্ঞানে

চল্লিশ পোপের জীবাণুমুক্ত আয়ু ফিরে আসে — এই বোধে ।

কিন্তু আমাদেরো

অন্য বহু পুরুষের মতো

আরো কুড়ি, বাইশ বছরের আয়ু বাকি আছে ।

ততদিন বিমান বন্দরে গিয়ে বসে থাকি

অথবা ছাপার কলে গিয়ে বলি আমার কবিতাগুলি

ছেপো না বা বুড়ো আঙুলের দাগ ছেপো না বা

ল্যাজের খুরের দাগ ছেপো না বা

আমাকে বদল করো

রহস্যময় মূল জানালায়

অন্ধকারে যখন হলুদ নীল ভিন্ন রং

মুছে গিয়ে পোপের সাম্রাজ্য আজ

বীজাণুর মতো ছোট

সংখ্যাহীন, ধূর্ত ও কোমল

মাতব্বর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল সদলবলে ।

দেবী রায় প্রথম থেকেই কবিতায় এক নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিল যাকে উত্তরাধুনিক আলোচকরা বলেছেন রাইজোম, লজিকাল ক্র্যাক, অনির্ণেয়তা, আয়রনি । এখানে দেবী রায়ের ‘আমি চুপ করে থাকলে’ কবিতাটা তুলে দিচ্ছি 

আমি চুপ করে থাকলে
নখ কাটতে গিয়ে আমার আঙুলে ব্লেড গঁথে যায়
আনেক গভীর
আমি আপেক্ষা করি, রক্তের — দেখা নেই
দারুন ভয় আমাকে চিৎ করে ফ্যালে, আমি ঢোঁক গিলি
এই ভয় — বিষম অন্তরঙ্গ কোনো মৃত্যুরই সমান আবিশ্বাস্য
বাস-ট্রাম আমায় বহু সময় গিলে নেয় কোনো কোনো
বন্ধুর ফ্ল্যাটে যেতে
এক পায়ে খাড়া হয়ে কড়া নাড়ি দরোজায় বহুক্ষণ
এক নাগাড়ে
হাত ধরে যায় ‘বাড়ি নেই’ অপরিচিত বিদেশী স্বরে কেউ বলে ওঠে
অথবা সরব হুক খোলার শব্দে দাড়ি কামানোর পর প্রথম
আয়নায় নিজের মুখ দেখার সময়ে আমি
হুডখোলা – কার
ছুটি, রেড  রোড ধরে ফাঁকা রাস্তায়
বন্ধুর স্ত্রী ঠেসে পরিচিত হতে চায় ফ্যাকাশে হেঁসে
দারুণ ক্ষিদেয় আমি অস্হির হয়ে উঠি – দারুণ ক্ষিদেয়
আমি
এখন বাসট্রাম অব্দি খেয়ে ফেলতে পারি – বেথানিয়া থেকে –
আসার সময়ে যিশু অব্দি এম্নি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল
আমি চুপ করে থাকলে রাস্তার পাথর অব্দি চিৎকার করে
ওঠে
মানুষের মুখের দিকে চেয়ে আমি বুঝি নপুংসক হয়ে জন্মায়
কেউ
মানুষের হাতে রাজনৈতিক নপুংসক হয়েছে
কেউ
কবিতাকে ধর্মের সমান দেখতে চেয়ে
নিজেকে নপুংসক করেছে

ইতিমধ্যে সুবিমল বসাক নামে এক যুবক আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে আমার সুবিধা হলো। তার মা আর ভাইরা পাটনায় থাকে । বলল, ইনকাম ট্যাক্স অফিসে স্টেনোগ্রাফার।  দেবী রায়ের তুলনায় বেশ পেশিবহুল চেহারা । বাঙাল বুলিতে কবিতা আর উপন্যাস লিখছে , স্কেচও আঁকছে। সেগুলো তো কলকাতার কোনো পত্রিকা ছাপবে না ।ওকে আইডিয়া দিলুম স্টেনসিলে কবিতা লিখতে আর ছবি আঁকতে । ও প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা বা দুটো বুলেটিন প্রকাশ করতো, তাতে ওর আঁকা স্কেচ থাকতো। সুবিমলের একটা কবিতা দিলুম এখানে : 

সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই

নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্‌গা আছি

অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই

আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই

ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি

তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া

কয় দণ্ড মুহূর্ত

কিছুটা সময়-ওক্তো

আমরা ‘পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলা’ খেলি

সুবিমল বসাকের আহ্বানে ত্রিদিব মিত্র আর ওর বন্ধুনি আলো মিত্র যোগ দিয়েছিল আন্দোলনে । ওরা উন্মার্গ আর The Waste Paper নামে দুটো পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করল । পরে ওরা আমাকে লেখা চিঠির দুটো সংকলন প্রকাশ করেছিল । সুবিমল বসাক ‘হাংরি আন্দোলনের দ্রোহপুরুষ’ নামে ত্রিদিব আর আলো সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিল, পুরোটাই তুলে দিচ্ছি, সেই সঙ্গে ত্রিদিবের কবিতাও :

হাংরি আন্দোলনের দ্রোহপুরুষ ত্রিদিব মিত্র এবং তাঁর তদানীন্তন প্রেমিকা আলো মিত্র ( যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে বহু ঝড়-জলের পর বিয়ে করেন ) সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় বিশেষ লেখালিখি দেখতে পাওয়া যায় না, তার কারণ হাংরির কয়েকজন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল,  যাতে এই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি বিশেষ বিজ্ঞাপিত ও প্রচারিত না হন। হাংরি  কেবল একটি পত্রিকা হয়ে থেকে যেত ত্রিদিব ও আলোর অবদান ছাড়া। তা যে সাড়া ফেলতে পেরেছে তার কারণ এঁদের দুজনার অভাবনীয় তৎপরতা।কালীদা, যিনি খালাসিটোলা ভাটিখানার মালিক বা ম্যানেজার ছিলেন, বলেছিলেন যে আলো মিত্রের আগে আর কোনো মহিলা খালাসিটোলায় ঢোকার সাহস করেননি।

ষাটের দশকে যা নতুন-নতুন কার্যকলাপ সাহিত্যিকরা আরম্ভ করেছিলেন তা ত্রিদিব মিত্র ও আলো মিত্রর মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁরাই প্রথম পোস্টকার্ডে কবিতা, পুস্তিকার আকারে কবিতা, রঙিনকাগজে কবিতা, ভাঁজকরা কাগজে কবিতা আরম্ভ করেছিলেন।তাঁরাই প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের  সমাধিতে কবিতা পাঠের আয়োজন করেছিলেন। তাঁরাই প্রথম খালাসিটোলা নামে কলকাতার বিখ্যাত ভাটিখানায়, জীবনানন্দ দাশের  জন্মদিনে, পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠান করেছিলেন।খালাসিটোলায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানও তঁদের অবদান। তাঁরা দুজনে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন; ইংরেজিতে ‘ওয়েস্ট পেপার’ ও বাংলায় ‘উন্মার্গ’ । তাঁদের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে পত্রিকার এরকম নাম রাখার কথা কেউ চিন্তা করতে পারতেন না। বস্তুত, তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপ্লব ঘটে গিয়েছে পশ্চিমবাংলায়।

মলয় রায়চৌধুরী  ও  দেবী রায়   যে-সমস্ত মুখোশ হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিলি করার জন্য ছাপিয়েছিলেন, জোকার দানব পশু পাখি মিকিমাউস দেবী-দেবতা ইত্যাদি, সেগুলি এনারা দুজনে পৌঁছে দিয়ে আসতেন তখনকার মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্ণধারদের, সংবাদপত্র-মালিকদের , যার জন্য যথেষ্ট বুকের পাটা দরকার। এনারা দুজনে কাঁধে মই নিয়ে কলকাতা ও হাও্ড়ার কলেজ ও অন্যত্র হাংরি আন্দোলনের পোস্টার সাঁটতেন; পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই  ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়  ।হাংরি আন্দোলনের পূর্বে কবিতার পোস্টারের ধারণা কলকাতার সাহিত্যিকদের ছিল না।ত্রিদিবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল খালাসিটোলার ভাটিখানায়।তারপর আমার মাধ্যমে মলয়ের সঙ্গে ও অন্যান্যদের সঙ্গে। মলয়ের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে ওঠে ত্রিদিবের এবং সেকারণেই ত্রিদিবের পত্রিকা দুটি হাংরি আন্দোলনের অভিমুখ হয়ে ওঠে।ওর পত্রিকা প্রকাশিত হলেই আমরা দল বেঁধে খালাসিটোলায় অনুষ্ঠান করতাম; তারপর বাইরে বেরিয়ে কলকাতার পথে অনেক রাত পর্যন্ত চরে বেড়ানো; কখনও বা গাঁজার পুরিয়া ম্যানেজ করে রামকৃষ্ণ ঘাটে সারা রাত। পকেটে টাকা থাকলে বেপাড়ায়। পেটে মদ পড়লেই ত্রিদিবের কন্ঠ থেকে কথা ছুটতে শুরু করত; অন্য সময় ও একেবারে চুপচাপ, কারোর সঙ্গে তখন কোনো কথা বলত না।একেবারে ফালগুনী রায়ের বিপরীত চরিত্র।আমরা কফিহাউসে একত্রিত হলেও অত্যধিক কথাবার্তায় বিরক্ত ত্রিদিব সাধারণত কফিহাউসে যেত না। যেত তখনই যখন হাংরির কোনো বুলেটিন বা মুখোশ বা পোস্টকার্ড বা ফোল্ডার বিলি করার থাকত, কিংবা কফিহাউসের সিঁড়ির দেয়ালে পোস্টার লাগাবার থাকতো। অনেকে পোস্টার ছিঁড়ে দিতো বলে ত্রিদিবের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি রুখতে হতো আমাদের।

কেবলমাত্র দুটি কবিতা-পুস্তিকা রেখে গেছেন ত্রিদিব — ঘুলঘুলি ও প্রলাপ-দুঃখ । ঘুলঘুলি  ছিল ফোল্ডারের আকারে এবং প্রলাপ-দুঃখ  ছিল ৪৮ পৃষ্ঠার, ল্যাকভার্নিশহিন কালো রঙের মলাট, কাভারে ত্রিদিবের কোমর পর্যন্ত নেগেটিভ ছবি — শুয়ে আছে ঘাসের ওপর, হাতে সিগারেট। গণেশ পাইন  এঁকে দিয়েছিলেন ওর প্রলাপ-দুঃখ  বইটির প্রচ্ছদ। বইটি প্রকাশের পরও ত্রিদিব সেইভাবে প্রচার করেনি, যখন কিনা হাংরি বুলেটিন সে পৌঁছে দিত সকলের টেবিলে বা বাসায় বা দপতরে।

 ত্রিদিবের ‘হত্যাকাণ্ড’ কবিতাটা তুলে দিলুম:

আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফাঁদে পড়তে হচ্ছে

মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে

চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের

ধ্বস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়

আমার মিথ্যে জিভ থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফঁড়ে

ঝলসা দিচ্ছে মানু-বাচ্চাদের

তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান

আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ

প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কঁদে উঠেছিলাম আমি

চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার

চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে

আমি দানব না যিশুকৃষ্ট বুঝতে না পেরে

রেস্তঁরায় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা

আজ আর কোনো রাস্তা খঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার

সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে

সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়

সব জীবনের মথ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা

আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু

অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়া

কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান

কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে

ভয়ে কঁচকে গিয়েছিল তার চোখ

অন্ধ চোখে কঁদে উঠেছিল মাথা নিচূ করে

এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে

নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর

আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে-আমার ভালবাসা

ভয় আর ভালবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে

বঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর

ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়

সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়

বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ

সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাশূন্যের বেতারে

টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু

এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়

রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি

আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য ‘টোপ’

নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে

খেলতে চাইলাম চাতুরী

তোমার প্রতারণা থেকে ভালবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম

আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা

আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা

আমার দিব্যজ্যোতি আমার আম্ধকার

আমার চারধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার

চলছে মানুষের

আমি বুঝতে পারছি মানুষ মানুষকে ভালবাসতে পারছে না

….মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালবাসেনি

উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্ধ লাশ

আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে

আমার ধর্ম কি মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে

আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে

স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু

পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা

অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটৈ ক্ষুরধার ভালবাসা

আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি

প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমত

অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান

কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু

আমার ভালবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি

অসুস্হ ভালবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য

মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও

আমার সকল উত্তাপ জযো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক

ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা

আগুনের হল্কা চুঁড়ে দিলে আমার গায়ে

শিশুর মত হেসে উঠলাম আমি

পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর

আকাশ ঘঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ

স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে

ওঃ

আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল

আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না

নিজেকেও তেমন করে ভালবাসা হল না আমার

এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি

এক সঙ্গেই হাসছি আর হাসছি না

ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি – অক্লান্ত আওয়াজ – আঁকাবাঁকা টানেল –

লুপ – পরিসংখ্যান – ক্ষুধা – মহব্বৎ – ঘৃণা –

কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের

আত্মাকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও

বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে

আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে

মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ ওব্দি

ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমিওঠা চোখে

মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার

কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালবাসা আমার অসহায়তা

মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে

অক্ষম আর আঊর্ব স্বাধীনতা

মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে

অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা

ওঃ আমি কোনো দিনই ভালবাসতে চাইনি

আঃ…………………………….আঃ

কলজে গঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়

বুকের ভেতর ইনজিনের চাপা ক্রোধ

রক্তের উত্তেজনে থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা

অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রণাম রেখেছিল সুবো

তিন মাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ

মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি

ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে

আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়

ভাঁটার সঙ্গে সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে

ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতদিন চিনতে পারেনি

আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খঁজে পাচ্ছি না নিজের

“মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই” বলতে ককিয়ে উঠেছিল

৩৫২ কোটি মানুষ তায় ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা

ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন

কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে

আমার ।

তাদের অজান্তেই…

 শান্তিনিকেতনে থাকাকালে ‘স্বকাল’ নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা আরম্ভ করেছিল প্রদীপ চৌধুরী । বিদ্যাভবনের ছাত্রী ঈশিতা ঠাকুরের প্রতি ইনফ্যাচুয়েশানে আক্রান্ত প্রদীপ নিজের কবিতায় যুবতীটির নাম উল্লেখ করে ; মেয়েটির তা পছন্দ হয়নি এবং বিদ্যাভবন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে । তাঁরা প্রদীপকে সতর্ক করে দ্যান কিন্তু ইনফ্যাচুয়েশানে আক্রান্ত প্রদীপের পক্ষে মেয়েটিকে ভোলা সম্ভব হচ্ছিল না । মেয়েটিকে আবার উল্লেখ করে নিজের কবিতায় । এখনকার মেয়েরা হয়তো দলবেঁধে যুবকটিকে গোটাকতক চড় মেরে বা হুমকি দিয়ে ছেড়ে দিত, কিন্তু এই ঘটনা পঞ্চাশ বছরের আগেকার তরুণীদের নিয়ে । সেই বিতর্কিত কবিতাগুলো প্রদীপ আমাকে পড়ায়নি ; ওই সংখ্যায় আমার কবিতা বা গদ্য ছিল না ।         

 বিদ্যাভবন কর্তৃপক্ষ প্রদীপ চৌধুরীকে রাস্টিকেট করে দিলেন । প্রদীপকে বলা যায় হাংরি আন্দোলনের প্রথম ক্যাজুয়ালটি । বিহিষ্কারপত্রটা তুলে দিচ্ছি এখানে :

নং. আই.ডি.পি/VII-১০/৬৩-১০                                       তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৬৩

শ্রীপ্রদীপ চৌধুরী

         আপনাকে সতর্ক করে দেওয়া সত্তেও এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ থেকে আপনি বিরত হননি। কর্তৃপক্ষের নির্ণয় অনুযায়ী এই পরিসরে ছাত্র হিসাবে আপনার উপস্হতি কোনোমতেই কাম্য নয় । অতএব আজ দ্বিপ্রহরের পূর্বেই আপনাকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে এবং জানানো হচ্ছে যে যতো সত্বর সম্ভব আপনি আপনার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নিন ও সমস্ত বকেয়া চুকিয়ে দিন ।

কালিদাস ভট্টাচার্য                      পি.সি দাশগুপ্ত          হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

অধ্যক্ষ বিদ্যাভবন                          প্রোকটর   বিভাগীয় প্রধান

শান্তিনিকেতন                            বিশ্বভারতী           ইংরেজি                                                                                   

      প্রদীপ চৌধুরীর কবিতা ‘রক্তের ভেতর ঢুকে পড়ছে কালো হাত’  তুলে দিচ্ছি এখানে

 রক্তের ভেতর ঢুকে পড়ছে কালো হাত।

‘কিছু দাও’ শরীরময় প্রতিধ্বনিত চীৎকার ।

আমি এই লোভীকে কিছু দিতে পারি না।

আমার গোপনীয়তা শেষ ।

আমার ভালবাসা ক্রীয়াশীল নয় ।

আমি শিরার ভেতর কার চাপা হাসি শুনি ।

সে-ও আমি ।

রাস্টিকেট হবার পর প্রদীপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় । যাদবপুরে পড়াকালীন প্রদীপের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এরপর তিনি হায়দরাবাদে ‘Central Institute of English and Foreign Languages’ (বর্তমান নাম: English and Foreign Languages University) এ ফরাসি ভাষা শেখেন। ফরাসি ভাষার প্রতি ওনার এতই তীব্র আকর্ষণ জন্মায় যে পরবর্তীকালে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি প্রদীপ ফরাসি ভাষাতেও কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজ জীবনেই প্রদীপ আকৃষ্ট হন ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবোর প্রতি। ফরাসি কবি লোত্রেয়ামোঁর লেখাও প্রদীপকে প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে তাকে হাংরি কবি হিসেবে টাইপকাস্ট করা হোক  তা চাইতো না। ফুঃ পত্রিকাটা ফরাসি, ইংরেজি আর বাংলায় প্রকাশ করতো । ফ্রান্সে বহুবার গেছে কবিতাপাঠ আর বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার জন্য । করোনায় মারা যাবার পর গণচিতায় ওর শব দাহ করা হয়েছিল।

ত্রিদিব মিত্রের নিকটবন্ধু ছিল সুবো আচার্য । পরে সুবো আচার্যর নৈকট্য গড়ে ওঠে প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে। আমার সঙ্গে সুবো আচার্য একবার দাদার বাসায় গিয়েছিল । দাদা তখন দুমকায় পোস্টেড । আমি আর সুবিমল বসাক বহুবার গেছি দুমকায় । শেয়ালদা থেকে রামপুরহাট । তারপর বাসে করে দুমকা।একবার ডেভিড গার্সিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলুম । দোল খেলেছিলুম আমরা সবাই । সুবো আচার্য দেওঘরে গিয়ে অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য হয়ে গেল । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, সুবো গিয়ে অনুকুল ঠাকুরকে বলেছিল, “আমাকে বাঁচান, আমি অধঃপতনের পথে চলে গেছি।” প্রদীপ চৌধুরী শুনে বললে, সেসব কিছু নয়, ওরা পারিবারিক স্তরে বামুন পুরুতের পরিবার । সুবো এখন বর্ধমানের অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমের প্রধান । সাধু হয়ে যাবার আগে লেখা সুবো আচার্যর ‘রিক্ত’ শিরোনামের কবিতা তুলে দিচ্ছি 

আমার যাত্রার আজ কেউ জেগে নেই, পাথুরে
জমিতে সূর্য্য ঢলে পড়ে, ছিলো কি শৈশব?
প্রত্যেকেই বড়ো দূর, মৃতপ্রায়, একা কিম্বা
                                      শূকর প্রচ্ছদের ভিতর ঢুকেছে

চতুদিকে আসন্ন রাত্রির ছায়া, নক্ষত্রের ষড়যন্ত্র, চাঁদের ইশারা,
মানুষও ফেলেছে দূরে তার নিজ বিভা, কবির প্রতিভা
ভয় পেয়ে সত্যের গা-থেকে মাংস খুবলে নিতে গিয়ে হাত সরায়
একশো দশ মাইল দূরে অপর যুবার নীচে তুমি শুয়ে হাসছো,
হাসো, গাও কিম্বা আলজিভ দিয়ে শীৎকার দাও,
                                                            তার সাথে পুনরাও শোও,

আমাদের প্রেম নেই, ভয় নেই, ব্যথা নেই, দুঃখ কষ্ট নেই,
লিঙ্গ তীব্র রেখেও বুঝতে পারি একদিন, এ-জীবন ছিলো
কি রকম আশ্চর্য্য সরল; ছিলো নাকি ? একদিন প্রেম ছিলো ?
ভালোবাসা ছিলো ? সেরকম নারী ছিলো ?
ভাবতেই চাঁদ ও নক্ষত্র কেউ চুরি করে নিয়ে যায় যেন
আমার চারিদিকে জেগে থাকে মাতৃ গর্ভের মতো মৌলি অন্ধকার-
পৃথিবীতে আর একবার জন্মের জন্য আমি রিক্ত হই।

ফালগুনী রায় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সুবিমল বসাকের ডাকে । ‘জেব্রা’ প্রথম সংখ্যা আর হাংরি  লিফলেটগুলো ফালগুনীকে টেনে এনেছিল সুবিমলের কাছে। ফালগুনীকে নিয়ে শেয়ালদা স্টেশানে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল সুবিমল।ফালগুনী সদ্য পাঠ-সমাপ্ত কবিতার গোছা থেকে একটি কবিতা দেয়, ।’জেব্রা’  দ্বিতীয় সংখ্যার প্রস্তুতি চলছিল, তাতে ওই কবিতা ছাপা হয়। পরে বাসুদেব দাশগুপ্ত ওর এক ফর্মার কবিতার বই ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ প্রকাশ করেছিল । ফালগুনীর মৃত্যুর পর সুবিমলের কাছে যে কবিতাগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে ‘ফালগুনী রায়সমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে দুই বাংলায়, বেশ কয়েকবার । ওর সব কবিতাই বিখ্যাত ।  ওর ‘এইখানে’ কবিতাটা তুলে দিচ্ছি : 

এইখানে সমুদ্র ঢুকে যায় নদীতে নক্ষত্র মেশে রৌদ্রে
এইখানে ট্রামের ঘন্ টিতে বাজে চলা ও থামার নির্দেশ
এইখানে দাঁড়িয়ে চার্মিনার ঠোঁটে আমি রক্তের হিম ও উষ্ণতা
ছুঁয়ে উঠে আসা কবিতার রহস্যময় পদধ্বনি শুনি— শুনি
কবিতার পাশে আত্মার খিস্তি ও চিৎকার এইখানে
অস্পষ্ট কু-আশার চাঁদ এইখানে ঝরে পড়ে গণিকার ঋতুস্রাবে

এইখানে ৩২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কোন গ্রীকবীর রমণ ও ধর্ষণের
সাধ ভুলে ইতিহাসে গেঁথে দ্যায় শৌর্য ও বীর্য এইখানে
বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীরের নরম স্বাদ ভুলে একটি মানবী থেকে মানবজাতির দিকে
চলে যায় চৈতন্যের ঊর্ধবাহু প্রেম—সর্বোপরি
ইতিহাস ধর্মচেতনার ওপর জেগে থাকে মানুষের উত্থিত পুরুষাঙ্গ এইখানে

এইখানে কবর থেকে উঠে আসা অতৃপ্ত প্রেমিকের কামগন্ধ
কয়েকলক্ষ উপহাসের মুখোমুখি বেড়ে ওঠে আমার উচ্চাশা এইখানে
প্রকৃত প্রশ্নিল চোখে চোখ পড়লে কুঁকড়ে যায় আমার হৃদপিণ্ড এইখানে
এইখানে সশ্রদ্ধ দৃষ্টির আড়ালে যাবার জন্য পা বাড়াতে হয়

আমি নারী মুখ দ্যাখার ইচ্ছায় মাইলের পর মাইল হেঁটে দেখি শুধু মাগীদের ভিড়
সাতাশ বছর –-একা  একা সাতাশ বছর বেক্তিগত বিছানায় শুয়ে দেখি
মেধাহীন ভবিষ্যৎ জরাগ্রস্ত স্নায়ুমণ্ডলীর পাশে কবিদের কবির কবিতা
চারিধারে ঢিবি দেওয়ালের নিরেট নিঃশক্ত অন্ধকার।

ফালগুনীর দিদি থাকতেন পাটনায় যেখানে ওর প্রেমিকার বিয়ে হয়েছিল । আমরা দুজনে নানা জায়গায় গিয়ে গাঁজার বরফি, শরবত খেতুম বা পাতা ফুঁকতুম । তখন সরকারি দোকানে এগুলো পাওয়া যেতো।

বেনারসের দুজন শিল্পী-লেখক আমার সূত্রে হাংরিতে যোগ দিয়েছিল । অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। করুণা একটা দারুন গদ্য দিয়েছিল বুলেটিনে, ‘জন্মমৃত্যু সম্পর্কে’ শিরোনামে

“আজ ভোর ৬.৪৫ মি. আমার একমাত্র ছেলে আরক মারা গেলো । ব্রংকোনিমোনিয়া । আমি ওকে একা নিয়ে চলে গেলাম নদীর ওপারে বালিয়াড়িতে । বসে বসে অনেক কিছু ভাবলাম । তারপর ওর গায়ের সঙ্গে ভারি পাথর বেঁধে মাঝগঙ্গায় ফেলে দিলাম । পাথর খুঁজতে প্রায় দুঘণ্টা লেগে গেলো ।বাড়ি ফিরে এসেছি । আমার বৌ ভীষণ কাঁদছে । মানুষের সেন্টিমেন্ট নষ্ট করার মতো আমার কাছে কিছুই নেই । আজ দুপুরে অফুরন্ত সময় ছিল । আমার জন্ম কাশীতে । বাবা তখন আই এন এতে নেতাজির গ্রুপে । তারপর পঁচিশ বচর যখন, বাবা আমায় নিয়ে যান রেংগুনে । আই এন এ ছেড়ে দিয়ে বাবা পুলিশে চাকরি নেন । রেংগুনে একনাগাড় প্রায় ১০ বছর । তারপর সাইরেন, ব্ল্যাকআউট, সংবাদপত্রের হেডলাইন, হাসপাতাল । জাহাজে চেপে বর্মা থেকে সোজা খিদিরপুর । খিদিরপুর থেকে আবার কাশী । জানতে পারলাম বাবা কোনো বার্মিজ মেয়েকে বিয়ে করেছেন । সেই থেকে সমাজের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে লড়াই ।  লেখাপড়া হলো না । ক্লাস টেনে পৌঁছে বাবার বাবার টাকা বন্ধ হয়ে গেল । তখন থেকেই আমি নেমে গেলাম । হেল্প ! হেল্প !! হেল্প !!!           

ছোটোবেলায় আঁকার ঝোঁক ছিল । ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম । ছবি আঁকতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে গেল ।  কাশীতে একটা ঘর ভাড়া করে নিজের স্টুডিও করলাম ।  ছবি দেখে লোকে পাগল বলতে লাগল । বাড়ির লোকে মা বোন সকলেই পাগল বলে বাড়ি থেকে বের করে দিলো ।            আমি বাড়ির বড়ো ছেলে । ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে একজন কায়স্হ মেয়েকে বিয়ে করলাম ।  অব্রাহ্মণ বলে বাড়িতে ঢুকতে পাই না ।           

 কেই নেই । কেউ নেই ।

শম্ভু রক্ষিত ‘ব্লুজ’ নামে একটা হাংরি পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করে হাওড়া থেকে । শম্ভু তখনকার লেটারপ্রেসে গিয়ে নিজেই কমপোজ করতো ।  হাংরির “জেব্রা” পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলুম, তার দ্বিতীয় সংখ্যায় শম্ভুর যে কবিতাটা প্রকাশিত হয়েছিল তার শিরোনাম ছিল “আমি স্বেচ্ছাচারী”, তাতে শম্ভু বলছে যে ও রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছেনি-শাবল চায়, আর হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে বাঘের মতন লাফিয়ে পড়বে — শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “আমি স্বেচ্ছাচারী” কবিতার অনেকদিন আগেই লিখেছিল শম্ভু। কবিতাটা এখানে দিলুম, লক্ষনীয় যে সেই সময়ের একরৈখিক কবিতার অনুশাসনকে শম্ভু ষাটের দশকে শুরুতেই অস্বীকার করেছিল : 

আমি স্বেচ্ছাচারী 

এইসব নারকেল পাতার চিরুনিরা, পেছন ফিরলে, এরাও ভয় দেখায়। 

কিছুই, এক মিনিট, কিছুই জানি না, সাম্যবাদী পার্লামেন্টে জনশ্রুতি সম্পর্কে বা। 

চণ্ডাল কুকুরদের আর্তনাদ আমাকে ঘিরে– এবং আমাকে আলবৎ জানতে হবে, আলবৎ আমাকে 

ডুবতে দিতে হবে, যেতে দিতে হবে যেখানে যেতে চাই না, পায়চারি করতে দিতে হবে। 

আমার গলা পরিষ্কার — আমি স্বেচ্ছাচারী – কাঁচের ফেনার মধ্যে চুল — স্পষ্ট করে কথা বলতে দিতে হবে 

আর কথাবার্তায় তেমন যদি না জমাতে পারি সেরেফ 

পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো — সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে। 

ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে। ঘামের জল ধুয়ে — শুদ্ধভাবে আমি সেলাম আলয়কুম জানিয়ে 

পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো ১ থেকে ২ থেকে ৩, ৪, ৫ গাছের পাতার মতো। রিরংসায়। 

মাটিতে অব্যর্থ ফাঁদ পেতে রেখে। রাস্তায়। ব্রিজের ফ্ল্যাটে। ট্রেনে, 

যে কোনো কিশোরীর দেহে। শেষ রাতে — পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে, কেবল স্হলভাগের 

হু হু করে জেটপ্লেনে আমি যেতে চাই যেখানে যাবো না, এর ভেতর দিয়ে 

ওর ভেতর দিয়ে — আর। হুম। একধরনের ছেনি-শাবল আমার চাই– 

যা কিছুটা অন্যরকম, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের নয় — ঠিক 

খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতো — রেডি — আমি বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ব। খবরদার। 


ইন্দিরা গান্ধির চাপানো এমারজেন্সির সময়ে জেলে পোরা হয়েছিল শম্ভু রক্ষিতকে, ওর জেলের স্মৃতিকথা পড়িনি, জানি না লিখেছে কিনা। বিনয় মজুমদার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সীমান্ত পেরিয়ে চলে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানে বিনয়কে তিন মাসের জন্য জেলে পোরা হয়েছিল। শম্ভু রক্ষিত আর জ্যোতির্ময় দত্ত আট মাস জেলে ছিল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে পুলিশ অফিসার ওদের ওপর দৈহিক অত্যাচার করেছিল তার নাম তারাপদ। অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত “ভায়োলেশান অফ ডেমোক্র্যাটিক রাইটস” এর তৃতীয় খণ্ডে লেখা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিত, জ্যোতির্ময় দত্ত আর প্রশান্ত বসুর ওপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার করেছিল, তারপর বিনা বিচারে তাদের আটমাস আটক রাখা হয়েছিল। গ্রেপ্তার করার সময়ে তাদের বাসস্হানের সমস্ত জিনিস পুলিশবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে লণ্ডভণ্ড করেছিল। জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়ি শম্ভু রক্ষিতের হাওড়ার ফ্ল্যাটের তুলনায় অভিজাত ছিল। জ্যোতির্ময় দত্তের মেয়ে সেই সময়ে পুলিশের আচরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়ে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছিল, তার হদিশ মেলে, কেননা গরিবের ওপর অত্যাচার করে পুলিশ যারপরনাই উল্লসিত হয়। শম্ভু রক্ষিতের তখনকার পোশাক যেমন ছিল, পরেও তেমনই জীর্ণ ও মলিন, পায়ে রবারের চটি। 

আমার সঙ্গে শম্ভু রক্ষিতের আবার দেখা হলো কবি দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুটিয়ারির বাড়িতে, তখনও পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি। আমি হুইস্কির একটা বড়ো বোতল নিয়ে গিয়েছিলুম। আমার “অ” বইটা উৎসর্গ করেছিলুম দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, সেটা দিতে গিয়েছিলুম, আর বইটা সেলিব্রেট করার জন্য হুইস্কি। কিছুক্ষণ পরে শম্ভু রক্ষিত এলো, দেবীপ্রসাদের কাছ থেকে কবিতা নেবার জন্য আর ওনাকে ‘মহাদিগন্ত’ দেবার জন্য, হাতে একগোছা প্রুফ– দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার।  কাঁচাপাকা কয়েক দিনের দাড়ি, মাথার সামনে দিকে টাক পড়ে গেছে, চোখের কোল বসে গেছে, হনু আর কন্ঠা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, রোগাটে হয়ে গেছে। শম্ভু রক্ষিত চলে যাচ্ছিল, আমি বললুম, কিছুক্ষণ থাকো, মদের বোতলটা ঝোলা থেকে বের করলুম। শম্ভুর মুখে ঔজ্বল্য ফুটে উঠলো। গেলাসের পর গেলাস খেয়ে  মাতাল হয়ে গেল শম্ভু। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন শম্ভুকে টালিগঞ্জ মেট্রোয় পৌঁছে দিতে।   ভূমেন্দ্র গুহ, আমার দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের পর যিনি আমার চিকিৎসা করেছিলেন, তিনি গিয়েছিলেন হলদিয়ার সুতাহাটার প্রত্যন্ত গ্রাম বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় শম্ভুর বাড়িতে, বেশ খানিকটা হাঁটা পথ। বলেছিলেন যে ঢুকেই দেখা যায় দেয়ালে বড়ো-বড়ো করে লেখা রয়েছে মহাপৃথিবী। ভাঙাচোরা চালা। নিজেই কোদাল চালিয়ে চাষবাস করে। ওর একমাত্র টেবিল ফ্যানটা চোরে তুলে নিয়ে চলে গেছে।  শম্ভুর শরীর অত্যন্ত খারাপ আর রোগ সারাবার টাকাকড়ি না থাকায় ভূমেন্দ্র গুহর উদ্যোগে কলকাতার একচল্লিশজন খ্যাতনামা পেইনটাররা, পরিতোষ সেন, যোগেন চৌধুরী, রবিন মন্ডল, তপন মিত্র আর বুদ্ধিজীবি কালীকৃষ্ণ গুহ, সন্দীপ রায় প্রমুখ শম্ভু রক্ষিতের সাহায্যার্থে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন, আর পেইনটিং বিক্রির টাকা শম্ভুকে দেয়া হয়েছিল। সে যাত্রা শম্ভু সেরে ওঠেন। শম্ভুর কবিতা ইংরেজি ও হিন্দিতে অনুদিত হয়েছে। আসলে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সামন্তবাদী ভুলভুলাইয়ার বাইরে সম্পূর্ণ বেপরোয়া না হলে নিজের যা ইচ্ছে লেখা যায় না, যা আমরা দেখেছি উইলিয়াম ব্লেক, আর্তুর র‌্যাঁবো, মালার্মের প্রথাবহির্ভূত কবিতার ক্ষেত্রে। শম্ভুর কবিতা পড়ে টের পাওয়া যায় যে ও কারোর তোয়াক্কা করে না, যেমন ইচ্ছে হয় তেমনভাবেই লেখে । আমি প্রতিষ্ঠান শব্দটা প্রয়োগ করলুম না। প্রতিষ্ঠান ভাবকল্পটা এমন ঘেঁটে গেছে যে বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতির সামন্তবাদী ক্ষমতার পীঠস্হানগুলোর কুকর্ম চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যায় । 

যাঁরা আমাদের সংবিধান লিখেছিলেন তাঁরা কেউই অনুমান করতে পারেননি যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ ওই সংবিধানেই ঘুমিয়ে আছে, আর সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। ক্ষমতাবানদের জুতো সাফ করবে বা জুতোর ফিতে বেঁধে দেবে আমলারা, সরকারি চাকুরেকে চটিপেটা করে ফলাও করে সেকথা বলে বেড়াবেন সাংসদ। হাজার-হাজার গরিবের টাকা মেরে লোপাট করে দেয়া হবে, আর জেলফেরত রাজনৈতিক আসামীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে, জেল থেকে বেরিয়ে দু-আঙুল তুলে ভিক্টরি সাইন দেখাবে, বুড়ো-বুড়িরা তাঁদের থেকে কম বয়সী নেতা-নেত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদের পচাইতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি যে ভাবে পচেছে, দিকে-দিকে গজিয়ে উঠেছে গ্যাঙলর্ডরা আর তাদের জিহুজুরিরা। 

তিন : মনোমালিন্যের শুরু
‘এই সময়’ পত্রিকার  আগস্ট ২০১৫ সংখ্যায় বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী হাংরিদের মনোমালিন্য নিয়ে এই আহ্লাদের গদ্যটা লিখেছিলেন :‘২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, সকাল ৭.৩০ মিনিট৷ সুভাষ এবং আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি, বাইরে গিয়ে চা খাব, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল৷ দরজা-খোলা মাত্র ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ৮/১০ জন লোক৷ মেঝের বিছানায় জুতা সহ দাঁড়িয়ে গেল ওরা৷ টেনে হিঁচড়ে ফেলতে লাগল জিনিসপত্র, বইপত্র৷ হাতে সার্চ ওয়ারেন্ট ধরিয়ে বলল, তারা লালবাজার থেকে আসছে৷’- হাংরি জেনারেশন আন্দোলন, শৈলেশ্বর ঘোষ গ্রেফতার হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ৷ পরে দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী ও প্রদীপ চৌধুরী৷ অভিযোগ? সাহিত্য অকাদেমী প্রকাশিত ‘হাংরি জেনারেশনের স্রষ্টাদের ক্ষুধার্ত সংকলন’-এর ভূমিকায় শৈলেশ্বর ঘোষ জানাচ্ছেন- ‘অশ্লীল সাহিত্য রচনা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’৷ স্বাধীনতার পর বাংলা সাহিত্যে যৌনতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ন্যাকামির এটিই কি প্রথম বহিঃপ্রকাশ? অতঃপর জীবন গিয়াছে চলে একান্ন বছরের পার৷ রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের স্বভাবজাত উজবুকপনা থেকেই থাকে৷ কিন্তু স্বাধীন দেশের সতেরো বছর বয়স হতেই কবিতা নিয়ে এহেন রাষ্ট্রীয় শিরঃপীড়া এবং গোদা টাইপের দাদাগিরি আমাদের মতো আজকালকার ছোঁড়াদের চোখে যদি কিঞ্চিত্‍ অলীক ঠেকে, সেই গুস্তাকিটুকু নির্ঘাত্‍ মাফ করে দেবেন এই কুনাট্যের দুর্ভাগা কুশীলবগণ৷ বলছি না যে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু এখন স্তিমিত৷ বরং খবরদারি বেড়েই চলেছে৷ প্রতি মূহুর্তে৷ কিন্তু মনে হয় না এখন আর ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়’ (ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা, শৈলেশ্বর ঘোষ) বা ‘আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও’ (প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার, মলয় রায়চৌধুরী) লেখার জন্য কাউকে কাঠগড়ায় উঠতে হবে৷ যাঁরা ক-অক্ষরে কাম (এবং অবশ্যই গোমাংস) খুঁজে পান, তাঁদের সাম্প্রতিক বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও সরকারি গা-জোয়ারির পরিসরটি আপাতত অন্য রকম৷ অশ্লীলতা নয়, ‘ভাবাবেগ’ নিয়েই ইদানীং যতেক পাঁয়তাড়া৷ আর বাংলায় কেউ কিসু পড়লে তো মাথাব্যথা! অতএব, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন এবং তার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক মাতব্বরি ও পুলিশি চোখরাঙানি একটি বিশেষ সময়ের ফসল৷ যার আদলটি ঠাহর করতে হলে ইতিহাসের দ্বারস্থ হওয়া আবশ্যিক৷ কম্মোটি যদিও নেহাত্‍ই সহজ নয়৷ হাংরি আন্দোলনকারীরা পরবর্তী সময়ে যে ইতিহাস লিখেছেন, সেগুলি উত্‍সাহী অথচ নিরপেক্ষ পাঠকের জন্য অসহনীয় রকমের কোন্দলাকীর্ণ এবং লেঙ্গিলাঞ্ছিত৷ মলয় রায়চৌধুরী ও সম্প্রদায় বনাম শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুবো-সুভাষ-প্রদীপ দ্বন্দ্বের আগ্রাসী শব্দবাণগুলির ভিড় থেকে সত্যটিকে খুঁজে বের করা দুরূহ৷ আন্দোলনের পিতৃত্বের দাবি নিয়ে তাঁদের অভিযোগ ও প্রতি-অভিযোগের অবিরত পালাগান বামপন্থীদের মতাদর্শগত কুঁদুলেপনাকেও লজ্জায় ফেলবে৷ তবুও অপাঠবিদ্ধ পাঠকের খাতিরে একটি সংক্ষিপ্ত আখ্যান পেশ করা জরুরি৷ শৈলেশ্বর ঘোষ জানিয়েছেন হাংরি জেনারেশন শব্দটির সূত্রপাত করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়৷ ১৯৬২ সালে ‘সম্প্রতি’ নামের একটি পত্রিকায় বিনয় মজুমদারের কবিতার সমালোচনায় শক্তি লেখেন- ‘বিদেশে সাহিত্য কেন্দ্রে যে সব আন্দোলন বর্তমানে হচ্ছে, কোনটি বীট জেনারেশন কোনটি এ্যাংরী বা সোবিয়েত রাশিয়াতেও সমপর্যায়ী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বাংলা দেশেও কোন অনুক্ত বা অপরিষ্কার আন্দোলন ঘটে গিয়ে থাকে তবে তা আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশে ক্ষুধা সংক্রান্ত আন্দোলন হওয়াই সম্ভব’৷ আন্দোলনের সঙ্গে শক্তির সম্পর্কের এটিই শুরু এবং এটিই প্রায় শেষ৷ এক-দু’বছরের মধ্যেই উভয় পক্ষের সম্পর্ক দাঁড়াবে আদায়-কাঁচকলায়৷ হাংরি আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব যাঁরা, তাঁরা ইতিমধ্যেই একক ভাবে লেখালেখি করছিলেন৷ ‘উপদ্রুত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বাসুদেব দাশগুন্তের ‘রন্ধনশালা’, যেটি সন্দেহাতীত ভাবে বিশ শতকের সেরা বাংলা ছোট গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম৷ ‘এষণা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’৷ কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘শয়তানের মুখ’৷ মূলত বিচ্ছিন্ন ইশতেহার এবং বুলেটিনের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল এই সমান্তরাল ধারার লেখালেখি৷ এগুলি সংবদ্ধ করা হয় ১৯৬৪ সালে৷ প্রকাশিত হয় হাংরি জেনারেশন সঙ্কলন৷ লেখকগণ- সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুন্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, উত্পলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরী ও সুভাষ ঘোষ৷ লেখা ছিল, এটি ‘মাতৃহারা মাতৃতান্ত্রিক মাতৃহন্তারক কবিদের কবিতা সংকলন’৷ অতঃপর পুলিশি হানা এবং কাঠগড়ায় লেখককুল৷ ঘটনাটির অভিঘাত ছিল ব্যাপক এবং আন্তর্জাতিক৷ মার্কিন মুলুক থেকে উড়ে আসেন ‘টাইম’ পত্রিকার সাংবাদিক লুই কার৷ প্রতিবেদনে লেখা হয়: ‘Last week, in a land that has become so straitly laced that its movie heroines must burst into song rather than be kissed, five scruffy young poets were hauled into Calcutta’s Bankshall Court for publishing works that would have melted even Vatsyayana’s pen. The Hungry Generation had arrived.’ বঙ্গীয় প্রতিক্রিয়াগুলিও কৌতূহলোদ্দীপক| সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- ‘সাহিত্যের নামে এরা নোংরামি করছে’৷জ্যোতির্ময় দত্ত- ‘ভাবতে দুঃখ হয় যে, ফরাসি দেশে যা একশ তিরিশ বছর আগে ঘটে গেছে তা এখন আমাদের দেশে বৈপ্লবিক বিবেচিত হয়৷তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়- ‘এমন এক দলের আবির্ভাব হয়েছে যারা নিজেদের নাম দিয়েছেন ক্ষুত্কাতর সম্প্রদায়৷ এঁদের লেখার কোন দৃষ্টান্ত দেয়া আমার পক্ষে সাধ্যাতীত৷’সন্তোষকুমার ঘোষ- ‘ক্ষুধিত (কী না পেয়ে জানিনে) লেখক যা লিখতে চেয়ে পারছেন না, খালি আগাছার চাষ বাড়াচ্ছেন, বয়স্ক সমরেশ যেন তাঁদের দেখিয়ে দিতেই ‘বিবর’ লিখলেন৷’পরবর্তী সময়ে এই গোষ্ঠীতে যোগ দেন অরুণেশ ঘোষ, সমীরন ঘোষ, অবনী ধর ইত্যাদি এবং অবশ্যই ফালগুনি রায়৷ অন্য দিকে অমিতাভ দাশগুন্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায় প্রমুখ অ-ক্ষুধার্ত লেখক নিছক নিন্দাবাদের পরিবর্তে প্রয়াসী হন হাংরি লেখকদের সাহিত্যকাণ্ডের বস্তুনিষ্ট মূল্যায়নে৷ সর্বোপরি, এই আন্দোলনই শঙ্খ ঘোষকে প্রণোদিত করে একটি কিংবদন্তি নিবন্ধ রচনায়- ‘শব্দ আর সত্য’৷ ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকায় শঙ্খ ঘোষ একটি সাক্ষাত্‍কারে নাকচ করেন অশ্লীলতার অভিযোগটি৷ অরুণেশ ঘোষকে বলেন- ‘সত্যিকারের পাঠকের কাছে এই ‘অশ্লীলতা’ কথাটির কোনও মানে হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না৷ আপাত-শ্লীলতার মধ্যে দিয়েও বহু লেখা ব্যর্থ হয়, আপাত-অশ্লীলতার মধ্য দিয়েও বহু লেখা উত্তীর্ণ হয়৷ প্রশ্ন এই ব্যর্থতা আর উত্তীর্ণতার, শ্লীলতা-অশ্লীলতার নয়৷কিন্তু শঙ্খ ঘোষও লক্ষ করেন হাংরি ‘চেতনায় নৈরাজ্যবাদের একটা লালন’৷ দেবেশ রায়ও নকশালবাদী নৈরাজ্যপন্থার সঙ্গে হাংরি ভাবনার সরাসরি তুলনা করেন৷ যে প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করেন প্রদীপ চৌধুরী তাঁর ‘শব্দ ও গোপন সত্য (অথবা কলিংবেল যাদের আতঙ্কিত করে)’ নিবন্ধে- ‘সন্দেহ নেই, সমাজ ও সভ্যতার বিষাক্ত সাইরেন আমাদের হাড়ও কাঁপিয়ে তোলে,… কিন্তু আপনি কী করে ভুলে গেলেন এরই সঙ্গে মাখামাখি আমাদের ব্যক্তিগত সম ও অসমকামী নানা ধরনের ভিশান, গতব্যক্তি ঐশী জীবনের বিষণ্ণতা, আনন্দ ও সন্ত্রাস-স্বপ্ন৷ এটাকে কোনো একমুখী রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে আপনি কিছুতেই ঢোকাতে পারেন না৷’ শুধু লেখাই নয়, হাংরি কবি-গল্পকারদের দৈনন্দিন জীবনচর্যাও গতানুগতিক সামাজিকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিল অবশ্যই৷ ভিখিরি ও বেশ্যাদের সঙ্গে যাপিত জীবন, বোহেমিয়ানার ট্র্যাডিশনাল পীঠস্থান শ্মশান-বেশ্যালয়-শুঁড়িখানায় নেশাতুর বিচরণ এবং খালাসিটোলায় জীবনানন্দ জন্মোত্‍সব পালনের মাধ্যমে তাঁরা মত্ত হস্তীবত্‍ বঙ্গের সুললিত পদ্মবনে আলোড়নও তুলেছিলেন৷ কিন্তু এটুকুই সব? তাঁরা তো রাষ্ট্রীয় ‘বিপ্লব চেয়ে দোষী’ ছিলেন না৷ ধূসরিমার অর্ধশত রূপ নিয়ে লাফালাফির যুগে বিতর্কটিকে সামান্য অলীক মনে হলে কি কিছু ভুল থেকে যাবে?

একটু পড়াশুনা করলে একজন আলোচক জানতে পারবেন যে একটা আন্দোলনে প্রচুর যুবক সমবেত হলে স্বাভাবিকভাবেই মতবিরোধ হয় । ডাডা, সুররিয়ালিস্ট, বিট, সিমবলিজম, প্রগতিশীল লেখক, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, নিম সাহিত্য, ইতালির ভবিষ্যবাদ, ধ্বংসকালীন, নতুন কবিতা ইত্যাদি আন্দোলনেও মনোমালিন্য হয়েছে ; সুররিয়ালিস্টরা তো প্যারিসের রাস্তায় হাতাহাতিও করেছে।

হাংরিদের মধ্যেও পরস্পরের সঙ্গে মনোমালিন্য আরম্ভ হলো । হাংরি আন্দোলনের তৃতীয় বছরে, ১৯৬৩ সালে সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল  কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দেবী রায়, “ইনি আমাদের আন্দোলনে যোগ দিতে চাইছেন, লেখা এনেছেন সঙ্গে, নিয়ে নেওয়া যাক” । সুভাষ ঘোষের ছোট্টো গদ্যটা নিয়ে নিলুম, সেটাই হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত সুভাষের প্রথম লেখা । আমি তখন অফিসের কাজে তিন মাসের জন্যে কলকাতায়, থাকি ডালহাউসি স্কোয়ারে অফিসের গেস্ট হাউসে, খাওয়া-থাকা অফিসেরই, ট্র্যাভেলিং অ্যালাউন্স যা পাই তা দিয়ে হাংরি বুলেটিন বের করার কোনো অসুবিধা নেই ।গেলুম টালা ব্রিজের তলায় পাশের রাস্তায় সুভাষের ভাড়া-করা বাসায়, বলল, আরেকজনের সঙ্গে থাকে, তার নাম শৈলেশ্বর ঘোষ, দুজনেই উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় এসেছে, পড়াশুনা আর  চাকরি-বাকরির ধান্দায় । “এষণা” নামে একটা চটি পত্রিকা দিল সুভাষ, সম্পাদক সতীন্দ্র ভৌমিক, তাতে শৈলেশ্বের ঘোষের “ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা” পড়ে বললুম, এটা ইংরেজিতে অনুবাদ করব । সুভাষ বলল, কালকে ও কফিহাউসে আসবে তোমায় লেখা দিতে, তখন পরিচয় হবে । পরের দিন শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে লেখা নিলুম । আমার অনুবাদ করা কবিতা আর যে কবিতা শৈলেশ্বর দিল, এই দুটিই কেবল হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । আমি বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষ দুজনেরই ফোটো নিয়ে কোলাঝ তৈরি করেছিলুম । সুভাষ বলেছিল, “তুমি পারশিয়ালিটি করছ, বাসুদেবের কোলাঝটা আমার হবার কথা ছিল, আমি কপালে বিকৃত শিশুর লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছি।” বাসুদেবের কোলাঝটা বাসুদেব যত্ন করে রেখেছিল, সুভাষ ওর কোলাঝটা কি করল জানি না । দুটো কোলাঝের ব্লক পাটনাতেই করিয়েছিলুম ; কলকাতা পুলিশ যখন পাটনায় আমাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল তখন ব্লকের দোকানে ঢুঁ মেরেছিল । ‘আর্তনাদ’ নামে যে পত্রিকা সুভাষরা প্রকাশ করেছিল তার ব্লকও আমার তৈরি করা ।

বাসুদেব দাশগুপ্ত সম্পর্কে সুবো আচার্য লিখলো, “বামপন্হী আদর্শ বেছে নেয়ার পর থেকে সে যা লিখেছে তাতে একজন স্টাইলিশ বামপন্হী মনে হয় এবং এও মনে হয় ঐ আদর্শ তাঁর মধ্যে খুব ভালোভাবে কেটে বসে যায়নি। আসলে অহং-এর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক, এক ধরণের নার্সিসাস কমপ্লেক্স তার মধ্যে কাজ করছে, এক ধরণের আত্মগর্বও তার মধ্যে দেখতে পাই।”

হাংরিতে বন্ধুরা যোগ দেয়ায়, আর বিনয় মজুমদারের বই রিভিউ করতে গিয়ে হাংরির আওয়াজ তোলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও চটে গিয়েছিলেন।  । তাঁকে নিরস্ত করার জন্য দাদার এই চিঠি সুনীলকে:

 ২০/৫/১৯৬৩

সুনীল,   

তোর দীর্ঘ চিঠি পেলাম। তোর মানসিক অবস্হা জেনে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। শক্তিকে আমরাই এত বড় করে তুলেছি। এর মূল দায়িত্ব তোর, আমার ও মলয়ের। এবং এখনও আমার প্রতিটি বন্ধুকে বড় করেই তুলতে চাই আমি। শক্তিকে লেখার জন্য প্রাথমিক উৎসাহ তুইই দিয়েছিলি। বারেবারে বাহবা দিয়ে ‘বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি’ একথা তুইই প্রথম তুলেছিস। অর্থাৎ শুধু এই যে আজ শক্তি সেকথা নিজে বলছে। চাইবাসায় থাকতেই তোকে বাদ দিয়ে শিল্পের সিংহাসনে বসার একটা ঘোরতর প্ল্যান উৎপল ও শক্তি অনেকদিন আগেই করেছিল। আমাকেও উপস্থিত থাকতে হয়েছিল এই সব আলোচনায়। পত্রিকা বের করার প্ল্যান তখনই হয়। আন্দোলনের ব্যাপারটাও মলয় বারবার তাগাদা দিতে থাকে। আমি বরাবরই কৃত্তিবাসকে ছাড়তে পারব না জানিয়েছি। নানান সেন্টিমেন্টাল কারণে কৃত্তিবাসকে আমি আমার নিজের পত্রিকা মনে করি। অনেকের মতন ‘সুনীলের কাগজ’ মনে করা সম্ভব নয়। শক্তি ও উৎপল তোকে বাদ দিয়ে ‘জেব্রা’ বার করতে পারবে কিনা মনে হয় না। অন্তত মলয় এটা হতে দেবে না। তাছাড়া সমস্ত নীচতার মধ্যেও সূক্ষ্ম বোধশক্তির দংশন শক্তিও এড়াতে পারবে না। আমাদের মধ্যে একটা ভাঙন গড়ে উঠবে এ আমার বিশ্বাস হয় না। হলে শক্তিরই প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। টাকাপয়সার দরকার ওর শিল্পের জন্যও, শীলাও আছে, দার্শনিক ঋণও প্রয়োজন, সমীর ও মলয়কে ও সেইসঙ্গে সুনীলকে বাদ দিলে যে মারাত্মক অবস্হায় ও পড়বে তা ও জানে। আমাকে শক্তি লিখেছে ‘জেব্রা’য় তোর লেখা থাকছে। বেরোতে নাকি মাস দুয়েক দেরি। বরং উৎপলই একটু বেশিমাত্রায় তোর বিরোধী। হয়তো ঈর্ষা, হয়তো অন্য কোনো কারণ। উৎপলকে খুশি রাখতে গিয়ে হয়তো এই সব জটিলতায় শক্তি বাধ্য হচ্ছে। মলয়ের অভিমান এই যে তুই ওকে বিন্দুমাত্র স্নেহ করিস না; নিতান্ত ছেলেমানুষী। সেবার শীলা পাটনায় ভর্তি হতে গেলে শক্তিকে পাটনায় নিয়ে যাই আমি। সেখানে মলয় ওকে এই আন্দোলন সম্পর্কে Convince করে। ছোটোগল্পে লিখেছে যে গল্পটা, তারই প্লট ও প্ল্যান মলয় শক্তিকে দেয় (ক্ষুৎকাতর আক্রমণ)। ঠিক হয় যে কলকাতায় গিয়ে পুস্তিকা বের করে ব্যাপারটা আরম্ভ হবে। আমরা সবাই থাকবো। তুইও নিশ্চয়ই । আমাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করেই শক্তি কলকাতায় ফিরেই ব্যাপারটা আরম্ভ করে দেয়। এদিকে ট্রেনিং-এ চলে আসতে হয় আমাকে। মলয় পাটনায়। কলকাতায় শক্তি একা নানানভাবে নিজের স্বপক্ষে সিংহাসন গড়ে তোলে ক্রমে। তুই ব্যাপারটায় যোগ না দেওয়ায়, যেটা ভুল-বোঝাবুঝিতে পেছিয়ে গেছে, আজ অবস্থা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা মলয়ও বলেছে। মলয় এখন যে কোনো রকমে তোকে চায় । ফলে হয়তো তোকে এই ধরনের আক্রমণ চালাচ্ছে। অদ্ভুত সব জটিলতা। ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা কবিতা সংকলন বার করতে চায় ও। আমাকে লিখেছে তোকে পদ্য পাঠাতে বলতে। ব্যাপারটা নিজেই সম্পাদনা করতে চায়, শক্তির জটিলতা এড়িয়ে। সন্দীপনও বোধহয় একটা গদ্য সংকলন বের করবে। আমি ‘চিহ্ণ’, ‘ছোটগল্প’ ও ‘জেব্রা’র জন্য ছোটগল্প পাঠিয়েছি ওদেরই অনুরোধে।

খ্যাতির প্রতি শক্তির প্রলোভন চিরদিনই আছে। ওর পরিবেশ অনুযায়ী হয়তো এটা স্বাভাবিক। আসলে মানুষ না হয়েই শিল্পী হওয়া যায়, এটাই যতো গণ্ডগোলের। ছোটোলোক, নীচ ও চোরও শিল্পী হতে পারে। শিল্পী হওয়ার জন্য বরং এসব ব্যাপার সাহায্যই করে। ফলে বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব নিয়ে গণ্ডোগোল বাধে।

এক মুহূর্তেই হয়তো শক্তির সমস্ত দম্ভ, অহংকার, নীচতা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বাংলাদেশের কাছে। এর উপযুক্ত নজিরের অভাব নেই আমার কাছে; কিন্তু শক্তির বিরুদ্ধে বা কারোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন। আমার কতকগুলো নিজস্ব আদর্শ আছে, তা ভুল বা ঠিক হোক আমি তা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। প্রতিক্রিয়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।

কৃত্তিবাসের জন্যও তোর যে আদর্শ, তাকে ধরে রাখতে হবে তোকে, আশপাশের কারো চিৎকারে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই। কৃত্তিবাস আমরা বের করে যাবোই। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসি। শক্তি শিল্পী হিসেবে অনেক বড়ো ও মানুষের চেয়ে শিল্পকে অনেক অনেক বড়ো মনে করে। আমি শিল্পকে পৃথক মনে করতে পারি না।   

প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক এবং উচিতও। শক্তি বা উৎপলের মতো কবিতা না লিখলে কবি নয়, এসব ছেলেমানুষীতে আমি বিশ্বাস করি না। শক্তির কিছু-কিছু কবিতা যেমন আমাকে উন্মত্ত  বিহ্বল করে, অলোকরঞ্জনের কোনো কোনো কবিতায় আমি তেমনই প্রস্ফূট হয়ে যাই । সেই মুহূর্তে অলোকরঞ্জনকে আমার সমস্ত স্বত্তার মালিক মনে হয় । কী করে তাকে অস্বীকার করি? তেমনই হয়তো এমনও কেউ আছেন যাঁর তারাপদর পদ্যে আরোগ্য হয়। এসব শ্রেষ্ঠত্ব স্থির করার আমরা কে? যারা কবিতা পড়েন তাদের ওপরই, সময়ের ওপর, এসব ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ঢাক ঢোল নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কি যে সুখ আমি বুঝি না। এসব চালিয়ে গেলে শক্তি অনেক বড়ো ভুল করবে। যতো বড়ো হতে পারে ও তাকে নিজ হাতে খর্ব করবে। হয়তো অ্যালেনের বিশ্বজোড়া নাম দেখে ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে। একথা শক্তি কয়েকবার বলেওছে আমাকে

জুনে পনেরো তারিখে এখান থেকে রওনা হয়ে সতেরো তারিখে চাইবাসা পৌঁছোব। তুই আয় না তখন। শক্তিকেও আসতে বলব। একসঙ্গে তিনজন থাকলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে আপনা থেকেই। চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে। বেলাও বেশ সুস্হ হয়ে উঠেছে।

চিঠি দিস । হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধেই না হয় কয়েকটা প্রচণ্ড গদ্য ও পদ্য লেখ। হাংরি জেনারেশনের একটা বিশেষ পুস্তিকায় বের করব আমি; মলয়ও রাজি হবে । আসলে এই সব আন্দোলনের চেয়ে হৃদয়ের আন্দোলনটাই আগে দরকার।

সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ হয়তো এভাবেই আত্মসাৎ করে যেতে হবে আমাকে। তবু এবং হয়তো এই জন্যেই শিল্পের চেয়ে আমি মানুষকে পৃথক করতে পারি না, বড়ো মনে করার বা ছোট মনে করার কারণ খুঁজে পাই না।

সমীর রায়চৌধুরী 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদার পোস্টিঙের সব শহরেই গেছেন, একা বা সস্ত্রীক, পাটনা, ধানবাদ, চাইবাসা, ডালটনগঞ্জ, মুজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা ইত্যাদি,  কিন্তু  ওনাদের বন্ধুত্ব সেই কলেজের দিনগুলোর মতন আর হয়নি, মূলত হাংরি আন্দোলনের কারণে । দাদা মারা যাবার পর সুনীল গঙ্গেপাধ্যায় দাদার সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত গদ্য লিখেছিলেন–

“একটি চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, আমাকে লেখা বিভিন্ন সময়ে অনেকের লেখা চিঠি। তাতে ছাপা হচ্ছে সমীর রায়চৌধুরীর কয়েকটি চিঠি। আমার স্মৃতিশক্তি ইদানিং দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ওই চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু আমার মনে ছিল না। সেই সব চিঠিতে বিধৃত হয়েছে হাংরি জেনারেশন গড়ার ইতিহাস আর কৃত্তিবাসের সঙ্গে সমীর রায়চৌধুরীর সম্পর্ক। আমার মনে পড়ে গেল, একসময় আমি কৃত্তিবাস নিয়ে বেশ সংকটে পড়েছিলাম। তখন আমার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল সমীর। সে আমাকে বুঝিয়েছিল যে কিছুতেই কৃত্তিবাস বন্ধ করা যাবে না। সে সব রকম সাহায্য করতেই প্রস্তুত, এমনকী টাকা পয়সা দিয়েও।

সমীর অন্য অনেক সময়েও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। একই কলেজে পড়ার সুবাদে বন্ধুত্ব, যদিও আমাদের বিষয় ছিল আলাদা। সমীরের জীববিজ্ঞান আর আমার অর্থনীতি। কলেজে তো অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়, কিন্তু কারুর কারুর সঙ্গে সে-বন্ধুত্ব খুব গাঢ় হয়ে ওঠে। গ্র্যাজুয়েশানের পর সমীর বেশ তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়েছিল। আমি বেশ কয়েক বছর বেকার অবস্হায় টিউশানি-মিউশানি করে কাটিয়েছি। সেই সময় সমীর কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে কৃত্তিবাসের খানিকটা টানাপোড়েন তো ছিলই, সমীর সেটা মেলাবার অনেক চেষ্টা করেছে। ওর ছোটোভাই মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে মামলা দায়ের করে, তাতে, হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মলয়ের পক্ষে প্রথম সাক্ষী দিয়েছিলুম আমি।

বিহারে চাকরিরত হলেও সমীর কলকাতা থেকে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করতে চেয়েছিল। তার প্রথম বই আমার ‘একা এবং কয়েকজন’। তখন আমাকে কবি হিসাবে ক’জনই বা চেনে। তবু আমার কবিতার বই প্রকাশ করায় সমীরের অনেকখানি ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছিল। সমীরের কাব্যগ্রন্থ বেরুল, ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’। নামটা বোধহয় আমারই দেওয়া। প্রেসেও ছোটাছুটি করেছি আমি। সে সময়ে সমীর চমৎকার রোমান্টিক কবিতা লিখত। পরে তার কবিতা একটা অন্যদিকে বাঁক নেয়। ওই সংস্থা থেকে সমীরের আরেকটি বই বেরিয়েছিল, ‘আমার ভিয়েৎনাম’। পরে সেই প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। লেখালিখি ছাড়াও সমীরের সঙ্গে আমার একটা গভীর নৈকট্যের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, যে সম্পর্কের মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন থাকে না। আমি জানতাম এই দীর্ঘকায়, সুঠাম চেহারার বন্ধুটির ওপর সব সময় নির্ভর করা যায়। আমার দিক থেকে ওকে কখন কী সাহায্য করেছি, তা বলতে পারি না। চাকরিসূত্রে সমীর যখন যেখানে বদলি হয়েছে, আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। যেমন ডালটনগঞ্জ, ভাগলপুর, দুমকা, মুজফফরপুর, চাইবাসা, দ্বারভাঙ্গা এবং ওদের নিজস্ব বাড়ি পাটনায়। সেই সময়কার আড্ডার উজ্জ্বল মধুর স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। বিয়ের সময়, সমীর বেশ একটা কৌতুক করেছিল। আমরা জানতুম, চাইবাসার বেলার সঙ্গেই ওর ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু সমীর রটিয়ে দিল, ও অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করছে। খুবই উদ্বিগ্ন অবস্থায় আমরা কয়েকজন বিবাহবাসরে যোগ দিতে গেলাম চাইবাসায়। সমীরকে কিছু জিগ্যেস করলে সে মুচকি হাসে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নববধুর মুখ দেখে আমার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। লাবণ্যময়ী বেলা পরে সমীরের সব বন্ধুকেই আপন করে নিয়েছিল। স্বাতীর সঙ্গে আমার বিয়ে উপলক্ষ্যেও সমীর আর বেলা দুজনে এসে উপস্থিত হয়েছিল আমাদের দমদমের বাড়িতে। বউভাতের রাতে নববধূকে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, তা আমার জানা ছিল না। জানব কী করে, আমি যে কাঠ বাঙাল। সমীরই প্রায় শেষ মুহূর্তে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ায় দু-জনে বেরিয়ে কিনে আনলাম একটা লেডিজ ঘড়ি, খুব সম্ভবত সমীরই সেটার দাম দিয়েছিল। তারপর এই দুই পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়।

সমীরের সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় প্রথমে আমিই করিয়ে দিই। তারপর শক্তি-সমীরের চাইবাসা পর্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। বিহারে থাকলেও সমীর মাঝে মাঝেই কলকাতা এসে অন্য সব লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।

হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হবার পর ওদের সঙ্গে আমার খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়। আমার ‘আনন্দবাজারে’ যোগ দেওয়া ও কবিতা ছাড়াও প্রচুর গদ্য লেখালিখি ওরা অনেকেই পছন্দ করেনি, শুনেছি। সেটা তো এস্টাব্লিশমেন্টের খপ্পরে পড়া, এবং কথাটা ঠিকই। কয়েক বছর পর শক্তিও অবশ্য ‘আনন্দবাজার’ সংস্থায় যোগ দিয়েছিল।

রাজনীতির মতন সাহিত্য জগতেও নীতিগত আপত্তি ও দূরত্ব থাকতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সেই দূরত্ব সৃষ্টি করার পক্ষপাতী আমি কোনোদিনই নই। হাংরি জেনারেশন পর্ব চুকে গেলে শক্তির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতায় সামান্য সাময়িক ফাটল খুব সহজেই জোড়া লেগে যায়। যেমন সন্দীপনেরও। কিন্তু কেউ কেউ দূরত্বটাই পছন্দ করে। সমীরের সঙ্গে বিচ্ছেদটাই আমার বেশি মনে লাগে। সমীরের লেখা, সাহিত্য সম্পর্কে ওর নানারকম পরিকল্পনা আমার বরাবরই পছন্দ ছিল। সবচেয়ে বেশি আপন মনে করতাম মানুষ সমীরকে।

জীবন কত নিষ্ঠুর। জীবনের গতি কোন সময় কোন বাঁক নেবে, তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। এক সময়কার সেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আড্ডা, পানাহার, পরস্পরের স্বপ্ন বিনিময়, এসবই কখন যেন ধূসর হয়ে যায়। বিহার ছেড়ে সমীর এখন কলকাতারই উপকন্ঠে বাড়ি করে সপরিবারে চলে এসেছে। অথচ ওর সঙ্গে আমার আর প্রায় দেখাই হয় না। কেন কে জানে! হয়তো আমার দিক থেকেই অনেক ত্রুটি আছে।

একটা সাম্প্রতিক ঘটনা বলি। চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে স্বাতী আর আমি গেছি একটা চিকিৎসালয়ে। বেশ ভিড়। তারই মধ্যে স্বাতী আঙুল দেখিয়ে বলল, ওইখানে সমীর বসে আছে না? কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই সমীর আর বেলা। কুশল বিনিময় হল। ছেলেমেয়েদের কথা হল। এক সময় আমি সমীরকে বললাম, কানাইলাল জানার বাড়িতে যে একটা উৎসব হল কদিন আগে, শুনেছিলাম, তোরও সেখানে যাবার কথা ছিল। তুই গেলি না কেন? তোর বাড়ির তো কাছেই।

সমীর আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি যাইনি, যদি তুই আমাকে সেখানে চিনতে না পারিস?

আমার বুকে যেন একটা বুলেট বিদ্ধ হল। এরকম নিষ্ঠুর কথা আমি বহুদিন শুনিনি। যে বন্ধুর সঙ্গে আমার তুই-তুই সম্পর্ক, যার সঙ্গে আমার কখনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি, কোনোদিন তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি, তার সঙ্গে দেখা হলে আমি চিনতে পারব না? এমন অভিযোগ শোনার জন্য কী দোষ বা অন্যায় করেছি আমি, তা জানি না। এরপর কয়েকদিন বেশ বিমর্ষ হয়েছিলাম। মনে হল, জীবনের কাছ থেকে এরকম আকস্মিক আঘাত আরও কত পেতে হবে কে জানে!

হয়তো সমীরও কোনো গভীর অভিমানবোধ থেকে এই কথা বলেছিল। আমি নিজেই নিশ্চয়ই সেরকম কোনো কারণ ঘটিয়েছি, কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গও আমার জানা নেই।”

নব্বুই দশকে কলকাতার বাঁশদ্রোণীতে এসে দাদা “হাওয়া ৪৯” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ আরম্ভ করেন। তিনি সুনীল, সন্দীপন, শক্তি, উৎপল, শরৎ প্রমুখ সবার সঙ্গে দেখা করে লেখা দেবার আহ্বান জানান। একমাত্র উৎপল ছাড়া আর কেউ সাড়া দেননি। দাদা অত্যন্ত দুঃখিত হন তাঁর নিকটবন্ধু সুনীলের ব্যবহারে। প্রায় দুই বছর দাদা কৃত্তিবাস পত্রিকাকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু যখন দাদা এবং অন্যান্য হাংরিরা গ্রেফতার হন ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি  সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। দাদা এই আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ভূমেন্দ্র গুহের মাধ্যমে দাদাকে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে, সবাই যখন অকাদেমি পুরস্কারের জন্য তাঁকে খোশামোদ করছে তখন দাদা তাঁর বাড়িতে একবারের জন্যও কেন যান না। হাংরি  মামলায় কলকাতায় দাদার যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তখন সুনীল একবারের জন্যও বলেননি তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতে। দাদার গল্পগ্রন্থ “খুল যা সিমসিম” নিয়ে যখন কলকাতার তরুণ লেখকমহলে আলোচনা আরম্ভ হয়েছিল গল্পের একটি নবদিগন্ত খুলে দেবার জন্য, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটি সম্পর্কে কোথাও এক লাইনও লেখেননি।  বিদেশে গিয়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বার্ধক্যেও হাংরির বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, অ্যালেন গিন্সবার্গকে বুঝিয়েছেন যাতে আন্দোলনকে কোনো গুরুত্ব দেয়া না হয়, দাদা তা জানতে পেরেছেন বিভিন্ন বিদেশী গবেষকদের কাছ থেকে। অমিতাভ ঘোষের বিদেশিনী স্ত্রী যখন “এ ব্লু হ্যাণ্ড” নামে একটি বই গিন্সবার্গকে নিয়ে লিখছিলেন তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে বিপথগামী করেন, যে কারণে বইটিতে সত্য তথ্য নেই বললেই চলে। শেষ বয়সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মরক্ষা করতে চেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি তাঁর ‘কিন্নর কিন্নরী’ উপন্যাসে। অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসে সমীর রায়চৌধুরীকে গুরুত্ব দেননি, যখন কিনা ঘটনাবলী চাইবাসায় ঘটেছিল।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় হাংরিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে সুনীল আমেরিকা থেকে তাঁকে একটি চিঠিতে হাংরি ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন । এই চিঠি পাবার পর সন্দীপন হাংরি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন ।

  আমাকে আমেরিকা থেকে যে চিঠিটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাকে হুমকি বলাই ভালো। কিন্তু আমার যে চিঠির জবাবে এই চিঠিটা লিখেছেন, মজার ব্যাপার, সেটা ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বই থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন । সুনীলের চিঠিটা এইরকম

আয়ওয়া
১০ জুন ১৯৬৪
মলয়,
তুমি কলকাতায় কী সব কাণ্ডের বড়াই করে চিঠি লিখেছ জানি না। কী কান্ড করছ ? আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ-কেউ ভাসাভাসা লিখেছে বটে কফিহাউসে কী সব গণ্ডোগোলের কথা। কিছু লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো ? এ-সব কিছু না — আমার ওতে কোনো মাথাব্যথা নেই। যত খুশি আন্দোলন করে যেতে পারো — বাংলা কবিতার ওতে কিছু আসে যায় না। মনে হয় খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার। পেতেও পারো বলা যায় না। আমি এসব আন্দোলন কখনো করিনি, নিজের হৃৎস্পন্দন নিয়ে আমি এতই ব্যস্ত। তবে, একথা ঠিক, কলকাতা শহরটা আমার। ফিরে গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। তোমরা তার একচুলও বদলাতে পারবে না। আমার বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই সম্রাট। তোমাকে ভয় করতুম, যদি তোমার মধ্যে এখন পর্যন্ত একটুও জেল্লা দেখতে পেতুম। আমার চেয়ে কম বয়সিদের মধ্যে একমাত্র তন্ময় দত্ত এসেছিল, আমার চেয়ে অন্তত ছ বছরের ছোটো— কিন্তু জীবনানন্দের পর অত শক্তিশালী কবি এদেশে আর কেউ আসেনি। প্রচণ্ড অভিমান করে ও চলে গেছে। সেজন্যে এখনও আমি অপরের হয়ে অনুতাপ করি। আমি নিজে তো এখনও কিছুই লিখিনি, লেখার তোড়জোড় করছি মাত্র, কিন্তু তোমার মতো কবিতাকে কমার্শিয়াল করার কথা আমার কখনো মাথায় আসেনি। বালজাকের মতো আমি আমার ভোকাবুলারি আলাদা করে নিয়েছি কবিতা ওগদ্যে। তোমার প্রতি আমার যতই স্নেহ থাক মলয়, কিন্তু তোমার কবিতা সম্বন্ধে এখনো কোনোরকম উৎসাহ আমার মনে জাগেনি। প্রতীক্ষা করে আছি অবশ্য।অনেকের ধারণা যে পরবর্তি তরুণ জেনারেশনের কবিদের হাতে না রাখলে সাহিত্যে খ্যাতি টেকে না। সে জন্যে আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ-কেউ একসময় তোমাদের মুরুব্বি হয়েছিল। আমি ওসব গ্রাহ্য করি না। নিজের পায়ে আমার যথেষ্ট জোর আছে, এমনকী একা দাঁড়াবার। আমার কথা হল : যে যে বন্ধু আছ, কাছে এসো, যে ভালো কবিতা লেখো কাছে এসো — যে যে বন্ধু নও, বাজে কবিতা লেখো, দূর হয়ে যাও কাছ থেকে। বয়সের ব্যবধান তোলা আমার কাছে অত্যন্ত ভালগার লাগে

চালিয়ে যাও ও সব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি। আমার ওসব পড়তে কিংবা দেখতে মজাই লাগে। দূর থেকে। সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে, কী জানি। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ। আমি তাই-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে। সুতরাং তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা, বেশি খোঁচাখুঁচি না করা। নইলে, হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না। জীবনে ওরকম উত্তেজিত হয়েছি পৌনে একবার। গতবছর। দুএকজন বন্ধুবান্ধব ও-দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সেক্ষমতা রাখি, জেনে রেখো। তবে এখনও ইচ্ছে নেই ও খেলাঘর ভাঙার।আমার এক বন্ধু জানিয়েছে যে তোমরা নাকি আমার কোনো-কোনো চিঠির অংশবিশেষ ছাপিয়েছ/ পত্রসাহিত্য-ফাহিত্য করার জন্য আমি চিঠি লিখি না। আমার চিঠি নেহাত কেজো কথা। অবশ্য লুকোবারও কিছু নেই। কিন্তু আগে-পরের কথা বাদ দিয়ে, ডটডট মেরে চালাকির জন্য আমার কোনো চিঠি কেউ ছাপিয়ে থাকে— তবে আড়াই মাস পরে ফিরে তার কান ধরে দুই থাপ্পড় লাগাব বলে দিয়ো/ আশা করি শারীরিক ভালো আছ। আমার ভালোবাসা নিও।
সুনীলদা

শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে গেল, মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চাপে আর সংবাদপত্র মালিকের শর্ত পূরণ করার জন্য । মুখোশ, কার্ড, শাদা-কাগজ, জুতোর বাক্স ইত্যাদি কাজগুলোয় আমার সঙ্গে দেবী রায় আর  সুবিমল বসাকও থাকত । আমাকে কফিহাউসে না পেয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দলবল নিয়ে কফিহাউসের সামনে সুবিমল বসাককে মারধর করার জন্য ঘিরে ধরেছিল, পেটানোর জন্যে কফিহাউসের সিঁড়ির তলায় পান-সিগারেটের দোকানে লোহার রড লুকিয়ে রেখেছিল । সুবিমল বসাকের চেহারা তখন ছিল কুস্তিগিরের, ওর হিন্দি গালমন্দের হুংকারে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দলবল নিয়ে পালায়  । 

শৈলেশ্বর ঘোষ অসাধারণ কবিতা লিখতো, লিখে গেছে ।   আমি ওর কবিতা ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে বুলেটিনে ছাপিয়েছিলুম । মূল কবিতাটা তুলে দিচ্ছি এখানে : 

এক

বৃক্ষাকাশে কবিতা টাঙাবো না আমরা, শোবার ঘরেই গাছ সঞ্চার হয়েছে,

গাছেতে ভূমধ্যাকর্ষণ হয় চোরাচালান বোঝে— শোবার ঘরেই চলে

অহরহ বিক্ষোভ-আক্রমণ; গাছের সঙ্গেই সুদীর্ঘকাল ফলে ওঠে

ভালবাসাবাসি— কলকাতায় দশবছর খারিজ নীলাম

দরসরবরাহ নিদ্রাপ্রেমের মূল্যবৃদ্ধি— ফাটকায় হাতবদল

দিনমান হৃদয় চিৎ— দিনমানভর তেত্রিশ হিজরের গর্ভ হয়

দিনমানধরে হে ঘোড়া ভৌতিক ক্ষুধা কবিতার ।

দুই

বহুকাল তেত্রিশ ভূতের সাথে প্রেম-সূত্রপাত বহুকাল

কোলকাতাবাংলায় খাতাপত্রে আক্ষেপ—

বহুকালধর্মলোল রাজপথে হে ঘোড়া কোথায় গেলে

একশ বালিকার বুকে তৃণগুল্ম খেয়ে কবিতা ফলন হয় !

তিন

একশ ভাদ্রবধূ সাধ খায়, কবিতারই শুধু রক্তপাত

দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছি আমরা পেচ্ছাবখানায়

কোলকাতা গলে যায়— হৃদয়ে সঙ্গমসূত্রউৎপাত ইত্যাদি

ধোয়ামোছা হয়— ময়দা বাণিজ্য করি না হে আমরা

একশ শয়তান মিলে দিনমান ভূত হয়, কলকারখানা প্রসব করে,

একশ শয়তান মিলে কুলবধূর গর্ভপাত করে—

একশ শয়তানের বিবিধ উৎপাত তাজ্জব হয়

সারাদিনমান কবিতার হে ঘোড়া এ কি ঋতুস্রাব !

চার

ছাব্বিশ বছরে খুব শোক হয় ছাব্বিশ বছর যেন তো নয়

ছাব্বিশ বছর নিদ্রারস পচে তবু দেখা নাই

হা লৌকিক হা অলৌকিক হা নিষ্ঠুর তবু দেখা নাই !

ছাব্বিশ বছরে কুমির ফসল নিয়ে যায়— জলপাহাড়

ফেটে যায় যানবাহন আত্মসাৎ ঘটে— ছাব্বিশ বছর

ক্ষুধাতৃষ্ণাহীন বসে আছি জুয়াচোর বেশ্যার মন্দিরে

ছাব্বিশ বছরের উপরই বলাৎকার ছাব্বিশ বছর

রক্তেই ক্রমসূত্রপাত ঘটে ভূতপ্রেত আসে

ছাব্বিশটি একান্নবর্তী বছর কোনোক্রমেই যেন নয়

হে ঘোড়া নিষ্ঠুর ছাব্বিশ বছর কেন দেখা নাই !

পাঁচ

কোন একদিন অবাধ সংকেত বিনিময়ে

ভালবাসার নৌকায় বাদাম পরানো হয়েছিল—

২৬ বছর গুণটানা ব্যবসায়ে জেগে বসে আছি

ঘোড়া তুমি জান পরিচয় তাদের

কেননা তোমারই খুরের মারে মুছে যায় কালির ছাপ

তোমারই প্রত্যাশাময় মুখের কাছে ভেসে ওঠে,

কোনো একদিন উঠেছিল ঘাসের চুমায় বিস্মিত হৃদয়—

কোনো একদিন স্ত্রীপুরুষের চোখে মুহূর্তে লাগান হয়েছিল বলে

আজও সেই মানুষের হল না প্রস্তুতি সময়

বহুবার বহুপথে হয়েছে ফেরা তবু হায়

২৬ বাঘের মত অতিহিংস্র গর্জন শেখেনি কোন পথে

ফিরে আসা হয়— অবাধ সংকেতবিনিময়ে একদিন হয়েছিল

দেখা মার্বেল পাহাড়ের সাথে— মাদিমদ্দ দুই

বেহদ্দ বেড়ালের থাবা জানতে পেরেছিল,

পাখীই কেবল ফিরে আসে ঘরে— বারংবার ২৬ বছর

দূর থেকে ছুটে আসে পশমের বল বিছানার কাছে

দেখা যায় সমুদ্রময় গড়ে উঠছে ত্রস্ত পোতাশ্রয়

হে ঘোড়া প্রত্যাশালিপ্ত সিঁড়ির উপরেই দেখা হবে ।

ছয়

হে ঘোড়া তোমার হৃদয়েই ছিল ভালবাসা

মেঘময় বিছানো ছিল পরমায়ুর খোল

ঘনিষ্ট চুমায় ছিঁড়ে যায় ব্লাউজশায়া ডুবোজাহাজ

ব্যভিচারবোধ ভরে তোলে ইতিহাসআদালত—

জানা গেছে বয়সকালে আমাদের ঊরুদেশময়

ভৌতিক সমুদ্র জাগে— জানা গেছে জুয়ার টেবিলেই

হয়েছিল যুদ্ধের জ্ঞান— জানা গেছে জন্মের নির্বাচন

হয়নি সফল— জানা গেছে জাহাজের পরাশ্রয়ীটান

গোয়েন্দারও কাপড় খুলে দ্যায়— হে ঘোড়া

তোমার নিশান আমার মুখের উপর চুম্বনতিথির

মত উড়ে আসে— রক্তের অভিমান বেশ্যার পেটে

ছেলে জন্মায়— চারদিকে দন্তোদ্গম উৎসবের আলো

খুরশব্দ লিখা টেবিলে তবু সহচর জেগে বসে আছি ।

সাত

তিন ঘণ্টা বসে আছি বেদনাপ্রধান চিঠি পকেটে

কোলকাতা চৌরঙ্গী লিখা এমন নিস্তব্ধ বন্দুক হাতে

কতদিন ঘুমজাগা প্রহরায় কাটাই— দশমনুমেণ্ট

ময়দান পকেটমারে এক একর জমির দাম !

তিন ঘণ্টা সবুজপল্লী অনুধাবনীয়তার হাতে মার খায়

হাঁস তবু উড়িয়েছিলাম গায়ে পড়া আধুনিক-জামা

পাড়াগাঁর স্ত্রীলোকের স্বামীসম্ভাষণ পূর্ণিমাগভীরে

হাজার শিশুর হাসিখেলা আক্রমণ কোলকাতা

তিনঘণ্টায় সাতসমুদ্রতল, মনুমেন্টময়দান

মেঘের পেটে যায়, বেদনাপ্রধান চিঠি পকেটে

এক একর জমির বিক্ষোভ দিনমান— বন্দুক

হাতে রাতজাগাপ্রহরায় হে ঘোড়া কতদিন কাটাই !

আট

তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়

হে ঘোড়া, কোলকাতায় তিনগেলাস স্বাস্থ্যসুধাপান

পরিত্রাণহীনতা হাসে পুরুতের নামাবলীগীতা

ধাতুধর্ম সাতবার গড়াগড়ি খায়— তিন বিধবা

দক্ষিণসাগরে বায়ুসেবী বেড়াতে যায়—

তেত্রিশ দেবতা ফলভোগী— চাষা মাশুল গুণে দেয়

পুণ্যচোর সদর দরজায়— গৃহস্থের মেয়েরা সব

আইবুড়ো ঘুম জেগে সারারাত খিল তুলে দেয়

পুরাণগীতা পড়ে কুলধর্ম রক্ষা শেখে, ঘোড়া তুমি

রেশমগুটিপোকায় প্রেম দিলে হৃদয় কোথায় !

গীতাধর্ম পাঠ শুনে কুকুরের অণ্ডকোষে ধাতুমুদ্রা জমে

ঘোড়া তুমি তেত্রিশ কোটি পুণ্যের গায়

নামাবলী লেখ হৃদয় কোথায় ?

তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্যধর্মহীন

রহস্য তলায় হে ঘোড়া

পরিবহনযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে আছে !

চার : কেষ্টবিষ্টুদের নালিশ

কল্লোল যুগ বইতে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত লালবাজারের পাল্লায় পড়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন, আমাদের তা থেকে আরেকটু বেশি কড়কানোর ব্যাপার ছিল কেননা তারপরেই শুরু হবে নকশাল আন্দোলন । নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা অচিন্ত্য সেনগুপ্ত এইভাবে দিয়েছেন:

“পরদিন সকালে মুরলীধর বসু আর শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় লালবাজারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভীতভয়সূদন শূলপাণির নামগান করতে-করতে।

প্রথমেই এক হোমরাচোমরার সঙ্গে দেখা। বাঙালি, কিন্তু বাংলাতে যে কথা কইছেন এ নিতান্ত কৃপাপরবশ হয়ে।

দেখতে তো সুখী-সজ্জনের মতই মনে হচ্ছে। আপনাদের এ কাজ?

পড়েছেন আপনি?

Darn it—আমি পড়ব ও সব ন্যাস্টি স্নাং? কোনো রেসপেকটেবল লোক বাংলা পড়ে?

তা তো ঠিকই। তবে আমাদেরটাও যদি না পড়তেন–

আমরা পড়েছি নাকি গায়ে পড়ে। আমাদেরকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পড়িয়ে ছেড়েছে। আপনাদেরই বন্ধু মশাই। আপনাদেরই এক গোত্র।

কে? কারা?

সাহিত্যজগতের সব শূর-বীর, ধন-রত্ন—এক কথায় সব কেষ্টবিষ্টু। তাদের কথা কি ফেলতে পারি? নইলে এ সব দিকে নজর দেবার আমাদের ফুরসৎ কই? বোমা-বারুদ ধরব, না, ধরব এসব কাগজের ঠোঙা?

পুলিশপুঙ্গব ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। পরে মনে করলেন এ ভঙ্গিটা যথার্থ হচ্ছে না। পরমুহূর্তেই মেঘগম্ভীর হলেন। বললেন, রবিঠাকুর শরৎ চাটুজ্জে নরেশ সেন চারু বাঁড়য্যে—কাউকে ছাড়বনা মশাই। আপনাদের কেসটার নিষ্পত্তি হয়ে গেলেই ও-সব বড় দিকে ধাওয়া করব। তখন দেখবেন–

বিনয়ে বিগলিত হবার মতন কথা। গদগদ ভাষে বলেন মুরলীধর :

এ তো অতি উত্তম কথা। পিছুতে-পিছুতে একেবারে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত। তবে দয়া করে ঐ বড় দিক থেকে সুরু করলেই কি ঠিক হতনা?

না। প্রবলপ্রবর হুঙ্কার ছাড়লেন : গোড়াতে এই এটা একটা টেস্ট কেস হয়ে যাক।

রাঘববোয়াল ছেড়ে দিয়ে চিরকালই কি চুনোপুঁটিদের দিকে নজর? গদির অধিপতিদের ছেড়ে সামান্য মুদি-মনিহারি?

চালান হয়ে গেলেন পুলিশ-োকোর্টে।

সতীপ্রসাদ সেন—আমাদের গোরাবাবু-পুলিশ-কোটের উদীয়মান উকিল-জামিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। মোকদ্দমা জোড়াবাগান কোর্টে স্থানান্তরিত হল। তারিখ পড়ল শুনানির।

এখন কি করা?

প্রভাবান্বিত বন্ধু ছিল কেউ মুরলীধরের। তিনি এগিয়ে এলেন। বললেন, বলো তো, তারক সাধুকে গিয়ে ধরি। তারক যখন তখন নিশ্চয়ই ত্রাণ করে দেবেন। ত্রাহি মাং মধুসূদন না বলে ত্রাহি মাং তারকব্রহ্মন বলতে নিশ্চয়ই কাজ হবে।

মুরলীধর হাসলেন। বললেন, না, তেমন কিছুর দরকার নেই।

তা হলে কি করবে? এ সব বড় নোংরা ব্যাপার। আর্টের বিচার আর আদালতের বিচার এক নাও হতে পারে। আর যদি কনভিকশান হয়ে যায় তা হলে শাস্তি তো হবেই, উপরন্তু তোমার ইস্কুলের কাজটি যাবে।

তা জানি। তবু—থাক। মুরলীধর অবিচলিত রইলেন। বললেন, সাহিত্যকে ভালবাসি; পূজা করি সেবা করি সাহিত্যের। জীবন নিয়েই সাহিত্য-সমগ্র, অখণ্ড জীবন। তাকে বাদ দিয়ে জীবনবাদী হই কি করে? সু আর কু দুইই বাস করে পাশাশাশি। কে যে কী এই নিয়ে তর্ক। সত্য কতদূর পর্যন্ত সুন্দর, আর সুন্দর কতক্ষণ পর্যন্ত সত্য এই নিয়ে ঝগড়া। প্রুডারি আর পর্নোগ্রাফি দুটোকেই ঘৃণা করি। সত্যের থেকে নিই সাহস আর সুন্দরের থেকে নিই সীমাবোধ-আমরা স্রষ্টা, আমরা সমাধিসিদ্ধ।

ভদ্রলোক কেটে পড়লেন।

ঠিক হল লড়া হবেনা মামলা। না, কোনো তদবির-তালাস নয়, নয় ছুটোছুটি-হয়রানি। শুধু একটা স্টেটমেন্ট দাখিল করে দিয়ে চুপ করে থাকা। ফলাফল যা হবার তা হোক।

গেলেন ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তর কাছে। একে সার্থকনামা উকিল, তার উপরে সাহিত্যিক, সর্বোপরি অতি-আধুনিক সাহিত্যের পরাক্রান্ত পরিপোষক। অভিযুক্ত লেখা দুটো মন দিয়ে পড়লেন অনেকক্ষণ। বললেন, নট-গিলটি প্লিড করুন।

যতদূর মনে পড়ে, চিত্রবহার দুটি পরিচ্ছেদ নিয়ে নালিশ হয়েছিল। এক যৌবনবেদনা, দুই নরকের দ্বার। আর শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহের গোটাটাই।

সবচেয়ে আশ্চর্য, চিত্রবহকে প্রশংসা করেছিল শনিবারের চিঠি। এমন কি, তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিল।

এই ভূতের-মুখে-রাম-নামের কারণ আছে। সুরেশবাবু মোহিতলালের বন্ধু। আর চিত্রবহ মোহিতলালের সুপারিশেই ছাপা হয় কালি-কলমে।

শনিবারের চিঠিতে চিত্রবহা সম্বন্ধে লেখা হয় :

..লেখক মানবজীবনের ভালো-মন্দ সুন্দর-কুৎসিত সকল দিকের মধ্য দিয়া একটা চরিত্রের বিকাশ ও জীবনের পরিণাম চিত্রিত করিয়াছেন। জীবনকে যদি কেহ সমগ্রভাবে দেখিবার চেষ্টা করেন তবে কিছুই বাদ দিবার প্রয়োজন হয়না। কারণ তাহা হইলে তাহার সৰ্বাংশের একটা সামঞ্জস্য ধরা পড়ে। কু ও সু দুই মিলিয়া একটি অখণ্ড রাগিনীর সৃষ্টি করে, তাহা morale নয়, immoraleও নয়—আরও বড়, আরও রহস্যময়।…

চমৎকার সুস্থ মানুরের মত কথা। ঋদ্ধিবাচন করতে জানে তাহলে শনিবারের চিঠি! তা জানে বৈকি। দলের হলে বা দরকার হলে করতে হয় বৈকি সুখ্যাতি। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।

নরেশচন্দ্র স্টেটমেন্টের খসড়া করে দিলেন। বললেন, প্রত্যেকে একখানা করে কপি কোর্টে পেশ করে দিন।

তথাস্তু। কিন্তু উকিলের দল ছাড়েন। বলে, ফাইট করুন। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মার খাবেন কেন?

বুঝবেনা কিছুতেই, উলটে বোঝাবে। ব্যাপারটা বুঝুন। এ ছেলেখেলা নয়, জরিমানা ছেড়ে জেল হয়ে যেতে পারে। ফরোয়ার্ডে না খেলুন গোলে গিয়ে দাঁড়ান। ফাঁকা গোলে বল মেরে পুলিশ জিতে যাবে এক শটে?

মহা বিড়ম্বনা। এক দিকে সমালোচক, অন্য দিকে পুলিশ, মাঝখানে উকিল। যেন একদিকে শেয়ালকুল অন্য দিকে বাবলা, মধ্যস্থলে খেজুর।

মুরলীধর তবু নড়েন না।

এর মশাই কোনো মানেই হয়না। হয় স্রেফ apologise করুন, আর না-হয় আমাদের লড়তে দিন। ফি-র ভয় করছেন, এক পয়সাও ফি চাইনা আমরা। সাহিত্যের জন্যে এ আমাদের labour of love।

মনে-মনে হাসলেন মুরলীধর। বললেন, ধন্যবাদ।

ভিড় ঠেলে আদালত-ঘরে ঢুকলেন তিনজনে। সার্জেন্ট আর লালপাগড়ি, গাঁটকাটা আর পকেটমার, চোর আর জুয়াড়ী, বেশ্যা আর গুণ্ডা, বাউণ্ডুলে আর ভবঘুরে। তারই পাশে প্রকাশক আর সম্পাদক, আর সাহিত্যিক।

ঢুকলেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। কটা ছেঁড়া মামলার পর ডাক পড়ল কালি-কলমের।

কে জানে কেন, কাঠগড়ায় পাঠালেন না আসামীদের। চেয়ারে বসতে সংকেত করলেন।

এলেন মহামান্য পি-পি, হাতে একখণ্ড বাঁধানো কালি-কলম। অভিযুক্ত অংশবিশেষ নীল পেন্সিলে মোটা করে দাগানো। বইখানা যে তাকে সরবরাহ করেছে সে যে ভিতরের লোক তাতে সন্দেহ কি।

যারা আমাদের মতের ও পথের বিরোধী, অথবা ভিন্নপন্থী ও ভিন্নমত, তাদের অভ্যুদয় দেখলে আমাদের মন সংকুচিত বা অপ্রমুতি হয়। সেটা মনের আময়, অশুদ্ধতা। মনের সেই অপবিত্রতা দূর করবার জন্যে ভিন্নপন্থীদের পুণ্যাংশ চিন্তা করে মনে মুদিতা-ভাব আনা দরকার। পুষ্পহার দুজনকেই প্রসন্ন করে, যে ধারণ করে আর যে ঘ্রাণ নেয়। তেমনি তোমার অর্জিত পুণ্যের সৌরভে আমিও প্রমুদিত হচ্ছি। এই ভাবটিই। বিশুদ্ধ ভাব।

কিন্তু এ কি সহজ সাধনা? সাহিত্যিক হিসেবে যার আকাঙ্ক্ষিত যশ হলনা সে কি পারে পরের সাহিত্যধর্মে হৃদয়ে অনুমোদনভাব পোষণ করতে?

পি-পি বক্তৃতার পিপে খুললেন। এরা সমাজের কলঙ্ক, দেশের শত্রু, রাষ্ট্রের আবর্জনা। এদেরকে আর এখন নুন খাইয়ে মারা যাবেনা, যদি আইনে থাকত, লৌহশলাকায় বিদ্ধ করতে হত সর্বাঙ্গে।

আসামীদের পক্ষে কি বক্তব্য আছে? কিছু নয়, শুধু এই বিবৃতিপত্র। শুধু বাক্য থাকলেই কাব্য হয়না। বক্তৃতা দিয়ে রস বোঝানো যায়না অরসিককে।

সেই নামহীন উকিল তবু নাছোড়বান্দা। সে একটা বক্তৃতা ঝাড়বেই আসামীপক্ষে। বিনা পয়সায় এমন সুযোগ বুঝি আর তার মিলবেনা জীবনে।

আমাদের পক্ষে কোনো উকিল নেই। বললেন মুরলীধর : একমাত্র ভবিষ্যৎই আমাদের উকিল।

ম্যাজিষ্ট্রেট উকিলকে বসতে বললেন।

তারিখ পালটে তারিখ পড়তে লাগল। শেষে এল রায়-প্রকাশের দিন।

আদালতের বারান্দায় দুই বন্ধু প্রতীক্ষা করে আছে। শৈলজানন্দ আর মুরলীধর। সাহিত্য-বিচারে কী দণ্ড নির্ধারিত হয় তাদের! দারিদ্র আর প্রত্যাখ্যানের পর আর কী লাঞ্ছনা!

কি হবে কে জানে। শুষ্ক মুখে হাসল শৈলজা।

কি আবার হবে। বড়জোর ফাইন হবে। মুরলীধর উড়িয়ে দিলেন কথাটা।

শুধু ফাইনও যদি হয়, তাও দিতে পারবনা।

অগত্যা ওদের অতিথিই না হয় হওয়া যাবে দিন কতকের জন্যে। তাই বা মন্দ কি! মুরলীধর হাসলেন : গল্পলেখার নতুন খোরাক পাবে।

সেই লাভ। সান্ত্বনা পেল শৈলজা।

দুপুরের পর রায় বেরুল। পি-পির সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের আখ্যান-ব্যাখ্যান বিশেষ কাজে লাগেনি ম্যাজিস্ট্রেটের। আসামীদের তিনি benefit of doubt দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।

হাংরিদের লেখাও খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পুলিশকে পড়ানো হচ্ছিল । পুলিশের বক্তব্যও এক :সাহিত্যজগতের সব শূর-বীর, ধন-রত্ন—এক কথায় সব কেষ্টবিষ্টু। তাদের কথা কি ফেলতে পারি? নইলে এ সব দিকে নজর দেবার আমাদের ফুরসৎ কই? বোমা-বারুদ ধরব, না, ধরব এসব কাগজের ঠোঙা?” আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস হতে পারে তার আঁচ কফিহাউসে ছড়িয়ে পড়েছিল আর তা আমাকে লেখা দেবী রায়ের এই চিঠি থেকে টের পাওয়া যায় 

সকালে, বাড়িতে
২২/৬/১৯৬৪

মলয়,
তুমি-আমি নাকি কলকাতায় অ্যারেস্ট হয়ে গেছি। চতুর্দিকে গুজব। কয়েকজন চেনা, হাফচেনার সঙ্গে দেখা হলে অবাক চোখে তাকাচ্ছে; ভাবখানা এই, ‘কখন ছাড়া পেলে’। আমার তো এখন একতারা নিয়ে বাউল হয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কলকাতায়। সবাই তালে আছে, ‘বাঘে ছুঁইয়ে দেওয়ার’, পর্নোগ্রাফি প্রমাণ করার। সুবিমলকে মে সে কে একজন বলেছে, ‘দেখব কী করে ‘হাংরি জেনারেশন’ বের হয়। সমীর রায়কে টেলিফোন করে ‘আমাদের দাদারা’ বাণী দেওয়ার তালে ছিল; কিন্তু বুঝে গেছে সমীর খচ্চর ছেলে, শালাদের কোঁচা খুলে নেবে। সমীরদার কী খবর ? এদিকে পারিজা খচে লাল। আমরা কেন গনদা পরতিকা দিয়েছি ইত্যাদি… শৈলেশ্বর বালুরঘাট থেকে ফিরেছে, দেখা করেনি, চিঠিও দেয়নি…ডাকে পাঠিয়েছি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। শৈলেশ্বররা লেখে এক, করে এক, বলে এক, ভাবে আরেক, ছোঃ: ‘এষণা’-র ব্যাপারটা জেনে নিও। চিঠি দিও। লালমোহন বলছিল, ‘ছোটোগল্প’ বেরোবে।
দেবী রায়

নালিশ ঠুকেছিল কলকাতার কেষ্টবিষ্টুরা, দুটো নাম জানতে পেরেছিলুম, সন্তোষকুমার ঘোষ আর আবু সয়ীদ আইয়ুব । কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামের সচিব এ. বি. শাহ মুম্বাই থেকে কলকাতায় এসে দেখা করে পুলিশের ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে । আমাকে চিঠিতে লিখে জানায়, “I met the Deputy Commissioner of Police the day after we met at the office of Radical Humanist at Calcutta. I was told that they would not have liked to bother themselves with the Hungry Generation but for the fact that a number of citizens to whom the writings of your group were made available, insisted on some action being taken.”

আবু সয়ীদ আইয়ুব কতো চটেছিল তা অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা  এই চিঠিতে স্পষ্ট: 

Dear Mr Ginsberg,

I am amazed to get your  pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with the Communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate did not, however, surprise me; for I never thought the Congress had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeois’ or ‘respectable’.  If any known Indian literature or intellectual comes under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of any kind have taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertizing leaflets and printed letters abusing distinguished people in filthy and obscene language ( I hope you agree that the word ‘Fuck’ is obscene and ‘Bastard’ at least in the sentence “Fuck the bastards of the Gangshalik School of Poetry’, they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avant-garde exhibition  ! You may think it your duty to promote in the name of Cultural Freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.  It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now ) thus giving the publicity and some public sympathy—publicity is precisely what they want to gain through their pranks. I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik Poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language —- a language of which you choose to remain totally ignorant. With all good wishes in spite of  our grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.

Yours Sincerely

Abu Sayeed Ayyub

আবু সায়ীদ আইয়ুব গিন্সবার্গকে লিখে জানাচ্ছে যে হাংরিদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে । বস্তুত পুলিশ তখন মামলা সাজাচ্ছে আর কাউকেই তখনও ছাড়া হয়নি । আইয়ুব-এর চিঠির প্রেক্ষিতে বিদেশি ও অবাঙালি কবিদের চিঠি পড়া যাক:

Allen Ginsberg, 704 East, 5th Street, New York, 28 September, 1964

Dear Malay,

I saw clippings from BLITZ, Sept 19, 1964 p6 and also I think Calcutta STATESMAN 17 September 1964 that you were arrested as well as Samir and two boys named Ghosh whom I don’t know, for your HUNGRY GENERATION manifestoes. Are these the same as were printed in the issue of KULCHUR#15? As soon as I read about it, I racked my brain about what I could do to help, and so today I wrote a whole bunch of letters to the following:-1 )A.S.Raman, Editor, Illustrated Weekly, Dr. Dadabhai Naoroji Road, Bombay. 2 ) Sharad Deora, Editor,Gyanodaya, 18 Brabourne Road, Calcutta. 3 ) Abu Sayeed Ayub, Editor, Quest ( sent a message to him indirectly), and member of Indian Congress for Cultural Freedom. 4 ) Shyam Lall, Editor, Times of India, New Delhi. 5) Khushwant Singh, novelist and member of Congress for Cultural Freedom, 49 East Sujan Singh Road, New Delhi.

I also wrote to Jyoti Dutta and phoned Lita Hornick of KULCHUR. I asked them, the Indians above all, what they could do to help you, suggested they activate the congress for Cultural Freedom as this sort of thing is the proper activity of the Congress and Quest magazine, and told them that the manifestoes were printed here in CITY LIGHTS JOURNAL and KULCHUR, and were not obscene. So the whole mess was scandalous bureaucratic illiteracy. Please if you need literary help or advice do try to contact these people for support. And in addition perhaps ask for advice/help from Mrs. Pupul Jayakar, 130 Sundar Nagar, New Delhi—she was our protectress in India, we stayed with her, she’s a friend of Indira Gandhi and others. I also notified Bonnie Crown here in New York, the Asia Society, 112E 64 Street, NYC—she commissioned poetry to be translated by Sunil and others and that pack of poems plus your rhythms etc. will be printed together by CITY LIGHTS. She can send you a letter on her official stationery saying your manifestos are known, published and respected in the US and not considered obscene. I will also enquire about Mr. S.K.Roy, the Indian Consul General here in New York who I do not know what he can do at this distance.

If there is anything you want me to do let me know. Write to me and let me know what the situation is and what is the cause of the trouble. In judging from BLITZ I suspected jealous ideological Marxists or something. Are you ruined at the bank?? I hope not. Regards to your family. Get the Congress for Cultural Freedom to supply you with a good lawyer who’ll take no fee. If the Indian Congress doesn’t cooperate, let me know, we’ll explain to the European office. Who are the Ghosh brothers? The manifestoes on prose and politics are pretty funny. I thought they were a little literary-flowery, but they MUST HAVE HIT SOME MENTAL NAIL ON THE HEAD. Good Luck.

Jai Ram

Allen Ginsberg

Allen Ginsberg, 704 East 5th Street, NYC,  January 11, 1965

Dear Malay,

Enclosed copies of letters from KULCHUR, from Abu Sayeed ayub ( 3 letters in answer to mine—each letter 2 pages) and one from A.B.Shah—Congress in Bombay. You should follow their letter up. Congress office in Paris has been contacted & they will probably send some note, notice to the Indian Committee. I answered some of your letters via Utpal—I sent copies of these letters, also, to show Sunil, Jyoti, etc. CITY LIGHTS JOURNAL#2 is on its way to you.

That Jyoti, Sunil, Sandipan & yourself are all working at slight cross-purposes is making things difficult. I suppose they are embarrassed by your ‘brashness’ (as TIME magazine might term it) or your slight edge of naivete as I would term it. However, if it is possible to reconcile with them & put up a united front it would be best for everybody’s safety. Best thing is to stop all cutty gossip, for it is only mainly gossip that Abu Sayeed is using as an excuse. Obviously they also were questioned by the Police, and so, feel a common threat with you. Don’t get angry at them—just work out a basis where you can all defend each other—and try you now—the only present basis (since there seems to be some literary disagreement) being freedom of literary expression. They all don’t want to be grouped as Hungry exclusively apparently, and they may resent or be scared or not want you to lump them all under your Hungry banner. And this is natural. Once a MOVEMENT gets name and publicity it is also a drawback as I’ve found. Also, the name is irrelevant & a drag sometimes to one’s individuality. See the first sentence of my letter to Shakti, Feb10,1963 that was published in a Hungry type magazine in Bengali. Best not to get angry at anyone—Jyoti, Abu Sayeed—even the police. Think carefully & coolly & get all working together if it is possible. I leave for Cuba in a week and will be back in 2 months. Love & Happy New Year

Allen

Margaret Randall, Mexico City, June 17, 1965

Dear Malay,

Please, please excuse so much time without writing, and now that I finally am able to sit down to write, this jumpy typewriter is driving me out of my mind. The man promised to come this week to fix it but this is Mexico (land of ‘manana’) etc!. How are things going for you—the trial; your case, the things taken from you and your friends, etc.??? All over the world, through EL CORNO, people write asking about you and wish you well, it has caused an international scandal among people in the arts, at least. I hope for good news, please write!!! And the book with Carlos Coffeen’s drawing on the cover—did it come out???

Under separate cover and by regular surface mail I have sent you two copies of our 13 in which I printed your letters. Hope they arrive one of these days and in good shape. Naturally: when the issue was printed I sent you a copy, but it must have gone astray. I don’t know why Samir Ray received his and you didn’t. Here we are in deep problems with the magazine. No money, for one thing, and tremendous work. Just when EL CORNO seems to have become a world wide interest spiritually and literally, it faces a quick death financially. The change of government here in Mexico in December has thrown us into utter gloom. All our base patronage was cut out from under us, and we were faced with stopping publication altogether, and so we had to turn to a thousand improvised plans to get us through. At the moment we are having a giant art show (more than 50 painters and other artists have donated works to sell for the benefit of the magazine). The show opened at a local gallery a week and a half ago. So far we have sold 18 works, keeping the linotype purring at least through the first part of 15. 15 is now at press and we hope to get through all of it, fingers crossed. I’ll try to use your poem in the first part of next year, but it isn’t at all sure. We have so much work at hand and so little space and money. In reality, space and money are the same thing!  Otherwise we are fine. Working like hell! Translating; writing, praying, trying to keep the mag going. Learning daily from our children (now there are three), the youngest is a year old today! Be well. Write. Good luck with the court case! Love

Margaret Randall

Allen Ginsberg, c/o City lights, 261 Columbus, SF, Calif, July 11, 1965

I have been wandering around from Moscow to Havana to Warsaw to Prague & thus didn’t get your letter of Jan 29th, much of which is obsolete by now? I have gotten so many conflicting letters & gossip from every body, I actually have no idea who’s doing what to who in India. Is your trial over or not, & what’s what? I’ve done all I can from here. I went to Cuba, as a judge of a poetry contest ( and later got kicked out for talking too much). It was a Latin American contest, the judges (as myself) all had to be able to read Spanish. Also they’d published poetry of mine & I had friends there and I had spent years in South America. So I got invited. I’ve been back a week & will leave again for San Francisco in 2 days. Then settle down to solitary poesy again. Write me news. I haven’t much time to correspond, though, except in big emergencies.

As ever

Allen

Daisy Aldan, 325 East 57 Street, New York, February 1, 1966

My dear Malay Roychoudhury

A friend of yours, Howard McCord, has sent me your address. I am distressed to hear about your plight, and hope that the situation will be ameliorated as soon as possible, even though, I do not at present, agree with the kind of poetry you and your friend are writing. I think YOU ARE EXTREMELY TALENTED. I am a poet myself and Editor, and a great associate of the Avant Garde. I consider myself in the forefront of the true Avant Garde. I published a magazine called FOLDER which presented poets whose work could not be published elsewhere because of its contemporaneity. But I think what you are doing now is first of all, passé, and second of all, a debasement of the spirit and language. I also think it is all wrong for India, and that there is room for excellence and contemporaneity without debasement. However, this is just my opinion, and I am sure you have good reasons for yours. You certainly should not be persecuted for your poems.

The major reason for this letter is to let you know that I am editing a book for Thomas Crowell called POEMS OF INDIA and I would be happy to consider some of your poems, and those of your friends. I wish to include poems of every region of India. Since the book is directed to young people, I can not publish any of the poems of the nature of the one Howard McCord published (a copy of which I have). If you wish to choose poems that do not deal with sex in this way, then I shall be more than happy to consider including them. I am eager to publish much contemporary work. Also any suggestions you may have about poems of the past which should definitely be included would be deeply appreciated. If any of your friend wishes to send me poems, then they should include a brief biography and permission for me to use.I will send you under separate cover, my own poems: THE DESTRUCTION OF CATHEDRALS, SEVEN:SEVEN, and A NEW FOLDER:AMERICANS:POEMS AND DRAWING, an anthology. Since it takes months for mail to get to India, I hope your answer will arrive before you receive them. All submitted poems, by the way, must be in English or translations. I spent four months in India last year—mostly in Bombay and gave a lot of readings of my work. I met many poets whose work I admire, among them, Padgaonkar, Karandikar, Ezekiel, Bapat, Katrak.I love India, and happy to be involved in this project. My best wishes to you, and I look forward to hearing from you soon.

Fraternally,

Daisy Aldan

Lawrence Ferlinghetti, San Francisco, 26 March, 1966

Dear Malay: I have read the legal decision on your case, and thank you very much for sending it. I find it laughable. I want to publish it together with your poem STARK ELECTRIC JESUS in the next ‘City Lights Journal’ which will be out this coming summer, and I enclose a small payment immediately, since I know you must need it desperately. I am sending a Copy of this letter to Howard McCord. Perhaps he knows the answers to the following questions and will send them to me right away, since time is of essence, and it may take some time to get a reply from you. I think it is a wonderful poem, and I will certainly credit McCord for having first published it. Bravo. Allen is in NY and his new address is: 408 East 10 Street, (Apt 4C), New York, NY. I need to know the answers to the following questions: (1). Was the poem first written in Bengali and was it the Bengali or the English version which was seized and prosecuted? (2). Is this your own translation, or whose is it? (3) Do you wish me to use the typewritten copy of the poem which you sent me last year, or the version printed by McCord? (I find some differences.) Let me hear as soon as you can. Holding the press.And Good Luck. I hope you are still able to survive! With love.

Lawrence Ferlinghetti

Octavio Paz, New Delhi, The 16th of July, 1966

Dear Mr. Choudhury:

Last time I was in Calcutta, I met some of your friends who talked to me about you.I hope I shall find an opportunity to meet you when I visit your city or whenever you get a chance to come to Delhi. Meanwhile please accept my best regards.

Cordially yours,

Octavio Paz

Ameeq Hanfee, 104 Gandhi Park Colony, Indore, 26 July 1966

My dear Malay,

I am extremely grateful to you for your permission to translate your poem ‘Zakhm’  into Urdu. I assure that the Urdu version of your poem will do full justice to it and may even sound better than the Hindi one. The Hindi translator has done his job very well, no doubt, but at places either he or the press has not been very careful in the use of ka! ki! Ke! etc., as well as certain Urdu words. On the whole the Hindi version seems to be a fairly faithful reproduction of the mood, spirit and expression of the original. I had written to Basak to send me literature of and on the Hungryalist writings and movement, and he had promised to enlighten me, but I did not get anything except his own article, the Calcutta Presidency Court judgment and the Hindi version of ‘Zakhm’. Whatever I know about your movement is through what I read in BLITZ, TIME, DHARMAYUG, MARAL, GYANODAYA, ANIMA, and LAHAR. I wish to go still deeper before venturing to write about the Hungryalists in Urdu. I am a poet and find your poetry—Hungryalist poetry—full of inspiration, freshness, fire and oxygen. I am looking forward to the day when we will meet and not only compare notes but also exchange heart and mind. I was all the more interested in ‘Zakhm’ because I found that you and I share a lot of common ground. There are so many lines in ‘Zakhm’ which express the same or similar experiences I have expressed in my long poems ‘Sindbad’, ‘Sharzad’ and ‘Shabgasht’. I must give you the credit of being more modern—rather up to date in your imagery, diction and poetic statements than I could be. Still your wound is not very different from mine. Let us all succeed in exploding the atom for real peace and freedom—the atom of our individual experience. After all the subterranean source is the same from which we all have our blood-lines connected. With admiration, regards and love

Ameeq Hanfee

Dan Georgakas, Box 418, Stuyvesant Station, New York, New York 10009, August 23, 1966

Dear Malay,

Sorry to be so long about writing but you can see I have been moving around. Your ‘In Defense of Obscenity’ is a beauty. Allan Van Newkirk is going to print it in GUERILLA. Allan and I are not connected with Artists Workshop except for in the most casual way. Smyrna Press is separate and so too is the new GUERILLA. Karl Heinz Weissner tells me he has contacted you (at my urging), and he is tuned on by Stark Electric Jesus. I hope you will dig my own Manifesto For The Grey Generation. Allen and I have founded a group called The League of Revolutionary Poets: Torp. We combine politics with poetry-in-happening—action events. Example: On August 6th we attended a peace parade and hung Johnson in effigy and flew the NLF flag. August 7th we attended the Festival of People at Artists Workshop, and held a mock trial (they had no warning) of love-dove poems, which angered many in the audience. August 9th: Anti-war poems: reading at downtown rally. August 13th: letter to paper congratulating Detroiters on letting their Greek Theatre die since any nation supporting a Vietnam atrocity could not support Gk Theatre too. New activities: war crime tribunal in Detroit, melon poetry reading in Pittsburgh, trial of love in Chicago. We seek creative vandalism. Today I read a foul story in the Village Voice. Wiped my ass with it and sent it into the paper. I am getting a squirt gun and will fill it with paint. Shoot when ready, the Grey Generation. I want to go to the opening night of the Opera when all the shitheads are there, and hurl anti-war poems from the galleries when the war-criminals enter. DADA lives. SURREALISM returns. Lasslett in Australia, Weissner in Germany. Nutall in Britain. Partisans of the world unite. Towers, open fire.Doubleday & Co will anthologize a poem for me. Story in homosexual magazine. Poem in communist magazine. Makes me a capitalist homosexual communist dog or a chameleon. Clifton de Berry is our man. io! ee! This is the world, begins with a BaaaaaaaaaaannnnnnnngggggggGGGGGGGGG…..’’’’’ Wichita Vortex Sutra—–wonderful. Ginsberg reads in Washington Square on Sunday to test new law about pornography and such. Allen says he has sent Miller’s Sexus. Prices sky high in New York. Faces ugly. Squalor everywhere. But a vitality. The Blacks are beautiful. Anger. Revolution. You must stay in India and smash them. This is the age of sabotage and subversion. Smash the word. Destroy the logic. Warp the system until it snaps. Love, oxygen, semen, tulip buds, serendipity syringes—-breakthrough in the grey room—dan georgakas

Dan

Carl Weissner, 24 September 1966

Dear loving brother guru

This finds me in the process of recovery from illness & series of bringdowns & now again working diligently on issue 4 of the mag….before the sickness had led my metabolic blues astray. I had got a job & they had to pay me for the whole period of illness which is the only pleasant thing about a job,…I have been able to cut costs for printing the mag down to something like 150 bucks, but still…Tell me: did you get your copy of the manifesto? (I mailed two copies to Subimal Basak) and did you get my last letter? What abt the proceedings of appeal? already over? And what is the outcome? favourable for you I hope!….yes will write to Donatella…..she has just sent an English translation of her Ginsberg essay which appeared in ‘Studi Americani’ in Italy last year…also good letters from Carol and Dan…. YES! BY ALL MEANS SEND THE TYPE SCRIPT OF LIFE , ARREST, TRIAL, GINSBERG, CALCUTTA!!!!! Listen:!! Gerard Malanga just sent a large and fantastic collection of poems, 4 of them dedicated to Allen! Also magnificent photos of Allen and himself! He will probably also write for KLACT abt his friendship with Allen! And Diana Di Prima sent a collection of cute short poems, all from 1957….all this will be included in KLACT 5 (spring 67)…I have also written to Allen & asked him to contribute original work, hoping he be willing to do so…COULD YOU WRITE HIM AND TELL HIM A FEW GOOD WORDS ABOUT ME AND KLACTO PLAN AND URGE HIM TO SEND STUFF??!!!! He is at 408 East 10th Street, Apt. 4C, New York, NY 10009…I have not yet found time to contact the people you told me, but will do so any day now….I will concentrate on Subimal’s and your work, tho… in No 5….but may be I will also contact Howard McCord (please give me his address!)….if it shd turn out that I have space left for more Bengali/Indian in No 5….. DID YOU RECEIVE THE ‘ICONOLATRE’ ISSUE I SENT YOU??!!! Also Larry Eigner sent me more poem: today, which will be in KLACT 5…yeah, things are really swinging now!….I am also thinking of publishing George Dowden’s new great visionary poem RENEW JERUSALEM in a limited edition, sometime later this year, if I have the money….(!)….. The English original of your article of course will be in KLACT, and I will translate it into German, too, and look around for possible publication in German mag…ok? O YEAH! Looking forward to translated passages from ‘JAKHAM’ plus one page in original BENGALI! GREAT! Please note: Bengali pages, if possible, should be written on white sheet of paper in black ink, and should be sent whole, that is, not folded—-so that it can be used for repro…. Do you know MAHENJODARO (ed. Samir Roy, 55/4 Natabar Pal Road, Howrah)? What is it like?—and POETRY TODAY (ed. Nissim Ezekiel, The Retreat, Bellasis Road, Bombay 8)? Qk. So much for this time. All best to you, Love

Carl

Carl Weissner, 5 December 1966

Dear malay

The great sky is open—-northern Italy washed away in vast mud & storm chaos & deluge—-desperate letters from Donatella Manganotti—-priceless artwork destroyed forever—and just a few minutes ago I hear in the news that they are in for yet another meteorologic showdown—Bihar province like a vast dried-up cunt I gather—hunger & revolts everywhere—German government collapsed, neo-Nazi movement scoring for the gaps: Christian & Social Democrats joining forces to make a last desperate attempt at saving the old ship St. Nanana already half drowned—Hanoi set ablaze by efficient hordes of technicians of death masterminded by sick pentagon eunuchs & a corny Texan cowboy putting out fake charismatic vibrations that materialize in tons of explosives & charred remnants of Asian bodies enabling Wall Street to hang on for another fiscal year—you see how they are caught in loops and spins of lethal genetic roulette—a uniform grey generation scurrying among nuclear debris of heavily infected areas of cancerous mind like rats in terminal stage of dream withdraw eating erogenous holes in huge chaotic setup of punch-cards that represent lives marked for Total Disposal—one more turnstile before the whole shithouse blows up—Nova Criminals wishing up dwarfed marks everywhere on this sick planet—SECONDS TO GO—you can already hear that heaving human blues heading for its irrevocable Dead Whistle Stop—so? Burning heavens, mister—nova armies conspiring across the wounded galaxies—icarus, nova-directed asteroid, due to blot out a terrestrial spot of bother the size of new york or tokio or London, on june 15, 1967—or September 13, 1968—what’s the difference—with the impact of one thousand hydrogen bombs—you see how things have grown to hitherto unimaginable bad proportions—a disarmament conference would have to include representatives of Nova, Interzone & Minraud, and there’s little chance that one could ever bomb this intergalactic gook rot to parley—and god knows how many of their agents are already operating among us disguised as word & image technicians seconds to go—we’ve got to attune our paranoiac feelers to that vast danger around us, spot them wherever they show a blind spot & stop them dead in their tracks—

In order to achieve this we have to provide ourselves with an insight into their methods & operating schedules, and the work of Bill Burroughs & a few other semantic cosmonauts shows precisely who they are & how they operate—in supersonic patterns of sense-wave control—or long, medium, short & ultra short waves of the world—in cozy bed sitters, court-rooms, arenas, parliaments, newspapers, or gone streets—in subcutaneous offices of annexed brains around the paralyzed globe—right where you are sitting now there in Bad News Department walking in on you cool & casual with a perfunctory ‘hello there’—and metamorphosing you into an obedient Hate Virus host in a matter of seconds—if you are not fully aware—each second & if you do not know who they are & how to fight them—now—in forthcoming issue of KLACTOVEEDSEDSTEEN you will find more details & outlines of steps to be taken towards an immediate universal survival training in a piece by Mr. Burroughs & Mr. Weissner; called LAGUERRE PARTOUT (war everywhere), precisely showing some of the hideous techniques by which the nova criminals try to mono-police & control & manipulate so-called ‘reality’ in order to subvert & takeover mind & consciousness of every single of us—

Carl

George Dowden, London. 22 April 1967

Dear Malay,

Good to hear from you; glad you have some kind of job now. I’ve gotten together with Utpal Basu here, good bloke, but doesn’t seem to be doing any writing here; just teaching. He introduced me to the shehnai (recording: The Magical Shehnai of Bismillah Khan), which is a lovely instrument. I dig the morning raga on that recording, but not the evening one particularly. I also wrote to Dick Bakken about collecting SALTED FEATHERS, just yesterday. I am about to write to the National Library of India about Ginsberg, as you suggested. Meanwhile, if you have spare copies of any Indian mags he was in, please send, like UTTARSURI of Dec 1963, MOHENJODARO of 1963 etc. AS I said, I’ll pay—or send you things in exchange. You mentioned wanting books on Cubism, Surrealism and Dadaism—there is a good series here, which includes all of these, a book on each; the publisher is Thomas Hudson; the Cubism book is by Edward f. Fry, Surrealism by Patric Waldberg, Dadaism by Hans Richter. Do you have these available there? If not, I’ll get them for you and send them. Let me know. Did RENEW JERUSALEM arrive all right? Let me hear you about it. Seeing lawyers now, wanting to safely bring out an edition here. America is getting worse and worse; lies and destruction, a threat to the whole world. Fortunately the youth are not listening to their bullshit except to jeer at it, and as long as that goes on, can not be stopped, there is hope. If the totalitarian impetus in America gets its own way, and all the power, then all hope is gone. South America would become the next Vietnam, and so on. But I think they will be stopped—though not until more blood flows. Let me know how you are doing. Write soon. Cheers,

George Dowden

পাঁচ : আইন আদালত : প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার 

১৯৬৩ সালে আমি  ৯০ লাইনের  কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ লিখেছিলুম। কবিতাটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে। প্রকাশের পর  আদালতে হাংরিদের  বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয়। কবিতাটি “হাংরি বুলেটিন ১৯৬৪” সংখ্যায় প্রকাশের পর হাংরির মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে  পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) এবং ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। যারা সংখ্যাটিতে লিখেছিল তাদের মধ্যে ছয়জনকে কলকাতা পুলিশ  গ্রেফতার করে । ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাকি সবাইকে মুক্তি দেয়া হলেও আমার বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশীট দেয়া  হয় আর ৩৫ মাসব্যাপী মামলা চলে। আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত আর বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সমীর বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু। পবিত্র বল্লভ আর সমীর বসু ছিল পুলিশের খোচর, ভুয়ো সাক্ষী ।ব্যাঙ্কশাল কোর্ট আমাকে সর্বোচ্চ সাজা ২০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল। গ্রেফতারি পরোয়ানার দরুন কবি উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। ঔপন্যাসিক সুবিমল বসাক আর কবি দেবী রায়কে কলকাতা থেকে মফঃস্বলে বদলি করে দেয়া হয়। ১৯৬৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের রায় নাকচ হয়ে যায়। কবিতাটা বিভিন্ন ভাষায় ভারতের, পূর্ব এশিয়া আর ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে । ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম” সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে কবিতাটা অন্তর্ভুক্ত ।  কবিতাটা এখানে দেয়া হলো 

‘ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব

আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে

আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না

সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা

শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও

চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়

সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে

আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে

আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও

প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে

শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ

মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?

তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম

কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না

একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়

ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন

কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে

এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ

সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা

ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব

শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়

দিতেই হবে শুভাকে

ওঃ মলয়

কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ

কিন্তু আমাকে নিয়ে কী কোর্বো বুঝতে পার্ছিনা

আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা

আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি

প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি

অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি

শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার

অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা

যোনিকেশরে কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্থতা

আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম

আমি বুঝতে পার্ছিনা কী জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাইছি

আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণ চৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি

আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে

শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমাকে

জন্মমুহুর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে

আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই

মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না

তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা

শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও

তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাততাড়িত কঙ্কাল

আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেক জন্ম নিতে দাও

আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?

সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?

আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?

শুভা না থাকলে আমি কি পেশাদার ভালোলোক হতুম মৃত ভায়ের

ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক

শুভা, ওঃ শুভা

তোমার সেলোফেন সতিচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও

পুনরায় সবুজ তোশকের উপর চলে এসো শুভা

যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়

১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে

তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ

পাঁজর নিকুচি-করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে

হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা

আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ

মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছিনা

তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়

সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব

শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব

কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই

শুভা

আমাকে তোমরা ল্যাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও

দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও

বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে

কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে

কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁ পেচেছাপে বয়ে যাইনি

কেন আমি রজঃস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়

অথচ আমার নিচে চিত আধবোজা অবস্থায়

আরাম গ্রহণকারিনী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার

এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়

আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই

এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে

মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে 

আমি মরে যাব

ওঃ এ সমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে

আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না

পায়জামার শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে

ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়

এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে

হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌন-পর্চুলায়

ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠ খেয়োখেয়ি।’

২০১৪ সালে এই কবিতা অবলম্বনে মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় এবং হ্যাশ তন্ময় একটি নির্বাক স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ চলচ্চিত্রটি ব্রিটেনের নো গ্লস লিডস্‌ ইণ্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সহ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, প্যারিস, বার্সেলোনা, জার্মানি, স্পেনসহ মোট ১২টি দেশের ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফিসিয়াল সিলেকশন এবং স্পেনের ম্যাডাটাক ইণ্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভেলে সবচেয়ে আশাপ্রদ ভিডিও শিল্পীর (Most Promising Video Artist) পুরস্কার পেয়েছে । 

ছয় : উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরায় হাংরি যুগ   

  আশির দশকের শুরুতে শিলিগুড়ি থেকে অলোক গোস্বামীর সম্পাদনায় ‘কনসেকট্রেশান ক্যাম্প’ আর মনোজ রাউতের সম্পাদনায় ‘ধৃতরাষ্ট্র’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে হাংরির শরীরে নতুন রক্ত এনেছিল কয়েকজন তরুণ কবি-লেখক, যাদের মধ্যে উল্লেখ্য , অলোক গোস্বামী, অরুণেশ ঘোষ, রাজা সরকার, সমীরণ ঘোষ, মলয় মজুমদার, বিকাশ সরকার, জীবতোষ দাস, মনোজ রাউত, রতন নন্দী, নিত্য মালাকার, সুব্রত রায়, নকুল মণ্ডল, তনুময় সরকার, দিবাকর ভট্টাচার্য, বিজয় দে, অন্যমন দাশগুপ্ত, জামালউদ্দীন, অনুভব সরকার, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, প্রবীর শীল, কিশোর সাহা, কুশল বাগচি, দেবজ্যোতি রায় প্রমুখ ।

হাংরি যুগ  আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল  মামলার পর, যদিও সুভাষ, শৈলেশ্বর, বাসুদেব, প্রদীপ ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশ করছিল: কিন্তু আশির দশকে উত্তরবঙ্গে হাংরিকে নতুন উদ্দীপনা দিলো কুড়ি-বাইশ বছরের তরুণের দল   ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার শারদ ১৪২২ সংখ্যায় স্মৃতিচারণ করাকালে অলোক গোস্বামী লিখেছে : “দিব্যি চলছিল প্রতিষ্ঠার সাম্পানে সওয়ারি হওয়ার লড়াই । মাঝপথেই হঠাৎ রাস্তাটা বাঁক নিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে গেল । সবার নয় । আমাদের কয়েকজনের । নিজেরাই ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম । ঘোরার ভাবনাটা বদলাতে সাহায্য করেছিল কিছু সাহচর্য ও লেখাপত্র । জেনেছিলাম সাহিত্য নিছকই বিনোদনের মাধ্যম নয় । নয় ভাতঘুমের সহায়ক বটিকা । পাঠক রুচি নামক ইওটোপিয়াকে সামনে রেখে শিল্প-সংস্কৃতির যে বেসাতি চালু আছে তার মূল উদ্দেশ্য শুধুই মুনাফা নয়, জনচেতনাকে দাবিয়ে রাখাও । সাহিত্য এবং জীবনকে একই মুঠোয় ধরতে হয় । এবং সত্য কোনো একমাত্রিক বিষয় নয় । প্রকৃত সত্যকে গোপন করতেই কলাকৈবল্যবাদ কিংবা প্রগতিশীলতার তত্ত্বের জন্ম । লিটল ম্যাগাজিনের মূল উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠানের লেখন সাপ্লাই করা নয়, কিংবা নয় হাত পাকাবার আসর । লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আরেকটি শব্দ ওপ্রোত জড়িত— ‘আন্দোলন’ । যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য, পাঠককে সচেতন করে তার প্রত্যাশা বাড়ানো । তেজস্ক্রিয় ভাষা মারফত প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা । প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণা জীবনের তলা থেকে উঠে আসে না । সুতরাং গা গতরের ভাষা ব্যবহার করে ভাষাকে এলিটিজম থেকে মুক্ত করতে হবে । অর্থাৎ কিনা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে হবে । আমরা কয়েকজন আস্হা রাখলাম নতুন শ্লোগানের সঙ্গে— ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’ ।”        

 উত্তরবঙ্গের এই হাংরিরা আমার  লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিল । তারা জানতো না যে আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ; মুচলেকা দিয়ে তাতে রাজসাক্ষী হয়েছিল শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । তার মানে উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তোলায় আমার কোনো ভূমিকা নেই । আদি হাংরি আন্দোলনের মতন তারাও স্বয়ম্ভূ ।   ওই একই প্রবন্ধে অলোক গোস্বামী লিখেছে, “যা পড়লাম তা মাথা বিগড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট । ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা । পরিচিত হলাম সুভাষ, শৈলেশ্বর, ফালগুনী, প্রদীপ, বাসুদেব, অরুণেশদের লেখাপত্রের সঙ্গে । হাতের কাছে পেয়ে গেলাম রোল মডেল । ব্যাস শুরু হয়ে গেল মফঃসসল শহরে আমাদের জেহাদি জীবন । আমরা কয়েকজন নিজেদের পত্রিকার ঝাঁপ নামিয়ে প্রকাশ করলাম যৌথ-সম্পাদিত কাগজ — ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ । ক্ষুধার্তদের সঙ্গে যখন আমাদের যোগাযোগ হয়, ততদিনে জেল-জরিমানা পর্ব মিটে গিয়ে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের ওপর থেকে প্রচারের আলো সরে গিয়েছে দূরে । নতুন প্রজন্মের কাউকে আকর্ষণ করতে পারছিল না ক্ষুধার্ত আন্দোলন । সুতরাং বলা যেতেই পারে, আটের দশকে ক্ষুধার্ত চেতনার পুনরুথ্থান ঘটেছিল শিলিগুড়িতে । এবং তা ঘটিয়েছিল ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ । তারপর সমগ্র উত্তরবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল হাংরি চেতনা । ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’-এর পাশাপাশি অন্যান্য শহর থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল অজস্র পত্রিকা, যেমন ‘জিরাফ’, ‘রোবট’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘দ্রোহ’, ‘বিকল্প’ ইত্যাদি ।”   উত্তরবঙ্গের তরুণ হাংরি আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথমে নেমে এলো উপেক্ষার খাঁড়া । তারপর কলকাতা নিবাসী এক কবি, যিনি উত্তরবঙ্গেরই লোক, তিনি সাংস্কৃতিক-রাজনীতি করে, উত্তরবঙ্গের হাংরিদের যৌথতাকে ভেঙে দেবার প্রয়াস করলেন ও সফল হলেন ; ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ ভেঙে গেল এবং শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল ।   ‘চন্দ্রগহণ’ পত্রিকার ওই সংখ্যায় রাজা সরকার লিখেছেন, “ এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও  হাংরি  আন্দোলন সম্পর্কে শিলিগুড়ির লেখক-জগৎ তখনও অন্ধকারে । খোঁজ খবর বইপত্র কিছুই পাওয়া যায় না । তার ওপর তখনো অতীতের নানা চাপের ফসল হাংরি লেখকদের ওপর দায় হিসাবে রয়ে গেছে । পত্রিকা বের হয় না । নিজেরাও তাঁরা তখন অনেকটা পরস্পর বিচ্ছিন্ন । আজ আর অস্বীকারের উপায় নেই যে ষাট দশকের হাংরি লেখকরা ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’-এর মাধ্যমেই উত্তরের এইসব অঞ্চলে পরিচিতি পান । আমরা টের পেলাম একটা হাংরিয়ালিজম দানা বাঁধছে কিছু হাংরি লেখকের মনে । দুই দশক পরে তখন আন্দোলনের একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে । হাংরি ম্যানিফেস্টোর অসম্পূর্ণতা দূর করার চেষ্টা । ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’ সেই কাজে কিছুটা ব্যবহৃত হয়েছে ।”

অলোক গোস্বামী তাঁর মেমারি লোকাল বইতে লিখেছে, “সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
–কী চাই!
মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
–কে আপনি?
এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
–কি কথা?
–গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
–কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
–এভাবে কথা বলছেন কেন?
–যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।

এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে ‘ছেলেধরা’ বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।

ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
–ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
–কোন পত্রিকা?
–কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
–নেব না। যান।

এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি। Aftershock শুরু হলো তারপর । শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ তো সরে গিয়েছিলেনই, সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।” কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।

হাংরি যুগের  যে কবিকে বলা যায় সবচেয়ে প্রতিভাবান,  সে উত্তরবঙ্গেই থাকতো আর ‘জিরাফ’ নামে একটা হাংরি পত্রিকা সম্পাদনা করতো । তাতে আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল । তার নাম অরুণেশ ঘোষ। তার সম্পর্কে ভূমেন্দ্র গুহ ‘গোঁয়ারগোবিন্দ অরুণেশ ঘোষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ”আনন্দবাজার পত্রিকা’র এক-কালের দোর্দন্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব, সন্তোষকুমার ঘোষ, শোনা যায়, কোনও এক সময় তাঁর কোনও-কোনও সাহিত্য প’ড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এবং তাঁর দারিদ্রের বিষয়ে জানতে পেরে তাঁকে আনন্দবাজার পত্রিকা’য় একটা চাকরি দিতে চেয়েছিলেন;অরুণেশ নিজেকে অপবিত্র করতে চাননি ব’লে সবিনয়ে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা’য় চাকরি করতে-করতে তিনি অবশ্যই বেশি চালাকচতুর হবেন, টাকাকড়ি বিষয়ে দুশ্চিন্তা অনেকটাই কেটে যাবে হয়তো তাঁর, পারিবারিক দায়দায়িত্বগুলিও বেশি ভদ্রস্থভাবে সামলাতে পারবেন, কিন্তু এক সময় হয়তো চার্লি চ্যাপলিন’র মডান টাইমস ছবিটার চার্লি’র মতন খাঁজ-কাটা ক’টা ঘুরন্ত চাকার খপ্পরে অসহায়ভাবে প’ড়ে যাবেন, এবং কাজটা সঠিক করেছেন ব’লে নিজেকে নিজে বোঝাতে থাকবেন। তা অসহনীয় ভাবে বড়ো দুঃখের হবে তাঁর পক্ষে। ভয়টা কাটাবার জন্য সন্তোষকুমার ঢের বুঝিয়েছিলেন তাঁকে, সবারই-যে এ-রকম  হতে হবে, তার কী মানে আছে, যার হয়, তার নিজের অনবধানতাবশত হয় অথবা জ্ঞানতই হয়, কিন্তু ভবি ভোলেননি।”

সাত দশকের মাঝামাঝি অরুণেশ ঘোষ তার “জিরাফ” পত্রিকার মাধ্যমে হাংরিকে আবার চাঙ্গা করে তুলেছিল।অরুণেশ উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার হাওয়ার গাড়ি গ্রামে বসবাস করতো আর  উত্তরবঙ্গে প্রায় কুড়ি জন কবি ও লেখককে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নতুন হাংরিদের মধ্যে পরবর্তীকালে যারা খ্যাত হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছোটোগল্প লেখক অলোক গোস্বামী, আর কবি রাজা সরকার , নিত্য মালাকার, জীবতোষ দাশ, সমীরণ ঘোষ, মনোজ রাউত, বিকাশ সরকার, সুব্রত তায়, নকুল মণ্ডল, তনুময় সরকার, দিবাকার ভট্টাচার্য, বিজয় দে, অন্যমন দাশগুপ্ত, জামালুদ্দীন, অনুভব সরকার, রাজীব সিংহ, মলয় মজুমদার, সুমন্ত ভট্টাচার্য, অরুণ বণিক, সেলিম মুস্তফা, রসরাজ নাথ প্রমুখ। । উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অরুণেশ সারাজীবন নিজের গ্রামে বুনিয়াদি স্কুল শিক্ষক ছিল। গ্রাম ছেড়ে যেতে চায়নি কলকাতায়। গ্রামের বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারের অরুণেশই ছিল  কর্তাব্যক্তি। সেকারণে তাকে ব্যতিক্রমী গৃহস্হ কবিও বলা হয়। অরুণেশ বিশিষ্ট সাঁতারু ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও পুকুরে স্নান করার সময়ে জলে ডুবে মারা যায়। 

কলকাতা মেট্রোপলিস থেকে বহুদূরে সম্পূর্ণ গ্রামীণ পটভূমিতে তারা নিয়ে এসেছিল গ্রাম ও গঞ্জের পাগল, গণিকা, মাতাল পুরুষ, বেশ্যালয়ের উঠোন, নগ্ন কিশোর, দালাল, ধর্ষক, খুনি, অপরাথী, সন্ন্যাসী, বিকলাঙ্গ, প্রসবঘর, ভাটিখানা, সিফিলিস, বেশ্যার সন্তান, গর্ভফুল, ভবঘুরে, গ্রামীণ রাজনীতি, দলতন্ত্র, ক্যাডারদের অত্যাচার, শ্মশান ইত্যাদি।  ব্যক্তিমানুষের প্রান্তিক অস্তিত্ব, কৌম জীবনের ব্রাত্য, অন্ধকার দিকগুলো বার বার উঠে এসেছে তাদের লেখনীতে। সামাজিক স্হিতিজাড্য, নিয়ন্ত্রিত জীবনচর্চার বিপ্রতীপ অবস্হানে তারা আস্হা রেখেছিল। অস্হিরতা, তীব্র সংঘাত ইত্যাদির ভিতর দিয়ে গূঢ় উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছে পাঠবস্তুকে। তার সংগে মিশিয়েছে উত্তরবঙ্গের লৌকিক যাদুবাস্তবতা, লোকজীবনের বর্ণময় জগৎ।অরুণেশের দুটো বিখ্যাত কবিতা পড়ে নেয়া যাক: 

ছোট শহরের অতিথি

নক্ষত্রের তলায় যেখানে এই

ভাঙাচোরা বাস আর আস্তাবল

যেখানে মরচে পড়া লোহালক্কড়ের

আবর্জনার মধ্যে আমাদের মদ ভাঙের আড্ডা

ফিসফিসানি মেয়েদের, চাপা হাসি আর থুতু ছেটানো

দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাইতোলা

সেইখানে, ভাঙা গাড়ির আস্তাবল

তোকে বয়ে নিয়ে এসেছে তোর মা

এ যেন আমাদের ছোট শহরের বেঁটেখাটো আর দাড়িওয়ালা

ঈশ্বরের সঠিক নির্দেশ: এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে

পালিয়ে না বেড়িয়ে সোজা চলে যায় আমার এখানে

এই ভাঙা গাড়ি, নেশুড়ে আর বেশ্যাদের আস্তানায়

আমরা যখন খাটো গলায় ধমক দিচ্ছিলাম মাতালদের

‘চুপ চুপ…পুলিশ’

যখন মেয়েরা অন্তর্বাসের তলায় গুঁজে রাখছে

ময়লা দোমড়ানো মোচড়ানো লালচে দুটাকার নোট

যখন গেলাশ উপচে গড়িয়ে পড়ছে মদ

মদে ভিজে উঠছে মৃত ধাতুর কঙ্কাল

ফণা তুলে জেগে উঠেছে চারপাশে

মদের নেশায় মদের গন্ধে মরচে-পড়ার মধ্যেও

টুকরো-টাকরা হয়ে যাওয়ার মধ্যেও হিস হিস চিৎকার

অতিথি

‘এতগুলো টাকার বিনিময়ে কী পাওয়া গেল

বেশ্যার কাছ থেকে?’ – ভোর হওয়ার আগেই

সে বেরিয়ে পড়তে চায় ঘর ছেড়ে, পরে নেয় জামা ও প্যান্ট

কল্পিত আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক করে নেয় চুল ও গোঁফ

একবার, দু-বার, তিনবার হলুদ রুমালে মুছে নেয় মুখ

জানতে চায়

জানতে চায় আধ-ঘুমস্ত আধ-ন্যাংটো মেয়েটির কাছে

মুখে কোনো ছাপ থেকে যাচ্ছে কিনা

কখনও মনে হয় গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে

নেহাতই এক মধ্যবিত্ত

কখনও – ভিন্ন এক গ্রহ থেকে আসা – ভাবি

এই আমাদের মূল নায়ক – শুধু মাথায় কিছুটা খাটো

হৃদপিণ্ডের ওপর একই মানিব্যাগে টাকা আর প্রেমিকার ছবি

মদের টেবিলে খুলে দেখায় সে

বেশ্যাকে টাকা গুনে দেওয়ার পর বেশ্যার উঠোনে দাঁড়িয়ে কাঁদে

এক হাতে জড়িয়ে ধরে নিষিদ্ধ পল্লীর উধের্ব মাথা-বাড়ানো

নাম-না-জানা গাছ

একই আচ্ছাদনের তলায় শুয়ে কেটে গেল আরও একটি রাত

একই স্ত্রীলোকের দু-পাশে দুজন, শরীরে বেশ্যার কাঁথা ও শরীর

যোনিতে হাত দিতে গিয়ে দেখি অধিকার করে আছে

আরেকজনের রোমশ থাবা

তবুও নারী বঞ্চিত করতে চায় না আমাকে

গোপনে মুখ টেনে নিয়ে গুঁজে দেয় স্তনের বোঁটায়

একটি হাত, একটি স্তন, একটি নিতম্বের গভীর চাপ

এমনকি নিজের যোনিদেশ দ্বিখণ্ডিত করে দুহাতের –

তালুতে নিয়ে বিপুল দাঁড়ায় অন্ধ রাত্রি জুড়ে

পরিহাস করে দেবতারা

কুকুরের কান্নায় চমকে ওঠা অতল রাতে চিত হয়ে ভাবি ‌

এই যে দুই পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া

উপর্যুপরি বীর্যপাত, মিশে গেল, মিলিয়ে গেল

কোন দুঃখের নদীতে?

রাস্তায় বেরিয়ে এসেই পরস্পরের অচেনা হয়ে যাই আমরা

ব্রাহ্মমুহূর্তের আকাশ ঢুকে পড়ে বুকে, মাথায় ও গুহ্যদ্বারে

মাথার ওপারে থাকে একটি নক্ষত্র ও ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি তার

কপাল থেকে যখন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত

তখনই সে বুঝতে পারে

‘এতগুলো টাকার বিনিময়ে কী পাওয়া গেছে বেশ্যার কাছ থেকে’

ছুটে ফিরে যায় সে একই ঘরে, সূর্য জেগে উঠেছে তখন

জেগে উঠেছে ঘুমন্ত বেশ্যার শরীর আর শহর

আমাদেরই গোটা মাথা জুড়ে ও জড়িয়ে

তখনই মনে হয় এই আমাদের মূল চরিত্র – বাবা শ্রমিক মা মধ্যবিত্ত

  • উত্তরবঙ্গে হারি আন্দোলনের প্রসার যাঁরা ঘটিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম রাজা সরকার । তাঁর  জীবন ও কবিতা ‘অনুধ্যান’ পত্রিকায় আলোচনাকালে  শিমুল মিলকী লিখেছেন : “কবি রাজা সরকারের জীবন ও কবিতা নিয়ে মূলত আলোচনা থাকলেও এর সাথে নেত্রকোণাকে জড়িয়ে আলোচনা করতেই হচ্ছে। কেননা, কবির জীবনের স্থানিক ও কাল-পরিচয়ের মধ্যে কবিতারও একধরনের পরিচয় আভাসিত হয়। কবির জীবনপঞ্জিকা ঘেঁটে কিছুটা সেই আলামত পাওয়া যায়।রাজা সরকার তাঁর আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থ আঁতুড়ঘর-এ বলেন- “রাতে স্বপ্ন দেখি বালক বয়স। স্বপ্ন দেখি ঘুরে বেড়াচ্ছি শ্রীমন্তপুর গ্রামে। এখন সেটা অন্যদেশ। ওখানে এখন ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না। এসব কথা কি কাউকে বলা যায়?… নস্টালজিক।”বলা না গেলেও এই কথা বলা হয়ে গেছে তার কবিতায় –
  • প্রতিবারেই আমি উৎসের দিকে যেতে চাই
  • পরিণতি ছুঁয়ে আছে পায়ের আঙুল
    জঙ্ঘা ও স্তন পেরিয়ে হাত
    হাতে আগুন
    গৃহস্থালি বসেছে তার উপর, সঙ্গে
    এই সুদাহ্য শবশয্যা-”
  • বিশেষ সংবেদনশীল হওয়ায় কবিকে আজীবন যে সংগ্রাম করে এগুতে হয় তা সাধারণের বাইরে। সেই সংগ্রাম অবশ্যই বহুমাত্রিক হয়ে থাকে। – জীবনের না-পাওয়া, হারানোর যন্ত্রণা ও অপমানের মধ্যে সেই সংগ্রাম যেমন গ্রথিত, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের মধ্যেও কবির রয়েছে সাহসিক বিস্তৃতি। তবে কবির এই সংগ্রাম মূলত কবিতার জন্যেই সংগ্রাম বলে ধরে নেবো। কেননা তিনি আমাদের কবিতাই উপহার দেন। তাঁর কাছে আমরা শেষমেশ কবিতাই চাই। কবিতার বিচার বড়ই কঠিন কাজ এবং প্রকৃত কবিতা চেনারও কঠিন বলে মনে করি। রাজা সরকারকে পড়তে গিয়ে আরাম প্রিয় পৃথিবীর মোহভঙ্গ হয়। তাকিয়ে দেখি বাস্তবে রক্তাক্ত উঠান। তিনি বলেন-‘আলোর বিকারে জন্মেছিল যে কিট, সে এসে দাঁড়িয়েছে এই নিস্প্রভ আলোতে,
    হাতে খড়্গ, চোখের জল, ঠোঁটের কোণে রক্ত-
    আঁচল ভর্তি মুদ্রা খসে পড়ে, ভিড় হয়, ট্রাফিকে হল্লা, ভাঙ্গে ঘুম
    আক্রান্ত মানুষ পালায়, রুগ্ন পিষ্ট হয়, দুর্বৃত্ত লুট করে আরো কিছু।’
  • রাজা সরকারের কবিতায় এমনিভাবে দেখতে পাই সমাজ, সংসার ও ধর্ম কাঠামোয় নানাবিধ আগ্রাসনের ছায়া। যেখানে আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও জীবনের নির্মম বাস্তবতা ধরা দিয়েছে। গূঢ় পর্যবেক্ষণ ও বিচার বিশ্লেষণের দক্ষতা দিয়ে তিনি নিজস্ব বয়ানে তাঁর কবিতাতীর্থে নব রূপায়ন ঘটিয়েছেন। তিনি তাঁর কবিতায় বলেন- ‘এটা সৌভাগ্যের যে তুমি বাইনারি শনাক্ত করে ফেলেছো। রক্তের প্লাজমা নিয়ে গবেষণা, মৌলতত্ত্ব, অনুপরমানুর ঝড়- চুইয়ে পড়া ফিদেল হাসিতে তুমি এসিড পোড়া নারীর কাছে জানতে চেয়েছো তার অনুভূতি কি রকম? কিংবা
  • ‘পৃথিবী শুধু মাংসের হয়ে গেলে নখের দ্বারা বোবাছন্দের চাষ হবে। দেহাতীত সবকিছুকে নির্বাসনে রেখে আমরা ছন্দবদ্ধ দেহ নিয়ে উৎসব করতেই পারি…প্রেতাত্মা ছাড়া শুধু মাংসের সেদ্ধ হয় না আজ’। তাঁর কবিতায় আছে দীর্ঘ জীবনযন্ত্রণার ইতিহাস। আছে মৃত্যুর ছায়াছবি। আছে রক্তের হিসেব। তাকে বাল্য বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। ট্রাজেডির শুরু মূলত এখানেই। শরনার্থী ক্যাম্পের কষ্টকর জীবনের সাথে তাকে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তারপর শিলিগুড়ি। সত্তরের দশকে নকসাল আন্দোলনের আবহ। শেষে কলকাতার জীবন। এই আবর্তনের মধ্যদিয়েই তাকে লেখাপড়া, চাকরি, বিয়ে, সন্তান লালন পালন সহ সবই করতে হয়েছে। জীবনের নানা স্তরে রক্তাক্ত অভিজ্ঞতায় তাঁর দিকদর্শন যেনো আরও প্রকট হয়ে ওঠেছে।কিন্তু কবিতায় তিনি অপ্রতিরোধ্য, বিদ্রোহী, সমঝোতা হীন, বেপরোয়া। মিতভাষী এই কবি অকপট বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন দুর্দান্ত কবিতার মাস্তুল।
    আমাদের রেখে যেতে হবে সীমান্তের চোরাপথ
    রেখে যেতে হবে তুমুল যৌন সতর্কতার ভেতর নির্বিকার আত্মহত্যা
    শূন্য ভাড়ার তুলে রাখা ছাই আর পাটাতনে গোপন গর্তভরা
    আমাদের কঙ্কাল আজও কামনা করে আগুন-হানাদার পেট্রোল-বোমা
    আমাদের রেখে যেতে হবে কুঠার, কেটলি আর লবণ
    রেখে যেতে হবে না-বাঁধা জ্বালানী কাঠের বোঝা, ময়লা গামছা
    রেখে যেতে হবে জং ধরা বল্লম
    রেখে যেতে হবে শূন্য ভিটে, আগাছা আর ঘাতকের ছায়াছবি
  • উত্তরবঙ্গে হাংরি যুগের ফাটলের রেশ এখনও বজায় আছে, যেমন স্নেহাশীস রায়ের সাম্প্রতিক   বক্তব্যে ধরা পড়ে: “শৈলেশ্বরকে লেখা অরুণেশের প্রায় ৮০টির মতো দীর্ঘ চিঠি( INLAND LETTER CARD) উদ্ধার হল। ‘সৃষ্টিক্ষমতাহীন কুকুরের দল এই ঘেউঘেউ চিরদিনই করে এসেছে’র পাশাপাশি অরুণেশ চাইছেন ‘আত্মমগ্ন গর্ভবতীর মতো নিজেকে নিয়ে থাকতে’। তাঁর সঙ্গে মিলারের লেখালিখির হাস্যকর তুলনা প্রসঙ্গে অরুণেশের মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দকে ইয়েটস্ এর অনুকারক এমনকি পাশাপাশি রেখে উভয়ের লাইন তুলে মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টার কথা! আর্থিক সংকট, বেশ্যা ও না-বেশ্যা অসংখ্য সংগমে তিনি কি না-প্রেমিক। না, এসবের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার সঙ্গে সহবাস করতে চাইছেন। দেশ, আনন্দবাজার, আজকাল প্রভৃতি বাজারি কাগজ সম্পর্কে একহাত নিতে ছাড়ছেন না এবং কৃষ্ণ ধর ও অমিতাভ দাশগুপ্তকে হিজড়ে লেখক বলতে রেয়াত করছেন না।হাংরি জেনারেশন সাহিত্য, রাজনীতি, কলকাতার সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি করে শৈলেশ্বরকে পাঠানো। ‘রোবট'(সম্পাদক : জীবতোষ দাশ) নিয়ে ভয়াবহ আবেগ।নিজের কাগজ ‘জিরাফ’ নিয়ে চিন্তাভাবনা। বাবার অসুখ। চিকিৎসকদের ‘মাগী’ বলা, টাকাও ধ্বংস করে রোগীও মারে।উত্তরবঙ্গের তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকার রাজনীতি। এমনকি নাম নিয়ে রাজা সরকারের (সম্পাদক : কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) ঈর্ষা ও কূটনীতি সত্ত্বেও তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা। আরও কত কী কথা বলেছেন চিঠিতে শৈলেশ্বরকে।এই চিঠিগুলো নিয়েই একটা সাংঘাতিক বই হয়ে যায়।একটা সময়, দীর্ঘ কবিতাযাপন, জৈব আততি ও ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই।বোমাটা ফেলব নাকি!” 

সাত : হাংরি যুগে ছবি আঁকা ও বিটদের সঙ্গে তুলনা

বিষয়টি নিয়ে জুলিয়েট রেনল্ডস, শিল্প সমালোচক, এই কথাগুলো লিখেছেন–    

দুটি আন্দোলনেই, কবি ও লেখকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে, বেশ কম লোককেই পাওয়া যাবে যিনি তর্ক জুড়বেন যে বিট আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল সাহিত্যের আন্দোলন । দুটি আন্দোলনই ডাডাবাদীদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাকে আকৃষ্ট করলেও, কেউই এই দুটিকে শিল্পের আন্দোলন বলতে চাইবেন না, যা কিনা ডাডা আন্দোলনকে বলা হয়, তাঁদের গোষ্ঠীতে সাহিত্যিকরা থাকলেও ।           

কিন্তু বিট এবং হাংরিয়ালিস্টদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকারকে যদি খুঁটিয়ে দেখা হয় তাহলে সন্দেহ থাকে না যে যেমনটা আলোচকরা মনে করেন তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি ছিল শিল্পীদের অবদান এই দুটি আন্দোলনে। বিট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিশ্লেষণেই তা সত্য বলে প্রমাণিত হয় । তাঁদের আন্দোলনে শিল্পের যে স্হির-নিবদ্ধ সন্দর্ভ প্রথম থেকে ছিল তা কখনও থামেনি । অবশ্য মনে রাখতে হবে যে বিটদের সম্পর্কে তথ্যাদি ভালোভাবে নথি করা হয়েছে, যা হাংরিদের  ক্ষেত্রে হয়নি, ব্যাপারটা প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের ফাটলের অবদান । বিট আন্দোলন কাউন্টার কালচার হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে উদয় হয়েছিল, যখন কিনা হাংরি আন্দোলন তার কায়া পেয়েছিল দরিদ্র, অবিকশিত একটি দেশে, তাও তারা সীমিত ছিল একটি রাজ্যে বা এলাকায় । তাছাড়াও, হাংরিদের রাজনৈতিকভাবে যেমন করে দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল তেমন বিটনিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই ঘটেনি । গিন্সবার্গ, ফেরলিংঘেট্টি, কোরসো, বারোজ এবং বাকি সবাই তাঁদের কুখ্যাতিকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাঁরা তা না চাইলেও পেরেছিলেন । এর ফলে তাঁদের আন্দোলন বহুকাল টিকে থাকতে পেরেছিল এবং লতায় পাতায় বেড়ে উঠতে পেরেছিল, জনমানসে কাল্ট হিসাবে স্হান করে নিতে পেরেছিল ।          

অপরপক্ষে, ১৯৬১ সালে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী ও দেবী রায় যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারি লাঠিচালনা ও নিজেদের মধ্যে অবনিবনার কারণে স্তিমিত হয়ে যায়, অবনিবনার কারণ ছিল সরকারের লোকেদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের হয়রানি ও নাকাল করার চাপ । অশ্লীলতার আরোপে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা ও পরে মলয়ের জেলজরিমানা ছিল হাংরি আন্দোলন ভেঙে ফেলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা । তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে নির্মম পুলিশি হানা দিয়ে বৌদ্ধিক ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, বই, পাণ্ডুলিপি এবং চিঠিপত্র ।           

হাংরি  শিল্পীদের ক্ষেত্রে, বেনারসে, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় এবং সহযোগী শিল্পীদের ‘ডেভিলস ওয়র্কশপ’ নামে স্টুডিও তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ, নষ্ট করে দিয়েছিল তাঁদের আঁকা পেইইনটিঙ, আন্দোলনের নথিপত্র, যা পরে আর ফেরত পাওয়া যায়নি । সৌভাগ্যবশত অনিল করঞ্জাইয়ের কিছু কাজ, হাংরি আন্দোলনের  সময়ের, সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল এবং তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য সম্পদ হিসাবে সংরক্ষণ করা গেছে, যেগুলোয় পাওয়া যাবে হাংরি আন্দোলনের আইডিয়া এবং উদ্বেগ । এগুলো থেকে হাংরি আন্দোলনকে আরও গভীর ভাবে বোঝা যায় । এটা বলা ক্লিশে হবে না যে শব্দাবলীর তুলনায় উদ্দেশ্যকে ছবি আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরতে পারে। অনিল করঞ্জাই ( ১৯৪০ – ২০০১ ) ছিলেন হাংরি আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত একমাত্র শিল্পী । একই ধরণের বিট চিত্রশিল্পী ছিলেন রবার্ট লাভাইন ( ১৯২৮ – ২০১৪ )। অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন যে বিট আন্দোলনের জন্ম দেয়ায় রবার্টের বেশ বড়ো অবদান আছে । রবার্টের সান ফ্রানসিসকোর বিশাল বাড়িতে বোহামিয়ান, পোশাকহীন, বুনো তরুণ-তরুণী বিট আন্দোলনকারীরা সবাই মিলে বিট আন্দোলনকে চরিত্র দিয়েছিলেন । বিট আন্দোলনের গ্রাফিক্স আর পোস্টার এঁকে দিতেন রবার্ট। অনিল এবং করুণাও হাংরি আন্দোলনে একই কাজ করতেন ।            

গিন্সবার্গ এবং রবার্ট নিজেদের মধ্যে নান্দনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন । তাঁরা দুজনেই আণবিক কাখণ্ডে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত যুবসমাজের চেতনায় প্রতিফলিত অবক্ষয় ও মৃত্যুবোধকে নিজেদের কাজে প্রতিফলিত করতে চাইতেন, রবার্ট লাভাইনের কথায়, “স্হায়ীত্বের মিথ্যা” সম্পর্কে তিনি গিন্সবার্গের থেকে জেনেছিলেন । যে জগতের ভবিষ্যৎ নেই সেখানে স্হায়ী শিল্পকর্মের ধারণা তাঁকে অবশ করে দিয়েছিল, যা থেকে তাঁর মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল যদি না তিনি বিটনিকদের সংস্পর্শে আসতেন । ‘পাগল, ল্যাংটো কবি’ হিসাবে লোকে গিন্সবার্গকে জানতো, এবং রবার্টকে গিন্সবার্গ বলেছিলেন ‘মহান উলঙ্গ শিল্পী’, দুজনেই সহকর্মী ও বন্ধুদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন নিজের নিজের কাজে, প্রথমজন জ্বলন্ত ‘হাউল’ কবিতায় এবং দ্বিতীয়জন তাঁর রেখা ও রঙে । তাঁর আঁকা যুবক গিন্সবার্গের অয়েলপেইন্ট ব্যাপারটাকে বিশদ করে তুলেছে । 

বিটদের তুলনায় অনিল করঞ্জাই পোরট্রেট আঁকা বেশ দেরিতে আরম্ভ করেন । স্টাইলের দিক থেকেই আর্টিস্ট দুজন ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের আঁকা বেশ কিছু পোরট্রেটে পাওয়া যাবে ব্যক্তিবিষয়ের কোমলতা । এটা অনিলের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে করুণার বাচ্চা মেয়ের চারকোল স্কেচে, যে বাচ্চাটাকে অনিল জন্মের সময় থেকেই জানতো, আর হাংরি আন্দোলনকারীদের ম্যাসকট হয়ে উঠেছিল ।

 রবার্ট লাভাইন, প্রেমে গিন্সবার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী, পিটার অরলভস্কির যে বিরাট পেইনটিঙ এঁকেছিলেন, সেইটিই ছিল গিন্সবার্গের সবচেয়ে প্রিয় ছবি । উলঙ্গ, সুন্নৎ না-করা লিঙ্গ যৌনচুলে ঢাকা, ছবিটা যৌনতা উত্তেজক হলেও দুঃখি আর বিষণ্ণ । গিন্সবার্গ লিখেছেন যে তিনি পিটার অরলভস্কির সঙ্গে পরিচয়ের আগে ছবিটা যখন দেখেছিলেন তখন ‘চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে বিদ্যুৎপৃষ্ট বোধ করেছিলেন।’ সেই সময়কার মানদণ্ড অনুযায়ী গিন্সবার্গ এবং লাভাইন দুজনেই ছিলেন পর্নোগ্রাফার । কিন্তু কবির তুলনায় শিল্পী বেঁচে গিয়েছিলেন আদালতের হয়রানি থেকে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কেননা সত্তর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সামনাসামনি নগ্নতা এবং সমকামকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করা হতো । রবার্ট লাভাইনের মতো অনিল করঞ্জাইও নগ্নিকা এঁকেছিলেন এবং আদালতের চোখরাঙানি পোহাতে হয়নি । কিন্তু অনিলের ‘ক্লাউডস ইন দি মুনলাইট ( ১৯৭০ ) রোমা্টিক ক্যানভাসে বিট পেইনটারের তুলনায় অনিলকে ভিশানারি বলে মনে হয় ।           

প্রখ্যাত কবি এবং ‘সিটি লাইটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, যাঁকে ‘হাউল’ প্রকাশ করার জন্য অশ্লীলতার আরোপের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের মামলার সময়ে হাংরিয়ালিস্টদের রচনা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেও শিল্পী ছিলেন । ফেরলিংঘেট্টির এক্সপ্রেশানিস্ট দৃশ্যাবলী, প্রথম দিকে বিমূর্ত, পরে ফিগারেটিভ এবং প্রায়ই সরাসরি রাজনৈতিক — দর্শকদের নাড়া দেয় এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধি করে ।           

‘নেকেড লাঞ্চ’ গ্রন্হের লেখক উইলিয়াম বারোজ, যাঁকে আইনের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল, বিট জেনারেশনের একজন নামকরা সদস্য, তিনিও ছিলেন ভিশুয়াল আর্টিস্ট । কিন্তু বারোজের পেইনটিঙ এবং ভাস্কর্য প্রকৃতপক্ষে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী । তিনি অনেক সময়ে নিজের মনের গভীরতাকে তুলে ধরার জন্য চোখ বন্ধ করে আঁকতেন, যাগুলো হতো উন্মাদগ্রস্ত, কেবল কড়া মাদক সেবনের এবং অযাচারী যৌনতার ফলেই নয়। বেশ কিছু ক্যানভাসে বুলেটের ছ্যাঁদা আছে, তাঁর দর্শকদের জানাবার জন্য যে উইলিয়াম টেলের মতন গুলি চালাতে গেলে তিনি নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন, স্ত্রীর মাথাকে খেলার বল মনে করে । বারোজকে বলা হতো ‘পাঙ্ক’-এর পিতা, পরে ‘পপ শিল্পের পিতা’ অ্যাণ্ডি ওয়ারহল-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং দুজনে একত্র হলে আমোদ করতেন । অ্যাণ্ডি ওয়ারহল বন্দুকের ব্যাপার ভালোই জানতেন, যদিও তিনি ছিলেন আক্রান্ত, আক্রমণকারী নন । ‘দি ফ্যাক্টরি’ নামে খ্যাত ওয়ারহলের নিউ ইয়র্কের স্টুডিওতে বারোজ প্রায়ই যেতেন ।           

প্রথম দিকে বিটদের বিমূর্ত এক্সপ্রেসানিস্ট পেইনটারদের সঙ্গে একাসনে বসানো হয়েছিল, যদিও বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটাররা তাঁদের জীবনযাত্রায় বিটদের অচিরাচরিত ব্যক্তিগত জীবনের মতন ভবঘুরে ছিলেন না । তাঁরাও মিডিয়াকে ও দর্শকদের তাঁদের কাজের মাধ্যমে চমকে দেবার প্রয়াস করতেন । তাঁরাও, একইভাবে, প্রথানুগত আঁকার রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতেন । তার জন্য তাঁরা বিশাল বিশাল ক্যানভাসে দ্রুত তরল স্ট্রোক দিতেন ; একে তাঁরা বলতেন ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’, আর এই ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’ ছিল হাংরিয়ালিজমের মননবিন্দু । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটিঙকে এখন নৈরাজ্যবাদী মনে হতে পারে, যা বিট এবং হাংরি আন্দোলনের রচনাপদ্ধতিতে একই ধরনের ছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু হাংরি পেইনটারদের শিল্পকলা ছিল সুচিন্তিত, তাঁদের কেঅস ছিল পরিকল্পিত ।           

একজন শিল্পী উন্মাদের মতন অনিয়ন্ত্রিত আবেগে এঁকে চলেছেন ব্যাপারটা নিছক ক্লিশে, এবং কম সংখ্যক শিল্পীই অনিল করঞ্জাইয়ের মতন এই ব্যাপারটায় জোর দিয়েছেন । নিওফাইট হিসাবেও, অস্হির তেজোময়তা ও পরিপূর্ণ জোশে অনিল করঞ্জাই এঁকেছেন প্ররিশ্রমান্তিক সুচিন্তিত ক্যানভাস । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকার কারণে, যাঁদের মধ্যে তাঁর বয়স ছিল সবচেয়ে কম, এই বৈশিষ্ট্যগুলো গুরুত্ব পেয়েছে । যে একমাত্র শিল্পী তাঁকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন ডাচ শিল্পী হিয়েরোনিমাস বশ ( ১৪৫০ – ১৫১৬ ) । বশের গ্রটেস্ক বিদ্রুপাত্মক চিত্রকল্প অনিল করঞ্জাইকে অনুপ্রাণিত করত, যে সময়ে অনিল শ্রেণিবিভাজিত এবং শোষিত সমাজের একক ভিশন নিজের পেইনটিঙে গড়ে নেবার প্রয়াস করছিলেন । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিজম সম্পর্কে অনিল বহু পরে জেনেছেন ।           

 সবচেয়ে কুখ্যাত বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট জ্যাকসন পোলক — ‘ফোঁটাগড়ানো জ্যাক’ — একজন ‘অ্যাকশান পেইনটার’, ক্যালিফর্নিয়ার ‘দি আমেরিকান মিউজিয়াম অভ বিট আর্ট’’-এ বহু শিল্পীর সঙ্গে স্হান পেয়েছেন । চরম ডাডাবাদী মার্সেল দুশঁও পেয়েছ, যিনি, বিটনিকরা জন্মাবার আগেই ‘অ্যান্টি-আর্ট’ শব্দবন্ধটির উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং সেকারণে বিটদের আদর্শ । কিন্তু শোনা যায় যে পঞ্চাশের দশকে যখন অ্যালেন গিন্সবার্গ ও গ্রেগরি কোরসো প্যারিসে দুশঁর সঙ্গে দেখা করেন, দুজনে নেশায় এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে গিন্সবার্গ দুশঁর হাঁটুতে চুমুখান, আর কোরসো নিজের টাই কেটে ফ্যালেন । বয়স্ক দুশঁর তা পছন্দ হয়নি । বিটদের সেসময়ের আচরণ এমনই স্বার্থপরভাবে অসংযত ছিল যে তাঁরা অনেককে চটিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন, এমনকি জাঁ জেনেকেও, যাঁর আদবকায়দা মোটেই ভালো ছিল না ।         

 বেনারসে বসবাসের সময়ে অনিল করঞ্জাই ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মাঝে ছবি আঁকার বিষয় নিয়ে কোনো অর্থবহ আলোচনা হয়েছিল বলে মনে হয় না । মার্কিন লোকটির আগ্রহ ছিল উচ্চতর ব্যাপারে প্রতি, অর্থাৎ সাধু, শ্মশানঘাট, মন্ত্র, গাঁজা ইত্যাদি । হিন্দি ভাষার বৌদ্ধ কবি নাগার্জুনের সঙ্গে অনিল ও করুণা অ্যালেন গিন্সবার্গকে হারমোনিয়ামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি গিন্সবার্গ ও অরলভস্কিকে ছিলিম টানার কায়দা শিখিয়ে ছিলেন, যা প্রায় ধর্মাচরণের ব্যাপার এবং মোটেই সহজ নয় । এ ছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকায় গিন্সবার্গ বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । অনিলের খারাপ লাগেনি কেননা তাঁর বয়স তখন কম ছিল, আনন্দ পেয়েছিলেন ইংরেজিতে কথা বলার সুযোগ পেয়ে, যা ভাষায় অনিল তখন অত সড়গড় ছিলেন না । অনিল আর করুণা দুজনেই খ্যাতিপ্রাপ্ত মার্কিন সাহেবকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের আমেরিকা কবিতার পঙক্তি চেঁচিয়ে অনিল বলতেন, “আমেরিকা তোমার ডিমগুলো কবে ভারতে পাঠাবে?”              

সন্দেহ নেই যে গিন্সবার্গ রেসিস্ট ছিলেন না, অন্তত সচেতনতার স্তরে । কিন্তু তাঁর মধ্যে সাদা চামড়ার মানুষের ঔদ্ধত্য ছিল, যা অন্যান্য বিটদের মধ্যেও ছিল । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন হওয়া সতবেও একটা স্তরে তা ছিল অত্যন্ত এলিটিস্ট । যেমন বারোজ, স্ত্রীকে খুন করার পরেও ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, কেননা তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছিলেন এবং তাঁর পরিবার ছিল বৈভবশালী । গিন্সবার্গ ততোটা ধনী পরিবারের না হলেও বেশ কমবয়সেই সুপারস্টার হয়েগিয়েছিলেন । তিনি ভারতে এসে যতোই গরিব সেজে থাকুন, তা তাঁকে তাঁর মঞ্চ থেকে নামাতে পারেনি, তা ছাড়া ভারতে তিনি চামচাগিরির সুখও পেয়ে থাকবেন । সম্ভবত হাংরি আন্দোলনকারীরাই একমাত্র তাঁর সঙ্গে সমানে-সমানে আইডিয়া আদান-প্রদান করেছিলেন এবং তাঁর কবিতায়  ও ভাবনাচিন্তায় হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রভাব স্বীকার না করাটা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে না ।          

গিন্সবার্গ, যিনি ভারতের ধর্মে পরোক্ষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়, হাংরি আন্দোলনকারীদের ধর্ম সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তাকে গ্রহণ করতে পারেননি । হাংরি আন্দোলনকারীরা ঈশ্বরকে বিসর্জন দিয়েছিলেন আর যে কোনো ধরণের উপাসনা-অর্চনা সম্পর্কিত বিশ্বাসকে সমসাময়িক ভাষায় নিন্দা করেছেন । অনিলের শৈশব বেনারসে কাটার দরুন তিনি ছোটোবেলা থেকেই ধর্মে বিশ্বাস করতেন না ; তিনি মন্দিরের বয়স্কদের বারো বছর বয়স থেকেই চ্যালেঞ্জ করতেন, আর তাদের তর্কে হারিয়ে দিতেন হিন্দুধর্মের জ্ঞানের সাহায্যে । বিজ্ঞাননির্ভর মানসিকতা নিয়ে অনিল সারাজীবন আস্তিক ছিলেন । প্রথম দিকের বৌদ্ধধর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করলেও অনিল তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সমালোচনা করতেন, আর শেষ জীবনে অ্যালেন গিন্সবার্গ এই ধর্মে ধর্মান্তরিত হন । অবশ্য বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে বিট কবিদের যুদ্ধবিরোধী রাজনীতির মিল ছিল, যেমনটা ছিল হাংরি আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যদের ।

 হাংরিদের রাজনীতির কথা যদি বলতে হয়, শেকড়পোঁতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবাই যেমন তীব্র আক্রমণ চালাতো তাকে অনিল করঞ্জাই সমর্থন করতেন, কিন্তু তাদের অ্যানার্কিজমকে মেনে নিতে পারেননি অনিল । হাংরিদের বক্তব্য যে মানবাস্তিত্ব হল রাজনীতিরও আগের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে বর্জন করা দরকার, তাও মানতে পারেননি অনিল । অনিল কিছু দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু হাংরিতে যোগ দেবার আগেই  বেরিয়ে আসেন । তা সত্বেও  অতিবামের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল । হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পরে তিনি নকশাল দলে যোগ দিয়েছিলেন, এই কথাটা সত্য নয় ।           

এ কথা সত্য যে বেনারস ও কাঠমাণ্ডুতে হাংরিরা যৌথ যৌনতার অর্গিতে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তা বিটদের যৌনজীবনের হইচইয়ের সামনে অত্যন্ত হালকা । অনিল এবং করুণা হিপি আর বিদেশি সাধক-সাধিকাদের সঙ্গে বেনারসে আন্তর্জাতিক কমিউনে  বসবাস করেছিলেন, এমনকি করুণা ছিলেন সেই কমিউনের ম্যানেজার ও মুখ্যরাঁধুনি । চেতনার বিস্তারের জন্য তাঁরা এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ইত্যাদি মাদক নিয়ে পাঁচিল ঘেরা জায়গায় এক্সপেরিমেন্ট করতেন । অনিলের চেতনায় এর প্রগাঢ় প্রভাব পড়েছিল কেননা অনিল দায়িত্বহীনভাবে মাদক সেবন করতেন না, পজিটিভ থাকার প্রয়াস করতেন, পেইনটার হিসাবে ভিশানের বিস্তার ছিল তাঁর কাম্য । ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ’ বলতে যা বোঝায় তার খপ্পরে তিনি পড়েননি ।  ( মলয় রায়চৌধুরী তাঁর  অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা উপন্যাসে তাঁদের যৌন জীবনের ছবি দিয়েছেন ।)       

হাংরিরা তাঁদের পেইনটিঙ ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটাও বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তৈরি করা গালগল্প, ১৯৬৭ সালে কাঠমাণ্ডুর বিখ্যাত একটি গ্যালারিতে প্রদর্শনীর শেষে এই সমস্ত ব্যাপার ঘটেছিল বলে প্রচার করা হয় । লেখকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাতে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যান্য হাংরিদের  কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল । করুণা তার যাবতীয় পেইনটিঙ পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলেন । অনিল করঞ্জাই একপাশে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করেছিলেন । অমন শিল্পবিরোধী কাজ তাঁর মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি । অনিলের আইকনোক্লাজম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ।          

হাংরিদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর কিছুটা অমিল থাকলেও, হাংরির নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে দিয়েছিলেন অনিল । ষাটের দশকে বেনারসের কমিউনে টানা বাহান্ন ঘণ্টায় আঁকা তাঁর ‘দি কমপিটিশন’ পেইনটিঙে তা প্রতিফলিত হয়েছে, কাজটা একটা বটগাছকে নিয়ে, যাকে তিনি উপস্হাপন করেছিলেন কেঅস এবং সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের মেটাফর হিসাবে । এই পেইনটিঙে হাংরিদের উদ্দেশ্য যেমন ফুটে উঠেছে তেমনই বিটদের উদ্দেশ্য ; প্রকৃতিপৃথিবীর  সঙ্গে মানুষের একাত্মতা, যে পৃথিবীতে অশ্লীলতা বলে কিছু হয় না এবং মানুষের ইনোসেন্স পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।           

হাংরির পরের দশকগুলোয় অনিল করঞ্জাইয়ের অঙ্কনজগতে পরিবর্তন ও পূর্নতাপ্রাপ্তি ঘটলেও, হাংরির সময়কার অভিজ্ঞতা তাঁর চেতনায় থেকে গিয়েছিল । তাঁর আইডিয়াগুলো হয়তো বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত, কিন্তু হাংরির লক্ষ্য তাঁর দৃষ্টির বাইরে কখনও যায়নি । তাঁর আঁকা পরবর্তীকালের ছবিগুলো অনেকাংশে ক্লাসিকাল, বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপগুলো দেখলে প্রথমদিকের পরাবাস্তব চিত্রকল্পের  বিরোধাভাসমূলক মনে হবে, যা তাঁর দর্শকদের বিভ্রান্ত করে ।   কিন্তু একথা নিশ্চয় বলা যেতে পারে যে প্ররোচনাদায়ক অলঙ্কারপূর্ণ চিত্রকল্প থেকে তিনি দূরে সরে গেলেও, ছবির ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটেনি । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনিল করঞ্জাইয়ের ছবিতে পাওয়া যাবে মানবাস্তিত্বের নাট্য যা প্রকৃতি নিজের মুড ও আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে । আর হাংরিদের কবিতার সঙ্গে তা খাপ খায় । বিনয় মজুমদার তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় চিত্রকল্পর আত্মাকে ধরে রেখেছেন, যখন তিনি বলেন:   

পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী

দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে

তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে

চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা ।          

অনিল করঞ্জাইয়ের জীবনেও মিলনের এই স্বপ্ন বার বার ফিরে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিগুলোয় । ১৯৬৯ সালে আঁকা ‘দি ড্রিমার’ নামের পেইনটিঙে অনিল স্পষ্ট করে তুলেছেন সৃষ্টিকর্মীর একাকীত্ব : সেই ‘ড্রিমার’  হাংরিদের  সংঘর্ষময় এলএসডি মাদকে মুখিয়ে রয়েছে ; অনিলের আরেকটি ওয়াটার কালারে মলয় রায়চৌধুরীর ঘোষণা এসেছে ছবির থিম হয়ে । মলয় বলেছিলেন, “আমি মনে করি প্রথম কবি ছিলেন সেই জিনজাসথ্রপাস প্রাণী  যিনি লক্ষ লক্ষ বছর আগে মাটি থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে তাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন।”  পরের দিকে অনিলের আঁকা কবি ও দার্শনিকরা, পাথরে খোদাই করা, প্রকৃতির শৌর্যমণ্ডিত, তাদের অস্ত্র কেবল তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা । এই ছবিগুলো মহান আর্টিস্টের মতন করে আঁকা । হাংরিতে অনিলের মতন এমন একজন ছবি আঁকিয়ে ছিলেন যিনি মৌলিক ।

আট : হাংরি যুগের ক্ষুধার্ত পত্রিকা পর্ব

হাংরিতে অংশগ্রহণকারীদের মুচলেকা দেয়া আর আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হওয়া নিয়ে ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার কার্তিক-পৌষ ১৩৯১ সংখ্যায় তাঁর সম্পাদকীয়তে শিবনারায়ণ রায় লিখেছিলেন : “যেটি আমার কাছে সবচাইতে গ্লানিকর মনে হয়েছে সেটি পুলিশের মূঢ়, অতিনৈতিক  জুলুমবাজি নয়, সেটি হল প্রথম ধাক্কাতেই বিদ্রোহী লেখকদের হার মানা । মকদ্দমা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল মলয়ের বিরুদ্ধে ; তাঁর বেশির ভাগ সাহিত্যিক সহকর্মীই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক পুলিশের কাছে অস্বীকার করেন । শহিদ হওয়া শিল্পীদের দায়িত্ব নয় ; কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ এবং বিপন্ন বন্ধুর প্রতি আনুগত্য না-থাকলে কোনও আন্দোলনই শক্তি অর্জন করতে পারে না । শিল্পকৃতির জন্য আন্দোলন জরুরি নয় ; শিল্পী ও ভাবুকদের মধ্যে অনেকেই নির্জনে বসে সাধনা করবার পক্ষপাতী । কিন্তু কোনও আন্দোলন — শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে হোক, আর জীবনের অন্য বিন্যাসেই হোক — প্রভাব ফেলতে পারে না, যদি না সেই আন্দোলনে যাঁরা অ২শভাক তাঁরা সৎ, নীতিনিষ্ঠ, এবং পরস্পরের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হন । যেমন উৎসবে ব্যাসনে তেমনি দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে পাশে থাকে সেই তো বন্ধু “।

কলকাতা হাইকোর্টে ব্যাঙ্কশাল আদালতের রায় খারিজ হবার পর আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাই আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট পোড়াবার চাকরি থেকে যাতে নিষ্কৃতি পাই তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছেড়ে যোগ দিই অ্যাগরিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশানে । নতুন চাকরিতে আমাকে কৃষি আর গ্রামীণ জীবন নিয়ে এতো বই পড়তে হতো আর ট্রেনিঙ নিতে হতো যে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় । পাটনার ইমলিতলা বস্তিতে বসবাস করে বাজরা আর জোয়ারের খেতের তফাত, মুসুরি আর মুগডালের খেতের তফাত, খেতে জলসেচের নানা পদ্ধতি, ভারত জুড়ে ছাগল, গোরু, শুয়োর ইত্যাদি পশুদের তফাত জানতুম না । হিমালয়ের তরাইতে যে জংলি গোরুর পাল থাকে তা জানতুম না । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়ার ফলে তুলনামূলকভাবে আমার পেনশন কমে গেছে, যদিও ভারতবর্ষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর ।

হাংরি বর্জনের বয়ানের কারণেই হয়তো, যারা কলকাতায় রইল তারা ‘ক্ষুধার্ত’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করল । ১৯৬৯ সালে প্রথম সংখ্যা আর ১৯৮৪ সালে সপ্তম বা শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল । প্রথম তিনটি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং পরের চারটি সংখ্যা শৈলেশ্বর ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।এই সময়ে অনেক নতুন লেখক হাংরি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষুধার্ত পত্রিকায় লেখা দিয়েছিল ।  এই সংখ্যাগুলো নিয়ে শঙ্খ ঘোষের উদ্যোগে সাহিত্য অকাদেমি থেকে একটা সংকলন ১৯৯৫  সালে প্রকাশিত হয় । বলাবাহুল্য সাহিত্য অকাদেমি ক্ষমতার একটি পীঠস্হান ।

শঙ্খ ঘোষের উদ্যোগে দে’জ থেকে একটা হাংরি জেনারেশন সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । বইটি সম্পর্কে কথাকলি দত্ত ‘৩৬৫ দিন’ সংবাদপত্রে ‘ইতিহাসের বিকৃতি’ শিরোনামে লিখেছেন,  “হাংরি জেনারেশন রচনা সংগ্রহ যখন দে’জ এর মতন নামী প্রকাশন সংস্হা প্রকাশ করে, তখন মনে ফুর্তি হয় । তাই বইটি তড়িঘড়ি সম্পাদকের কাছ থেকে সংগ্রহ করি । সম্পাদক সব্যসাচী সেনকে আমি জানি না । প্রথমে ভেবেছিলাম, ঘ্যাম কেউ হবেন বোধহয়, খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম, না না, তেমন কেউ নন, শৈলেশ্বর ঘোষের চামচা । শঙ্খ ঘোষ অবধি এখনও পৌঁছোতে পারেনি বেচারা , চেষ্টা যদিও আছে খুবই, তবে শঙ্খর চামচা অভীক মজুমদারের কাছ অবধি পৌঁছে গেছে । যদি ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে । কথা হচ্ছে হাংরিদের নিয়ে — এর মধ্যে আবার শঙ্খ ঘোষ এলেন কোথ্থেকে ! অভীক ভাইটি, সব্যসাচীর ভাইপোটি, শঙ্খ ঘোষকে আমি আনিনি — এনেছ তোমরা — বইয়ের শুরুতে । যে মাঝারি মাপের কবিটি লম্বা জিব বের করে সারা জীবন আনন্দবাজারের পা চেটে-চেটে কবিগুরু হলেন, তিনি নাকি হাংরি ! সোনার পাথরবাটি ! কাঁঠালের আমসত্ব ! তাঁর খিদে তো অন্য ভাই অভীক, ভাইপো সব্যসাচী । এখন ৬৭০ পাতার বই তোমাদের প্রকাশ করতে হল শুধু শঙ্খর নির্দেশে, শৈলেশ্বরকে হিরো বানাতে এবং হাংরি স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে হেয় করতে ! বেচারা ! ইতিহাস চক-ডাস্টার নয় যা চাইলেই মুছে দেওয়া যায় । যে যাই বলুক, হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন । তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই হয়তো ছিলেন, কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী এই আন্দোলনের জনক । অভিভাবকবাবুরা কথা ঘোরাতে চাইলেও সত্যিটা সত্যই থাকবে । মলয়ের নেতৃত্বে ১১ টি প্রস্তাবের ইশতাহার বের করেছিল আন্দোলনকারীরা । একটা টকে যাওয়া ও পচে যাওয়া সময়ের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিবাদ ।”

কথাকলি দত্ত যাই বলুন না কেন, শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি যুগের একজন প্রতিভাবান কবি; কবিতায় নবায়ন এনেছে শৈলেরশ্বর।   তার অনুগামীদের যে ‘ক্ষুধার্ত’ অভিধা সরিয়ে  ‘হাংরি’’ ভাবকল্পটিকে সংকলনগুলোতে স্বীকার করতে হয়েছে তা হাংরি যুগের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি । তবে শেষ বয়সে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বসে ফোটো তোলানো শৈলেশ্বর ঘোষের উচিত হয়নি ।

এই প্রসঙ্গে সব্যসাচী সেনকে দেয়া শৈলেশ্বর ঘোষের সাক্ষাৎকারের অংশটা উল্লেখ্য

সব্যসাচী সেন : আমরা তো আমাদের কবিদের দেখছি, তারা ছুটছেন প্রচারের পেছনে, পুরস্কারের পেছনে, ছুটছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠার পেছনে- সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, সাফল্যের পেছনে-

শৈলেশ্বর ঘোষ  : আজকের সারা পৃথিবীই তো ‘সাফল্য’ শব্দটার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অসুখ। এখানেও তুমি একটা ভুল করলে, ‘সকলে কবি নয় কেউ কেউ কবি’। সাফল্যের পেছনে যারা ছোটেন তারাই তো ক্ষমতার মূল্যবোধগুলিকে মানুষের মনে বৈধতা দিয়ে দেন এবং ক্ষমতা তাদের আরো বড়ো সাফল্যের দিকে ছুটতে বলে।

ক্ষুধার্ত পর্বে  ছোটোগল্প লেখক অবনী ধর এক নতুন প্যানারমা সৃষ্টি করেছে । কবি শুভঙ্কর দাশ আর শর্মী পাণ্ডেকে অনুরোধ করে আমি অবনী ধরের সব কয়টি গল্পের সংকলন সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলুম । 

১৯৬৮ সালের সন্ধ্যা । হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জড়ো হয়েছেন জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য । টেবিলে উঠে পড়লেন অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন এই গানটা, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সবাই, এমনকি হাংরি আন্দোলনের কয়েকজন ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । যে সাংবাদিকরা খবর কভার করতে এসেছিলেন তাঁরাও গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা । পরের দিন দি স্টেটসম্যান যে সংবাদ দিয়েছিল তাতে ভাসা-ভাসা উল্লেখ ছিল । সেই সপ্তাহের ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে । ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু । 

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ

শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।

উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ ।

১৯২০ সালে, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিল এবং তারও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । 

অবনী ধরের নৃত্য হাংরি যুগকে অন্যান্য সাহিত্যিক ভাবনাচিন্তা থেকে আলাদা করে তোলে। কেউ কি ভাবতে পারেন যে কল্লোল যুগের কোনো লেখক খালাসিটোলায় টেবিলের ওপরে উঠে নাচতে-নাচতে গান গাইছেন ?

নয় : হাংরি যুগের সার্থকতা

হাংরির সার্থকতা নিয়ে অভিজিত পাল যে কথাগুলো বলেছেন তা আমি এখানে তুলে ধরছি। বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । ১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট ।৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট ।৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে ।৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। ৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । ৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্হীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্হীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর । ৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে । ৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন ।১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।১১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে । তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি । এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্হের কাহিনির অনুকরণে ; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে । আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের । সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল । বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’ । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন । যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হ ‘আমার চাবি, ইত্যাদি । তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন ।১২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ । হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য । পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন । ১৩ ) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন । ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি  আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল । হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে । তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে । সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে । তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন । ১৪ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল । রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই । নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি । রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে । হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা । এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।১৫ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা ; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন । হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন । যোগসূত্র খোঁজাল কথা বললেন । শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন । এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন । তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট । যেমন অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল । ১৬ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো । কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা । হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা । ভঙ্গুরতার কথা । তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা । হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব । ১৭ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা । তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা । গুরুগম্ভীর কবিতার কথা । নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা । যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা । তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল । এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না । উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা । ১৮ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্হিতাবস্হার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন । পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে ; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন । ১৯ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন । বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের । অভেদের সন্ধান করলেন । একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন । বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন । উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি । ২০ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা হা্রণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে । ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না ; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না ; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন । তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হগুলি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, পদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা । যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস । যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন । হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে  তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে । ২১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম । উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে । বামপন্হী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে । যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে । পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ২২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি । পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে । ২৩ ) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্হিতি পরিলক্ষিত হয় । পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে । যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন,  প্রমুখ ।২৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল ; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল । সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন । শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো । ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন ।হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন । শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না । শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’ । তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন । পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন ; সম্পূর্ণ কাব্যগণ্হ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই । ২৫ ) হাংরি জেনারেশন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় দারুণ আঘাত হেনেছিল।  প্রতিঘাতে তাদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল।  হ্যান্ডবিল আকারে প্রকাশিত হাংরি বুলেটিনগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। ‘হাংরি জেনারেশন’ যেসব সাহিত্যিকদের জন্ম দিয়েছে, তারা ব্যক্তিগত জীবনে এক অর্থে অসফল হলেও তাদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসঙ্গতিকে, এত অল্প সময়ে এভাবে কলমের আঘাতে আর কোনো সাহিত্যকেন্দ্রিক আন্দোলন, জর্জরিত করতে পারেনি। ২৬ ) হাংরি আন্দোলন সাবলম্বী করেছে বাংলা সাহিত্যকে, আধুনিকোত্তর সাহিত্যের ভিত্তি মজুবত হয়েছ এই আন্দোলনের প্রভাবে । এমন নজির পৃথিবীর খুব কম ভাষাতেই রয়েছে। হাংরি আন্দোলন অনন্য করে তুলেছে বাংলার গদ্য ও কাব্যধারাকে, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাই বাংলা কবিতার ক্ষুধা আন্দোলনের স্রষ্টা।২৭ ) কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকায় অলোক বিশ্বাসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কবি-অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “হাংরির পরে আরও আন্দোলন হল, কোনোটাই হাংরির কৌলিন্য পায়নি।”

                     ——————–xxxxxxxxxxxxx—————————–

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

ময়ূর প্রজন্ম : মিয়ানমারের কবিতা আন্দোলন

ময়ূর প্রজন্ম : মিয়ানমারের কবিতা আন্দোলন

মিয়ানমারে একটি কবিতা দলের পাঁচ সদস্যকে দেশটির সেনাবাহিনীকে নিয়ে ঠাট্টা করার অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ময়ূর জেনারেশন দলটিকে এপ্রিল মাসে তাদের “থাংয়াত”-এর জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল -যা  একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প জনার, যা কথ্য শব্দ কবিতা, কমেডি এবং নৃত্যকে একত্রিত করে অনুষ্ঠিত হয়। অভিনয়শিল্পীরা সামরিক বাহিনীকে অবমূল্যায়ন করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হবার পর প্রত্যেককে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকে কবিতা পাঠ সরাসরি প্রচার করার দোষে আন্দোলনের তিন সদস্যকে অতিরিক্ত চার্জের সম্মুখীন হতে হয়। পাবলিক স্টেটমেন্ট আইনের ৫০৫.এ ধারার অধীনে পাঁচজন কবি – কে খাইন তুন, জায় ইয়ার লুইন, পেইং পিয়ো মিন, পেইং ইয়ে থু এবং জাও লিন হুতুতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। মং ইউ পাই, মিয়ানমারের সমসাময়িক  কবিতার একটি অতিপরিচিত নাম, ৯ মার্চ তাঁর নিজের শহর মাইক-এ  বিক্ষোভে প্রদর্শনের সময় গ্রেপ্তার হন। তাঁকে মায়েক কারাগারে দুই বছরের জন্য পাঠানো হয়েছ,  যেখানে তিনি আজ অবধি রয়েছেন। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত প্রথম কবিরা হলেন কো চান থার সোয়ে এবং মা মিন্ট মিন্ট জিন। মার্চের শুরুতে মনিওয়াতে গণবিক্ষোভের সময় একজনের মাথায় ও অন্যজন বুকে গুলি করে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে, যখন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর দলকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন দলটি  এক ডজন কবিকে প্রার্থী করেছিল, যাদের সকলে জয়ী হন। ছায়া সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ ই মন ছিলেন এমন একজন বিজয়ী। ইউ সেন উইন ছিলেন মনিওয়াতে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রতিনিধি । তিনি কবিতা ও নাটক  লিখেছেন। একদিন সকালে, একজন আততায়ী ষাট বছর বয়সী মিঃ সেন উইনের উপর এক বালতি পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে মারে।

Posted in Uncategorized | Tagged , , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

কবিতা পড়া, কবিতা শোনা, কবিতা এড়িয়ে যাওয়া: মলয় রায়চৌধুরী

এক

.

ভারতবর্ষের ভাষাগুলোতে বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগ-জনিত এই শ্লোক প্রথম কবিতা বলে প্রচারিত। 

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।

যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।। ”

স্কুলে সংস্কৃত শিখেছিলুম । কম নম্বর পেতুম । সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ পড়িনি । মহাভারতও নয়।

.

কৃত্তিবাসের রামায়ণও পড়িনি, যদিও ইমলিতলার বাড়ির পুজোর ঘরে কৃত্তিবাসের রামায়ণ লাল শালুতে মোড়া রাখা থাকতো। রামায়ণ পড়েছি রাজশেখর বসুর অনুবাদে । মহাভারত পড়েছি অনুবাদে।কাশীরাম দাসের নয় ; কালীপ্রসন্ন সিংহের । ইমলিতলার বাড়িতে মহাভারত রাখা হতো না, বাড়িতে মহাভারত রাখলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া-মারামারি হয়, তাই । এই দুই মহাকাব্যের পরও বাংলায় মহাকাব্য লেখা হয়েছে :  মাইকেল মধুসূদন দত্তের পর মহাকাব্য-রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৃত্রসংহার) এবং নবীনচন্দ্র সেনের ‘ত্রয়ী’ যথাক্রমে রৈবতক (১৮৮৭),কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩),প্রভাস(১৮৯৬) । এই শতকের শেষে গীতিকাব্যের বন্যাবেগ না এলে, মহাকাব্যের ধারাকে বিশ শতকের আরম্ভ পর্যন্ত টেনে আনা চলতো। বিশ শতকেও আমরা অনেক মহাকাব্য পেয়েছি। কিন্তু সমসাময়িক গীতিকাব্যের আন্তরিকতা, সত্যবোধ এবং দীপ্তির কাছে তা অত্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ায় আজ আর তার খোঁজ কেউ নেন না। বিশ শতকের মহাকাব্যের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – আনন্দচন্দ্র মিত্র (হেলেনা কাব্য), কায়কোবাদ (মহাশ্মশান), হামিদ আলী (সোহ্‌রাববধ কাব্য), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (অনলপ্রবাহ) এবং যোগীন্দ্রনাথ বসু (পৃথ্বীরাজ)। এগুলোর মধ্যে মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্য ছাড়া কোনোটাই পড়িনি ।  অশ্ব ঘোষ-এর লেখা ‘বুদ্ধকার্তিকা’ আর ‘সৌন্দরানান্দকাব্য’  পড়িনি  । কালিদাস-এর   ‘ঋতুসংহার’ ‘মেঘদূত’, ‘রঘুবংশ’,  ‘কুমারসম্ভব’ , ‘মালবিকাগ্নিমিত্র‘ ,’বিক্রমোর্বশীয়’ আর ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’,  সবই পড়েছি  অনুবাদে। ‘গিলগামেশ’ মূল রচনা পড়িনি, স্কুলে থাকতে গল্পের বইতে পড়েছি । গীতা,  বেদগুলো  পড়েছি চাকরিতে ঢোকার বছর দশেক পর, বাংলা অনুবাদে । কোরান পড়েছি অনুবাদে – বুঝতে পারিনি । 

.

অর্থাৎ বই পড়ার শিক্ষার সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার কোনো যোগ নেই । পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কবিতা লেখেন এবং সেগুলোকে ডেসিফার করা সহজ নয়। কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কবির জন্ম হয়। এ কথা যেকোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা না হলে ফরাসি কবি আর্তুর র‍্যাবো কিভাবে ২০ বছর বয়সের মধ্যে লিখে ফেললেন তার ভয়ংকর সুন্দর সব কবিতা, হুইটম্যান কেন ভবঘুরে জীবন যাপন করেও হয়ে ওঠেন মার্কিন কবিতার জনক, লেটোর দলের অন্যদের মতো হারিয়ে না গিয়ে নজরুল কিভাবে নাড়িয়ে দেন বাংলা কবিতার ভুবন। আর অসম্ভব প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যেখানে হতে পারতেন ভাইয়ের মতো আইসিএস অফিসার, তা না হয়ে, হয়ে উঠলেন বিশ্বকবি। কবির জন্ম না হলে এসব অসম্ভব, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এঁরা কেউ পাঠশালায় কবিতা শেখেননি ।

.

কবিতার উৎপত্তি নির্ণয় করা কঠিন, কারণ লিখিত কবিতার প্রাচীনতম উদাহরণ সম্ভবত সময়ের কাছে হারিয়ে গেছে।  নাসার একটা  রিপোর্ট আছে মহাভারতের যুদ্ধের সময়কালের ওপর। মহাভারতে যে তেরো দিনের ব্যবধানে পুর্ণ চন্দ্রগ্রহণ আর পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ব্যাখ্যা আছে সেই সূত্র ধরে নাসার পক্ষ থেকে এস বালাকৃষ্ণান কয়েকটা বছরকে চিহ্নিত করেছেন, যে সময়ে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যেমন, ৩১২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ২৫৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ১৮৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ১৩৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ইত্যাদি । তবে গবেষকদের মতে বাল্মীকি রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রমাণ (যেমন মহাভারতে সতীদাহ প্রথার উল্লেখ থাকলেও রামায়ণের মূল পাঠে তা নেই) থেকে অনুমিত হয় এই গ্রন্থ মহাভারতের আগে লেখা হয়েছিল। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, হিন্দু কালপঞ্জিতে উল্লিখিত যুগপর্যায়ের দ্বিতীয় যুগ, ত্রেতায় এই মহাকাব্য লেখা হয়। গল্প অনুযায়ী, ত্রেতা যুগেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা দশরথের ছেলে রামের জন্ম হয়। এগুলো মহাকাব্য বা সেই সময়ের কবিতা । মহাভারত আর রামায়ণ মহাকাব্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এ-দেশের মানুষের ধর্মাচরণ, নিষ্ঠা, বিশ্বাস। এবার মাটি খুঁড়ে রামায়ণ-মহাভারতের সময়কার জীবনশৈলী খুঁজতে দিল্লিতে  খোঁড়াখুড়ি চলছে। দেশজুড়ে দুই মহাকাব্যের শিকড়ের খোঁজে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগকে খননকার্যের নির্দেশ দিয়েছে  সরকার। ফেব্রুয়ারি মাসে, রাজধানী দিল্লি থেকে মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্বে  শুরু হয়েছে খোঁড়াখুড়ির কাজ। 

.

একটা লেখাকে ঠিক কী ব্যাপার কবিতায় পরিণত করে সেটা এমন এক বিষয় যার উত্তর সাহিত্য সমালোচনার সমগ্র ইতিহাস এখনও দিতে পারেনি।কবিতার উদ্দেশ্য কী তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন।  কেন মানবসমাজে কবিতার  সৃষ্টি হয়েছে ? প্রথমত, মানব সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে শৈল্পিক সৃষ্টিতে নিযুক্ত । মানব আচরণের প্রাচীনতম প্রমাণের বেশিরভাগই, যা আজও টিকে আছে, তা শিল্পের সাথে সম্পর্কিত, যেমন গুহাচিত্র, হরপ্পার ছোট ভাস্কর্য, পিরামিডের ভেতরে নানা ধরনের ছবি, মায়া আর অ্যাজটেকদের কাজ। সম্ভবত কবিতার অস্তিত্বের কারণ তা লেখা বা গাওয়া,  যা মানুষের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য। আলাদা করে ভাবলে, প্রতিটি কবিতার অস্তিত্বের নিজস্ব কারণ থাকতে পারে। কিছু কবি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ঘটনা বর্ণনা করতে লেখেন, যেমন সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলো, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি। অন্যগুলো জগতসংসার  সম্পর্কে স্বতন্ত্র সত্য প্রকাশ করতে, দার্শনিক ধারণা প্রকাশ করতে, কোনো ঘটনার  প্রাণবন্ত ছবি আঁকতে, নিজের জ্বলন্ত মগজের, ব্যর্থ প্রেমের, পচনরত কালখণ্ডের কথা বলতে, লেখা হয়েছে । যেমন ভারভারা রাও এই দেশের পচনরত কালখণ্ড সম্পর্কে লেখার জন্য জেলে রয়েছেন বহুদিন। সরোজ দত্ত আর দ্রৌণাচার্য ঘোষকে খুন করা হয়েছিল । শম্ভু রক্ষিতকে জেলে পোরা হয়েছিল।

.

রাষ্ট্রের পক্ষে কবিদের অপ্রয়োজনীয় মনে করে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আগেভাগেই কবিদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো। কিন্তু কবিতা তো শুরু হয়েছিল ব্যক্তি-এককের আত্ম-প্রকাশের একটা রূপ হিসেবে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির উদ্ভবের সঙ্গে পালটেছে কবিতা।তাদের কাব্যিক অনুষঙ্গ নির্বিশেষে, স্বৈরশাসকরা কবিতার বিপদ অনুভব করে, এই কারণেই তাদের শাসনামলে কবিদের নিয়মিতভাবে কারারুদ্ধ, নির্যাতন, হত্যা বা নির্বাসনে পাঠানো হয়। এমনও হয়েছে যে শাসকেরা কবির লেখা সহ্য করতে না পেরে হয় সরকারিভাবে তাকে খুন করেছে বা চুপচাপ গুমখুন করেছে বা লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় পিনোশের সরকার কবি পাবলো নেরুদাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করে। স্পেনে দক্ষিণপন্থী দলের উত্থানের সময়ে সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পক্ষপাতী লোরকা। গ্রানাডার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা এতটাই অস্থির ছিল যে কেউই সেখানকার মেয়রের দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। লোরকার আত্মীয় মন্তেসিনো এই পদে বসার সাতদিনের মধ্যেই খুন করা হয় তাঁকে। আর এই হত্যার পরের দিনই ১৯৩৬ এর ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার হন লোরকা। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯ আগস্ট।কবি ওসিপ ম্যাণ্ডেলস্টামকে গুম খুন করে লোপাট করে দিয়েছিলেন স্ট্যালিন। ১৯৫২ সালে তেরোজন ইহুদি কবি-লেখককে  মস্কোর লুবিয়াঙ্কা কারাগারে খুন করা হয়েছিল । কবিতা মানুষকে হত্যা করে না। একনায়করা করে। কিন্তু কবিতা আমাদের মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, আমাদের সাক্ষ্য দিতে বলে, সময়ের ব্যাখ্যা চায়।  “কবি শব্দই বিদ্রোহবাচক,কারণ জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থান যে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি,” একথা বলেছিলেন  শৈলেশ্বর ঘোষ।

.

কোনো কোনো কবি মৃত্যুর ওপার থেকেও আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। ১৯৪৪ সালে হাঙ্গেরির জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবার আগে মিক্লোস রাদনোতি তাঁর শেষ কবিতা লিখেছিলেন। তাকে মাথায় গুলি করে খুন করা হয়েছিল আর তাঁর লাশ পরে  গণকবরে পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে তাঁর কবিতা লেখার  ছোট নোটবুক, যার একটা পাতায় ছিল “আমি লিখি, আমি আর কি করতে পারি? একটা কবিতা বিপজ্জনক, / আর তুমি যদি কেবল জানতে যে কীভাবে একটা বাতিক, সূক্ষ্ম লাইন, / এমনকি এর জন্যও সাহস লাগে …”। নাজিম হিকমেত তাঁর  জীবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জেল ও নির্বাসনে কাটিয়েছেন। ওলে সোয়িঙকা বায়াফ্রার  বিদ্রোহীদের সাথে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন আর  পড়া-লেখার উপকরণ ছাড়াই দুই বছরের জন্য নির্জন কারাগারে বন্দী ছিলেন। বন্দী কবিদের সাম্প্রতিক তালিকাটি দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় – ডারেন তাতুর, ট্রান ডুক থাচ, স্টেলা নায়ানজি, আহনাফ জাজিম,  ইলহান কোমাক, আশরাফ ফায়াদ। মিয়ানমারের সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানে ৩০ জনের বেশি কবিকে বন্দী করা হয়েছে এবং চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। উইঘুর কবিদের চীনা বন্দিশিবিরে বন্দি রাখা অব্যাহত । রাশিয়ার গোয়েন্দারা একজন কবিকে বিষ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল আর  ইরানে, কবিদের “অপপ্রচার করা” এবং “পবিত্রতার অবমাননা” করার জন্য রাস্তার মোড়ে বেত দিয়ে পেটানো হয়েছে। এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস  একটা একক ঘটনায় তুলে ধরা যায়: বেলারুশিয়ার কবি স্টেপান লাটিপভ মিনস্কে বিচার চলাকালীন একটা কলমের নিব দিয়ে নিজের ঘাড়ের রক্তশিরায় ছুরি চালিয়েছিলেন । আমেরিকার সান কোয়ান্টিন কারাগারে  মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের অনেকের শেষ আশ্রয় কবিতা লেখা, যদিও তাদের ভয়ঙ্কর তকমা দিয়ে আলাদা-আলাদা খোপে রাখা হয়, আর লেখাগুলো জেলের বাইরে এনে কর্মী বা শিল্পীদের সহায়তায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। 

.

বহু কবি শাসকের তুষ্টির জন্য তার পদসেবা বেছে নিয়েছে । এই কবিদের কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে সমাজ-শাসক-ইতিহাস-দেশ ইত্যাদির পঠন-পাঠন করতে হবে।  কিছু লোক কিছু নির্দিষ্ট ধরণের কবিতা বোঝা কঠিন বলে মনে করতে পারে, আবার অন্যরা তা সহজে বুঝতে পারে । কিছু কবি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বার্তা জানাতে জটিল ভাষা বা চিত্রকল্প ব্যবহার করতে পারে, অন্যরা আরও সরল ভাষা ব্যবহার করতে পারে। শেষ পর্যন্ত, কবিতা বোঝা কঠিন হবে কি না তা ব্যক্তিগত রুচি, শিক্ষা, আগ্রহ আর ব্যাখ্যার বিষয় ।

.

দুই

.

কবিতা সম্ভবত গুহাচিত্রের পরের ধাপ । আম্বাদেবী রক আশ্রয়কেন্দ্রে ভারতের প্রাচীনতম গুহাচিত্র রয়েছে অম্বাদেবী গুহার দেয়ালে  যা ২৫০০০ বছর আগের। ভীমবেটকার গুহাচিত্র প্রায় ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। গুহাচিত্রকে মানব প্রাণীর সৌন্দর্যের উপলব্ধির প্রথম অভিব্যক্তি আর জীবনের এক রহস্যময় বা পবিত্র দিকের প্রতিনিধিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা যায়। প্রাগৈতিহাসিক বিষয়ের আর্ট গ্যালারিতে  পাথরের ওপর প্রাণবন্ত রঙের প্রাণীদের অজস্র ছবি আর কাজের আকর্ষণীয় ভঙ্গি দেখা যায়। গুহা চিত্রগুলো হল একটা ক্যানভাস হিসাবে গুহার দেয়াল ব্যবহার করে তৈরি করা পেইনটিঙ। প্রস্তর যুগে তৈরি, শিল্পের এই কাজগুলি প্রায়শই কাঠকয়লার মতো প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে আঁকা হতো। রঙ সাধারণ সরঞ্জাম  হাত দিয়ে বোলানো হতো। কবিতাও ওইভাবে বেরিয়ে আসে, মগজের গুহার দেয়াল থেকে। ২৫০০০ বছর দেয়ালের গায়ে আঁকা ছবিগুলো টিকে আছে ; এথেকেই তো প্রমাণ হয় যে মানুষ প্রথম থেকেই জানতে চেয়েছে  তার আস্তিত্বের মানে, বলতে চেয়েছে যে পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতে হলে শিকার করা আর খাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু আছে । বিশ্বের প্রাচীনতম গুহার দেয়ালে যাঁরা ছবি  তৈরি করেছেন তাদের সম্পর্কে কিছুই কি জানি আমরা ? 

.

পাথরে বা গুহার দেয়ালে আঁকা  বা খোদাই করা ছবি—যা বিশ্বজুড়ে পাওয়া গেছে—মানুষের যোগাযোগের প্রাচীনতম রূপগুলির মধ্যে একটিকে প্রতিফলিত করে, যার সাথে ভাষার বিকাশের সম্ভাব্য সংযোগ রয়েছে– তাই একে কবিতার আর গানের প্রথম ধাপ বলা যায়। প্রাচীনতম ছবিগুলো প্রায়শই বিমূর্ত দেখায় যা প্রতীকী হতে পারে। যখন পরবর্তীতে প্রাণী, মানুষ এবং মিশ্রচিত্রণ করা হয়েছে তা হয়তো একধরনের আধ্যাত্মিক কাজ ছিল। আরও স্পষ্টভাবে, গুহা শিল্পের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রতীকী, বহুমুখী ভাষার ক্ষমতা কীভাবে বিকশিত হয়েছিল সে সম্পর্কে সূত্র সরবরাহ করে । এই ধারণার একটি চাবিকাঠি হল যে গুহা শিল্প প্রায়শই শাব্দিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত, যেখানে শব্দ দৃঢ়ভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। এই আঁকাগুলো গুহার বেশ গভীরে, যেখানে ঢোকা কঠিন, সেই অংশগুলোতে অবস্থিত, যা থেকে আঁচ করা যায়  যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি গুহাগুলোর মধ্যে আঁকার একটা প্রধান কারণ ছিল। ছবিগুলো সম্ভবত শব্দগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করতো যা সেই দাগগুলোতে প্রাথমিক মানুষেরা বলতে চেয়েছিল। 

.

শব্দ আর অঙ্কনের এই যোগাযোগকে বলা যায় শ্রুতির তথ্য এবং চোখে-দেখা একটা মিশেল যা প্রাথমিক মানুষদের প্রতীকী চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়া ছিল।শব্দ এবং চিত্রের সংমিশ্রণ এমন একটি জিনিস যা আজ কবিতাকে চিহ্নিত করে,  অসীম নতুন বাক্য তৈরি করার ক্ষমতা দেয় কবি আর পাঠককে। গুহাচিত্রগুলোতে মানসিক চিত্রকল্পের পাশাপাশি উপলব্ধি, বা কাব্যিক কল্পনা, সেইসাথে পুঙ্খানুপুঙ্খ  কাজ ব্যবহার করা হয়েছে । কখনও কখনও একটা দেয়ালে সমস্তই যেন কবিতা, কখনও কখনও সমস্তই যেন গদ্য–অন্য সময়ে  পরিবর্তনশীল সংমিশ্রণ, যেখানে কবিতা গদ্যে পরিণত হয়, গদ্য কবিতায় পরিণত হয়।

.

এই প্রসঙ্গে শ্রুতি আন্দোলনের কবি পরেশ মণ্ডলের ভিজুয়াল কবিতা উল্লেখ করতে হয় । ভিজ্যুয়াল কবিতা একটি কবিতার অর্থের উপর জোর দেওয়ার জন্য কবিতায় চিত্র, রঙ, বিন্যাস, আকার, টাইপোগ্রাফি এবং প্যাটার্নের মতো গ্রাফিক বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করে। ভিজ্যুয়াল কবিতার প্রয়াস হলো পাঠককে সংবেদনশীল স্তরে সম্পৃক্ত করার, কবিতার চাক্ষুষ চেহারা ব্যবহার করে শব্দের সাথে অর্থের আরেকটি স্তর যুক্ত করা। সৃষ্টি এবং জাগতিক বস্তুর প্রতিনিধিত্বকারীর মধ্যে সম্পর্ক গড়ার উপরোক্ত আকাঙ্ক্ষা আমাদের জিনের মধ্যে  পোঁতা আছে আর আমাদের বিবর্তনের সাথে তা জড়িত । গুহা শিল্পের মতো, কবিতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাঠানো  গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সাংস্কৃতিক স্মৃতি হয়ে ওঠে । দুপুর মিত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, শ্রুতি আন্দোলনের কবি মৃণাল বসুচৌধুরী  বলেছেন, “এটুকু হয়ত বলাই যায়, বাংলা কবিতার অবয়বে যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এসেছে, কবিতার পংক্তির ১৪, ১৮ কিংবা ২২ অক্ষরের ঠাসবুনোন থেকে মুক্তি পেয়ে অক্ষরবৃত্তও যে দৃষ্টিনন্দন হয়ে খেলা করছে কবিতায়। কবিতার বহিরঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে, তার জন্য শ্রুতির কবিদের প্রচেষ্টাকে না মানাটা অন্যায় হবে। তার্কিকরা ১৯৬৫ সালের আগে কবিতার চেহারা কেমন ছিল এবং পরবর্তী দু’এক বছরে তা কিভাবে হঠাৎ বদলে গেল ভেবে দেখবেন।”

.

মানুষের বিবর্তন যত এগিয়েছে, শৈল্পিক আচরণ আরও জটিল এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে।সময়ের সঙ্গে তাই ছবি আঁকায়  আর কবিতা লেখায় অবিরাম রদবদল ঘটে চলেছে ।  নিয়ান্ডারথালরা, যদিও  অন্যায়ভাবে তাদের হিংস্র জানোয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তাদের শৈল্পিক আচরণের আধিক্যে অবাক করার মতো।  তারা পেইন্টিংয়ের প্রাচীনতম উদাহরণগুলির মধ্যে কয়েকটি তৈরি করেছিল, প্রাকৃতিক রঞ্জক ব্যবহার করে বিমূর্ত ছবি এঁকেছিল আর গুহার দেয়ালে স্টেনসিল-ছাপ  তৈরি করেছিল । জানি না কোনো নিয়ানডারথাল সমালোচক সেগুলোর মানে জানতে চেয়েছিল কিনা । গুহা চিত্রের মতো, কবিতা আমাদের আরও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে উৎসাহ যোগায় , সমসাময়িক সমাজে মানুষের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে আর আমরা সাংস্কৃতিকভাবে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সে সম্পর্কে তথ্য সম্প্রচার  করে ।

.

তিন

.

‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইতে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছেন, “কাব্যের ইতিহাসে প্রগতির লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায় কিনা এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। যাঁরা বলেন খগ্বেদ-সংহিতা, কঠোপনিষদ্‌, কিংবা সং অব. সলোমনের তুল্য কবিতা পরবর্তীকালে আর রচিত হয় নি, তাঁদের কাব্যরসাস্বাদনে ভক্তিরসের আমেজ লেগেছে এমন সন্দেহের অবকাশ যদি-বা থাকে, বিশুদ্ধ কাব্যরসবিচারের উপর নির্ভর ক’রেই বহু দায়িত্জ্ঞানসম্পন্ন সমালোচক এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে ব্যাস, বাল্সীকি, হোমর, সফোক্লিস প্রভৃতি আড়াই-তিন হাজার বছর পূর্বে কবিকর্মকে সার্থকতার যে-স্তরে তুলে দিয়ে গেছেন, তার চেয়ে উচ্চতর শিখর-আরোহণ পরবর্তী কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি আজও। কিন্তু কাব্যের প্রগতি তর্কাধীন হলেও তার গতি অনস্বীকার্য । নদীর মতো কবিতাও চলে এবং সিধে চলে না, কখনো হঠাৎ কখনো ধীরে-ধীরে বাঁক নেয়, কখনো-বা এমন মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় আপন আধারে, আধেয়তে, বা উভয়ত, যাকে ইতিহাসে যুগাস্তব বলেই অভিহিত করতে হয়।” 

.

বাংলা কবিতায় তেমনই এসেছে নানা আন্দোলনের বাঁকবদল, এসেছে আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, পুনরাধুনিকতা ইত্যাদি। বাঙালির আধুনিকতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত  করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেই। আর রবীন্দ্রনাথ এসে তাকে দিয়েছিলেন তীব্র স্রোত। তবে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাঙলা কবিতা তখনও আধুনিকতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। আর তাই মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা ছিল পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দগঠন, ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয়ও ছিল আলাদা। বলতে গেলে মাইকেল থেকে রবীন্দ্র (রবীন্দ্রনাথের পুরো কাল নয়; ১৮৬১-১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ) সময় পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের জন্য ছিল আধুনিকতার প্রস্তুতিকাল। এই সময়েই আধুনিকতা প্রস্তুত হচ্ছিল তিরিশের জন্য। 

.

তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই বাঙলা কবিতা ইউরোপীয় আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর আগের কবিরা আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। বিচিত্র প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমও ছিল প্রায় সম্পর্কশূন্য। ত্রিশের দশকের কবিরাই প্রথম আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোনো এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই ছিল বিংশ শতকের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তনিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়। 

.

বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার কথা বললেই উপরোক্ত দুজনের নাম  ভেসে ওঠে ।  প্রথম আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যে এসেছে উনিশ শতকে নবজাগরণের  হাত ধরে।   মধুসূদন দত্ত  শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক কবি।  যে বছরে মধুসূদন দত্তের আধুনিকতার প্রকাশ, সেই বছরই আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১)। উনিশ শতকের এই আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবাদ আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আর মধুসূদন পড়া আরম্ভ করে পাঠক বুঝতে পারেন যে যথেষ্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন কম হয় । বিশ শতকের তিরিশের কবিদের কথা তো পরে উঠবে । তার আগে   নজরুল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, এই তিনজনের মধ্যে অন্যরকম প্রয়াস দেখা গিয়েছিল, কিন্তু আসলে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার আরম্ভ  তিরিশের দশকে।  ‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত, জসীমউদ্দীন  বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত  কবি ভিন্নঘরানার কবি যাঁর সঙ্গে তিরিশের কবিদের কবিতাভাবনার মিল নেই। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে। একই কথা বলতে হয় নজরুল সম্পর্কে, যাঁকে তিরিশের কবিদের থেকে ভিন্নভাবে পাঠ করা হয়। এই দুজন কবি কিন্তু তিরিশের কবিদের তুলনায় জনপ্রিয় ।  মোহিতলাল আর যতীন্দ্রনাথ আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, পুনরাধুনিকতার  ভিড়ের চাপে সিলেবাসের বাইরে বেরোলেন না ।

.

রবীন্দ্রনাথের পর যে আধুনিকতাবাদীরা আমাদের সামনে উদয় হলেন, তাঁরা, কী বলব, বুদ্ধদেব বসু-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ, উন্নাসিক শব্দটা ব্যবহার যুৎসই হবে । সম্ভবত ইংরেজি শিক্ষার গোমর । রবীন্দ্রনাথকে যেকোনো কবি অ্যাপ্রোচ করতে পারতেন, তিনি খোলাখুলি মতামত দিতেন । কিন্তু তাঁর পরে যাঁরা এলেন, তাঁরা ব্লকেড খাড়া করার সাহিত্যিক উন্নাসিকতা নিয়ে এলেন, যেন ওনারাই নান্দনিক সংস্কৃতির মালিক । এই জিনিস চালু করে গিয়েছিল ইংরেজরা, যে-কারণে আমাদের দেশের প্রান্তিক সমাজের সাহিত্য একেবারে মুছে গেছে, এমনকি সেসব বইপত্র-পুঁথি-পাঁচালি আর পাওয়া যায় না । প্রান্তিকদের কবিতাকেও আমল দিতেন না তিরিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের কবিরা । আধুনিক শব্দ এসেছে ‘অধুনা’ থেকে, যার মানে সম্প্রতি বা আজকাল, অথচ সমসময়ের নিম্নবর্গের কবিদের তাঁরা পাত্তা দেননি।’আধুনিক’ অভিধার কালগত তাৎপর্য্য নেই, তা আসলে চিন্তাজগতে দার্শনিক রদবদল।  রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন,’পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে?এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা।’(‘আধুনিক কাব্য’, সাহিত্যের পথে )। রবীন্দ্রনাথ চাননি যে তাঁকে আধুনিকতাবাদের বাইরে রাখা হোক। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পর থেকে এবং ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ফুরিয়ে যেতে থাকলে কবিতা পড়া, কবিতা শোনা কমে যাওয়া আরম্ভ হয় । আধুনিক সংস্কৃতির আবির্ভাবের কারণে পাঠক আর কবিতার মাঝে যে ফাটল দেখা দেয় তা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে । 

.

চার

.

কবিতায় আধুনিকতার পুরোধা-প্রতিকৃৎ কবি হলেন শার্ল বোদলেয়ার।  এই পথ আরও প্রশস্ত করেছেন জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, পল ভ্যালেরি, পল ভের্লেন, গটফ্রিড বেন, আঁদ্রে ব্রেঁত, স্যামুয়েল বেকেট, জাঁ জেনে, এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, ইয়েটস প্রমুখ। এঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের ফলে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার চর্চা শুরু হয়েছিল তার রেশ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাওয়া যায় না। বাংলা কবিতায় ইউরোপের আধুনিকতা এনেছেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে প্রমুখ । কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার পত্তন করা যে কঠিন তা বুদ্ধদেব বসু টের পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে ‘ রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক ’ প্রবন্ধ লিখেছিলন: ‘ আমাদের পরম সৌভাগ্যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, কিন্তু এই মহাকবিকে পাবার জন্য কিছু মূল্যও দিতে হয়েছে আমাদের– দিতে হচ্ছে। সে-মূল্য এই যে বাংলা ভাষায় লেখার কাজটি তিনি অনেক বেশি কঠিন ক’রে দিয়েছেন। একজনের বেশি রবীন্দ্রনাথ সম্ভব নয়; তাঁর পরে কবিতা লিখতে হ’লে এমন কাজ বেছে নিতে হবে যে-কাজ তিনি করেননি; তুলনায় তা ক্ষুদ্র হ’লে– ক্ষুদ্র হবারই সম্ভাবনা– তা-ই নিয়েই তৃপ্ত থাকা চাই।’ বোদলেয়ার বলেছেন আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি আলাদা আলাদা কিন্তু এর কেন্দ্রিয় জায়গাটা এক অর্থাৎ মন। ত্বকের যে অনুভূতি, কান দিয়ে যা শুনছি; তা যাচ্ছে মগজে, সেখান থেকে নির্দেশ আসছে। সামনে কারা আছে বা কাদের দেখছি তাও নির্দেশ দিচ্ছে মগজ। বোদলেয়ার বলছেন আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের যে ইন্দ্রিয়বেদ্যতা তার উৎস  এক। 

.

আধুনিক কবিতার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য আবু সায়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘ আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ ’ বইতে  উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমত: ‘ কাব্যদেহের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ, যার পরিণাম কাব্যরচনায় ও সমালোচনায় দেহাত্মবাদ, ভাষাকে আধার বা প্রতীক জ্ঞান না ক’রে আপনারই দুর্ভেদ্য মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসত্তা জ্ঞান করা। ’ দ্বিতীয়ত: ‘ জাগতিক অমঙ্গল বিষয়ে চেতনার অত্যাধিক্য।’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন : “কোনোখানেই তিনি দুর্গম নন- অন্তত বাইরে থেকে দেখলে তা-ই মনে হয়; একবারও তিনি অভিধান পড়াতে ছোটান না আমাদের, চিন্তার চাপে ক্লান্ত করেন না, অর্থ খুঁজতে খাটিয়ে নেন না কখনো। আর তার বিষয়বস্তু- তাও বিরল নয়, দুষ্প্রাপ্য নয়, কোনো বিস্ময়কর বহুলতাও নেই তাতে; এই বাংলা দেশের প্রকৃতির মধ্যে চোখ মেলে, দু’চোখ ভ’রে যা তিনি দেখেছেন তা-ই তিনি লিখেছেন, আবহমান-ইতিহাস লুঠ করেননি, পারাপার করেননি বৈতরণী অলকানন্দা। এইজন্য তাঁর যেমন দুঃসাধ্য, তার প্রলোভনও তেমনি দুর্দমনীয়।”

.

তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতার অভিযােগে সর্বাপেক্ষা বেশী অভিযুক্ত বিষ্ণু দে,  (১৯০৯-১৯৮১)।টি এস এলিয়ট যেমন বিশ্বাস করতেন- “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion”,- বিষ্ণু দে-ও তেমনি কবিতায় কল্পনাবিলাস বা ভাববিলাসকে প্রশ্রয় দেন নি কখনও, মনন ও পাণ্ডিত্যের শিল্পিত প্রকাশ হিসাবেই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতাকে। তাই সেই পাণ্ডিত্য ও মননের ভার তাঁর কবিতাকে করেছে সাধারণ পাঠকের কাছে দুরূহ এবং কবি হিসাবে বিষ্ণু দে হয়ে উঠেছেন আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতম কবি। আর সত্যই, যথেষ্ট শিক্ষিত না হলে বিষ্ণু দে’র কবিতা অনুধাবন কঠিন ; কেবল কলেজে পড়াশুনা করলেই বিষ্ণু দে’র কবিতা স্পষ্ট হবে না । তাঁর কবিতা পড়ার সময় পাঠককে জানতে হবে  ট্রয়লাস, ক্রেসিডা, ওফেলিয়া, হেলেন,  কাসান্দ্রা, এলসিনাে ইত্যাদি এঁরা কে আর কেনই বা বিষ্ণু দের কবিতায় এলেন।

.

‘আধুনিকতাবাদ’ কেবল ওই সংকীর্ণ সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নয় । আধুনিকতাবাদের সূচনাকাল হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ের ইতিহাসকার আর লেখকরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কথা বলেন। যেমন, ইতিহাসবিদ উইলিয়াম এভারডেলের মতে আধুনিকতা ১৮৭০ এর দশকে শুরু হয়েছিল, যখন গণিতবিদ রিচার্ড ডেডেকিন্ডের (১৮৩১-১৯১৬) ‘ডেডেকিন্ড বিভাজন’ এবং লুডভিগ বোল্টজম্যানের (১৮৪৪-১৯০৬) ‘পরিসংখ্যানগত তাপগতিবিদ্যা রূপক (বা দার্শনিক) অবিচ্ছিন্নতা’ ভেঙে যেতে শুরু করে। ইভারডেল মনে করেন যে ১৮৮৫-৮৬ সালে সিউরাতের “লা গ্রান্ডে জট দ্বীপে একটি রবিবারের বিকেল” নামের ছবি আঁকায় “বিন্দু” ব্যবহারের  সাথে সাথে চিত্রকলার আধুনিকতা শুরু হয়েছিল।আধুনিকতাবাদের আরেকজন অগ্রদূত হলেন ফ্রেডরিখ নিৎশে (১৮৪৪-১৯০০)। বলা যায় যে যারা কবিতা পড়তে চায় তারা এসব জেনে কীই বা করবে!

.

  ফ্রান্সে স্থানীয়ভাবে সাহিত্যে বোদলেয়ার, চিত্রকলায় মনে আর কথাসাহিত্যে ফ্লবেয়ারের সঙ্গে সঙ্গে  আধুনিকবাদ প্রবর্তিত হয়েছে বলা হয় । সঙ্গীত এবং স্থাপত্যে আধুনিকবাদের শুরু কিছুটা পরে হয়েছে । বাংলায় যাঁরা আধুনিক কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন, তাঁদের কাছে আধুনিকতা ইউরোপ থেকে আনা একটি দার্শনিক আন্দোলন ছিল যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতায় নবায়ন এনেছিল। যেসব ব্যাপার আধুনিকতাবাদকে  রূপ দিয়েছিল তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতাবাদ এনলাইটেনমেন্টের চিন্তাধারার অভ্রান্ততাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং অনেক আধুনিকবাদী চিন্তক ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পরের কবিরা অনেকেই ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিয়েছিলেন ; জীবনানন্দ দাশ থেকে বিনয় মজুমদার হয়ে হাল আমলের কাজল সেন পর্যন্ত বহু আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবি-চিন্তক নিরীশ্বরবাদী । আধুনিকতাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আত্মসচেতনতা এবং সামাজিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য নিয়ে বিদ্রুপ, যা আমরা সমর সেনের কবিতায় পাই।

.

সমর সেনের ‘উড়ো খই’ আর ‘বাবু বৃত্তান্ত’ আমি পড়েছিলুম। জানতুম উনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি রোমান্টিক কবি নই; আমি মার্কসিস্ট’। বাঙালি মার্কসবাদীরা জন্মরোমান্টিক; তাঁরা কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-অভিনেতা, দারিদ্র্যের মাহাত্ম্যপূজক, বুদ্ধিজীবী হিসাবে অহংকারী, মানবতাবাদী, দুর্ভোগের জন্যে সবসময়ে তৈরি, আত্মবলিদানকে মনে করেন সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। ফলে সমর সেনের প্রজন্মের পর এক অদ্ভুত মার্কসবাদী বাঙালি প্রজন্মের তত্ত্ব পাওয়া গেল, যা এরকম : গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, জবরদখল করা ভালো, একঘেয়ে করে দেয়া ভালো, গ্রামছাড়া করে দেয়া ভালো, খেতখামার পুড়িয়ে দেয়া ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, ইত্যাদি ইত্যাদি।সমর সেন রবীন্দ্রনাথের লিরিকাল রোমান্টিসিজম থেকে বাঙলা কবিতাকে বের করে এনেছিলেন, সেই হিসাবে তিনি রোমান্টিক কবি নন, তবে তা বাঙলা কবিতায় আধুনিকতাবাদী রোমান্টিসিজমের একটি প্যারাডাইম শিফ্ট হলেও মার্কসবাদী হিসাবে রোমান্টিক মধ্যবিত্তের “বাবুকবিতা”। মার্কসবাদের জন্য কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন, তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। কম বয়সে কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়াকে বাঙালি আলোচকরা কিংবদন্তির অন্তর্গত করেছেন, যেমন  র‌্যাঁবো । জায়গায় পড়েছি যে সমর সেন ছিলেন টি এস এলিয়টের আধুনিকতাবাদের পথচারী এবং অমন আধুনিকতার সঙ্গে মার্কসবাদের সংশ্লেষ বাংলা বিপ্লবী কবিতায় আনতে চেয়েছিলেন।

.

সমর সেনের কবিতা সম্পর্কে সরোজকুমার দত্ত লিখেছিলেন, “তাঁর কবিতা ‘ইনটেলেকচুয়াকল ক্লিকের’ জন্য লেখা, আমার-আপনার জন্য নহে। পাঠক সম্প্রদায়ের প্রতি এই সানুনাসিক অবহেলা আপনার কাব্যকে সর্বসাধারণের উপভোগ হইতে বাঁচাইয়া দুর্বোধ্য করিবার এই গলদঘর্ম প্রয়াসে ইহা আর যাহাই হউক, বিপ্লবী মনোভাবের পরিচায়ক নহে। মসীকৌলিন্যের অভিমানে শ্রীযুত সেন আজ আর্টের প্রচাররূপ ও কমিউনিকেটিভনেসকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করিতেছেন। রচনার আবেদনের পরিধি সংকীর্ণ হইতে সংকীর্ণতর হইয়া ক্রমে আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হইতে বসিয়াছে। এই শম্বুকবৃত্তিকে কি বিপ্লবী প্রচেষ্টা বলিব? ইহা বিপ্লবের নামে ইণ্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কির চরম অবস্হা মাত্র।”

.

পাঠক আর কবির মাঝের ফাটল বাড়তে লাগল ।পরের প্রজন্মের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। বেচারা পাঠক।’আধুনিক বাংলা কবিতায় দুর্বোধ্যতা’ প্রবন্ধে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ সুধীন্দ্রনাথের ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদ করার মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির স্বার্থপরতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে দাবি।” এরকম কবিতা পড়ার জন্য পাঠকের পড়াশুনা জরুরি আর সেই কারণেই পাঠক কবিতাকে এড়িয়ে যান । তাঁর কাছে তো প্রতি বছর শারদ সংখ্যা ভরে-ভরে কবিতা ছাড়াও পৌঁছোয় গল্প, উপন্যাস, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় । 

.

পাঁচ

.

আবদুল হালীম খাঁ তাঁর ‘কবিতা ও আধুনিক কবিতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, “দুঃখের বিষয় মানুষের যেমন শত্রু রয়েছে, বাংলা ভাষার কবিতারও কিছু শত্রু রয়েছে। তাঁরা বাংলা ভাষার কবিতার অগ্রগতি, উন্নতি ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কবিতাকে তাঁরা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, কবিতা যেন আর পাঠকরা না পাঠ করেন। তারা কবিতা নামে কষ্ট করে কষ্টা গদ্য লাইন ছোট বড় করে লিখছেন। আবার কেউ যা লিখছেন তা সম্পূর্ণ অবোধ ছন্দ সুরের বালাই নেই। বাংলা কবিতায় এমন সব আবর্জনা যারা জমিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের কেউ কেউ প্রশংসা করছেন।” আবদুল হালীম খাঁ’র মতন পাঠকদের আবির্ভাব আঁচ করে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু   সমালোচকদের অভিযোগের উত্তরে লিখেছিলেন, ‘পাঠকের বোধগম্যের উপর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এমন কথা বোধহয় শোনা যায়নি। … কবিতা সম্পর্কে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বোঝায় না, স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে, তা বোঝা যাবে না, বোঝান যাবে না।’

.

আধুনিক কবিতার শুরুতেই যখন দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল, তখনকার পাঠক কি যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না? বরং এখনকার তুলনায় তাঁরা শিক্ষিত ছিলেন। এখন শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকছে ; আদালতে তারা নিজেদের আকাট বলে প্রমাণ করছে । তারা কবিতা পড়ে না, বাংলা ভাষাটাই জানে না । অথচ কবিতা-লেখকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে । কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, কবিরা নিজেদের সৃষ্টিতে মোহিত, সেই গুহাচিত্রের মানুষদের মতন । গুহাচিত্রের কালখণ্ড থেকে আমরা বহুদূরে চলে এসেছি । কবিতার আদল-আদরায় রদবদলের পাশাপাশি চিন্তার জগতেও বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে । অল্পসংখ্যক পাঠক ওই পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত । কবিতা পাঠক যদি চিন্তার জগতের রদবদলের সঙ্গে পরিচিত না হন তাহলে এখনকার কবিতার সঙ্গে তার ‘সংযোগ’ ঘটবে না।

.

আধুনিকতাবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের  তত্ত্ব বেশ প্রভাবশালী ছিল। ফ্রয়েডের চিন্তাভাবনার মূল “মানসিক জীবনে অবচেতন সত্ত্বার প্রাধান্যের” ধারণা, যাতে সমস্ত ব্যক্তিক বাস্তবতা মৌলিক তাড়না এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যার মাধ্যমে মানুষ বাইরের বিশ্বকে অনুভব করে। ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ফরাসি পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।গোপাল হালদার তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, “কবি মাত্রেই যে বিষয়কে অবলম্বন করেন তার একটি হল বিষয়বস্তুর দিক, অপরটি প্রকাশ ও রূপায়ণের দিক। এই বিষয়বস্তু ও তার প্রকাশধর্মীতা এই দুয়ে মিলে সাহিত্যে একটি অখণ্ডতার প্রকাশ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কবি কৰ্ম বা কবি নিমির্তির এক বিশেষ কৌশল এই দুয়ের সমন্বয় করতে পারে, কিন্তু বিশেষ বস্তু হিসেবে যা ঘটে থাকে তাকে অনুসরণ করাই সাহিত্যেকের ধর্ম নয়, অর্থাৎ বিষয় নির্বাচনে কবিকে তাঁর একটি সামগ্রিকতার দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন, “প্রাচীন মধ্য যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের বিষয়গত, ভাবগত, এমনকি তার রূপায়ণগত পরিবর্তন হয়েছে আমূল। আধুনিক যুগ জীবনের নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে তার বিচিত্র প্রকাশ। তাই আজকের আধুনিক কাব্যের নানান বিভাগও সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্যের সহস্রমুখী জীবনকে প্রকাশ করার জন্য কত বিচিত্র পথের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন—বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পর্যন্ত শুধু কাব্যেরই প্রকাশ, যেখানে দেব দেবীই ছিল মুখ্য অবলম্বন সেখানে মানুষ নিজের প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। তারপর জীবনের ধারা পালটেছে, সাহিত্যের আঙ্গিক প্রকরণও বদলে গেছে। বিষয়বস্তু তো বটেই, পদ্যের স্থানে আসছে গদ্য এবং কাব্যের ক্ষেত্রে কত বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে, কত নতুন ছন্দ, নতুন রীতি, কত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অভিব্যক্তি আধুনিক সাহিত্যের প্রবন্ধে, সমালোচনায়, কাব্যে তা প্রকাশিত হয়েছে। যুগে যুগে সমালোচনার রূপ ও রীতির কতই না পরিবর্তন হয়েছে।”  

.

 সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ২০শ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন আধুনিকতাবাদী আন্দোলন যা ২০শ শতাব্দীর শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট্য এটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে সেটি হল রােমন্টিকতাবাদের বিরােধিতা করা। রােমান্টিকতাবাদের উৎপত্তি হয় নতুন আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠার সাথে সাথে। এই দৃষ্টিমতে শিল্প ভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে দূরত্ব রচিত হয়েছে এবং ঐতিহ্যের পতন ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে অবিশ্বাস, আনুগত্যহীনতা, প্রেম-ভালােবাসা, মায়া-মমতাহীনতার নতুন মূল্যবােধ জন্ম লাভ করছে। অপরপক্ষে পুরাতন ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন সেটিই হল রােমান্টিকতাবাদ। ১৯শ শতকের আন্দোলন হল রােমন্টিকতাবাদ এবং ২০শ শতাব্দীতে আধুনিকতাবাদ রােমান্টিকতাকে বর্জন করে এক নতুন আন্দোলন হিসেবে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়। 

.

ছয়

.

আধুনিকতাবাদের সমর্থনে ইয়ুর্গেন হাবেরমাস  একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটিতে তিনি ফরাসি চিন্তকদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছিলেন। তার মধ্যে অবশ্যই বদরিয়া, জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিদা উল্লেখ্য। হাবারমাসের বক্তব্য হল আধুনিক কাল বিশেষ করে আলােকময়তার যে অবদান ঐতিহ্য, অন্ধবিশ্বাস এগুলাে পরিত্যাগ করতে পেরেছিল এবং ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সংকীর্ণ স্বার্থ হতে মুক্ত মানুষ যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিশীলতা প্রয়ােগের মাধ্যমে সমাজের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারবে এবং সমস্যা মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারবে মনে করা হয়েছিল । তিনি বলেন যে আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্টের কারণে আমরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। নানা ধরনের যুদ্ধ, গণহত্যা ঘটে থাকলেও প্রগতির যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি।  হতে পারে আলােকময়তার যাত্রা অসম্পূর্ণ, তবে এটা নিশ্চিত যে আমরা উপকৃত হয়েছি। তিনি বলেন, মানুষ মাত্রই যুক্তিবাদী। সে নিপীড়িত হলে অবশ্যই নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়। বিজ্ঞানের সাহায্যে, উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার সাহায্যে মানুষ নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়। 

.

 বাংলা ভাষায় তিরিশের দশক থেকে কবিতার যে আধুনিকতাবাদী বাঁকবদল ঘটে, সেই বাঁকবদলের পর থেকে, ফিকশান পাঠক আর সংবাদপত্র পাঠকরা  মনে করেন, তাঁরা সমসাময়িক কবিতা বুঝতে পারেন না, তাই এড়িয়ে যাওয়াই ভালো । বুদ্ধদেব বসু এই ‘বুঝতে পারা’ ব্যাপারটাকেই হেয় প্রতিপন্ন করেছিলেন  ।  এই অবস্হা দেখে, বাংলায়  যাঁরা তারকা কবি, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, জয় গোস্বামী, শ্রীজাত প্রমুখ, তাঁরা পাঠকদের জন্য ফিলগুড কবিতা লিখেছেন ; কলকাতার বিজলি-থামে সর্ষের তেল বিক্রির পোস্টারে হাসিমুখে দেখা গেছে সুনীলকে, যেমন এককালে রবীন্দ্রনাথ গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে ছিলেন । বস্তুত  কবিতার পাঠক এখন কেবল কবিরাই,  যাঁরা মনে করেন যথেস্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন  কম হয় ।  কবিতা লেখা’, ‘কবিতা পড়া’ গ্রন্থে  শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “যে মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় তারই সঙ্গে থাকে তার বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, তীব্রতা, বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ। এই সামগ্রিকতার ছবি থেকে আমরা মনে রাখতে পারি যে, সমস্ত রকম খাঁচা ভেঙে কবি যখন তাঁর নিজস্ব সত্য অস্তিত্বের প্রকাশ করে যান তাঁর নিজেরই ভাষায়, যার মধ্যে ধরা পড়ে গোটা জগৎজীবন, তখন সেটা তৈরি করে তোলে আরেকটা, আরও একটা নতুন কোনো আদল।” এই নতুন আদলের কবিতাকে ফিকশান-পাঠক আর সংবাদপত্র-পাঠকরা এড়িয়ে চলেন । বাংলাদেশের আলোচক টোকন ঠাকুর তাঁর প্রবন্ধ ‘কবিতার পাঠক কি কমে যাচ্ছে’তে বলেছেন, “কবিতা কবির লিখে যাওয়া কয়েকটি বাক্যের বেশি কিছু, সে কথা অবশ্য খুব বেশি লোক জানেন বলে মনে হয় না। তাই কবিতাপাঠ থেকে রস নিতে পারার ক্ষমতা পাঠকের থাকতেই হবে। যাঁর নেই, তিনি আর যা–ই হোন, কবিতা-পাঠক হবেন না।” যে-ভাষা খবরের কাগজে নিত্যদিন ব্যবহৃত হয়, সাহিতা-বিশ্লেষণেও অনেকে সেই একই ভাষা প্রত্যাশা করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদিও মোক্ষম কথা লিখে গেছেন -“যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবিকে দোষারোপ করা অন্যায় – তবু কোনো ইতরবিশেষ হয়নি।”

.

‘কবির সঙ্গে বসবাস’-এ জয় গোস্বামী লিখেছেন, “যাঁরা ছন্দ না জেনেই কবিতা লিখে চলেছেন, তাঁদের কবিতা হয়তো ভালো হচ্ছে, মুদ্রণযোগ্যতাও পাচ্ছে বিভিন্ন কবিতা-পত্রিকায়– কিন্তু বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে চার ভাগের তিনভাগ কবিতাই যে কোনও না কোনও ছন্দকে আশ্রয় করে লেখা! তাহলে, যাঁরা ছন্দকে কবিতায় ব্যবহারযোগ্য মনে করছেন না, কিন্তু কবিতাকে মুদ্রণযোগ্য অবস্থায় উন্নীত করে কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ ছাপিয়ে চলেছেন, তাঁদেরও ব্যক্তিগত কবি পরিচিতি ভালোভাবেই ঘটছে সমাজে। তবে ছন্দ-বিজ্ঞান না-জানার কারণে, তাঁরা নিজেরা যে বঞ্চিত হচ্ছেন কত কত অসামান্য ছন্দ-সৌন্দর্যের উপভোগ থেকে, সেকথা কি একবার তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন না? আমি লিখব, লেখা ছাপাব, কিন্তু পাঠক হিসেবে নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলব না? কী জানি, যে যুগের যা যুগলক্ষণ, তাকে তো আমাদের মতো বৃদ্ধদের মুখ বুজে স্বীকার করে নিতেই হবে!” একথাটা ঠিক যে কবিতায় ছন্দ থাকলে সেই কবিতা না ‘বুঝলেও’ চলে,কেননা পুজোয় যেমন ধুনুচি নাচ সবায়ের মগজে একরকম আহ্লাদ যোগায়, তেমনই কবিতার ছন্দ।

.

সাত 

.

বাঙলা সাহিত্যের আধুনিকতা একটা পথ ধরে এগোচ্ছিল কিন্তু তার ওপর বাজ পড়লো দেশভাগের। ছিতরে গেল আধুনিকতা । ইউরোপের মতন আমরা কোনও দার্শনিক পেলুম না । শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত প্রমুখকে দার্শনিকের মান্যতা দিয়েও কথাটা বলতে হলো । কবিতার এলাকাকে বজ্রবিদ্যুত এমন ফালাফালা করে দিয়ে গেল যে চল্লিশের দশকে বেশির ভাগ কবি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়ে সরাসরি মনের কথা লাইনে লাইনে সাজাতে লাগলেন । চল্লিশের দশকের সূচনাবিন্দু থেকেই বাংলা কবিতায় সমাজসচেতন  রাজনৈতিক মনোভঙ্গিই হয়ে ওঠে কাব্যভাবনার নিউক্লিয়াস।  সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, দিনেশ দাস, , বিমল ঘোষ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। যদিও তিনি  স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর অবস্থান- ‘আমার কবিতা কোনোদিনই চল্লিশের প্রগতিশীল কবিতা বা কবিদের কাছ থেকে অন্ন বা জল আহরণ করেনি। বরং আমি নিজের কবিতাকে যতটা বুঝি, আমার কবিতার শিকড় অন্যখানে। সেখানে আজও যাঁরা জলসিঞ্চন করছেন তাঁরা সবাই দলছুট একক কবি – যেমন জীবনানন্দ, তারপর নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ।’ (নান্দীমুখ : ১৯৮০)। তিনি আরোও বলেছেন  ‘চল্লিশের ‘প্রগতি সাহিত্য’ প্রথম থেকেই আমার কাছে খণ্ডিত এবং যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে। বাংলা কবিতায় শ্রেণীসচেতনতার কথা প্রবহমান চিরসত্য। আবহমান কাল ধরেই সমাজ ও রাজনীতি জড়িয়ে আছে কবিতার শরীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস, মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, বিজয়লাল সেই কবে থেকে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে বিপ্লবের বীজ।’  সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথ্যরীতিতে রচিত  কবিতা সহজবোধ্যতার কারণে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করেছিল। মানবিক বোধ আর রাজনৈতিক বার্তা ছিল তাঁর কবিতার  প্রধান অভিমুখ। তাঁর কবিতা পড়ার জন্য পাঠকের শিক্ষিত হবার দরকার হয়নি । পরবর্তী কালখণ্ডের কবিরা কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান না । ব্যাপারটা অদ্ভুত কেননা যাঁর কবিতা সহজবোধ্য তিনি প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যের পরও পাঠকদের থেকে দুরে চলে গেছেন।

.

পাঠক কবিতা পড়েন এবং কবিরা লেখেন  কারণ আমরা মানব জাতির সদস্য। আর মানব জাতি আবেগে ভরা। এবং চিকিৎসা, আইন, ব্যবসা, প্রকৌশল, এগুলি মহৎ সাধনা এবং জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু কবিতা, সৌন্দর্য, রোমান্স, প্রেম, এগুলোর জন্যই আমরা বেঁচে থাকি।  দুর্ভাগ্যবশত, “মূলধারার” সবকিছুই কালক্রমে বিরক্তি উদ্রেককারী আর ওভাররেটেড ; কবিতার বাণিজ্যিক পাতা  প্রবণতা হয়ে ওঠে আর জায়গা পাবার জন্য নকলনবিশী আরম্ভ হয় ।

.

আধুনিকতাবাদ একটা তত্ব ।তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর ‘সময়ের প্রত্নতত্ব’ বইতে বলেছেন, “মূল প্রশ্নটা হলো : তত্ব কী এবং তত্তের কেন প্রয়োজন ? এই প্রসঙ্গ ইতিমধো বেশ কয়েকবার আলোচিত হয়েছে। তবু আরো একবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। “তত্ব – এর আভিধানিক অর্থ হলো স্বরূপ বা যাথার্থ্য। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তম্বরূপই তত্ব। কোনো ঘটনা-বিন্যাস বা ভাব-বিন্যাসের সারাৎসার যখন অনুসন্ধান করি এবং সেই অনুসন্ধানের বার্তা বা প্রতিবেদন তৈরি করি, তখনই তত্বকথা জন্ম নেয়। তার মানে, তত্ব হলো বিশেষ দৃষ্টি এবং দার্শনিকেরই অন্য নাম তাত্তিক।….প্রতীচ্যের আধুনিকতা বিষয়ক আকল্প ওঁপনিবেশিক ভারতবর্ষে, বিশেষ ভাবে বাঙালির ভাববিশ্বে অনেকখানি পুনর্বিনাস্ত হয়েছিল। বিলম্বিত পুঁজিবাদের পর্যায়ে আধুনিকোত্তরবাদের সূচনা হলো যখন, বাঙালির চেতনায় তার অভিঘাত বহুধা বিচ্ছুরিত হলো।নয়া পনিবেশিক পরিস্থিতির মধ্যেও এত দ্রুত পটপরিবর্তন হয়ে চলেছে যে গত দুই দশকে উত্তরাধুনিকতা ও আধুনিকোত্তরবাদী চিন্তার সহাবস্থান আমরা লক্ষ করেছি। এই বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত । প্রবল অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্র-বিচ্যুতির আবহে এমন ধরনের আশ্চর্য নতুন সাহিত্যিক পাঠকৃতি রচিত হয়ে চলেছে যে এদের বিশ্লেষণ করতে গেলে পুরোনো পাঠাভ্যাস সংহিতায় আর কুলোচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক তত্তের উপযুক্ত সমর্থন ছাড়া এখন কোনো ধরনের প্রতীতি অসম্ভব।”

.

আট

.

বহু পাঠক কবিতায় উত্তরাধুনিকতার প্রভাবকে জটিলতার আর পাঠকের সঙ্গে দূরত্ব গড়ে ওঠার কারণ বলে মনে করেন । যদিও আধুনিকতাবাদের সাথে উত্তর-আধুনিকতাবাদ পদটি সম্পর্কিত। এরা দুটো ক্রমান্বয়িক পর্ব হলেও  শব্দ দুটির মধ্যে বিপরীতধর্মিতার চেয়ে ধারাবাহিকতা অনেক বেশি। ষাট আর সত্তর দশকের কবিদের রচনায় উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্য প্রথম দেখা দেয় । আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদ পদ দুটিই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে বােঝায়। দুটি পদই ২০শ শতকে শিল্প, সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে খণ্ডিতকরণকে দেখে, কিন্তু এই দেখার মেজাজ ভিন্ন। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজন স্পষ্ট ছিল । বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় নিম্নবর্ণের কবিদের রচনা প্রায় নেই। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাতেও প্রথম পর্বে নিম্নবর্ণের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না ।কিন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করে, এটি রকমারি মিশ্রণ, যুক্তিভাঙন ইত্যাদিকে সমর্থন করে।ভাষাতাত্বিক প্রবাল দাশগুপ্ত তাই উত্তরাধুনিকতাকে বলেছেন ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বা ‘অধুনান্তিক’ ।

.

প্রবাল দাশগুপ্ত অধুনান্তিককে বলেছেন “সাজানো বাগানের পরের স্টপ” । আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই কথাগুলোতে, “কিছু কাল আগে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বলে একটা প্রসঙ্গ ফেঁদেছিলাম। সেই সূত্রে ভেবে বলো তো, তুমি যখন আধুনিক বিজ্ঞানের দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ দিয়ে দূরের মহতো মহীয়ান্ আর কাছের অণোর্ অণীয়ান্ জিনিসপত্রকে যথাক্রমে কাছে টেনে আনো এবং বাড়িয়ে মাঝারি আয়তনে নিয়ে আসো যাতে তোমার নজরে তাকে ধরতে পারো, তখন তুমি আদতে কী করছ? আমি বলে দিই? জিনিসটাকে তুমি তোমার বাগে আনছ, যাতে তোমার পছন্দমতো ম্যাগনিফিকেশনে দেখতে পাও। বাগ, ইয়ানী বগীচা, ওই বাগান আর কী। তোমার সাজানো বাগানে নিয়ে আসতে পারলে তবে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলো, এইবার ধরতে পেরেছি। নীটশে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় দিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে ১৮৮৯ সালে, একজন প্রখ্যাত নীটশেবিদ পণ্ডিতকে চিঠি লিখে বলেন, “আমাকে তুমি ধরতে পেরেছ ভালো করেই জানি। খুব ভালো ধরেছ। এবার আমায় ছাড়তে পারবে কি? ছেড়ে দেখাও তো?” অধুনান্তিক শেখাটা ওই ছাড়তে শেখার দস্তুর। বাগে আনা কথাটার ব্যুৎপত্তি যাঁরা জানেন তাঁরা ভুল ধরিয়ে দেবেন, সেই অপেক্ষায় আছি, পাঠক তুমি তখন ধরতে পারবে আসল উত্তরটা কী হবার কথা, আমি আগাম বলে রাখছি, তার পর ভুলে যেও না উত্তরটা ধরতে পারার পর ছাড়তে পারাও চাই, নইলে তোমার সঙ্গে আকাশের সংযুক্তি ছিঁড়ে যাবে, পড়ে থাকবে খালি আধুনিকবাদের যুক্তি, দেখবে যে মাটির সঙ্গে একেবারেই আকাশের কোনো যোগ নেই তাকে আর মাটি বলে চিনতেই পারছ না, মনে হচ্ছে ছাই। চারিদিকে অসত্য কথন, মিথ্যাচার, ক্ষমতার রহস্যাবৃত কথাস্রোত সচেতন মানুষকে দগ্ধ করে। এক আস্তিক বিপন্নতা দেখা দেয়। লেখার মাধ্যমে সে তার কথন বিশ্বকে ব্যাপ্তি দেয়। পুনর্নির্মাণ করে তার সত্যদ্রষ্টা সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। ধারণাময় এই ধরিত্রীর মাইক্রোস্তরে যতই প্রবেশ করা যায়, দেখা যায়, বহু সংকেত এমনই যে, বাস্তব জগতে বা প্রাত্যহিক কাজেকর্মে তা তেমন কাজে লাগে না। তবু তা প্রয়োজনীয় নয়, একথাও বলা যাবে না। অস্বীকার করা যাবে না, ব্যক্তি মনের সৃজন জগতের মুক্তির একটি পরিসর নির্মাণে তার ভূমিকার কথা।”

.

জাঁ ফ্রাঁসোয়া  লিওতার্ ‘দ্যা পােস্ট মর্ডান কন্ডিশন এ রিপাের্ট অন নলেজ’ নামক একটি বই লেখেন। লিওতার্, ইয়ুর্গেন  হাবারমাসের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেন যে, আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্ট  কিছু মহাবয়ান বা মহাসন্দর্ভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। এই বয়ানগুলাে প্রচণ্ড শক্তিশালী। এই আন্দোলনে যুক্তিবাদী ধারণাগুলাে যেমন, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি ধারণাগুলাে শক্তিমত্তা অর্জন করে। তিনি বলেন যে, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলাে দাবি করে যে সমগ্র বিশ্বে যা কিছু ঘটছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, মূলত পারে না। লিওতারের বক্তব্য হল, বাস্তব আরাে জটিল আরাে বহুবিধ এবং সত্যও বহুবিধ। তিনি বলেন কোনাে বিশেষ সংঘাতের ক্ষেত্রে নানাবিধ যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা সামনে নিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিওতারের কথা হল, বিভিন্ন অবস্থান হতে সত্যাকে বুঝতে হবে, একটি বিষয়ে সত্য পরবর্তীতে সেটি সত্য নাও হতে পারে। লিওতারের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ বিবিধতা মুছে ফেলে, এটি সমরূপতা ও অখণ্ডতা তৈরির চেষ্টা চালায়। লিওতার বারবার মেটা-ন্যারেটিভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ানের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। তিনি এটির প্রতি সন্দিহান। তিনি বলেছেন, এই মহাবয়ানসমূহ তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। উত্তর আধুনিকতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই বিশ্বাসহীনতা এবং বিবিধতার ওপর গুরুত্বারােপ। সত্য বহুবিধ এবং সত্য উপলব্ধিতে অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সত্য বহুবিধ হলে কবিতার সত্যও বহুবিধ হবে ।

.

জাঁ ফ্রাঁসোয়া বদরিয়ার বলেছেন যে,  আধুনিকতাবাদে বাস্তব এবং অবাস্তবের বিভাজন রেখা স্পষ্ট ছিল। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য দাঁড় করানাের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। যেমন, ভূত দেখা, এটি বিজ্ঞান সম্মত নয় বিধায় এটা বাস্তব নয়। বদরিয়ার বক্তব্য হচ্ছে যে, বর্তমানের সমাজ জীবনে সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের সর্বব্যাপী প্রভাবের কারণে বাস্তব এবং অবাস্তব, সত্যি আর কল্পিত, আসল আর নকল, উপরিতল আর গভীরতা,  এসবের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে গেছে। এর ফলে আমরা একটি হাইপার রিয়েল সংস্কৃতি পাই। যেখানে দুইয়ের ভিন্নতা ক্ষয়ে গেছে। যেমন, আমরা প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলতে পারি। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া রূপের পরিবর্তন করে সৌম্যকান্তি বা সুন্দরী হয়ে আরেকজন হয়ে যেতে পারি। যেমন নাকটা পছন্দ হচ্ছে না, তা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারি। এই প্রেক্ষিতে বদরিয়া বলেন যে বাস্তব এবং পরিবেশন এই দুয়ের মধ্যে যে সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল সেটি উত্তর-আধুনিকতার ফলে সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এসবের প্রভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অধ্যাপক ইহাব হাসান একটি বিকল্প জ্ঞানভাষ্য এবং সমালােচনার মাধ্যম হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে  মানতে চান। তিনি যে উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বলতে চান তাতে উইলিয়াম ব্লেক, ডি সাদ; একটা সময়ের পাউন্ড, জয়েস, দাদা, স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ, নব্য ফরাসি উপন্যাসের ধারা, জেনে, বিট আন্দোলন, জনপ্রিয় সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে চান।

.

অধুনান্তিক পত্রিকা “হাওয়া৪৯”-এর সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরী আধুনিক কবিতা আর অধুনান্তিক কবিতার বৈশিষ্ট্য এইভাবে চিহ্ণিত করেছেন : –

.

আধুনিক কবিতা : যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি ধাপেধাপে এগোয়, কবিতায় আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো বজায় থাকে, একরৈখিক, ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটোসাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বদ্ধসূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ সমাপ্তি, ডিসটোপিয়া, সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর, তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ, ‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র নির্মাণ, একক ‘আমি’, পূর্ব নির্ধারিত মানদন্ড, ক্যানন দাঁড় করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই মূল পপসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র পেডিগ্রি বা কুলজি, একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা, গোপন গভীরে শিকড়, কবিই টাইটেল হোলডার, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, একমুখী প্রগতি, ধ্বনি মেলান কবি, কবি একজন বিশেষজ্ঞ, শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, চার্ট টপার কবি, একজনকে তুলে ধরা, হিরো কবি, গুরু কবি, এক সময়ে একজনই বড়ো, ব্র্যাণ্ড নেম কবি, আইকন, কথার খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখা, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন, বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন, একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, হাইকমাণ্ড, পলিটব্যুরো, নিটোলো কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল যেমন সনেট ওড ব্যালাড ইত্যাদি, কবিকে প্রকৃতির বাইরে সংসাস্কৃতিক জীব মনে করা, প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের চমৎকারিত্ব, ঘুরিয়ে বলা, স্হিতাবস্হার কদর, নাক উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ, ব্যবধান তৈরি করা, ভালো কবিতা-খারাপ কবিতার বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া কবিতা, খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম, অবচ্ছিন্নবোধ, কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব, প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ গঠন, মৌলিকতার হামবড়াই, একটিমাত্র বার্তার বাহক, কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির ব্যক্তিসত্তার বিবেচন, আধিপত্যের প্রতিষ্ধঠা, বৃক্ষশাখার মতন ইনটারলিংকড।

.

উত্তরাধুনিক কবিতা : যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোবার প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ-যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগ, এলোমেলো দেখায়, দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ, মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি, হেটেরোটোপিয়া, মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত মানে, যা ইচ্ছা তা মনে করে নিতে পারেন পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত অস্বীকার, যা আছে তা লোনোর দরকার নেই, স্বচ্ছতা, ভিতর-বাহির আলাদা নয়, একক ‘আমি’র অনুপস্হিতি, ‘আমি’র বন্ধুত্ব, ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন, মিশ্রতা, লিমিনালিটি, সংকরায়ন, সংকরত্ব, মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব, মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন, পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড় ছড়িয়ে পড়া, রাইজোম্যাটিক, প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়, দিগ্বিদিকে গতিময়, অ্যাক্টিভিস্ট, জগৎ আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন, কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য, বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দেয়া, পাঠকৃতি বিচার্য – কবি নয়, সার্বিক চিন্তা-চেতনা, কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই, শব্দার্থের ঝুঁকি, আত্মমনস্কতা থেকে কবিতার মুক্তি, জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট, মর্মার্থজোট, বহুমতাদর্শের পরিসর, বাক্যজোট, প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত পরিবর্তণ, ভঙ্গুরতার স্বীকৃতি, জীবন থেকে উঠে আসা ধারণা, বহুরঙা, অপরিমেয় নাগাল, নির্দিষ্টতার বাইরে, প্রতীকবর্জন, সরাসরি বলা,পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ, যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি পরোয়াহীন, কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবিচ্ছিন্নতার দিকে, প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ, সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বৈভিন্ন্য অনুশীলন, কবিতা ফ্লাক্স থেকে উপজাত, কাইনেটিক, কেন্দ্রিয় বিষয়ের অনুপস্হিতি, কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন, প্রান্তিক শব্দ, আঞ্চলিক শব্দ, পথচলতি অভিব্যক্তি, একসঙ্গে বহু কন্ঠস্বর, বার্তার বহুলতা ও বার্তা বর্জন, আধিপত্যের বিরোধিতা, ছবি ও লাইন ঘাসের মতন ইনটারলকড, সংজ্ঞার সীমা ছাপিয়ে যাওয়া ।

.

নয়

.

আমরা পেয়েছি শিবনারায়ণ রায়কে, যিনি বলেছিলেন,   “ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে, সেইসঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে প্রচুর। তাহলেই সবটা মিলিয়ে নতুন নতুন পথ হাজির হবে আমাদের সামনে”। তবুও শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে বাংলা সাহিত্যে সুররিয়ালিজমের প্রভাব যথাকালে আসেনি। অথচ এ তো ভারতবর্ষেরই। সুররিয়ালিজমের মূল খুঁজতে অনেক চলে গেছেন প্রাচীন গ্রিসে যেখানে ডেফির দেবতা সক্রেটিসকে বলেছিলেন, নিজেকে জানো। কিন্তু তারও বহু আগে আমরা শুনেছিলাম আত্মানং বিদ্ধি। ধ্যানের সাহায্যে অপরলোকে উত্থান, শরীর ছাড়িয়ে গিয়ে দৈববাণী শ্রবণ, বেদ যে কারণে অপৌরুষেয়, অ্যালকেমির সমান্তরাল তান্ত্রিক উপাসনা ইত্যাদি। কিন্তু সাহিত্যে আমরা এগুলো ভুলে গেছি অনেকদিন, সম্ভবত ইংরেজদের প্রভাবে। সারা পৃথিবীর সচেতন লেখকদের মধ্যে এমন বোধহয় একজনও নেই— যিনি সুররিয়ালিজমকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পেরেছেন।   জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তবতার অসাধারণ প্রয়োগ দেখতে পাই। যাঁরা জীবনানন্দের কবিতা বুঝতে পারতেন না তাঁদের পরাবাস্তব আন্দোলনের কথা জানা ছিল না।

.

আধুনিক কবিতার পরের কালকন্ডে যে ধরণের কবিতা আর গল্প লেখা আরম্ভ হলো সেগুলোকেই উত্তরাধুনিক বলা যায়। একটি কবিতা উত্তরাধুনিক ফর্মে হতে হলে যেসব মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়—তা নিয়ে হয়তো তর্ক আছে। এক পক্ষ বলেন অঙ্কের হিসাব কষে বা বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ধরে নির্ধারিত ছকে একজন কবি কবিতা আর গল্প-উপন্যাস লেখেন না। ঠিক বিপরীত কথা বলছেন কেউ কেউ।  তথাকথিত ছক থেকে কবিতাকে মুক্ত করে সাবলিলভাবে বেড়ে উঠতে দেয়াই উত্তরাধুনিকতা। এতে অন্যের প্রভাব চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকে না। এতে শেকড়ের টান ও নিজস্বতার প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

.

উত্তরাধুনিকতা হলো একটি আভাঁগার্দ বহুরৈখিক পথ । আভাঁগার্দ মানে ‘অ্যাডভান্স গার্ড’ বা ‘ভ্যানগার্ড’, আক্ষরিক অর্থে ‘ফোর-গার্ড’, ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো । আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল । এই  সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য । শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে । বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয় । তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়।  কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক  বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য । আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে যারা এগিয়ে যাবার কথা বলেন । কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন ।

.

আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ  প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে ( হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন), ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করেL তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ । উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেকসময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না । মরে যাবে জেনেই  আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয় । কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ  থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন । ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো । প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প । আভাঁগার্দকে  কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে । অনেক শিল্পী  আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন । ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন ।

.

প্রাগুক্ত বইতে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেছেন, “সাহিত্যিকতার সংগঠনে উপস্থাপনার কত বহুমুখী তাৎপর্য হতে পারে এবং পাঠকৃতির নির্মিতিতে অন্তর্বয়ন ও পরাপাঠের গুরুত্ব কত বেশি,এ সম্পর্কে তারা আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন । কোনও যথাপ্রাপ্ত বাস্তবতার পুনরুখাপন করাই শিল্প নয়। ভাষার বহুস্বরিক বিন্যাস ও প্রতিন্যাসের মধ্য দিয়ে বাস্তব অহরহ পুননির্মিত হয়। যে-অনুপাতে ভাষা নতুন হয়ে ওঠে, ঠিক সেই অনুপাতে শিল্পকেও মৌলিক বলতে পারি । এইজনো সৃষ্টি ও নির্মাণের দ্বন্ধ। আর, এই ধারণাও এখন অচল যে নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার অধিকারী শুধু লেখক এবং পাঠক কেবল নিস্ত্রিয় ভোক্তা। রোর্লা বার্ত তার বিখ্যাত 5/7, বইতে বাচনিক নন্দনের নতুন পর্যায়ের সুচনা করেছেন। বালজাকের “সারাসিন’ এর আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি পাঠককেন্দ্রিকতা ও লেখককেন্দ্রিকতার নতুন সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ভাষা থেকে অর্থের উদ্তাসনে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেখানে পাঠক সব্তিয় না হয়ে পারে না। স্বভাবত ভাষার অভিব্যক্তিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য । কিন্তু যেখানে পাঠকৃতিকে আমরা নিষ্ক্রিয় পাঠক হিসেবে গ্রহণ করি, সেখানে ভাষাতেও অর্থাৎ অর্থবোধে সক্রিয়তার বিদ্যুৎস্পর্শ দেখা দিতে পারে না। যেখানে পাঠকের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যিক সেখানে লিখন-প্রক্রিয়া কার্যত লেখক থেকে পাঠকের কাছে সরে যায়।”…”সংস্কৃতি ও বর্বরতার দ্বান্বিকতা কিংবা অমঙ্গলবোধ সম্পর্কিত চুড়ান্ত চেতনা কীভাবে সাংস্কৃতিক সমালোচনা-ধারাকে প্রভাবিত করে, এসম্পর্কে আডোর্নোর মন্তব্য নিঃসন্দেহে আমাদের ভাবায়। আউস্হিৎস সভ্যতার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বিপুল গুরুত্বসম্পন্ন জলবিভাজন রেখা । এই রেখার ওপারে যারা রয়েছে, কবিতা লেখা তাদের কাছে বর্বরতার অভিজ্ঞান কেন-_ তা তলিয়ে ভাবতে হয়। সৃষ্টির জ্ঞানও ধবস্ত হয়ে যাচ্ছে সার্বিক বিনষ্টির গাঢ়তম ছায়ার অভিঘাতেঃ তাই কবিতার মতো সূক্ষ্ম সংবেদনশীল শিল্পমাধ্যম এখন নিরাশ্রয়। তবে এই কথাগুলিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা সমীচীন কি না, এই প্রশ্ন উঠে তাইযন্ত্রণাময় আত্মসমালোচনার সুত্রে বাচনিক আতিশয্য অনিবার্ধ হয়ে পড়েছিল। হয়তো শিক্পকর্মকে কেউ কখনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ বলে ভাবতে না পারে ।”…”প্রতিটি পাঠকৃতি মানে সিসিফাসের পুনর্নবীকৃত উদ্যম; বয়ানের ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকে তাৎপর্যের গভীরে পৌছানোর সোপানমালা। অধ্যবসায়ী শিল্পরসিক পাঠক/দর্শক ছাড়া অন্য কেউ তাদের আবিষ্কার করতে পারেনা ।”

.

দশ

.

আধুনিকতাবাদীদের পরের কবিরা, যাঁদের ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই দশকের কবি বলা হয় তাঁদের কবিতায় বক্তব্য আছে, কিন্তু বক্তব্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া চলে না। কবিতাজুড়েই চলে দ্বিরুক্তিবদাভাস, শ্লেষ ও কূটাভাসের খেলা। পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও তাঁরা নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আহরণ করেন উপমা উৎপ্রেক্ষা ও রূপক, মিথ ও মেটাফর। অনেক কঠিন সমাজ বাস্তবতার কথা বললেও তাঁদের কবিতার ভাষা অধিক সম্ভাবনা তৈরি করে । কবিতার পাঠ অবশ্য রুচির ওপরও নির্ভর করে, তবে যে কবিতাগুলো  পাঠককেকে চিন্তা করার আর পুনর্বিবেচনা করার উৎসাহ যোগায় সেগুলোই টিকে থাকে ।  কবিতার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটা ব্যাখ্যা সঠিক হবে মনে করা উচিত নয় কেননা পাঠকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে আর সেটাও তো বৈধ। সাংস্কৃতিক জীবনে আমাদের কবিতা দরকার।  সত্যিই তাই। কবিতা ভিন্ন পথের প্রচার করে, গোষ্ঠী কিংবা আন্দোলন গড়ে তোলে এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে। যারা কবিতা  লিখতে শুরু করে তাদের জীবনের ছবি আঁকার অনুমতি দিতে পারে ; রূপক, চিত্রকল্প এবং প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলো সামলাবার উপায় বাতলাতে পারে বা নিজেদের কিছু অংশ যা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করতে প্রস্তুত নয় তা কবিতার দেহে লুকিয়ে রাখতে পারে। কবিতা পাঠকদের ভাষা ব্যবহার করার আর ভাঙার অনুমতি দেয় – তা এক গভীর অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে,  প্রচলিত নিয়ম ভাঙতে পারে (ব্যাকরণ, ছেদ, যতি, যতিহীনতা, ভাঙাবাক্য ইত্যাদি, যেমন অনন্য রায়, শম্ভু রক্ষিত করেছেন )।

.

যেহেতু কবিতা নিয়মকে অমান্য করে, কবিতা সকলের জন্য অবাধ। কিশোররা তাদের শব্দভাণ্ডারে সীমাবদ্ধ থাকার সময় তাদের কণ্ঠস্বর লেখায় প্রকাশের উপায় খুঁজে পেতে পারে। তাছাড়া কবিতা সর্বজনীন।উচ্চস্বরে পড়লে, কবিতা হল ছন্দ এবং সঙ্গীত ; আর ছন্দ মানে প্রচলিত ছন্দ নয়। গর্ভবতী মায়েরা আজকাল পেটের বাচ্চাদের গান গেয়ে শোনান, কবিতা পড়ে শোনান । পেটের বাচ্চারা শব্দ বা অর্থ বুঝতে পারে না ঠিকই, কিন্তু তারা মায়ের ভাষার ছন্দ অনুভব করবে, শব্দের অর্থ কী তা নিয়ে বড়ো হয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠবে এবং সম্ভবত তাদের নিজস্ব ভাষাজগত তৈরি করতে চাইবে। জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে,  ছন্দের মাধ্যমে সদ্য গোঁফ-ওঠা ছেলেরা আর বুক-ওঠা মেয়েরা প্রেমের  কবিতায় প্রবেশ করে। কবিতা  সাহিত্যের সমস্ত জনারের মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল। ওই কিশোর-কিশোরীদের জন্য কবিতা শারীরিক এবং পূর্ণাঙ্গ যা তাদের হৃদয় এমনকি অস্তিত্বকে সক্রিয় করে তোলে আর কখনও কখনও তাদের মনের ফাঁদগুলোকে কাটিয়ে বেরোতে পারে।

.

যখন লোকেরা বলে যে কবিতা নিছক বিলাসিতা, বা ফালতু বিকল্প, বা কবিতা ব্যাপারটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য, বা স্কুলে কবিতা পড়ানো  উচিত নয় কারণ এটা অপ্রাসঙ্গিক।কিংবা কবিতা  সম্পর্কে এমন সব কথা  বলা হয় যা  অদ্ভুত আর বোকাবোকা, তাহলে বুঝতে হবে যারা অমন কথা বলছে তাদের জীবন বেশ সহজ ছিল। কঠিন জীবনের জন্য কঠিন ভাষা প্রয়োজন – আর তা থেকেই অঙ্কুরিত হয় কবিতা। সাহিত্যকে শক্তিশালী করার জন্য  এমন একটি ভাষা জরুরি যা শক্তিশালী । কবিতা লুকানোর জায়গা নয়। কবিতা হলো  খোঁজার জায়গা।কিন্তু মনে রাখলে ভালো হয় যে, যখন কেউ কবিতাকে আঁকড়ে তার সমস্যার সমাধান করার উপায় বের করার চেষ্টা করে বা নিজের দুঃখকষ্ট প্রশমিত করার জন্য পড়ে বা লেখে, তখন  হতাশ হবার সম্ভাবনা থাকে । হয়তো কবিতা একটা মামুলি নিরাময় হতে পারে। কিন্তু একটা কবিতা তার নিজের  অভিজ্ঞতাসঞ্জাত, তাই কবিতা কখনই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন হতে পারে না।

.

আসলে “কবিতা” বলতে বহু পাঠকের কাছে  জোর-জুলুমের চাহিদা বোঝায়। এটি একটি অন্তর্নিহিত কারণ  অবজ্ঞার সাথে দেখা হয় এবং কেন কবিতাকে সময় নষ্ট তকমা দিয়ে খারিজ করা হয়। ফিকশান ও সংবাদপত্র পাডকের  মধ্যে বেশিরভাগই কবিতা এবং মানব সম্ভাবনার মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পান না । কবিতা লিখতে শুরু করে বহু কিশোর বিব্রত বোধ করে আর লুকিয়ে লেখে । বাণিজ্যিক পত্রিকায় লুকিয়ে কবিতা পাঠায় । ছাপা হলে কলার তুলে আত্মপ্রকাশ করে । বাণিজ্যিক পত্রিকা সম্পর্কে সমালোচকদের বক্তব্য হল যে কবিতা অস্পষ্ট বা কঠিন হলে, তারা তা প্রকাশ করে না। তাদের প্রকাশিত বেশিরভাগ কবিই ফিকশান পাঠকদের জন্য লেখা ; তারা আর সত্যই যুগান্তকারী কিছু প্রকাশ করতে চায় না। পরীক্ষামূলক কবিতার চেতনা যা  প্রারম্ভিক দিনগুলিতে কবিতার লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে আসরে এনে তুমুল কাণ্ড ঘটিয়েছিল তা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস পত্রিকা সুনীলের সঙ্গেই বুড়িয়ে গিয়েছিল। দেখা যাক বীজেশ সাহার কবিতার পত্রিকা নতুন করে ঢেউ তুলতে পারে কিনা।

.

এগারো

.

গুস্তাভ ইউং তাঁর থিয়োরি অফ শ্যাডো বা  ছায়াতত্বতে বলেছিলেন, একজন মানুষের বিকাশ যে বৃত্তি বা মূল ধারায় হয়েছে তার বাইরেও কিছু সম্ভাবনা ছিল যা সে  হতে পারতো । কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি । তাহলে এই সম্ভাবনাগুলো যায় কোথায় ? আসলে সেইসব সম্ভাবনা অবচেতনে ছায়া হয়ে তার সঙ্গেই ঘোরে ফেরে । কবিতার পাঠক হতে পারতো এমন মানুষ শেষ পর্যন্ত পাঠকের ছায়া নিয়ে ঘোরে । পাঠক হওয়া এড়িয়ে যেতে হয় । সে বরং শ্রোতা হতে চাইবে । কিন্তু তেমন অনুষ্ঠান বাংলায় সাধারণ পাবলিকের জন্য হয় না বললেই চলে, যেমনটা হিন্দি বা উর্দুতে হয় ।

.

আলোক সরকার বা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বা সিদ্ধেশ্বর সেন বা এমনকি আল মাহমুদের কবিতা বোঝার প্রধান বাধা হলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব আক্ষরিক হওয়ার আমাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা। আমরা প্রায়ই অত্যন্ত আক্ষরিক পরিভাষায় কথা বলি এবং লিখি, কারণ আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমদের বোঝা যাচ্ছে। সুতরাং যখন যোগাযোগ অন্য কেউ করতে চায় , আমরা তাকে একইভাবে দেখি এবং তার কথার আক্ষরিক অর্থ বের করার চেষ্টা করি। এটা কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । যে কবিতা পাঠকের মন মাতায় তা আক্ষরিক নয়,  সংজ্ঞা অনুসারে। কবিতা হিসাবে, পাঠবস্তুটা আমাদের এক উচ্চতর সত্যের সামনে দাঁড় করায়  যা  অ-আক্ষরিক, অরৈখিক উপায়ে প্রকাশ করা হয়, এমন একটি উপায়, যা যিনি রচনা করেছেন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নবায়িত। তাই পাঠককে প্রথমেই যা করতে হবে তা হল  কবিতার মুখোমুখি হলে আক্ষরিক নিশ্চয়তার  জন্য নিজের আকাঙ্ক্ষাকে বাদ  দেওয়ার চেষ্টা । শুধু চুপচাপ পড়া, তারপর জোরে জোরে পড়া, শব্দগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য নিজের মগজে ঘুরতে দেয়া। পাঠক তা থেকে অর্থ বের করতে না পারলেও কবিতাটাকে একটা শৈল্পিক অভিজ্ঞতা হিসাবে উপভোগ করতে চেষ্টা করুন, যেমন পিকাসো, মাতিস, দালি, তায়েব মেহতা, এস এইচ রজা, রাম কুমার প্রমুখের পেইনটিঙ দেখার সময়ে করেন।

.

আমরা যদি কবিতার ভাষা বুঝতে না পারি, তবে বুঝতে হবে  যে মানুষের যোগাযোগ একটি মৌলিক উপায়ে অবরুদ্ধ  । এই ব্যর্থতার অনুভূতিই ব্যাখ্যা করে কেন বহু ফিকশান বা সংবাদপত্র পাঠক  উদাসীন হওয়ার পরিবর্তে কবিতাকে ঘৃণা করার প্রবণতা দেখায়। কবিতা পড়া নিজেই একটা দক্ষতা, যেমন কেউ তা  লিখতে শেখে, তেমন করেই কবিতা কীভাবে বুঝতে হয় তা শিখতে পাঠকের কিছুটা সময় নেওয়া উচিত। অবশ্য, পাঠককে ধারাবাহিক হতে হবে কারণ সে যত বেশি পড়বে, তত সহজে  সমস্যাটা কাটিয়ে উঠবে।    উপন্যাসের জন্য পাঠক যেমন সময় নেয়, তেমনই  কবিতার জন্য সময় দেয়া দরকার । বাঙালি যুবক-যুবতীরা কম বয়স থেকেই কবিতা লেখার চেষ্টা করে, ফলে কবিতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়ে যায় ; কিন্তু অনেকে কবিতা লেখা ছাড়ার সঙ্গে কবিতা পড়াও ছেড়ে দেন । হিন্দি আর উর্দুর মতন বাংলায় যদি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান হয় তাহলে তাঁরা আবার কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হবেন বলে মনে হয় । ফেসবুকে অজস্র কবিতা প্রতিদিন লেখা হয়, তা সে যেমন লেখাই হোক, আমি তাদের তারিফ করি ।

.

কবিতা  মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই রয়েছে । কবিতা দেবতাদের  ভাষা হিসাবে পরিচিত ছিল আর সমস্ত পৌরাণিক এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পদ্যে লেখা হয়েছে ।  সবাই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকেই স্বীকার করেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদ থেকে শুরু।  চর্যাপদ যদি আমাদের কবিতার প্রথম বই হয় তাহলে মনে রাখতে হবে চর্যার ভাষার আলোচনায় সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয় সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা। চর্যাগীতি গুলো রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মতত্ত্ব আর গুহ্য সাধনপদ্ধতি সম্পর্কিত নানা তথ্য নির্দেশ লিপিবদ্ধ করা এবং সেই তথ্যগুলো যাতে সাধারন মানুষের বোধগম্য না হয় সেই কারনে পদগুলির প্রকাশভঙ্গিতে প্রহেলিকাময় রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষ্যা ইত্যাদির আড়াল ব্যাবহার করেছিলেন পদকর্তারা। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে সন্ধ্যা শব্দ অভীষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এটা বোঝাতে যে পদগুলোর প্রকৃত অর্থ শুধুই মর্মজ্ঞের কাছে বা দীক্ষিত ব্যাক্তির কাছে প্রকাশ্য, অন্য কারো কাছে নয়। অন্য কোনো সাধারণ ব্যাক্তির এই অর্থ বোঝা বা বোঝার চেষ্টা করাও অনুচিত এটাই মনে করতেন পদকর্তারা; আর তাই তাঁরা পদ রচনার ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছিলেন এই প্রহেলিকাময় সন্ধ্যা ভাষা। তাই যদি হবে তাহলে তরুণতম কবিরা যেভাবে লেখার চেষ্টা করছেন সেই কবিতাগুলোকে কেন বলা হবে না মর্মজ্ঞ আর দীক্ষিতদের জন্য লিখেছেন কবি । যেমন বারীণ ঘোষালের কবিতা, যেমন অলোক বিশ্বাসের কবিতা, যেমন ধীমান চক্রবর্তীর কবিতা ।

.

বারো

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। ইসলামি ধর্মসাহিত্য,পীরসাহিত্য,বাউল পদাবলি,পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ,মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, নাথসাহিত্য ইত্যাদি ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। গদ্য যে মাত্র ৩০০ বছরের পুরানো তা জেনে ফিকশান ও সংবাদপত্র পাঠকরা  হতবাক হতে পারেন। চিঠিপত্র লেখা এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত। দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি সংস্কৃতি ও পার্সি – এই দুই ভাষার প্রভাবে পরিকীর্ণ। পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ-এর রচনা রীতি বাংলা গদ্যের অন্যতম আদি নিদর্শন। তবে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা আলালের ঘরে দুলাল বাঙালা ভাষায় রচিত আদি গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগেও অনেক লেখক বাংলায় গদ্য রচনা করেছেন।  তাদের লেখায় নানান অসঙ্গতি ছিলো, যথাযথভাবে ব্যাকরণ অনুসরণ করা হতো না এবং বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হতো না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে গদ্যরচনা শুরু করেন এবং যথাযথভাবে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার করেন। বাংলা সাধু গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গ রুপ দান করেছেন তিনি। বাংলা গদ্য ভাষার বিকাশেও তার অবদান অনেক। তিনি সাধু ভাষায় বাংলা গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। 

.

যথেষ্ট পড়াশোনা দ্বিজেন্দ্রলালেরও ছিল কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ডিকোড করতে পারতেন না ।  তাঁর মতে, ‘রবীন্দ্রসাহিত্য অস্পষ্ট’। দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন সে আপনার অক্ষমতা। … অস্পষ্টতা একটা দোষ, গুণ নহে’ (কাব্যের অভিব্যক্তি প্রবাসী ১৩১২ কার্তিক)।  দ্বিজেন্দ্রলালের মত ছিল, রবি খালি ‘প্রেম’ নিয়ে লিখতে বসেন। নাটক নভেলও তাই। ‘কেন পৃথিবীতে মাতা নাই, ভ্রাতা নাই, বন্ধু নাই – সব নায়ক আর নায়িকা? তাও যদি কবিরা দাম্পত্য প্রেম লইয়া কাব্য লেখেন, তাহাও সহ্য হয়। ইহাদের চাই হয় বিলাতি কোর্টশিপ নয়ত টপ্পার প্রেম। নহিলে প্রেম হয় না। অবিবাহিত পুরুষ ও নারী চাই-ই। ফল দাঁড়ায় এই যে এরূপ প্রেম হয় ইংরাজি (অতএব আমাদের দেশে অস্বাভাবিক) না হয় দুর্নীতি মূলক’ (কাব্যে নীতি সাহিত্য ১৩১৬ জৈষ্ঠ সংখ্যা)।’

.

শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজের কবিতার মানদণ্ডে এতোই বিভোর থাকতেন যে পঞ্চাশের কবিতা সিংহ-এর কাব্যে নারীশক্তির যে-স্বর জোরালোভাবে বিচ্ছুরিত হয়েছিল তা টের পাননি। আটের দশকে মল্লিকা সেনগুপ্তের কাব্যরচনা সেই নারীবাদী স্বরকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করল তা টের পাননি। মল্লিকার আত্মপ্রকাশের সমসময়েই এলেন সুতপা সেনগুপ্ত, আনিতা অগ্নিহোত্রী ও চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। সমাজকে দেখার জন্য মেয়েদের যে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ তা এঁদের রচনার মধ্যে ফুটে উঠল।  আটের দশকের সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকেতবাহী কবিতার নিজস্বতা টের পাননি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।  শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি যথেস্ট শিক্ষিত ছিলেন না, অথচ অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন, একটা পত্রিকায় ‘এত কবি কেন?’ নামে  বিক্রয়যোগ্য তর্কে বলেছিলেন,  ‘গদ্যের ঘাড় মটকে পদ্য আদায় করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে।.এখন যারা কবিতা লেখে তাদের বেশিরভাগই লেখে এক ধরনের ভাঙচুরময় গদ্যে।কেন লেখে? লেখা সহজ বলে।… কবিতা লেখার প্রথম শর্ত ছন্দ।’ ‘আমার কাছে যদি কোনও তরুণ কবি আসে, লেখা দেখায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেকসপিয়ারের সনেট অনুবাদ করতে বলি।…সে কবি আর দ্বিতীয়বার আমার কাছে আসে না।সে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে চলে যায়।সহনশীলতা ও সম্পাদকীয়তা ওর রক্তে।ও ঘষে-মেজে সেই তরুণের একটি কবিতা ‘দেশ’-এ ছাপিয়ে দেয়।…সেই তরুণ কিন্তু হয়ে উঠল জবরদস্ত কবি।তাকে এখন ঠেকায় কে? সুনীল কবিতার যত বড়ো পৃষ্ঠপোষক তত বড়ো শত্রু।’ ‘বাংলাদেশের যে সব পত্রিকাগুলো পাই তার  মধ্যে পাঠযোগ্য কোনও লেখা খুঁজে পাই না।ভুল ছন্দে কী সব বিচিত্র লেখা।আমাদের এখানকার তরুণ রচনা থেকে অনেক কাহিল।’ ‘স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার’ বইটি শামসুর রাহমানের শেষতম কবিতার বই।আমায় উৎসর্গ করা।বইটি হাতে পেয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম কদিন ধরে।পড়ে উঠতে পারলাম।কিন্তু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।শামসুরের কবিতায় সে-ধার গেল কোথায়?’ ‘ও ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,  যে কীভাবে মহাকবি  তৈরি করে চলেছে প্রতি হপ্তায় এবং মহিলা কবি।এত মেয়ে পদ্য লেখে।…আমার তো মেয়েদের কবিত্বে খুব সামান্য আস্থা আছে।এতখানি বয়সেও কবিতা সিংহ ভুল ছন্দে কীভাবে কবিতা লিখে চলেছে।’

.

আবার একদা মন্ত্রী অশোক মিত্র, যিনি বড়ো বেশি শিক্ষিত ছিলেন, তিনি লিখেছেন, ‘মাল্যবান থেকে শুরু করে তাঁর প্রতিটি প্রকাশিত প্রতিটি গল্প-উপন্যাস আমি অপ্রকাশিত দেখতে পেলে খুশি হতাম…যাঁরা এ-সমস্ত নিভৃত স্বগত রচনাদি টেনে হিঁচড়ে মুক্ত আকাশের নীচে অনাবৃত করছেন তাঁরা জীবনানন্দের স্মৃতিকে সম্মান জানাচ্ছেন কিনা তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ।  অবশ্য অশোক মিত্র  জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে মত পাল্টে  বলেছিলেন, ‘”অনুভবের গভীরতার দিক থেকে বিচার করলে বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের কাব্যের তুলনা নেই। প্রায় ২০ বছর ধরে জীবনানন্দের কবি প্রতিভার প্রতি যে নির্দয় অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল, তা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে কলঙ্কের এক চরম চিহ্ন হয়ে থাকবে।”

.

সুধীন্দ্রনাথ দত্তও বড়ো বেশি শিক্ষিত ছিলেন । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক লাইনও লেখেননি জীবনানন্দকে নিয়ে। মুখে বলেছিলেন জীবনানন্দ ‘নেভার এ স্পন্টেনিয়াস পোয়েট’। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে জীবনানন্দর কবিতা ছাপিয়েছিলেন নেহাতই বিষ্ণু দে অনুরোধ করেছিলেন তাই।তফাত ছিল কাব্য বোধ ও জীবন দর্শনে। তিরিশের দশকের বেশ কয়েকজন কবি-আলোচক জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে আমল দিতে চাননি । তাঁরাও বেশ শিক্ষিত আর বিখ্যাত ; স্কুল-কলেজের সিলেবাসে আছেন ।  সাগরময় ঘোষ প্রকাশ করতে চাননি, ফেলে রেখেছিলেন । ঠিক কী কারণে জীবনানন্দের কবিতা তাঁদের মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য ছিল না ? ব্যাপারটা কি ‘আসন্ন সময়কে উপলব্ধির অভাব’ ? কেন জীবনানন্দের কবিতাকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে চাননি ? এটা নিয়ে কেউ কি লিখেছেন ?  ১৯১৫ সালে জীবনানন্দ কবিগুরুর কাছে কিছু কবিতা পাঠান। তখন তার বয়স ষোলো। কবিগুরু জবাব দেন,  “’তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মাঝে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।’

.

ননী ভৌমিকও বেশ শিক্ষিত, শুনেছি শিক্ষা আর দীক্ষার জোরে বহুকাল সোভিয়েত রাষ্ট্রে ছিলেন । তিনি ‘বাঙলা সাহিত্যে বাস্তববাদের সমস্যা’ প্রবন্ধে লেখেন-  “সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ অস্বীকৃতিরই একটি আধুনিক মুখোশ মাত্র। আপন অবচেতনার রঙে স্বাধীন বাস্তব জগতকে, মানুষ এবং তাঁর ভূত-ভবিষ্যতকে এমন করে রাঙিয়ে দেওয়ার দুর্লক্ষণ আতঙ্কের কথা; অথচ বিস্ময়ের কথা এই যে এমন সমালোচক আছেন যারা এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন, চিন্তাহীন, উদ্ভট অনুভূতিস্রোতকে আখ্যা দেন ‘ঐতিহাসিক বোধ’ বলে।’ [‘পরিচয়’, অগ্রহায়ণ ১৩৫৯] গিরিজাপতি ভট্টাচার্য ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র আলোচনায় লিখলেন,”’এই গ্রন্থে স্থানে স্থানে কাঁচা হাতের ছাপ চোখে পড়ে, সুন্দর ও সার্থক পঙক্তির প্রাচুর্য থাকলেও সমগ্র কবিতা মাঝে মাঝে নিষ্প্রভ ও অস্পষ্ট মনে হয়। কতকগুলি ভাব, উপমা ও বাক্যের পুনঃ পুনঃ সমাবেশ কবিতাগুলোর দৌর্বল্য প্রকাশ করে, তথাপি এই বইয়ে এমন সৌন্দর্যস্বাতন্ত্র্য ও কবিত্ব-বিকাশ আছে যা কবির অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক। অন্ততঃ বইটির কতগুলো কবিতা জীবনানন্দের জন্য আধুনিক কবিদের প্রথম শ্রেণীতে স্থান নির্দেশ করবে।’ জীবনানন্দ শুরুতেই যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সমর্থন পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব তাদের মাঝে অন্যতম। কিন্তু জীবনানন্দকে নিয়ে মধ্য-চল্লিশের দশকে বিতর্ক শুরু হলে এহেন বুদ্ধদেবও আস্থা হারিয়ে ফেলে তার সমালোচনা করেন। তিনি লিখলেন, বুদ্ধদেব বসু : ‘জীবনানন্দ দাশ আমাদের নির্জনতম স্বভাবের কবি। এই নির্জনতার বিশিষ্টতাই তাঁর প্রাক্তন রচনাকে দীপ্যমান করেছিল। মনে মনে এখনো তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিরতন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওআরের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত ক’রে তিনি এইটেই প্রমাণ করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন যে তিনি ‘পেছিয়ে’ পড়েন নি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়। এর ফলে তাঁর প্রতিশ্রুত ভক্তের চক্ষেও তাঁর কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর নেই। দুর্বোধ বলে আপত্তি নয়; নিঃসুর বলে আপত্তি, নিঃস্বাদ বলে।’ বুদ্ধদেব বসু। তিনি পরবর্তীতে জীবনানন্দের একজন বন্ধুপ্রতিম ও ভক্ত পাঠক হয়ে উঠেছিলেন। ‘প্রগতি’ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষসংখ্যায় তিনি লেখেন,  ‘জীবনানন্দবাবু বাঙলা কাব্যসাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে আমার মনে হয়। তিনি এ পর্যন্ত মোটেই popularity অর্জন করতে পারেননি, বরঞ্চ তার রচনার প্রতি অনেকেই বোধ হয় বিমুখ; -অচিন্ত্যবাবুর মতো তাঁর এরই মাঝে অসংখ্য imitator জোটেনি। তার কারণ বোধ হয় এই যে জীবনানন্দবাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময়সাপেক্ষ;…তার কবিতা একটু ধীরেসুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়।’ [‘প্রগতি’, আশ্বিন ১৩৩৫] । প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো গুণী লেখক জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্‌ক্তি নিয়ে, যেমন ‘সুরঞ্জনা তোমার হৃদয় আজ ঘাস’-এর কথা বলে রসিকতা করতেন। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলায় পাঁচ বছরের কবিতা অর্থাৎ ১৩৫৫-১৩৫৯ বঙ্গাব্দের একটি প্রবন্ধে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক বিশ্নেষণে লিখেছিলেন, ‘সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি কোন কিছুর মধ্যে নন, সেই ভাবান্তরহীন কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। প্রকৃতি ও জীবনের সমস্ত কিছুই তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর একের পর এক সমস্ত কিছুই তিনি ধূসর কুয়াশায় আপাদমস্তক মুড়িয়ে দেন।’

.

তেরো

.

 যথেস্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন  কম হয় বলার মধ্যে  সত্যতা আছে । অনেকের কাছে কবিতা কঠিন কারণ একটা রচনা খুব কম শব্দে তথ্যের গুরুতর সংকোচন নিয়ে গঠিত। কাজের সম্পূর্ণ প্রশংসা করার জন্য একজনকে অবশ্যই কাঠামো, আঙ্গিক এবং সাহিত্যিক শৈলীগুলো জানতে হবে। বাংলা পদ্যের ইতিহাস শুরু হয়েছে চর্যাপদ থেকে; কিন্তু গদ্যের ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। গদ্যের চারিত্র্য নির্ভর করে শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যে পদ  স্থাপনার ক্রমের ওপর। আধুনিক যুগে গদ্যের প্রধান দুটি ব্যবহার হলো কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ। আঠারো শতকে বাঙ্গালা গদ্যের বিকাশ সূচীত হয়েছিল। কবিতা পড়ার ও বোঝার জন্য পাঠককে  খুব মনোযোগী হতে হয়। অন্যদিকে, গদ্য খুব প্রত্যক্ষ এবং সাধারণত যে যুগে যে ভাষায় কথা বলা হয় সেই ভাষায় লেখা হয়। গদ্য সাধারণত বলে যে লেখাটার অর্থ কী, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে কোনও একক ব্যাখ্যা সম্ভব নয় আর তা আমরা স্কুলে  রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা পরীক্ষার খাতায় ব্যাখ্যা করার সময়ে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি ।

.

কবিতাকে সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য-ধারা বলে মনে করা হয়। ফেসবুকে তাই অজস্র কবিতা প্রতিদিন পোস্ট হয় । গ্রীক ভাষায়, একটা কবিতাকে মানুষের অসাধারণ সৃষ্টি বলা হতো, আর প্লেটো বলেছিলেন কবিতা হলো বাস্তবতার অনুকরণ । ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতা চিন্তা ও অনুভূতির  স্বতঃস্ফূর্ত ওপচানো বলেছেন। ওয়র্ডসওয়র্থের বিরোধিতা করে টি, এস, এলিয়ট বলেছিলেন, “কবিতা আবেগের উপচে ওঠা নয়, তা আবেগ থেকে মুক্তি; কবিতা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়, ব্যক্তিত্ব থেকে অব্যাহতি। তবে, অবশ্যই, শুধুমাত্র যাদের ব্যক্তিত্ব এবং আবেগ আছে তারাই জানেন যে এই জিনিসগুলি থেকে পালাতে চাওয়ার অর্থ কী।”  কিটস,  রোমান্টিক কবি , মনে করতেন যে কবিতা যদি গাছের পাতার মতো অবাধে বেরিয়ে না আসে, তবে তা না আসাই ভাল। যদি এসব  কথা সঠিক হয়, তবে কেন ফিকশান ও সংবাদপত্র পাঠকের  কাছে কবিতা বোঝা  কঠিন মনে হয় ? কবিতা খুব আকর্ষক এবং মনোমুগ্ধকর হতে পারে কারণ বোদ্ধা পাঠক তাকে ডিকোড করতে সক্ষম হলে পান৷ যেহেতু তা  সহজ নয়, তাই একজন পাঠককে অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের কবিতার সাথে সাথে  গদ্য কাঠামোর বিভিন্ন সাহিত্যিক রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কবিতা সবার বোঝার কথা নয়। কবিতা একটা নির্দিষ্ট কারণে একটা নির্দিষ্ট দর্শকের উদ্দেশ্যে লেখা । তারা ব্যক্তিগত ব্যাপার ; কোনো গেটসভা বা মাঠসমাবেশ বা মোড়মিটিঙের পাবলিকের জন্য নয় ।

.

কবিতা গণিতের মতো নয়, যেখানে পাঠক ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে আর উত্তর মূল্যায়ন করতে নিয়ম এবং ফরমুলা ব্যবহার করতে পারে। কবিতা পাঠে ভয় আর ঝুঁকি জড়িত । পাঠক মনে করতে পারে যে তার অজ্ঞতা ধরা পড়ে যাবে । মানুষ তো  মর্মার্থ সৃষ্টিকারী প্রজাতি। যখন থেকে আমরা ভাষা উদ্ভাবন করেছি, তখন থেকে আমরা  দুর্দান্ত কিছু আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি , তা গুহার দেয়ালে, শিলালিপিতে বা কাগজে, যেখানেই হোন। পাঠক অমুক কবিতা বা তার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারছে না?  কবিতায় সে ঢুকতে পারছে না । এই চিন্তাভাবনা, বিষাক্ত। যদিও এটি একটি সর্বজনীন অনুভূতি, পাঠক নিজের অজ্ঞতার লজ্জা সম্পর্কে কথা বলতে চায় না । তাই টের পাওয়া যায় কেন অনেক লোক কবিতাকে ঘৃণা করে; কবিতা আক্ষরিক অর্থে পাঠকের অজ্ঞতার লজ্জার অনুভূতি প্রকাশ করে । সেরকম পাঠক কবিতাকে আর কবিদের অপমান করা শুরু করে ।

.

যদিও কবিতা সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে আর  অনেক রূপ, অভিব্যক্তি এবং শৈলী রয়েছে, তবে  একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ , তা হল কবিতাকে অনুভূতির মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয় । ফিকশান  আর সংবাদপত্র পাঠের  জন্য তার দরকার হয় না, তবে কবিতা অবশ্যই তা দাবি করে, তাই পাঠককে কবিতার শক্তির সাথে একটা তাৎক্ষণিক সংযোগ তৈরি করতে হয়। যদি তা না ঘটে তাহলে কবিতা সম্ভবত  অমন পাঠকের জন্য নয়! বেশিরভাগ স্কুল আমাদর জীবনের বহু  চমৎকার ব্যাপার নষ্ট করে দেয়, যার ফলে বড়ো হয়ে পাঠক ভেবে আপশোষ করে যে সেগুলো কতো আনন্দের  হতে পারতো । এর প্রধান কারণ হল শিক্ষকরা ছাত্রদের ওপর চাপ দেয়, তাই ছাত্ররা প্রতিদিন ক্লাসে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে বড়ো হয়ে  তাও  পছন্দ করে না। ব্যাপারটা সত্যি যে বাজারে গদ্যের আবির্ভাবের দরুণ  কবিতার মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে গদ্য ।বাজারের নিয়মে ভোগ্যবস্তু হিসেবে পাঠকদের কাছে উপন্যাস পরম প্রিয়। বিখ্যাত মহাকাব্য এখন পাঠক গদ্যে পড়তে চায় । গল্প বলার ক্ষমতার ফলে গদ্য  জিতে গেছে । কৃত্তিবাসের রামায়ণের বদলে পাঠক গদ্যে রামায়ণ পড়তে চায় বা ফিল্ম-টিভিতে দেখে সন্তুষ্ট থাকে ।

.

কবিতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে একটা হলো ভাষা। ‘লস্ট ইন ট্রানস্লেশান; বা “অনুবাদে হারিয়ে যাওয়া” সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এমনকি যখন অনুবাদ হুবহু হয়, ছন্দের সমস্যা, বা একট পদের পরিমাপের গোলমাল ঘটে যায়। একটা কবিতা মূল ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে গেলেই তার মেজাজ হারিয়ে যায়।বোদলেয়ারের একই কবিতা অজস্রবার অনুবাদ হয়েছে আর সেগুলোয় আসল বোদলেয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায় না । শেক্সপিয়ার বা গালিবের কবিতার অনুবাদে আমরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাই ; মূল কবিদের পাই না । অতএব, একটি কবিতা তার মূল ভাষায় পড়া সবচেয়ে ভাল, তাই পাঠক সম্ভবত নিজের মাতৃভাষার কবিতা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করবে। কবিতা এতই সূক্ষ্ম যে এটা কেবল তার আসল রূপের সাথে খাপ খায়। পাঠক যখন খুঁতখুঁত করে যে একটা বিদেশী কবিতা “ভালো হয়নি:, তখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে শব্দ নিয়ে কারিকুরি এতো সহজে কাজ করে না !

.

চোদ্দ

.

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুনিপুণ অভিনেতা এবং অভিনয়ের সুদক্ষ শিক্ষক । কবিতার আবৃত্তিতে এবং প্রবন্ধ গল্প নাটক ও উপন্যাসের পঠনেও তিনি সুদক্ষ ছিলেন । তাঁর সাধারণ কথাবার্তাও ছিল সাহিত্যধর্মী ও সুরেলা । এসব কথা বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথের নিজকণ্ঠের যে মুষ্টিমেয় রেকর্ডিং  হয়েছে তা  নিতান্তই অকিঞ্চিতকর ।

.

গেয় কবিতা এখনও লেখা হয় । যিনি লেখেন তিনি সেগুলো গেয়ে শোনান। চণ্ডীমণ্ডপের বদলে এখন মঞ্চে কবিতা গেয়ে শোনান গায়ক কবি অর্থাৎ প্রযুক্তির সঙ্গে ফরম্যাট পালটে গেছে। । যেমন, কবির সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, রূপম ইসলাম, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। রেডিওতে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হয় । কবিতা সিংহ যখন আকাশবাণী কলকাতায় ছিলেন তখন বহু তরুণকে কবিতা পাঠের সুযোগ দিয়েছিলেন। দূরদর্শনে পঙ্কজ সাহা প্রতিষ্ঠিত কবিদের অনুষ্ঠান করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ বা বুদ্ধদেব বসুর ‘জোনাকি’-র মতো কবিতায় প্রদীপ ঘোষের কন্ঠ সকলের কাছে সমাদৃত । প্রদীপ ঘোষের স্ত্রী গৌরী ঘোষও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা পাঠ করতেন।বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু মঞ্চে পাঠ করেছেন প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা। শুভ দাশগুপ্তের ‘শ্রীচরণেষু নেতৃবৃন্দ’ নামক স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।  ইউটিউবে বহু কবির কবিতা পাঠ আছে । এপার-ওপার দুই বাংলার, প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত কবিদের । ফালগুনী রায়ের কবিতা অনেকে পাঠ করেছেন । আমার কবিতাও দুই বাংলার বাচিক শিল্পীরা পাঠ করেছেন। কবিদের দেখেছি বাচিক শিল্পীদের টাকা দিয়ে নিজের কবিতার সিডি তৈরি করিয়েছেন ।

.

কবির লেখা কবিতা গায়ক বা গায়িকারা গেয়ে শোনান বা রেকর্ড করেন। যেমন জয় গোস্বামীর মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় গেয়েছেন লোপামুদ্রা মিত্র, আবৃত্তি করেছেন মুনমুন মুখার্জি ।  নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্রসাহেব শর্মা ২০১২ সাল থেকে ‘রেডিও বঙ্গনেট ’ নামের একটি ইন্টারনেট নির্ভর রেডিও স্টেশন চালিয়ে আসছেন৷ তাঁদের এখনও পর্যন্ত ৪ -টি চ্যানেল চালু হয়েছে৷ একটিতে শোনা যায় ধ্রুপদী সঙ্গীত , একটিতে লোকগীতি , একটিতে আধুনিক বাংলা গান , একটিতে রক সঙ্গীত৷২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এই ৪টি চ্যানেল৷ সাহেব জানালেন , ‘রক সঙ্গীতের চ্যানেলটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রূপম ইসলামের৷ তখন থেকেই একটা বাংলা কবিতার চ্যানেল নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল৷ব্রততীদি এগিয়ে আসায় এই চ্যানেলটি করতে আর আমার অসুবিধে হবে না৷ ’ব্রততী বলেছেন , ‘কেবলমাত্র কবিতার জন্য ডেডিকেটেড এই রকম চ্যানেল আমাদের দেশে নেই৷ বিদেশে কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে৷ আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এই রকম একটা কিছু করার৷ বেলঘরিয়ার ‘শঙ্খমালা ’ সংস্থা আর আমার পাঠশালার ছাত্র -ছাত্রী তাতার -ঊর্মি-সোমেশ -সৌম্য -সোহম — এঁদের সহযোগিতায় ইতিমধ্যেই আমি প্রায় ২০০ ঘণ্টা কবিতার রেকর্ডিং সংগ্রহ করে ফেলেছি৷ আমার নিজের সংগ্রহেও অনেক কিছু ছিল৷ এই চ্যানেলটা শুরু করার ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ নেই৷ আমিই ঠিক করব কী ধরনের প্রোগ্রামিং চলবে দিনভর৷’ ব্রততী বলেছেন , ‘আমার টার্গেট শ্রোতা হল এই প্রজন্মের নেট -স্যাভি এবং স্মার্টফোন ব্যবহার করা মানুষরাই৷ এই প্রজন্মের কাছে বাচিক শিল্পকে জনপ্রিয় করাই আমার উদ্দেশ্য৷ কোনও সন্দেহ নেই বাংলা কবিতা শোনার আগ্রহী মানুষ এখনও অনেক রয়েছেন৷ তার প্রমাণ , রবীন্দ্রসদনে আমাদের অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে৷ ’কীভাবে ডাউনলোড করা যাবে এই অ্যাপ ? সাহেব শর্মা জানালেন , ‘গুগল প্লে স্টোর কিংবা অ্যাপল অ্যাপস্টোর -এ গিয়ে radio bongonet টাইপ করলেই পাওয়া যাবে এই অ্যাপ৷ এছাড়া http://www.bongonet.net এই ওয়েবসাইটে গেলেই পাওয়া যাবে সমস্ত নিয়ম কানুন এবং রোজকার প্লে -লিস্ট৷ ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এই চ্যানেলে ঠিক সেই -সেই কবিতাই রাখছেন যা সবাই শুনতে চান৷ কেবল , প্লে -লিস্ট দেখে জেনে নিতে হবে কখন আপনার পছন্দের কবিতাটি শোনা যাবে৷

.

কবিতা ক্রমশ রকব্যাণ্ডের অংশ হয়ে উঠেছে, যেমন মহীনের ঘোড়াগুলি ১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড। এটি ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝ পর্বে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, এব্রাহাম মজুমদার, তাপস দাসতপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই সাত জন সঙ্গীতশিল্পী সহকারে নব্বই দশকের পর তারা ব্যাপকভাবে ভারতীয় রক যুগের কিংবদন্তি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী আভা-গার্দ সঙ্গীতদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯) এই তিন অ্যালবাম ভারতীয় রক মিউজিকের মাইলস্টোন।  পরে এসেছে ফসিলস, ক্যাকটাস, ভূমি, চন্দ্রবিন্দু   ইত্যাদি । ২০০০-এর দশকে মেটাল জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, ইনসমনিয়া এবং আন্ডারগ্রাউন্ড অথরিটির মতো অনেক ব্যান্ড হেভি মেটাল এবং বিকল্প সঙ্গীত বাজানো শুরু করে । আমার ‘ডেথ মেটাল’ কবিতাটা একটা রকব্যাণ্ড ইউটিউবে দিয়েছে।

.

বাঙালি গেয় কবিদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ্য কবির সুমন । কবির সুমন একজন তারকা কবি, নিজের গান নিজে লেখেন, অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি হয়  ৭০০ থেকে ২২০০ টাকায়্ এবং তা হাউসফুল যায় । হিন্দি ভাষায় বহু তারকা কবির নাম শোনা যায় যাঁরা অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের জন্য লাখ টাকা নেন, যেমন গুলজার, জাভেদ আখতার, প্রসূন যোশী, কুমার বিশ্বাস,  আশুতোষ রাণা প্রমুখ। হিন্দি ভাষার কবি কুমার বিশ্বাস কবিতা সম্মেলন ও মুশায়রার ক্ষেত্রেও একজন নেতৃস্থানীয় কবি। এ পর্যন্ত তিনি কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং হাজার হাজার কবিতা সম্মেলন ও মুশায়রা পরিচালনা করেছেন। দেশের শতাধিক  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি বিএইচইউ, আইএসএম ধানবাদ, আইআইটি রুরকি, আইআইটি ভুবনেশ্বর, আইআইএম লখনউ, এনআইটি জলন্ধর, এনআইটি ত্রিচি ইত্যাদির মতো অনেক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ।

.

বিটনিক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারত থেকে একটা হারমোনিয়াম কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন । তাঁকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কবিতা পাঠ করতে ডাকলে তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে কবিতা শোনাতেন। নিউ ইয়র্কে সেন্ট মার্কস চার্চে তরুণ কবিরা নিয়মিত কবিতা পাঠ করেন কোনো-না-কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ হাতে নিয়ে। আজকালকার গেয় কবিতা, বিভিন্ন দেশে, প্রায়ই জনপ্রিয় সঙ্গীতের বিপরীত ।

.

 লিথুয়ানিয়ায় গেয় কবিতার পথপ্রদর্শক ভিটাউটাস কার্নাগিস একবার বলেছিলেন, ‘ পপ গানের সস্তা, জীর্ণ শব্দের বদলে গেয় কবিতা সত্যিই একটা পাল্টা সংস্কৃতি।’ এখনকার গেয় কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল শ্রোতাকে কবিতা আর সঙ্গীতের শক্তিতে মোহিত  করা । যাঁরা  কবিতাকে গানের মতো পাঠ করেন তাঁদের  বলা হয় বার্ড’ বা চারণকবি। তাঁদের গানগুলো সাধারণত বিখ্যাত লিথুয়ানিয়ান কবিদের রচনা বা বার্ডদের নিজের লেখা কবিতার উপর ভিত্তি করে তৈরি। বাদ্যযন্ত্র (প্রায়শই একটি গিটার, কম প্রায়ই একটি বেহালা বা একটি পিয়ানো) ব্যবহার করা হয় আর শ্রোতাদের মধ্যে সঠিক মেজাজ তৈরি করে, যাতে শ্রোতা শব্দগুলোকে অনুধাবন করতে পারে। বার্ডরা তাদের পরিবেশনায় গান আর আবৃত্তিকে মিশিয়ে উপস্হাপন করে। উল্লেখযোগ্য লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ কবি যাঁরা তাঁদের কবিতা গেয়ে পাঠ করেন তাঁরা হলেন কোসটাস স্মোরিজিনাস, লেভা নারকুটে, ভিতাউতাস কেরেনাজিস, আলিনা ওরোয়োভা প্রমুখ। কেউ কেউ অন্যের প্রকাশিত কবিতা ব্যবহার করে বা সমসাময়িক কবিদের সাথে সহযোগিতা করে। কবিতা-গায়ক শিল্পীরা শুধুমাত্র মঞ্চ অভিনেতাই নন, বিভিন্ন পেশার লোকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের সাধারণত খুব কম বা কোনও বিশেষ সঙ্গীত শিক্ষা নেই। 

.

গেয়  কবিতা, বাঙালির মধ্যযুগে জনপ্রিয় ছিল অথচ আমরা সেই পরম্পরা কেন হারিয়ে ফেলেছি তা গবেষণার বিষয় হলেও, বিশ্বের অনেক অংশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবর জনগণের মধ্যে শৈল্পিক অভিব্যক্তির একটি জনপ্রিয় রূপ হিসেবে আজও বজায় আছে। ফারসি, আরবি আর তুর্কি সাহিত্যের বেশিরভাগ কবিতা মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের কারণে টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের গেয় কবিতা একটা জীবন্ত ঐতিহ্য হিসাবে রয়ে গেছে কারণ গায়ক-কবিরা কেবল প্রাচীন পাঠ্য এবং সুরে রদবদল করেই কবিতাকে নানা জায়গায় নিয়ে যান না বরং বর্তমান সংবেদনশীলতাকে প্রতিফলিত করার জন্য নতুন রচনাও তৈরি করেন। গায়ক-কবিদের কবিতাগুলোর চিত্রকল্পে একটি দ্বৈত অর্থ রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যা বস্তুগত এবং পার্থিব আনন্দের তুচ্ছ প্রতীক বলে মনে হয় তাও রহস্যময় পরমানন্দ এবং ঐশ্বরিক প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করে।

.

মার্কিন সম্পাদক এবং কবি অ্যালিসন অ্যাডেল হেজ কোক আদিবাসী আমেরিকান কবিতার  বহুভাষিক সংকলনে গেয় কবিতা একত্র করেছেন, যেগুলো বিগত কালখণ্ডের সাক্ষী এবং পুনরুদ্ধার করা গেয় লবিতায়  পুরানো এবং নতুন কণ্ঠ যোগ করেছেন।  সমগ্র আমেরিকা থেকে আশিরও বেশি কবিকে জড়ো করেছেন, আলাস্কা থেকে চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে, এবং আন্তর্জাতিক কবিদের পাশাপাশি শেরউইন বিটসুই, লুইস এরড্রিচ, জয় হারজো, লি ম্যারাকল এবং সাইমন অর্টিজের মতো পরিচিত নামগুলোও রয়েছে। আদিবাসি কবি-গায়করা লিখেছে ভিন্ন অঞ্চল এবং সমান্তরাল অভিজ্ঞতা থেকে,  পাকা মাটির ঢিবিকে গুঁড়িয়ে রাজপথ তৈরি  থেকে, তাদের হাপিশ-হওয়া গ্রাম পালটে গিয়ে মহাদেশের প্রথম বিশাল শহরগুলো থেকে, বরফঢাকা এলাকা  থেকে, আগ্নেয়গিরির দোআঁশ জমি থেকে, মুছে ফেলা ইতিহাসের অঞ্চলগুলো থেকে। এবং অবিরাম সশস্ত্র সংঘাতের এলাকা যেখানে “উত্তর ঔপনিবেশিকতা” আর “উত্তরাধুনিকতা” স্রেফ ব ইদ্যায়তনিক ধারণা নয় বরং  জীবন্ত বাস্তবতা।

.

অপেক্ষায় আছি কবে বাঙালি যুবক-যুবতী কবিরা ফিরিয়ে আনবেন গেয় কবিতার পরম্পরা।

Posted in Uncategorized | Tagged , , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

অ্যানাঈস নিন ( Anais Nin ) : মলয় রায়চৌধুরী

সন্মোহিনী, কামুক, দ্রোহী লেখিকা আনাঈস নিন : মলয় রায়চৌধুরী

অ্যানাঈস নিনের আসল, সেন্সরবিহীন ডায়েরির মতো  সূক্ষ্ম, অন্তর্দৃষ্টি এবং বেদনাসহ খুব কম লেখাই একজন নারীর বহুগামী মাংসল যৌনতা ও প্রেমের জীবনকে এমন খোলাখুলিভাবে মেলে ধরেছে । অসাধারণ জীবনের যাবতীয় তথ্য,  সম্পর্কের শারীরিক দিকগুলির সাথে  মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের সম্পূর্ণ বর্ণালীর ছটাকে স্পষ্টভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।এমনই  এক যুবতী যিনি তাঁর যৌন এবং মানসিক আকাঙ্ক্ষাপূর্তির জন্য সামাজিক বিধিনিষেধ, অপরাধবোধ ও অনৈতিকতার তকমা বিসর্জন দিয়ে নিজেই নিজেকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আর লিখে গেছেন, যা সাধারণত পুরুষরাও লিখতে ইতস্তত  করে। নিন ছিলেন অপার্থিবভাবে নারীসুলভ, সূক্ষ্মতা, টেক্সচার এবং আবেগে আনন্দিত। নারীর অসারতা বা দুর্বলতা হিসেবে অনুভূতিগুলোকে চাপা দেননি। তাঁর আত্ম-জ্ঞান ছিল তাঁর কাছে একটি সম্পদ । তিনি নারীর অভ্যন্তরীণ বিশ্বের বর্ণনা করার জন্য অব্যর্থ শব্দাবলী খুঁজে পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “একজন মহিলার পুরুষের মতো আনন্দ পাওয়ার অধিকার রয়েছে!”

.

তার ডায়েরি শিখিয়েছে যে জীবনের গুণমান বাড়িয়ে তোলার জন্য সৌন্দর্যের ছোট মুহুর্তের সঞ্চয় জরুরি। যে নারী এক হতে প্রত্যাখ্যান করতে পারে সেইই  স্বয়ংকে একাধিক করে তুলতে পারে। 

১৯৬৬ সালে নিন যখন তাঁর ডায়েরির অংশগুলো প্রকাশ করা শুরু করেন, তখন তাঁর জীবনের এই দিকটি বাদ দেওয়া হয়েছিল, যদিও স্পষ্টতই লেখক ও অভিনেতা অঁতনা আতোর সাথে, হেনরি মিলার এবং তাঁর স্ত্রী জুনের সাথে তাঁর উভকামী যৌন সম্পর্কের বিষয়ে সে সময় প্যারিসে অনেকে জানতো।  এছাড়াও হিউ পার্কার গুইলার এবং রুপার্ট পোলের সাথে তাঁর বিয়ের কথা লিখেছেন ; একই সময় এ দুজনের স্ত্রী ছিলেন তিনি।  রোজনামচা অনুযায়ী অ্যানাঈস নিন তাঁর মনোবিদ রেনে অ্যালেন্ডি এবং অটো র‌্যাঙ্ক ছাড়াও, জন স্টেইনবেক,  এডমন্ড উইলসন, গোর ভিদাল, জেমস এজি, জেমস লিও হারলিহি এবং লরেন্স ডুরেল সহ অনেক সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের প্রেমিকা ছিলেন। মিলারের সাথে তাঁর আবেগপূর্ণ প্রেমের সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব তাঁকে যৌনতা এবং লেখিকা হিসাবে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছিল । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – অ্যানাঈস নিন, প্রতিশোধ নেবার জন্য, তাঁর বাবার সাথেও যৌন সম্পর্ক পাতিয়েছিলেন।

নিন তার নিজের বাবাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন এই জন্য যে তাঁর বাবা শৈশবে তাঁকে আর তাঁর মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আর শৈশবে  পরিত্যাগের প্রতিশোধের জন্য বাবাকে অজাচারী যৌনতায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন । ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘ইনসেস্ট’ অনেকের মতে, এক স্তরে ঘৃণ্য, এবং তবুও নিন বিজয়িনী এবং সীমালঙ্ঘনকারী  যা সচরাচর কোনো নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না । তাঁর  জার্নালের তৃতীয় খণ্ডে,’অজাচারনামে তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক যৌন সম্পর্কের কথা অকপটভাবে আর বিশদে লিখেছেন ।

আনাঈস নিন ছিলেন “ফেমে ফেটাল”, যা একটি ফরাসি শব্দ , আক্ষরিক অর্থে, “মারাত্মক মহিলা।”  একজন ফেমে ফেটাল হলেন একজন মহিলা যিনি নরকের মধ্য দিয়ে গেছেন। সম্ভবত সে একটি গোপন ব্যথার আশ্রয় নিয়েছে বা একটি আঘাতমূলক শৈশব হারানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে. ফলস্বরূপ, সে নিষ্ঠুর এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বা অন্তত বিপদের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। একজন সংবেদনশীল স্প্যানিশ মেয়ে, আনাঈস নিন তার বাপের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল এবং বাপ তার মাকে পরিত্যাগ করেছিল। বাপ হামেশাই তার  ধনী সঙ্গীত ছাত্রীদের সাথে পালিয়ে যেতো।

১৯৩৩ সালে, ২০ বছরের বিচ্ছেদের পর, নিন তাঁর বাবার সাথে আবার দেখা করেছিলেন। মেয়ে এবং বাবা অপরিচিত ছিলেন, বাবা তখন একজন কুখ্যাত ডন হুয়ান এবং নিন একজন ৩০ বছর বয়সী নারী। নিন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে তাঁর বাবা কীভাবে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ধ্বংস করেছেন তার জন্য এক টুকরো অনুশোচনা পর্যন্ত ছিল না । স্ত্রী-সন্তানদের দুরাবস্হা সম্পর্কে তাঁর বাবার কোনও ধারণা ছিল না। আনাঈস  বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর বাবা একজন ভয়ঙ্কর এবং স্বার্থপর মানুষ। মোটেই আদর্শিক দেবতা নন যা তিঁনি তাঁর ডায়েরিতে বর্ণনা করেছিলেন। তাই বদলা নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

তারপরে, একটি চিত্তাকর্ষক বাঁকবদলে, অ্যানাঈস নিন, একসময়ের আঘাতপ্রাপ্ত শিশু, তাঁর পিতার প্রলোভনকারী দ্বৈত ব্যক্তিত্বকে সৃজনশীল ডায়নামো হিসাবে গ্রহণ করেছিল। নিনের বহু প্রেমিক ছিল এবং অবশেষে তাঁর জার্নালে তাঁর দুঃসাহসিক কাজগুলোকে ধরে রাখার জন্য দুইজন স্বামীর স্ত্রী হয়ে উঠলেন। তিনি কয়েক ডজন সূক্ষ্ম সুন্দর গদ্যের টুকরাও তৈরি করেছিলেন, এমনকি আধুনিক মহিলা ইরোটিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে যা পরিচিত । তাঁর ডায়েরিগুলো অবশেষে অসাধারণ প্রশংসা পেয়েছে এবং তিনি তার “স্বপ্ন থেকে এগিয়ে যাওয়ার” উদাহরণ অনুকরণ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অনুসারী নারীদের কাছে হ্যামেলিনের বাঁশিঅলা হয়ে  গেছেন।

আনাঈস নিনের ডায়েরিগুলো সাহিত্যের একটি অসাধারণ কাজ। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন “আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপরের মাটি আসলে কিছুই নয়”। তাঁর ডায়েরি তার অভ্যন্তরীণ জীবন, “সেন্সরবিহীন স্বপ্ন, মুক্ত অচেতন” বর্ণনা করে গেছে এবং তা টিকার টেপের মতন পাঠকের মগজে ফিল্মের মতন চিত্রিত হয়।যদিও ডায়রিগুলোই গভীর ব্যক্তিগত নথি, যা শুধুমাত্র একজন নারীর মনস্তাত্ত্বিক ভূগোলই প্রকাশ করে না, বরং  সমস্ত মহিলাদের, সমস্ত মানুষের অভ্যন্তরীণ জীবনের রহস্য উন্মোচন করে৷

তার সেন্সরবিহীন ডায়েরিগুলো সাহিত্যের প্রচলিত মানদণ্ডে বিস্ফোরক। নিঃসন্দেহে সেগুলো বিক্ষুব্ধ নৈতিকতাবাদী দলকে চটিয়ে দেবে যারা নিনের নিজের নৈতিক কোড অনুসারে বাঁচার সাহসের জন্য, তাঁর দুঃসাহসিক কাজগুলো সম্পর্কে লিখতে এবং তারপরে সেই লেখা সবার পড়ার জন্য প্রকাশ করাকে মেনে নিতে পারেননি। যেভাবে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে তা প্রমাণ করে যে তার ডায়েরি পচনরত স্নায়ুতে আঘাত করেছে।

তার জীবনের অবিশ্বাস্য পরীক্ষায়, আনাঈস নিন অনেক কিছু করেছিলেন যা খুব কম মহিলাই লেখায় স্বীকার করবেন – বা  বিবেচনা করতে পারেন। তাঁর জীবনের বেশিরভাগ ঘটনা তাঁর যৌন জীবনের সঙ্গে ছিল, এমন এক অঞ্চল যা নারীরা তাদের নিজস্ব শর্তে নিয়ন্ত্রণ করতে লড়াই করে। নিনের ঘটনাবহুল এবং উত্তেজনাপূর্ণ জীবন ছিল বলে মনে হয়, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি “নিউরোসিস” বা “অসুস্থতায়” ভুগছিলেন এবং তিনি এর কারণ বোঝার জন্য লড়াই করেছিলেন।  এমনকি   বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছাড়াই, নিন একটি আধুনিক শিল্প ফর্ম তৈরি করে গেছেন যা শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট যোগাযোগের এই শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় স্থান করে নিয়েছে যখন কিনা তাঁর ডায়রি ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তিতে পূর্ণ। 

অ্যানাঈস তাঁর  ব্যাঙ্কার স্বামী গুইলারের কাছে একজন ভাল স্ত্রী হয়ে বেড়ে ওঠতে চেয়েছিলেন, কিন্তু  অস্তিত্বের বিষণ্নতা ইতিমধ্যেই তাঁর মস্তিষ্কে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁর বাবার তাঁদের পরিত্যাগ এমন একটা ঘটনা ছিল যা থেকে তিনি কখনই নিজেকে  পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেননি । ফলে তাঁর আশ্রয় ছিল  ডায়েরি। এটি সেই বাহন যার মাধ্যমে তিনি তাঁর কল্পনাগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, কারণ এটা তাঁর সৌন্দর্য এবং সুখের এবং ভালবাসা এবং আরাধ্য হওয়ার স্বপ্নগুলোকে সংরক্ষণ করেছিল। তবে একথা সত্য, , তিনি আদর্শ প্রেমের লোভে পদে-পদে নিজের জীবনকে ধ্বংস হতে দিয়েছিলেন।

আনাইস নিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে হেনরি মিলার, তার স্ত্রী জুন, নিনের নিজের স্বামী এবং তাঁর মনোবিদ ও অন্যদের সাথে  যৌন সম্পর্কের অন্তরঙ্গ বিবরণ তাঁর জীবদ্দশায় আর প্রধান অংশগ্রহণকারীরা জীবিত থাকাকালীন যেন প্রকাশ করা না হয়। নিন ছিলেন রোমান্টিক, কামুক, বিদ্রোহী, পারার মতন চনমনে আর উপলব্ধি-সন্ধানী। তিনি সৃজনশীলতা এবং কল্পনাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা কম নারীই পারেন। তিনি এমন একটি জীবনযাপন করেছিলেন যেখানে কোনও আনন্দ বা ঝুঁকি প্রত্যাখ্যান করা হয়নি।

.

একজন নারীর নিজের  লেখার মধ্যেই পরিত্রাণ খুঁজে পেতে,  গোপনীয়তা বাদ দিয়ে, রোজনামচার পাতাগুলো এক অবিস্মরণীয় আনাই নিনকে উন্মোচন করে, যিনি  শেষ পর্যন্ত রহস্যময়, সম্ভবত অবর্ণনীয়। ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যুর সময়, ডায়েরিগুলো প্রায় ১৫০টি হাতে-লেখা খাতায় পাওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে সাতটি  সম্পাদনা এবং প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩১ সালের আগে লেখা তাঁর প্রাথমিক ডায়েরির চারটি খণ্ড  ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়। তার পরের  ডায়েরিগুলো ১৯৮৬ সাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। 

 নিন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অটো র‌্যাঙ্কের কাছে মানসিক চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন, কিন্তু  অটো র‌্যাঙ্কও নিনের প্রেমে পড়েন এবং এই গল্পটি ডায়েরিতে, ‘ফায়ার’ অংশে লেখা আর সেই নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর ‘নিয়ারার দ্য মুন’ অংশে নিন  মার্কসবাদী গঞ্জালো মোরে-এর সাথে তাঁর যৌন  সম্পর্কের কথা লিখেছেন এবং ‘মিরাজ’-এর ডায়েরি অংশের শুরুতে বর্ণিত৷

‘মিরাজ’ অংশ ১৯৩৯ সালে নিনের আমেরিকায় যাওয়ার সাথে শুরু হয় এবং ১৯৪৭ সালে শেষ হয় যখন তিনি সেই বিশিষ্ট  প্রেমিকের সাথে দেখা করেন যিনি  তাঁর অতৃপ্ত ক্ষুধা মেটাবেন। মাঝামাঝি  সময়কে নিন “নরক” হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যে সময় তিনি এক ধরণের কামুক উন্মাদনা অনুভব করতেন, এমনই একজন  যে তাঁর প্রেমে জ্বালানি যোগাবে। ‘মিরাজ’ অংশ ঠিক তেমনই।  একের পর এক মরীচিকা রাস্তায় নাচছে, একের পর এক আশ্রয় ও জলের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু তারপরে অনেক আশা ও স্বপ্নের মতো নিষ্ঠুরভাবে বাষ্প হয়ে গেছে। সমস্ত শিল্পীর মতো, নিনের চর্যা ছিল তাঁর অনুভূতি এবং তিনি তাঁর বাবার প্রত্যাখ্যান থেকে উদ্ভূত ছিন্নভিন্ন ব্যথার আয়নায় নিজেকে প্রতিবিম্বিত করেছেন । এই অংশে, নিন তাঁর “অসুখ” সম্পর্কে লিখেছেন, নিজেকে বারবার আত্ম-এবং পেশাদার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, এবং যা তাঁর মনে হয়েছে বিপদজনকভাবে ধ্বংসের কাছাকাছি ।

অবশেষে, ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে রুপার্ট পোলের সাথে পরিচয় হবার পর, নিন শেষ পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ সম্পর্ক উপভোগ করবেন, যেটি তার প্রেমের জন্য উন্মাতাল অনুসন্ধানের অবসান ঘটাবে, যদিও এখানে তাঁর গল্প শেষ হয় না। পরিবর্তে, তিনি তারপর একটি “ট্র্যাপিজ” জীবন শুরু করবেন যেখানে তিনি বছরের পর বছর ধরে দুজন স্বামী রুপার্ট পোল এবং হুগো গুইলারের মধ্যে দোল খাবেন – এক অসম্ভব কীর্তি এবং তার জীবনকাহিনির সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়গুলোর অন্যতম৷  বাবা ও প্রেমিকদের দ্বারা পরিত্যক্ত, প্রচন্ড বেদনা, এবং যৌন চাহিদা থেকে, আনাঈস নিন একটি জীবনব্যাপী শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন যা অতুলনীয়, যা কল্পকাহিনী এবং গম্ভীর সন্দর্ভ, ডায়েরি এবং উপন্যাসের মধ্যে  বাধা ভেঙে দেয়, সচেতন এবং অচেতন, সামাজিকভাবে- অনুমোদিত এবং অননুমোদিত, সরকারী এবং ব্যক্তিগত, সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। এই ধরনের সেন্সরশিপ সমাজে ছিল এক সময়ে ।  

অ্যানাঈস নিনের কাছে, একটি ডায়েরি শুরু করার জন্য একজন বীর নায়িকার নির্মাণ দরকার ছিল। তিনি নিজের একটি আদর্শ সংস্করণ হিসেবে গড়ে তুললেন সেই বীরাঙ্গনা। তবে তাঁর ডায়েরিতে লেখার ফলে তাঁর চরিত্রের প্রকৃত দিকগুলিও আবিষ্কার করেছেন তিনি নিজে এবং তাঁর পাঠকরা। লেখাগুলো খাঁটি ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে লেখা ছিল “তার বিভক্ত ও বিশৃঙ্খল স্বভাবের সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান” এবং বলেছিলেন, “আমি যতই বিচ্ছিন্ন প্রভাব অনুভব করতাম না কেন, লেখা আমার কাছে  ছিল সম্পূর্ণতার একটি কাজ।” এইভাবে, নিনের ডায়েরি একটি অনন্য নথি হিসাবে কাজ করে যা একজন ব্যক্তিত্বের বিবর্তন, আর দ্রোহকে  বর্ণনা করে।

 ডায়েরি লেখা নিনের আত্মনির্মাণকে স্পষ্ট করে তোলে, এও প্রকাশ করে যে কেন তা প্রয়োজনীয় ছিল এবং সেই আত্মের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করতে সহায়তা করেছিল। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ডায়েরি লেখা নিনকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যে তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা, প্রথম সম্পর্ক এবং নিজের প্রথম দর্শনের জন্য তাঁর “বন্ধনে থাকা” দরকার নেই। তিনি “বিকৃত আয়না” ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পরিপূর্ণতা ও আনন্দ অনুভব করতে পেরেছিলেন।

নিনের কাছে ডায়েরি  লেখা ছিল ক্যাথারসিস, সৃজনশীলতা এবং থেরাপি সবকিছু একত্রে ।  লেখা নিজের কাছে আসার একটি উপায়। তিনি যেমন  ব্যাখ্যা করেছেন, “অভিজ্ঞতার মুহূর্তটি ইতিমধ্যে চলে গেলে, লেখাটাই আবার সেই জীবনযাপন করার একটি উপায়। জীবন ঘটনা দিয়ে তৈরি এবং অ্যানাঈস এটি জানতেন কারণ তিনি  নিজের জীবনের একাধিক সংস্করণ এবং গল্প, জার্নাল, কবিতা এবং সৃজনশীল কথাসাহিত্যে তার অভিজ্ঞতার মুহূর্তগুলো আরেকবার তৈরি করেছিলেন। তাঁর প্রতিভা এবং তাঁর উন্মাদনা প্রতিটি পৃষ্ঠায় ঢেলে দিয়েছেন ।

অ্যানাই নিন-এর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো

ডায়রি ও চিঠিপত্র : ১) চার খণ্ডে ১৯১৪ থেকে ১৯৩১ ডায়েরি ; ২ ) সাতখণ্ডে ডায়রি যা তিনি নিজে সম্পাদনা করেছিলেন ; ৩ ) হেনরি অ্যণ্ড জুন -জার্নাল অফ লাভ ( ১৯৩১-১৯৩২ ) যা নিনের মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী রুপার্ট পোল প্রকাশ করেন ; ৪ ) ইনসেস্ট : ফ্রম এ জার্নাল অফ লাভ ( ১৯৯২ )  ; ৫ ) ফায়ার : ফ্রম এ জার্নাল অফ লাভ ( ১৯৯৫) ; ৬ ) নিয়ারার দ্য মুন : ফ্রম এ জার্নাল অফ লাভ ( ১৯৯৬ ) ; ৭ ) মিরাজেস : দি আনএক্সপারগেটেড ডায়ারি অফ অ্যানাই নিন, ১৯৩৯-১৯৪৭ ( ২০১৩ ) ; ৮ ) ট্র্যাপিজ : দি আনএক্সপারগেটেড ডায়ারিজ অভ অ্যানাই নিন ১৯৪৭ -১৯৫৫ ( ২০১৭ ); ৯ ) দি ডায়ারি অফ আদার্স : দি আনএক্সপারগেটেড ডায়ারিজ অফ অ্যানাই নিন ১৯৫৫ – ১৯৬৬ ( ২০২১) ; ১০ ) লেটার্স টু এ ফ্রেণ্ড ইন অসট্রেলিয়া ( ১৯৯২ ) ; ১১) এ লিটারেট প্যাশান : লেটার্স অফ অ্যানাই নিন অ্যান্ড হেনরি মিলার ( ১৯৮৭ );  ১২ ) অ্যারোজ অফ লঙগিঙ : লেটার্স বিটউইন অ্যানাই নিন অ্যান্ড ফেলিক্স পোলাক ১৯৫২ – ১৯৭৬ ( ১৯৯৮ ) ; ১৩ ) রিইউনাইটেড : লেটার্স বিটউইন অ্যানাই অ্যান্ড জোয়াকিন নিন ১৯৩৩ ১৯৪০ ( ২০২০) : ১৪ ) লেটার্স টু লরেন্স ডুরেল ১৯৩৭ – ১৯৭৭ ( ২০২০ ) 

উপন্যাস : ১ ) হাউস অফ ইনসেস্ট ( ১৯৩৬ ) ; ২ ) উনটার অফ আর্টিফিস ( ১৯৩৯ ); ৩ )সিটিজ অফ দি ইনটিরিয়র – পাঁচ খণ্ডে ( ১৯৫৯ ); ৪ ) ল্যাডার্স অফ ফায়ার ; ৫ ) চিলড্রেন অফ অ্যালবাট্রস ; ৬ ) দি ফোর চেমবার্ড হার্ট : ৭ ) দি স্পাই ইন দ্য হাউস অফ লাভ ; ৮ ) সিডাকশান অফ দি মিনোটর ( ১৯৫৮ সালে সোলার বার্ক নামে প্রকাশিত হয়েছিল ) ; ৯ ) কোলাজেস ( ১৯৬৪ )

ছোটগল্প সংকলন : ১ ) ওয়েস্ট অফ টাইমলেসনেস ( মৃত্যুর পর প্রকাশিত ) ; ২ ) আণ্ডার এ গ্লাস বেল ( ১৯৪৪ ) ; ৩ ) ডেল্টা অফ ভেনাস ( ১৯৭৭ ) ; ৪) লিটল বার্ডস ( ১৯৭৯ ); ৫ ) অলেট্রিস ( ২০১৬ )

প্রবন্ধ : ১ ) ডি এইচ লরেন্স – অ্যান আনপ্রফেশনাল স্টাডি ( ১৯৩২ ); ২) দি নভেল অফ দি ফিউচার ( ১৯৬৮ ) ; ৩) ইন ফেভার অফ দি সেনসিটিভ ম্যান ( ১৯৭৬); ৪ ) দি মিসটিক অফ সেক্স – ১৯৩৪ – ১৯৭৪ ( ১৯৯৫ )

সমালোচকরা, সমাজে তাঁর ডায়েরি ও উপন্যাসের নৈতিক প্রভাবের চেয়ে তাঁর ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে বেশি আপত্তি করেছেন। হেনরি মিলারের সাথে ক্ষিপ্ত তর্কে নিন দাবি করেছিলেন যে নারীরা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে  পারে আর ‘মেল গেজ’ বা পুরুষের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যেতে পারে।যদিও তিনি সাহিত্যিক সাফল্যের উচ্চতা অর্জন করতে পারেননি যা তিনি চেয়েছিলেন, নিন একটি সাংস্কৃতিক  বিপ্লবের হোতা হয়ে উঠেছিলেন এবং তা হলো ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের নারীবাদী আন্দোলন। তিনি নারীর স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের বিরল ক্ষমতার জন্ম দিয়েছিলেন। ‘ ডেল্টা অফ ভেনাস’ বইতে নিন পাঠকদের নতুন অভিজ্ঞতার জগতে স্বাগত জানান যেখানে তিনি দাবি করেন যে ‘কান্না, হাসি, প্রতিশ্রুতি…নতুন মুখ, নাচ এবং মদের সাথে যৌনতা মিশ্রিত করা হোক।’ গল্পের  এই সংকলন নারীর যৌনতা সম্পর্কিত চাহিদা তুলে ধরেছে।  অ্যানাঈস নিজে যাকে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ নাম দিয়ে  খুলে দিয়েছিলেন। নিনের লেখাগুলোয় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন জনপ্রিয় নারীবাদী বক্তা করে তুলেছিল; অবশ্য নারীবাদী আন্দোলনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে নিন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ছিলেন । ১৯৭৩ সালে, তাঁর মৃত্যুর আগে, নিন  ফিলাডেলফিয়া কলেজ অফ আর্ট থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের  ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।১৯৭৬ সালে ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’ তাঁকে বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার দিয়েছিল।

নিনকে অনেক সমালোচক নারীর লেখা ইরোটিকার পথিকৃৎ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি ছিলেন  নারীদের মধ্যে প্রথম একজন যিনি ইরোটিক লেখার এলাকার সবটুকু  অন্বেষণ করেছেন এবং অবশ্যই ইউরোপ-আমেরিকার আধুনিক সাহিত্যে প্রথম  মহিলা যিনি ইরোটিকা লেখার জন্য পরিচিত। তার আগে, কেট চোপিনের কাজের মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম সহ মহিলাদের দ্বারা লেখা ইরোটিকা বিরল ছিল। তাঁর ডায়রিতে নিন  লেখক ডুনা বার্নস, ডি.এইচ. লরেন্স,  মার্সেল প্রুস্ত, আঁদ্রে জিদ, জাঁ ককতো, পল ভ্যালেরি এবং আর্তুর র‌্যাঁবোর দ্বারা অনুপ্রেরণার কথা লিখেছেন ।

তাঁর পুরো নাম অ্যাঞ্জেলা আনাঈস হুয়ানা আন্তোলিনা রোসা এদেলমিরা নিন ই কুলমেল (জন্ম ১৯০৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ; মৃত্যু ১৯৭৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ) নামটা স্প্যানিশ । পরিচিত  অ্যানাঈস নিন নামে। আনাঈস নিন জন্মেছিলেন ফ্রান্সের নিউইলিতে। তাঁর বাবা  জোয়াকিন নিন ছিলেন  কিউবান পিয়ানোবাদক এবং সুরকার এবং মা কাতালান বংশদ্ভুত রোজা কুলমেল, ফরাসি এবং ডেনিশ বংশোদ্ভূত কিউবান গাযিকা। তাঁর বাবার দাদা বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন , প্রথমে সান্তো ডোমিঙ্গোয়, তারপর নিউ অরলিন্স, এবং অবশেষে কিউবায় ।

নিন তাঁর প্রারম্ভিক বছরগুলো স্পেন আর কিউবায়, ষোল বছর প্যারিসে ( ১৯২৪- ১৯৪০) আর তাঁর জীবনের বাকি অর্ধেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন, যেখানে তিনি একজন ভিন্নধারার লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। অ্যানাঈস নিন ক্যাথলিক রোমান পরিবারে জন্মালেও ষোলো বছর বয়সে ধর্মের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে গির্জায় যাওয়া  ছেড়ে দেন। তিনি তাঁর শৈশব এবং প্রাথমিক জীবন ইউরোপে কাটিয়েছেন। তাঁর বয়স যখন দুবছর তখন তাঁর বাবা-মা আলাদা হয়ে যান; তাঁর মা তারপর অ্যনাঈস আর তার দুই ভাই, থোরাভিদ আর জোয়াকিনকে নিয়ে প্রথমে বার্সেলোনা, আর তারপর নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাস করতে চলে যান, যেখানে অ্যানাঈস উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। নিন ১৯১৯ সালে ষোল বছর বয়সে হাইস্কুল ছেড়ে দেন। তাঁর ডায়েরি অনুযায়ী তিনি একজন শিল্পীর মডেল হিসেবে কাজ শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর, নিন  স্প্যানিশ  বলতে  ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু  ফরাসি ভাষা বলতে পারতেন আর  ইংরেজিতে সাবলীল হয়ে ওঠেন।

৩ মার্চ, ১৯২৩ সালে, হাভানা, কিউবাতে, হিউ পার্কার গুইলারকে ( ১৮৯৮ – ১৯৮৫ ) অ্যানাঈস নিন বিয়ে করেন । গুইলার ছিলেন একজন ব্যাঙ্কার এবং শিল্পী । গুইলার পরে “ইয়ান হুগো” নামে পরিচিত হন ; সেসময়ে গুইলার  ১৯৪০ দশকের পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র তৈরি করা আরম্ভ করেন । পরের বছর তাঁরা দুজন প্যারিসে চলে যান। সেখানে গুইলার তাঁর ব্যাঙ্কিং ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং নিন লেখালেখির প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। তাঁর ডায়েরিতে তিনি ফ্ল্যামেংকো নাচ শেখার কথাও লিখেছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাজটি ছিল ১৯৩২ সালে ডি এইচ লরেন্সের মূল্যায়ন নিয়ে ষোলো দিনে লেখা ‘ডি.এইচ. লরেন্স: একটি  এ প্রফেশনাল স্টাডি’।

তাঁর ১৯৩১-১৯৩৪ ডায়েরি অনুযায়ী, নিন  ইরোটিকায় প্রথম আকৃষ্ট হন যখন তিনি তাঁর স্বামী, মা এবং দুই ভাইয়ের সাথে  প্যারিসে ফিরে যান। তাঁরা গ্রীষ্মের জন্য  একজন আমেরিকানের  অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিলেন, এবং নিন বেশ কয়েকটা ফরাসি পেপারব্যাক পেয়েছিলেন । ডায়রিতে লিখেছেন “একের পর এক, আমি এই বইগুলো পড়ি, যেগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল৷ আমি আমেরিকাতে কখনও কামুক সাহিত্য পড়িনি৷ বইগুলো আমাকে অভিভূত করেছিল।  সেগুলো পড়ার আগে আমি নির্দোষ ছিলাম, কিন্তু যখন আমি সেগুলো  পড়লাম, তখন যৌন শোষণ সম্পর্কে আমি জানতাম না এমন কিছুই বাকি রইল না। বলা যায় ইরোটিক বিদ্যায় আমি  ডিগ্রি পেলাম।” নিন লিখেছিলেন, “আমি শুধুমাত্র পরমানন্দের জন্য বাঁচতে চাই। ছোট ডোজ, মাঝারি ভালবাসা,  অর্ধ-ছায়া, ঠান্ডা চাই না। আমি বাড়াবাড়ি পছন্দ করি। এমন চিঠি পেতে চাই যা পোস্টম্যান বইতে পারে না, এমন বই যা তাদের কভার থেকে উপচে পড়ে, এমন যৌনতা  থার্মোমিটারকে ফাটিয়ে দেয়।”

১৯২৩ সালে, নিন প্যারিসে  আমেরিকান লেখকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন । হেনরি মিলার আর  হেনরির স্ত্রী জুনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়  এবং আরম্ভ হয় হেনরি আর জুন মিলারের সঙ্গে অ্যানাঈস নিনের জটিল প্রেমের ত্রিভুজ যা তাঁর সেই সময়ের ডায়েরির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।  পরে এই ত্রিভুজ নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছে । তাঁর ডায়েরি অনুসারে, অ্যানাঈস নিনের বোহেমিয়ান  জীবনধারা শুরু হয়  প্যারিসে হেনরি মিলারের সঙ্গে যৌনসম্পর্কের সময়কালে। মিলারের সাথে তাঁর মিলন খুব আবেগপূর্ণ এবং শারীরিক ছিল যার ফলে নিন গর্ভবতী হয়ে পড়েন আর ১৯৩৪ সালে গর্ভপাত করাতে হয় । হেনরি মিলার পাঁচবার বিয়ে করেছেন আর ডিভোর্স দিয়েছেন : ১) বিয়েট্রিস সিলভাস উইকেন্স, বিয়ে ১৯১৭, ডিভোর্স ১৯২৪; ২) জুন স্মিথ ম্যান্সফিল্ড, বিয়ে ১৯২৪, ডিভোর্স ১৯৩৪; ৩ ) জ্যামিনা মার্থা লেপ্সকা, বিয়ে ১৯৪৪, ডিভোর্স ১৯৫২ ; ৪ ) ইভ ম্যাকক্লুর, বিয়ে ১৯৫৩, ডিভোর্স ১৯৬২ ; এবং ৫ ) হোকি টোকুডা, বিয়ে ১৯৬৭, ডিভোর্স ১৯৭৮ ।  মিলারের শেষ প্রেমিকা ছিলেন ব্রেণ্ডা ভেনাস, যাঁকে তিনি বিয়ে করেননি, লিভ টুগেদার করতেন আর অজস্র প্রেমপত্র লিখতেন, যেগুলো সংকলিত করে ব্রেণ্ডা ভেনাস একটি গ্রন্হ প্রকাশ করেছেন । অ্যানাঈস নিন বিবাহিত ছিলেন এবং মিলারকে বিয়ে করতে চাননি।

 মিলারের জীবনে অ্যানাঈস নিনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নিন ছিলেন একই সঙ্গে তাঁর মা আর শয্যাসঙ্গিনী । নিনের অনুমতি না নিয়ে মিলার কোনো সাহিত্যিক নির্ণয় নিতেন না । ১৯৩৫ সালে নিন আমেরিকায় থাকতে চলে গেলে মিলার তাঁর পেছু নিয়েছিলেন এবং নিনকে বোঝান তাঁর স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে । নিন রাজি হননি । মিলার তাঁর “ব্ল্যাক স্প্রিঙ” বইটি নিনকে উৎসর্গ করেন ।  অ্যানাঈস নিন তাঁর ডায়েরিতে হেনরি মিলার সম্পর্কে, আরও অনেক কথার সঙ্গে এইকটা কথাও লিখেছেন, “হেনরি যেন একজন পৌরাণিক অপরাধী । ওর গদ্য তরঙ্গায়িত অগ্নিশিখার মতন, প্রবল স্রোতপূর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিপজ্জনক ও মায়াময় । আমাদের যুগে দরকার হিংস্রতা । আমি ওর লেখার তেজকে উপভোগ করি, ওর কুৎসিত, ধ্বংসাত্নক, ভয়হীন, নান্দনিক শৌর্য । জীবনকে পুজো করার পাশাপাশি, সমস্তকিছু সম্পর্কে অত্যুৎসাহী এবং আবেগি দক্ষতা, হাসিঠাট্টা, প্রাচুর্য এবং আকস্মিক ধ্বংসাত্মক ঝড় আমাকে অবাক করে । সমস্তকিছুকে ও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় : ভণ্ডামি, কপটতা, ভয়, ছ্যাঁচড়ামি, আশাভঙ্গ । এটা ওর প্রবৃত্তির হুলিয়া । ও উত্তম পুরুষে লেখে, প্রকৃত নামগুলো ব্যবহার করে, ও শৃঙ্খলা আর আঙ্গিককেই কাহিনি হিসাবে গড়ে তোলে । ও  অসংযতভাবে এমনকরে লেখে যে আমরা তা বিভিন্ন স্তরে একযোগে অনুভব করি”।

এই সময় অর্থের জন্য  মরিয়া, নিন, হেনরি মিলার এবং তাঁদের কয়েকজন বন্ধু  একজন বেনামী “সংগ্রাহকের” জন্য এক ডলার প্রতি পাতার বিনিময়ে কামোত্তেজক এবং পর্নোগ্রাফিক আখ্যান লিখতে শুরু করেন, কিছুটা রসিকতা হিসাবে। নিন তাঁর ইরোটিকার চরিত্রগুলিকে চরম ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্হাপন করেছিলেন । ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে সেগুলো ‘ডেল্টা অফ ভেনাস’ নামে প্রকাশ করার অনুমতি দেন আর রাতারাতি সাড়া পড়ে যায়।২০১৬ সালে, ইরোটিকার একটি পূর্বে অনাবিষ্কৃত সংগ্রহ, ’অলেট্রিস, প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল।

অ্যানাঈস নিনের  সাথে হেনরি মিলারের প্রথম দেখা হয় ১৯৩১ সালে । তিনি যেন মিলারের মতন একজন পুরুষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরের  জার্নালে তাঁদের প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা দিয়েছেন । তিনি প্রথমে মিলারের লেখার প্রেমে পড়েছিলেন, এবং তারপরে মিলারের স্ত্রী জুনের দ্বারা প্রলুব্ধ হন । হেনরি মিলার ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ এবং ‘ব্ল্যাক স্প্রিং’-এর মতো নিষিদ্ধ, কামোত্তেজক উপন্যাসের লেখক ছিলেন । অ্যানাঈস নিনের সাথে দেখা করার সময়, হেনরি তার পাঁচ স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী জুন অ্যান্ডারসনের সাথে ছিলেন।

নিন ডায়রিতে লিখেছেন,’যখন মিলার প্রথম গাড়ি থেকে নেমে দরজার দিকে হেঁটে এলো যেখানে আমি অপেক্ষা করছিলাম, আমি একজন পুরুষকেকে দেখতে পেলাম যাকে আমি পছন্দ করতে পারবো। তাঁর লেখায় তিনি সাবলীল, সাহসী, পশুসুলভ, মহৎ। তিনি এমন একজন মানুষ যে জীবন মাতাল করে তুলতে পারবে, আমি ভেবেছিলাম। মিলার আমার মতন । আমার দরকার ছিল একজন বয়স্ক মনের পুরুষ, একজন বাবা, আমার চেয়ে শক্তিশালী একজন মানুষ, একজন প্রেমিক যে আমাকে ভালবাসায় পথ দেখাবে কারণ বাকি সবই এক-একজন নিজের তৈরি জিনিস। বেড়ে ওঠার এবং তীব্রভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা আমার মধ্যে এতটাই শক্তিশালী যে আমি তা প্রতিরোধ করতে পারি না। আমি কাজ করব, আমি আমার স্বামীকে ভালবাসব, তবে আমি নিজের চাহিদাকেও পূরণ করব।

জুন আনাঈসকে প্রলুব্ধ করেছিল; : নিনের ডায়েরিতে  জুনের প্রতি তার  শারীরিক আবেগের কথা আছে, তা পরিপূর্ণ হোক বা না হোক, কিন্তু হেনরির প্রতি তার দৈহিক সম্পর্ক অবশ্যই পূর্ণ হয়েছিল। নিন লিখেছেন, “”আমি ইতিমধ্যেই হেনরির লেখায় আকৃষ্ট, কিন্তু আমি আমার শরীরকে আমার মন থেকে আলাদা করেছি। আমি মিলারের শক্তি, তার কুৎসিত, ধ্বংসাত্মক, নির্ভীক, ক্যাথার্টিক শক্তি উপভোগ করি।” হেনরি যদি কুৎসিত তাহলে জুন অপ্রতিরোধ্যভাবে সুন্দরী । অ্যানাঈস এবং হেনরির মধ্যে সম্পর্ক ত্রিমুখী হয়ে ওঠে: নিয়ন্ত্রক জুন আবেগপ্রবণ অ্যানাঈসকে প্রলুব্ধ করে ফ্যালে।

গুইলার হেনরির সাথে নিনের  সম্পর্কের কথা সবই জানতেন এবং ভয়ও পেয়েছিলেন যে তিনি মিলারের কাছে আনাঈসকে হারাবেন। নিন লিখেছেন, “গুইলার মিলারের প্রশংসা করে। একই সঙ্গে সে উদ্বিগ্ন। গুইলার ন্যায়সঙ্গতভাবে বলেছে, তুমি মানুষের মনের প্রেমে পড়ে যাও। আমি তোমাকে হেনরির কাছে হারাতে যাচ্ছি।” গুইলার সত্যিই নিনকে হারিয়ে ছিল, প্রথমে মিলারের কাছে, পরে রুপার্ট পোলের কাছে, যদিও তারা বিবাহিত ছিল।

নিন এবং মিলারের সাহিত্যিক বন্ধুত্ব এবং যৌন সম্পর্ক একটা তীব্র রোম্যান্সে পরিণত হয়েছিল যা কয়েক দশক ধরে চলেছিল এবং এটি লক্ষণীয় যে নিন তার ডায়েরির বিশাল সংগ্রহে তাঁর যৌন জীবন বিশদে নথিভুক্ত করেছেন।  তাঁরা দুজনেই ধারাবাহিক, জেদপ্রিয় প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন। মিলার তাঁর উপন্যাসে যৌনতার বিস্তারিত প্যাসেজ লিখেছেন, আর নিন সেরা মহিলা ইরোটিকা লেখকদের একজন হিসাবে বিবেচিত হয়েছেন, নিঃসন্দেহে দুজনেই একে অপরের প্রতি তাদের আবেগপূর্ণ আসক্তি দ্বারা উৎসাহিত হয়েছেন। নিন মিলারের বইয়ের প্রথম মুদ্রণ থেকে শুরু করে প্রায় এক দশকের ভাড়ার কিস্তি পর্যন্ত সবকিছুর জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু তারপরে যখন মিলার তাঁর উপন্যাসগুলো থেকে প্রচুর রোজগার আর প্রশংসা পেতে আরম্ভ করলেন তখন তিনি নিনকে সমর্থন করা থেকে সরে যান যার ফলে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা ভেঙে যায়।

অ্যানাঈস নিনকে লেখা হেনরি মিলারের প্রেমপত্র ( নিনের স্বামীর অবর্তমানে তাঁর বাড়িতে কয়েকটা দিন অবিরাম যৌনসম্পর্ক কাটিয়ে আসার পর লেখা )–

 ১৪ আগস্ট ১৯৩২

অ্যানাঈস

আমাকে আর সুস্হমস্তিক বলে মনে কোরো না । নিজেদের আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে কোরো না । লোভেসিয়েঁতে যা ঘটেছিল তা বিবাহ — তুমি এর বিরোধিতা করতে পারো না । তোমার দেহের অংশ গায়ে এঁটে নিয়ে আমি ফিরে এলুম ; আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, সাঁতার কাটছি, রক্তের সমুদ্রে, তোমার আন্দালুশিয় রক্তে, চোলাই- করা আর বিষাক্ত। আমি যা কিছু বলছি আর ভাবছি তা ফিরে-ফিরে ওই বিবাহের কাছেই চলে যাচ্ছে । তোমার বাড়ির গৃহকর্তৃীর রূপে তোমাকে দেখলুম, ভারি মুখশ্রীর এক মুসলমাননি, শাদা ত্বকের এক নিগ্রোনারী, সারা গায়ে অজস্র চোখ, নারী, নারী, নারী । জানি না কেমন করে তোমার থেকে দূরে থাকবো, এই মাঝের সময়গুলো আমার মৃত্যু । হিউগো যখন বাড়ি ফিরে এলো তখন তোমার কেমন লেগেছিল ? তখনও কি আমি সেখানে ছিলুম ? আমি দেখতে পাচ্ছি ওর সঙ্গে সেভাবেই চলাফেরা করছ যেমন আমার সঙ্গে করেছ । পা একের সাথে আরেক । কমনীয় । মিষ্টি, বিশ্বাসঘাতী মৌনসন্মতি । পাখির সহজবশ্যতা । আমার সঙ্গে তুমি হয়ে উঠেছিলে নারী । আমি তার জন্য প্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলুম । তুমি কেবলমাত্র তিরিশ বছরের নও — তুমি হাজার বছরের ।

 আমি এখানে ফিরে এসেছি আর এখনও ধিকিয়ে-ধিকিয়ে আসক্তিতে জ্বলছি, ধোঁয়াওঠা মদের মতন । মাংসের আসক্তির জন্য তা কিন্তু নয়, তোমাকে পাবার সম্পূর্ণ ক্ষুধায়, গিলে ফেলার ক্ষুধায় । কাগজে আত্মহত্যা আর হত্যার সংবাদ পড়ি আর আমি তা ভালো করে বুঝতে পারি। আমি কাউকে হত্যা করার মতো বোধ করি, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা হয় । আমার মনে হয় চুপচাপ বসে থাকাটা অবমাননাকর, সময় কাটানো, দার্শনিক দিক দিয়ে ভাবলে, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া । সেই দিনকাল কোথায় গেলো যখন পুরুষরা একখানা দস্তানার জন্য, একটা চাউনির জন্য পরস্পর লড়তো, মেরে ফেলতো, মরে যেতো ? ( মাদাম প্রজাপতির সেই ভয়ংকর গানটা কেউ বাজাচ্ছে — “একদিন সে-পুরুষ আসবেই !”)

 আমি এখনও শুনতে পাচ্ছি তুমি রান্নাঘরে গান গাইছো — একধরণের সঙ্গতিহীন কিউবার গোঙানির রেশ । আমি জানি রান্নাঘরে তুমি আনন্দ পাও, আর যে খাবার রান্না করছ তা  দুজনে একসঙ্গে বসে খাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো খাবার। আমি জানি তুমি নিজেকে ছ্যাঁকা লাগিয়ে ফেলবে কিন্তু নালিশ করবে না। আমি সবচেয়ে বেশি শান্তি আর আনন্দ পাই তোমার খাবার ঘরে বসে যখন চলাফেরার দরুণ তোমার পোশাকের শব্দ শুনতে পাই, তোমার পোশাকে যেন ইন্দ্রের হাজার চোখের কারুকাজ করা ।

 অ্যানাইস, আমি এর আগেও তোমার কথা ভেবেছি, কিন্তু এখন আমার মধ্যে যা ঘটছে তা নিশ্চিত আর সেরকম নয় । ব্যাপারটা এই জন্যেই কি আহ্লাদের যে তা ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আর লুকিয়ে-চুরিয়ে করা ? আমরা দুজনে কি পরস্পরের জন্য অভিনয় করছিলুম, পরস্পরের প্রতি ? আমি কি কম আমি ছিলুম, নাকি বেশি আমি, আর তুমি কম না বেশি তুমি ? এটা কি মাথাখারাপের ব্যাপার যে বিশ্বাস করতে হবে এই ভাবেই চলবে ? কবে আর কোথায় একঘেয়ে মুহূর্তগুলো আরম্ভ হবে? আমি তোমায় লক্ষ করি সম্ভাব্য খুঁত বের করার জন্য, দুর্বল বিষয়ের জন্য, বিপজ্জনক এলাকার জন্য, আমি কিছুই খুঁজে পাই না — কিচ্ছু নয় । তার মানে আমি প্রেমে পড়ে গেছি, অন্ধ, অন্ধ । সারাজীবন অন্ধ থাকার ( এখন ওরা ‘হেভেন অ্যাণ্ড ওশান’ গাইছে লা জিওকোণ্ডা থেকে )।

 আমার চোখে ভাসছে তুমি গ্রামোফোন রেকর্ড বার বার বাজাচ্ছ — হিউগোর রেকর্ড, “পারলে মোই দ আমোর” । দুজন দুমুখো মানুষের বাঁচা, দুজন দুমুখো মানুষের স্বাদ, দুজন দুমুখো মানুষের আনন্দ ও কষ্ট । এর ফলে তুমি যে কেমনভাবে হলরেখায় কেটে যাচ্ছ আর চষে যাচ্ছ । আমি সবই জানি, কিন্তু তা বন্ধ করার জন্য করতে পারি না কিছুই। আমি সত্যিই চেয়েছি যে ওগুলো আমিই সহ্য করি । আমি জানি এখন তোমার দুই চোখ খোলা । কিছু ব্যাপারকে তুমি আর বিশ্বাস করতে পারবে না, বিশেষ অঙ্গভঙ্গী তুমি দ্বিতীয়বার আর করবে না, কিছু বিশেষ দুঃখ, ভুলবোঝাবুঝি তুমি আর দ্বিতীয়বার অনুভব করতে পারবে না। এক ধরণের ফাঁকা অপরাধী আলোড়ন তোমার কোমলতায় দেখা দেবে আর তার সাথে ক্রুরতা করবে। পশ্চাত্তাপ নয়, প্রতিশোধ নয়, দুঃখ নয়, গ্লানি নয় । একটা বেঁচে নেবার উপায় যা তোমায় অতল থেকে টেনে তুলবে না, কিন্তু এক উচ্চতর আশা, এক বিশ্বাস, এক আনন্দ, যার স্বাদ তুমি পেয়েছ, তা ইচ্ছে করলেই আবার পেতে পারো ।

 সারা সকাল আমি আমার নোটগুলো নিয়ে বসেছিলুম, আমার জীবনের তথ্যগুলো ঝালাই করছিলুম, ভেবে পাচ্ছিলুম না কোথা থেকে শুরু করি, কেমন করে আরম্ভ করি, আমার সামনে কেবল একটা বই দেখতে পাবার জন্যই কেবল নয়, বরং বইয়ের জীবনসমগ্র চাই । কিন্তু আমি আরম্ভ করতে পারছি না । দেয়ালগুলো একেবারে ফাঁকা — তোমার সাথে দেখা করতে যাবার আগে আমি সবই নামিয়ে নিয়েছিলুম ।  যেন আমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাবার জন্য তৈরি ছিলুম । দেয়ালের দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে — যেখানে আমরা দুজনে মাথা রেখেছিলুম । বাইরে যখন বাজ পড়ছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আমি বিছানায় শুয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি । আমরা রয়েছি সেভাইল-এ আর তারপর ফেজ-এ আর তারপর কাপ্রিতে আর তারপর হাভানায় । আমরা অবিরাম বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু রয়েছে টাইপরাইটার আর বই, আর তোমার শরীর সবসময় আমার পাশে আর তোমার চোখের দৃষ্টি কখনও বদলাচ্ছে না । লোকে বলাবলি করছে যে আমরা দুর্দশায় আক্রান্ত হবো, আমরা পরে পশ্চাত্তাপ করবো, কিন্তু আমরা খুশি, আমরা হাসাহাসি করছি, আমরা গান গাইছি । আমরা স্প্যানিশ আর ফরাসি আর আরবিয় আর তুর্কি ভাষায় কথা বলছি । আমাদের প্রবেশ সর্বত্র অবাধ আর আমাদের চলার পথে ফুল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে ।

 আমি বলছি এ এক অদ্ভুত স্বপ্ন — কিন্তু এই স্বপ্নকে আমি বাস্তবে পেতে চাই । জীবন ও সাহিত্য একযোগে, বিদ্যুৎপ্রবাহ উৎপাদন যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা, তুমি তোমার রঙবদলানো গিরগিটির আত্মা নিয়ে আমাকে দিচ্ছ হাজার ভালোবাসা, সবসময়ে নোঙরে বাঁধা, তা যেকোনো রকমের ঝড়জলই হোক বা বাড়িতে বা যেখানে আমরা দুজনে থাকবো । সকালবেলায়, যেখানে আমরা শেষ করেছিলুম, সেখান থেকে আবার শুরু করবো । পুণর্জন্মের পর পুণর্জন্ম । তুমি দৃঢ়ভাবে নিজেকে জাহির করছ, জীবনের বৈভবশালী  বৈভিন্ন্য তোমার চাই, আর যতো তুমি নিজেকে জাহির করো ততো তুমি আমাকে চাও, আমার প্রয়োজন বোধ করো । তোমার কন্ঠস্বর ভেঙে পড়ে, গভীর হয়ে ওঠে, চোখ আরও কালো, তোমার রক্ত আরও ঘন, তোমার দেহ আরও সুঠাম । এক ইন্দ্রিয়সুখী আজ্ঞা আর পীড়নশীল প্রয়োজনীয়তা । আগের থেকে বেশি নিষ্ঠুর — সচেতনভাবে, ইচ্ছাকৃত নিষ্ঠুরতা । অভিজ্ঞতার তৃপ্তিহীন আহ্লাদ ।

 ২৩  মে, ১৯৩৩ সালে আনাঈস নিন এই চিঠিটি  হেনরি মিলারকে লিখেছিলেন:

হেনরি, জুন যখন বলেছিল তুমি সম্পূর্ণ স্বার্থপর, আমি এটা বিশ্বাস করিনি। আজ তুমি আমাকে গভীরভাবে হতবাক করেছ। আমি সর্বদা জানতাম যে আমি তোমাকে যা দিতে পারি তার জন্য তুমি আমাকে ভালোবাসো আর আমি তা বুঝতে এবং গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কারণ তুমি একজন শিল্পী । আমি  কখনই আশা করিনি যে তুমি সারাজীবন মানুষ হয়ে থাকবে, এমনকি সপ্তাহে সাত দিনও। সপ্তাহে একদিন, বা দশদিন পর একদিন এতটা কঠিন মনে হয়নি।  তুমি আমাকে ছেড়ে যে সোমবার চলে গেলে সেদিন গুইলার ফিরে এসেছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে যা ঘটেছিল তা নিয়ে তুমি একেবারে পরোয়া করো না। তুমি অবিলম্বে সব ভুলে যেতে চাও। তুমি আমাকে লিখেছিলে: “আমি খুব অসহায় বোধ করছি”। আমি সে সব কিছু মনে করিনি। তুমি আমার সব কিছু থেকে মুক্ত, তোমাকে মুক্ত করার ইচ্ছা মেনে নিয়েছ। তুমি জানো আমি এটা বোঝাতে চেয়েছিলাম. কিন্তু যত তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছি, তুমি তোমার আত্মমগ্ন জীবনে ফিরে গেলে। আর আমি এটা জানতাম। শুক্রবার আমি নিজেকে বললাম: ‘আমি হেনরিকে আসতে দেব না। ও আমাকে স্বার্থপরের মতন ভালবাসে, শুধুমাত্র নিজের আনন্দের জিনিস জন্য। সে সত্যিই আমাকে পাত্তা দেয় না। আর আজ তুমি এটা প্রমাণ করেছ। তুমি ভাল, সুস্থ, চিন্তামুক্ত থাকতে চাও. তুমি আমার জীবনকে পাত্তা দিলে না। তুমি আমাকে দশদিন  দেখে ঠান্ডা হয়ে গেছো। তুমি আমাকে আদরও করোনি। তুমি সৌম্য হতে ঘরের ভেতরে আসোনি, তোমার নির্মমতার প্রমাণ। সত্য হল তুমি ক্লিচিতে সম্পূর্ণ সুখী, একা। আমি দেখব যে তোমার নিরাপত্তা, তোমার স্বাধীনতা যেন অব্যাহত থাকে । কিন্তু  হেনরি,  বাকি সব মৃত। তুমি এটা মেরে ফেললে।

আনাঈস

ডায়রিতে নিন লিখেছিলেন, “কাল রাতে আমি কেঁদেছিলাম। আমি কেঁদেছিলাম কারণ যে প্রক্রিয়ায় আমি নারী হয়েছি তা বেদনাদায়ক ছিল। আমি কেঁদেছিলাম কারণ আমি আর  অন্ধ বিশ্বাসের শিশু ছিলাম না। আমি কেঁদেছিলাম কারণ আমার চোখ বাস্তবে উন্মুক্ত হয়েছিল – হেনরির স্বার্থপরতা, জুনের ক্ষমতার প্রতি ভালবাসা, আমার অতৃপ্ত সৃজনশীলতা  নিজের জন্য অপর্যাপ্ত হতে পারে না।

ফ্রান্সে বসেই ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’ বইটি চার বছর ধরে লিখেছিলেন মিলার কিন্তু সেখানেও  বইটির প্রকাশক পাওয়া সহজ ছিল না, তার প্রধান কারণ সেখানকার সাহিত্যিক মহলে বুদ্ধিজীবি হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পারছিলেন না প্রায়-ভিকিরি ভবঘুরে চালচুলোহীন চল্লিশবছরের মাগিবাজ হেনরি মিলার, যিনি ১৯৩০ সালে লেখা আরম্ভ করে বইটি শেষ করেন ১৯৩৪ সালে । বইটির জন্যে আর্থিক সাহায্য করেন মিলারের যৌনসঙ্গিনী লেখিকা অ্যানাইস নিন, তাঁর আরেক প্রেমিক মনোচিকিৎসক অটো র‌্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, তারপরই বইটি প্রকাশ করতে রাজি হয় ওবেলিস্ক প্রেসের মালিক জ্যাক কাহানে । ছাপতে দেবার আগে বইটির পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেছিলেন অ্যানাইস নিন, ভূমিকাও তিনি লিখে দিয়েছিলেন ।

১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মের শেষের দিকে, যখন  যুদ্ধের কারণে বিদেশি বাসিন্দাদের  ফ্রান্স ছেড়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, নিন প্যারিস ত্যাগ করেন এবং তাঁর স্বামী গুইলারের সাথে নিউইয়র্ক সিটিতে ফিরে যান । 

প্রথম বিয়ে বজায় থাকতেই নিন তাঁর চেয়ে বয়সে ছোটো রুপার্ট পোল নামে সৌম্যকান্তি এক যুবককে বিয়ে করেন । পোল ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার একজন সুদর্শন, ফরেস্ট রেঞ্জার। কিছু আবেগপূর্ণ রাত একসাথে থাকার পর, নিন গুইলারের জন্য একটি গল্প তৈরি করে ফেলেছিলেন — গুইলারকে তিনি ইতিমধ্যেই “ট্রপিক অফ ক্যান্সার” লেখক হেনরি মিলারের সাথে যৌনজীবন কাটিয়ে প্রতারণা করেছিলেন । পোল, যিনি ভেবেছিলেন যে নিন তাঁর প্রথম স্বামী হিউ পার্কার গুইলারকে তালাক দিয়েছেন, নিনকে তার সাথে পশ্চিম উপকূলে যেতে বলেছিলেন। নিন তা করতে রাজি হন, কিন্তু গুইলারকে বলেছিলেন যে তিনি লাস ভেগাস ড্রাইভে এক বন্ধুর কাছে যাচ্ছেন।

নিন এবং পোল ১৭ মার্চ, ১৯৫৫ সালে অ্যারিজোনার কোয়ার্টজ সাইটের জাস্টিস অফ পিসের অফিসে বিয়ে করেছিলেন। নিন এগারো বছর ধরে গুইলারের সাথে তাঁর বিয়েকে পোলের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন।এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, আনাঈস নিন দ্বৈত জীবন যাপন করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক উপকূলে দুটি ভিন্ন পুরুষের সাথে যৌনজীবন-রহস্যের মহানন্দে। একজন স্বামী ছিলেন নিউ ইয়র্ক সিটির  ধনী চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ব্যাংকার, যিনি নিনকে বিলাসবহুল একটি সর্বজনীন জীবনধারা দিয়েছিলেন। অন্য স্বামী ছিলেন নিনের চেয়ে কুড়ি বছরের ছোটো সুদর্শন ফরেস্ট রেঞ্জার, যার সাথে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা মাদ্রেতে  পাহাড়ের পাশের কেবিনে আবেগপূর্ণ জীবন কাটাতেন। পোল আর নিন সিয়েরা মাদ্রেতে একটা কেবিনে মার্কিন গ্রামীণ জীবনযাপন করতেন, যেখানে নিন নিজেকে মিসেস আনাঈস পোল হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন যদিও তিনি তখনও গুইলারের সাথে বিবাহিত।

দুজনের কেউই অন্য স্বামীর কথা জানতেন না। নিন তাঁর সময়কে তাদের মধ্যে ভাগ করে, ছয় সপ্তাহের জন্য পিছনে উড়ে এক দিকে আবার ছয় সপ্তাহের জন্য অন্য দিকে উড়ে যেতেন। তিনি এই ভারসাম্যমূলক কাজটিকে তাঁর ‘ট্র্যাপিজ উড়াল’ বলে অভিহিত করেছেন — দুই শহর এবং দুই পুরুষের মধ্যে  অবিরাম দোল-খাওয়া। নিন একসঙ্গে দুটি অভিজ্ঞতার জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। আমেরিকার পূর্ব উপকূলে একটি পরিশীলিত শহুরে জীবন এবং পশ্চিমে একটি রোমান্টিক  জীবন। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ছিল বিশেষ করে তিনি একজন মহিলা আর সময়টা এমন  যখন বহুবিবাহ এবং ‘খোলা সম্পর্ক’ সমাজের অনুমোদন পেতো না। মহিলাদের জীবন মানেই ছিল বিয়ে,  মাতৃত্ব আর সংসার করা। তার বিরুদ্ধে অ্যানাঈস  নিন  নিজের শর্তে জীবনযাপন করেছেন।  কিন্তু দুজন পুরুষ একইসঙ্গে তাঁকে ট্যাক্সের খাতিরে নির্ভরশীল বলে দাবি করায় আইনি গণ্ডোগোল এড়াতে ১৯৬৬ সালে অ্যানাঈস নিনকে পোলের সাথে বিবাহ বাতিলের ব্যবস্থা করতে হয় । কাগজে-কলমে বিয়ে বাতিল হলেও পোলকে ছাড়েননি  নিন । যদিও বিয়ে বাতিল করা হয়েছিল, নিন এবং পোল ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একসাথে বসবাস করতেন, যেন তাঁরা বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী । বারবারা ক্রাফটের মতে, তাঁর মৃত্যুর আগে অ্যানাঈস হিউ গুইলারকে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। 

প্রথম স্বামীর দৌলতে অ্যানাঈস নিনের পার্সে প্রচুর টাকাকড়ি আর চেকবুকের দুটো সেট থাকতো।  নিউইয়র্কের জন্য আনাইস গুইলার আর লস অ্যাঞ্জেলেসের জন্য আনাইস পোল নামে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ডাক্তার এবং নিউইয়র্কের ডাক্তারদের কাছ থেকে দুটি ভিন্ন নামের প্রেসক্রিপশন নিতেন ।  নিন  আর্থিক সহায়তার জন্য আইনত গুইলারের সাথে বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর শেষ বছরগুলি পোলের সাথে কাটিয়েছেন। তিনি এবং পোল লস এঞ্জেলেসের সিলভার লেকের আশেপাশে একটি ছোট বাড়িতে থাকতেন যেটি পোল তাঁর ফরেস্ট রেঞ্জার এবং পরে লস অ্যাঞ্জেলেসের থমাস স্টার কিং জুনিয়র হাই স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে  চাকরি থেকে বাঁচানো অর্থ দিয়ে তৈরি করেছিলেন। 

নিনের সার্ভিকাল ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে ১৯৭৪ সালে।তিনি কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করেন কারণ রোগটা মেটাস্ট্যাসাইজ হয়েছিল, এবং অসংখ্য অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বিকিরণ এবং কেমোথেরাপি করা হয়েছিল। নিন ক্যান্সারে মারা যান সিডারস-সিনাই মেডিকেল সেন্টারে , ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৪ জানুয়ারী, ১৯৭৭ সালে। নিনের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহ দাহ করা হয়, আর ছাই ছড়িয়ে দেয়া হয় সান্তা মনিকা বে মারমেইড খাঁড়িতে।

১৯৭৭ সালে নিনের মৃত্যু হলে, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এ তাঁর মৃত্যুতে পোলকে তাঁর স্বামী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস গুইলারকে তাঁর স্বামী হিসাবে উল্লেখ করেছিল।

অ্যানাঈস নিনের সাহিত্য নির্বাহক হিসাবে, পোল ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রকাশনার  নতুন মরণোত্তর সংস্করণের প্রস্তুতির তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে গুইলারের মৃত্যুতে, পোল সান্তা মনিকার উপকূলের একটি খাঁড়িতে, যেখানে নিনের ছাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেখানেই গুইলারের ছাই  ছাই ছড়িয়ে দেন।

Posted in Uncategorized | Tagged , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

উৎকোচ-নীতি-নৈতিকতা-দুর্নীতি  : মলয় রায়চৌধুরী

এক

আমি : আরে মুর্শিদ, হাওয়া৪৯-এর সম্পাদক, বলেছেন উৎকোচ-নীতি-নৈতিকতা-দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে একটা লেখা দিতে ।

বন্ধুনি : দিয়ে দিন । সিঙ্গাপুরে দুর্নীতি নেই বললেই চলে । কেন ? কারণ দুর্নীতির প্রমাণ পেলেই তার পোঁদে বাঁশ করে দেয়া হয়, তা লোকটা যতো বড়োই হোক না কেন । সিঙ্গাপুরের তুলনায় ভারতবর্ষে, বাঁশ প্রচুর হয়, কিন্তু কারোর পোঁদে বাঁশ করা হয়েছে বলে তো শুনিনি । চীনও অমন ব্যবস্হা নিচ্ছে । চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উনিশতম কংগ্রেসে  প্রেসিডেন্ট ও পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং দুর্নীতির বাঘ, মাছি ও শিয়ালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার   কথা বলেছেন। দুর্নীতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড়া না দেওয়ার ঘোষণা করে উনি বলেছেন, ‘আমরা নামকাওয়াস্তে আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, আত্মপরতা, বিলাসিতা ও সুবিধালাভের চেষ্টার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। কোথাও কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা দেখানো হচ্ছে না। বাঘ, মাছি, শিয়াল—সবার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ ওদের দেশে তো গুলি করে মারা হচ্ছে । 

আমি : যতো দিন যাচ্ছে আমাদের দেশে দুর্নীতি ততো বাড়ছে । 

বন্ধুনি : দুর্নীতি মাপবার একটা সূচক আছে, জানেন নিশ্চয়ই : যাকে বলে সিপিআই।  এমন একটা সূচক যা বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন আর মতামত সমীক্ষা করে  সরকারী ক্ষেত্রে দুর্নীতির ধারণা স্তর অনুসারে  দেশগুলোকে নম্বর দেয়৷ সিপিআই সাধারণত দুর্নীতি মানে, “ব্যক্তিগত লাভের জন্য  ক্ষমতার অপব্যবহার” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল  প্রতি বছর এই সূচক প্রকাশ করে । ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের সিপিআই, সেই অনুযায়ী ১০০ বা খুব স্বচ্ছ থেকে ০ অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত” স্কেলে ১৮০টি দেশকে র‍্যাঙ্ক করা হয়েছে । ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আর সুইডেন বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, তারা ক্রমাগতভাবে উচ্চ র‍্যাঙ্কিং করে। আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলি হল সিরিয়া, সোমালিয়া আর দক্ষিণ সুদান, ২০২১ সালে এদের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ছিল যথাক্রমে ১৩, ১১ আর ১১। ভারতের তলার দিকেই, ৭৮ নম্বরে ।

আমি : ভালো বলেছিস । কতো রকমের দূর্নীতি আর তার সঙ্গে যুক্ত মানুষ আছে, জানলে অবাক হবার বদলে ভয় করে : চোরচোট্টা গাঁটকাটা বাটপাড় ঘুষখোর কালোবাজারি দালাল সাট্টাবাজ কারচুপিকারী প্রতারক মালপাচারি ,  কাটমানি, কালোবাজার, কালোটাকা, ঘুষ, নজরানা, উৎকোচ, হাওয়ালা, স্মাগলিঙ, গরু পাচার, কয়লা পাচার, মেয়ে পাচার, গণধর্ষণ, ডাকাতি, খুন, তহবিল তছরূপ, ভর্তি কেলেঙ্কারি, নারদা, সারদা,  কর্পোরেট কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, নোটনকল, রোজভ্যালি, চাকরি বিক্রি, দলিল কারচুপি, জিপ কেলেঙ্কারি, এলআইসি কেলেঙ্কারি, বেনামি সম্পত্তি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, এইচডিডব্লিউ সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জেএমএম ঘুষ কেলেঙ্কারি, তানসি ল্যান্ড ডিল কেলেঙ্কারি, বিটুমেন কেলেঙ্কারি, ইউরিয়া কেলেঙ্কারি, লটারি কেলেঙ্কারি, অনন্তনাগ পরিবহন সাবসিডি কেলেঙ্কারি, তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নির্বাচনে টিকিট বিক্রি, জোচ্চুরি, কাজের বরাত, নদীতটের বালি বিক্রি,  পনজিস্কিম কেলেঙ্কারি, চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, ফাটকা জোচ্চুরি,  কালোটাকা সাদা করা, সাংবাদিক হত্যা, শেল কোম্পানি, সত্যম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি, মাদক পাচার, জাল ওষুধ বিক্রি, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, আদর্শ হাউসিঙ কেলেঙ্কারি, কার্টেল, সুইসব্যাঙ্কে লুকোনো টাকা, নীরব মোদি জালিয়াতি, ক্রিকেটে গড়াপেটা, ললিত মোদির ক্রিকেট কেলেঙ্কারি, বিজয় মাল্য আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিষমদ কাণ্ড, আসল বোতলে নকল ব্ল্যাক লেবেল-শিভাস রিগাল, বেআইনি লেনদেন, এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন-রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কেলেঙ্কারি, ন্যাশানাল হেরাল্ড কেলেঙ্কারি , আলি বুদেশ, আনিশ ইব্রাহিম, দাউদ ইব্রাহিম, হাসান আলি খান, আবদুল লতিফ, হাজি মস্তান, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন, ভরদারাজন মুদালিয়ার, ছোটা রাজন, ছোটা শাকিল, বক্সার ভাদিভেলু, বীরপ্পন, হেরোইন, আফিম, কোকেন, গুণ্ডা, মস্তান, অমিত ভরদ্বাজ, মেহুল চোকশি, সয়েফ দরবার, রাজকিশোর দত্ত, রজত গুপ্ত, হরশদ মেহতা, নটওয়রলাল, শিবাজী পাঁজা, রামালিঙ্গা রাজু, জি জনার্দন রেড্ডি, আবদুল করিম তেলগি, মুখতার আনসারি, ঠগ বেহরাম, লরেন্স বিশনোই, দিলীপ বুয়া, রঞ্জিত চিমা, মায়া ডোলাস, কোলি ফয়াজ, ভিকি গোস্বামী, সান্তোখবেন জাদেজা, এম পি জয়রাজ, বিনদি জোহাল, এজাজ লাকড়াওয়ালা, করিম লালা, ভুরা মুঞ্জা, নায়িম, রবি পুজারী, মুথাপ্পা রায়, ছোটা রাজন, গোপাল রাজওয়ানি, কোতওয়াল রামচন্দ্র, আবু সালেম, অগ্নি শ্রীধর, শ্রীপ্রকাশ শুক্লা, মানয়া সুরভে, হরিশংকর তিওয়ারি, আক্কু যাদব, ডি পি যাদব, মায়া ডোলাস, আনন্দপাল সিং, নির্ভয় গুজ্জরম মণীন্দ্রপাল সিং, জালিয়াৎ, অপহরণকারী, চন্দ্রমোহন শর্মা, ধন্না সিং,এম জয়শংকর, রিপার জয়নন্দন, চন্দ্রকান্ত ঝা, মোহন কুমার, রভিন্দর কুমার, মোট্টা নাভাস, সন্তোষ পোল, রমণ রাঘব, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দেবেন্দ্র শর্মা, দরবারা সিং,আশারাম, ফলাহারিবাবা, এম জয়শংকর, মনিন্দরপাল সিং কোহলি, বিট্টি মোহান্তি, সুনীল রস্তোগি, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দরবরা সিং, তাঁতিয়া ভীল, ফুলন দেবী, কোলি ফয়াজ, ইথিক্কারা পাক্কি, জম্বুলিঙ্গম নাদার, জগ্গা জাট, সীমা পরিহার, শিবকুমার প্যাটেল, কোতওয়াল রামচন্দ্র, দেবেন্দ্র শর্মা, মান সিং, পানসিং তোমার, কিরণজিত সিং আহলুওয়ালিয়া, নভজ্যোত সিং সিধু, হংসরাজ গঙ্গারাম আহির, প্রেমচন্দ গুপ্তা, এস জগতরকশাকন, শ্রীপ্রকাশ জায়সওয়াল, নবীন জিন্দল, মধু কোডা, দাসারি নারায়াণা রাও, সুবোধকান্ত সহায়, রাডিয়া টেপ, অজয় সিং চৌতালা, পুরুষোত্তম নরেশ দ্বিবেদী, পাপ্পু কালানি, রামনিবাস গোয়েল, বালমুকুন্দ গৌতম, মায়া কোডনানি, সজ্জনকুমার, বীর সিং মাহতো, বিক্রম সিং মাজিথিয়া, রশিদ মাসুদ, জগন্নাথ মিশ্রা, ভুরা মুঞ্জা, নীললোহিতাদাসন নাদার, ফ্রানসিসকো পাচেকো, রাজু পাল, আর বালকৃষ্ণ পিল্লাই, মনোজ প্রধান, প্রবোধ পুরকাইত, গোপাল রাজওয়ানি, সাহি রাম, সুখ রাম, সুরেশ রাণা, ভি কে শশীকলা, টি এম সেলভাগণপতি, মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন, জগদীশ শর্মা, রাধারমণ শাস্ত্রী, বিজয়কুমার শুক্লা, তাহির হুসেন সিদ্দিক, অক্ষয়প্রতাপ সিং, আনন্দমোহন সিং, অনন্তকুমার সিং, প্রভূনাথ সিং, সঞ্জীব সিং, সুরজভান সিং, মোহম্মদ সুর্তি, প্রেম খাণ্ডু থুঙ্গন, শেখর তিওয়ারি, সান্দ্রা ভেঙ্কটা ভিরাইয়া, আনন্দসেন যাদব, মহেন্দ্র যাদব, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বিক্রি, জুলুমবাজি, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, সুপারি কিলিঙ, শিশু চুরি, অবৈধ গর্ভপাত, ছিনতাই, এনকাউন্টার, মিত্রোখিন পেপার্স, হিংসা, হপ্তাউসুলি, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, প্রোটেকশান মানি এটসেটরা ।

বন্ধুনি : বাপ্রে ! দেশটা এতো গণ্ডোগোল সামলায় কেমন করে ! এ তো রসাতল ! রসাতল ! দুর্নীতি শব্দটা যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার হয় তখন সাংস্কৃতিক অর্থে “সমূলে বিনষ্ট হওয়াকে” নির্দেশ করে। আমরা সত্যিই এগিয়ে চলেছি সেই পথে ।

আমি : স্বাধীন ভারতে ঘুষ খাবার আদি পর্বটা কিন্তু কৃষ্ণ মেনন শুরু করেছিল, নেহেরুর পেয়ারের লোক । ১৯৪৭-৪৮ সালে, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান দখল করতে চাইছে কাশ্মীর, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারতের আরও কিছু জিপ গাড়ির দরকার ছিল। তখন ব্রিটেনের ভারতীয় হাইকমিশনার ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পুরোনো মেরামত করা ২০০০ জিপ কেনার জন্য  অর্ডার দেন ৷ ওই পুরনো  জীপ কিনতে যে দাম দেওয়া হচ্ছিল সেই  দামেই নতুন জীপ কেনা যেত আমেরিকা বা কানাডা থেকে । নাম না-জানা  যে অ্যান্টি-মিস্টান্টেসকে জিপগুলো সরবরাহ করার জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার মূলধন ছিল মাত্র ৬০৫ পাউন্ড। কৃষ্ণমেনন এজন্য ১৭২০০০ ডলার দিতে রাজি হন ।তার মধ্যে মোট পেমেন্টের ৬৫% কোনো পরিদর্শন শংসাপত্র ছাড়াই দেওয়া হয় আর ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০% । বাদবাকি টাকা ডেলিভারী হওয়ার এক মাস পরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কোম্পানিটি অবশ্য দুই বছরে মাত্র ৫৯টি জিপ সরবরাহ করে  সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে।ব্রিটেন কর্তৃক জিপগুলির অর্থ প্রদান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতকে ব্রিটিশ যুদ্ধ ঋণের অংশ হিসেবে ।  মেনন এই চুক্তিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। মেনন প্রোটোকল এড়িয়ে একটি ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । যদিও বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল , মাত্র ১৫৫টা জিপ ডেলিভারি করা হয়েছিল ; যদিও প্রটোকল অনুসারে মেননকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে বলা হয়, তবে নেহেরু সরকারকে জিপগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । এদিকে চুক্তির তথ্য ভারতে পৌঁছলে এখানকার সংসদ সহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ।

বন্ধুনি : আপনি মিত্রোখিন পেপার্সের খবর পড়েছেন ? ইনডিয়াকে আমাদের চেয়ে বিদেশিরা বেশি বুঝেছে। সোভিয়েত আমলের গুপ্তচর মিত্রোখিন যেসব কাগজপত্র রেখে গেছে তাতে দাবি করেছে যে কৃষ্ণমেননের ১৯৬২ আর ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে ওরা প্রচুর টাকা দিয়েছিল ওনাকে জেতাবার জনয় । কৃষ্ণমেনন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানের বদলে তাই সোভিয়েত মিগ কিনেছিলেন

আমি : জানি, জানিমেনন দুজন মেমের প্রেমে পড়িছিলেন । ওনার জিপ কেনার কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল আয়ঙ্গার সাব-কমিটি আর ১৯৫১ সালের ৯ই এপ্রিল নেহরুর কাছে পেশ করা রিপোর্টে গোলমালের তথ্যগুলো ছিল। তদন্ত হয়েছিল ; সেসব ধামাচাপা পড়ে যায়  পরে, মেননকে কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মেনন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিশ্বস্ত বন্ধু হন। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব , ইউ ভি কল্যাণম , এক সংবাদপত্রের সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে নেহরু, কৃষ্ণমেননের মতো দুর্নীতিবাজ সহকর্মী তৈরি করেছিলেন, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন কুখ্যাত ‘ জীপ কেলেঙ্কারি ‘তে জড়িয়ে পড়েন৷ 

বন্ধুনি : মিত্রোখিন লিখেছে  যে জোসেফ স্টালিন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সম্পর্কে ভালো মতামত দেননি । স্ট্যালিন মনে করতেন  নেহেরু আর মহাত্মা গান্ধী দুজনে “সাম্রাজ্যবাদী পুতুল” , যারা ব্রিটিশদের সামনে মাথা নত করেছিল আর তাদের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ব্রিটিশদের ভারতে তাদের দখল শক্ত করতে সাহায্য করেছিল। মিত্রোখিন আরও লিখেছে যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিনিময়ে দুকোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল আর সোভিয়েত গুপ্তচরদের অবাক করে দিয়ে, তিনি যে ব্যাগটিতে টাকা পেয়েছিলেন তাও ফেরত দেননি।

আমি : তার আগের ব্যাপারটা জানিস ? ১৬ ই আগস্ট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগের সভা। বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে সেদিন সভায় উপস্থিত ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসলমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিল হোসেন সোহরাওয়ার্দী‚ খাজা নাজিমুদ্দিন‚ ইস্পাহানি ও মুসলিম লিগপন্থী দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়‚ “সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম‚যা করতে পারিস কর। সভা শেষ হতেই উপস্থিত মুসলমান জনতা প্রথমে আক্রমণ করে সভা দেখতে আসা হিন্দু জনতাদের। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ – হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন জখম‚ ধর্ষণ। ক্যানিং স্ট্রিট‚ ওয়েলেসলি স্ট্রিট‚ ধর্মতলা স্ট্রিট‚ কর্পোরেশন স্ট্রিট‚ মানিকতলা রোড আর বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। লুট হয় কমলালয় স্টোর্স‚ ভারতকলা ভান্ডার‚ লক্ষ্মী স্টোর্সের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো। আক্রান্ত হয় উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দু পাড়াগুলি। গড়পাড়‚ নারকেলডাঙা‚ বেলেঘাটা‚ ফুলবাগান‚ পার্ক সার্কাস‚ কলুটোলা‚ চিৎপুর জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়ায় ‘মুসলিম লিডার’-রা। আর শুধু সাধারণ মানুষই না‚ তাদের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েননি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস‚ গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী‚ রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক‚ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এস.মুখার্জির মতো বিশিষ্ট বাঙ্গালিরাও। আক্ষরিক অর্থেই যেন একখণ্ড নরক নেমে আসে কলকাতার বুকে। নিহত হয় অসংখ্য হিন্দু‚ ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছিলো অগুনতি। হিন্দুদের উপর বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ রাস্তার পাশে ধর্ষিতা মৃত মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করে লিগের গুন্ডারা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিল তারা।  হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য। আর শুধু বাঙ্গালিই নয়‚ হিন্দু হলেই আর ছাড় ছিল না কারও। মেটিয়াবুরুজে উড়িয়া শ্রমিকদের বস্তিতে চলে আক্রমণ। কম করে ৫০০ জন উড়িয়া শ্রমিককে সেখানে হত্যা করা হয়েছিলো। অসহায় শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন হুগলি নদীর জল।

বন্ধুনি : ঠিক বলেছেন । সেই থেকে কলকাতা হয়ে গেছে হত্যার শহর ।

আমি : দেশভাগ ! ওফ ভাবা যায় না । 

বন্ধুনি : আপনি পড়েননি  বোধহয়, ‘ফ্রম প্ল্যাসি টু পাকিস্তান’-বইতে হুমায়ূন মির্জা লিখছেন, “পাকিস্তানের এক সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জা, যিনি পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন, তিনি মি. জিন্নাহকে বলেছিলেন, যে মুসিলম লীগ পাকিস্তান দিল, সেই দলটাকে যেন অবহেলা করা না হয়।”  সঙ্গে সঙ্গে মি. জিন্নাহ পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, “কে বলল মুসলিম লীগ আমাদের পাকিস্তান দিয়েছে? আমি পাকিস্তান বানিয়েছি, আমার স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে।”

আমি : আরে কী যে বলিস, সেই কবে পড়েছি,  খালিদ লতিফ গৌবা এক জায়গায় লিখেছিলেন যে তিনি মি. জিন্নাহকে কোনও একটা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। “আমি জানি না কীভাবে নামাজ পড়তে হয়,” জবাব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। মি. গৌবা বলেছিলেন, “মসজিদে অন্যরা যা করবে, আপনিও তাদের দেখাদেখি সেটাই না হয় করবেন।”

বন্ধুনি : আপনি এটা জানেন  ? মি. জিন্নাহর সহকারী ছিলেন মুহাম্মদ করিম চাগলা, যিনি পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন।তিনি আত্মজীবনী ‘রোজেস ইন ডিসেম্বর’-এ লিখেছেন, “একবার আমি আর মি. জিন্নাহ ঠিক করেছিলাম বোম্বের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘কর্ণগ্লিয়াজ’-এ খেতে যাব। উনি দু কাপ কফি, পেস্ট্রি আর শুয়োরের মাংসের সসেজ অর্ডার করলেন। আমরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা মুসলমান ব্যক্তি ওখানে হাজির হলেন, তাঁর সঙ্গে একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে।” “ওঁরা মি. জিন্নাহর বেশ কাছাকাছি বসেছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওই বাচ্চা ছেলেটি মি. জিন্নাহর সামনে রাখা সসেজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে আর তারপরেই ছোট একটা টুকরো তুলে নিজের মুখে পুরে দিল। আমি এই বাচ্চাটার কাণ্ড দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।” একটু পরে ওঁরা চলে গেলেন। তখন মি. জিন্নাহ আমার ওপরে বেশ রেগে গিয়ে বললেন, “চাগলা, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। ওই বাচ্চা ছেলেটাকে শুয়োরের মাংসের সসেজ খেতে দিলে তুমি?”

আমি : বুঝলি, ইনডিয়াকে ডিফাইন করে কেলেঙ্কারিগুলো । তোমরা স্বীকার করো বা না করো । স্বাধীন ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল ১৯৫৭  সালে । এখনকার কেলেঙ্কারিগুলোর তুলনায় মামুলি, কিন্তু সেসময়ে, সবে সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলতে আরম্ভ করেছে, কেলেঙ্কারিটা ছিল বোমা ফাটার মতন । অর্থমন্ত্রী, টি টি কৃষ্ণমাচারীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। জানা যায় যে, ১৯৫৭ সালের জুন মাসে পাবলিক সেক্টর লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) কলকাতা-ভিত্তিক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্ধ্রার মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানিতে ১.২৪ কোটি  টাকা মূল্যের জালি স্টক কিনেছিল। . এলআইসির তখন পর্যন্ত ইতিহাসে বিনিয়োগটি সবচেয়ে বড় ছিল, কিন্তু নিয়মানুযায়ী তার বিনিয়োগ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। ব্যবসায়িক সাংবাদিক সুচেতা দালাল তার শিল্পপতি এ.ডি. শ্রফের জীবনীতে লিখেছেন, “প্রচুর প্রমাণ ছিল,” যে মিঃ মুন্ধরা “কোম্পানিগুলোকে রক্তাক্ত করছিলেন আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন, একই সাথে বাজারে  ফাটকা খেলে দাম বাড়াচ্ছিলেন।”

বন্ধুনি : আপনিও জানেন কি না জানি না, নেহেরু যুগে, কংগ্রেস প্রায়ই শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করত, যা কখনও কখনও দল আর সরকারকে সমস্যায় ফেলেছিল। যেমন, যখন মুন্ধরা, একজন শিল্পপতি যিনি ১৯৫০ এর দশকে পার্টিকে অর্থায়ন করেছিলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন তিনি সরকারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এটি ফেরত দেওয়ার সময়। নেহেরু বাধ্য হয়ে এলআইসিকে তার কোম্পানির শেয়ার স্ফীত দামে কেনার নির্দেশ দেন। অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারী, যিনি স্পষ্টতই উপর থেকে নির্দেশে কাজ করছিলেন, সত্য বেরিয়ে এলে চাকরি হারান।

আমি : সবচেয়ে আগে জওয়াহারলাল নেহেরুর প্রেমের কথা বল ! ওই মোটা লোকটা একজন যুবতীর প্রেমে পড়ে নানা গোলমাল করেছে বলে লোকেরা চেল্লাচ্ছে । নেহেরুর প্রেম নিয়ে সেসময়ে তেমন চেঁচামেচি হয়নি । ডিকি মাউন্টব্যাটেন লোকটাও কেমন ! বউয়ের সঙ্গে ওপন ম্যারেজ চুক্তি করে ফেললো যাতে দুজনে যার সঙ্গে ইচ্ছে প্রেম করতে পারে । কে কার সঙ্গে সেক্স করছে দ্যাট ইজ ইমম্যাটেরিয়াল । দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, লক্ষ-লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে, কতো বউরা-মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুনোখুনিতে মারা পড়ছে হাজার-হাজার মানুষ, আর তুমি তখন একজন মেমের সঙ্গে প্রেম করছ। একটা ফোটোতে দেখেছি, মাউন্টব্যাটেন ক্যাবলার মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে আর ওর পেছনে হাসাহাসি করছে নেহেরু আর এডউইনা । নকল হাসি নয়, বুকভরা হাসির ছররা ।  জওহরলাল-এডউইনা-মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক পাবলিকের সামনে আসার পর্বটাও  হয়েছিল  নোংরামি ও কদর্যতার মাধ্যমে, যখন আরেক বিবাহিতা নারী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল তার স্বামীর সাথে এডুইনার অবৈধ প্রণয়ের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। এছাড়া এডুইনা ভালোবাসার খেলায় মেতেছিল লেসলি হাচিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীর সাথেও, যে বিষয়টা পাবলিকের নজরে এলে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।  স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি দুঃখবিলাস করেনি মাউন্টব্যাটেন। অনেকের মতে, স্ত্রী সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন হয়ে পড়েছিল উদাসীন । ১৯২৯ সাল নাগাদ, মাউন্টব্যাটেন এডুইনার সাথে এক  সন্ধিচুক্তি করেছিল, যাকে ওরা বলে ‘খোলা বিয়ে’ । 

বন্ধুনি : আপনি ওটা জানেন? ওরা যেদিন আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, সেদিনের বিদায় সভায় নেহেরু সরাসরি এডউইনাকে সবায়ের সামনে বলেছিল, আপনি যেখানেই গেছেন, আপনি সান্ত্বনা এনেছেন, আপনি আশা এবং উৎসাহ এনেছেন ; এটা কতো আশ্চর্যের বিষয় যে ভারতের জনগণ আপনাকে ভালবাসবে এবং আপনাকে নিজেদের একজন হিসাবে দেখবে এবং আপনি যাচ্ছেন বলে দুঃখিত হবে । ওদের মধ্যে প্লেটোনিক সম্পর্ক ছিল নাকি যৌন সম্পর্ক ছিল তা কেউই জানে না। তার এডউইনার মেয়ে স্বীকার করেছে যে ১৯৪৭ সালের পরেও তারা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ওরা চিঠি আদান প্রদান করত । ১৯৬০ সালে এডউইনা মারা যান। মেয়ে লিখেছেন যে তার মা নেহেরুর সাথে বেশ উন্মাদভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, এতটাই যে মিস্টার মাউন্টব্যাটেনও চোখ বন্ধ করতেন যেমনটি আমরা অনেক ঐতিহাসিক ছবিতে দেখতে পাই ।

আমি : হ্যাঁ, ছবি দেখেছি ।

বন্ধুনি :নেহেরু সেই সময়ে একজন বিপত্নীক আর সমসাময়িক ভারতীয়দের তুলনায়  ‘আধুনিক’ ছিলেন, তাই এডউইনার সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলেন, যদিও হয়তো শারীরিক নয়, কিন্তু এমন কিছু যা খুব কমই স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আজও করতে দেয়। এডউইনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, যাঁকে সেই সময়ে সেরা পোশাক পরা মহিলাদের একজন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি জমকালোভাবে কেনাকাটা করতেন, পার্টিতে  চটকদার ছিলেন আর ওনার নৌ অফিসার ভাইসরয় স্বামী  তার চেয়ে অনেক বেশি গ্ল্যামারাস ছিলেন। স্বামী লোকটি তার স্ত্রীর সাথে খুব বেশি রোমান্টিকভাবে যুক্ত ছিলেন না । তাঁরও বহু যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মাউন্টব্যাটেন একবার বলেছিলেন, তারা দম্পতি হলেও, দুজনেই বিছানায় অন্যদের সাথে বেশি সময় কাটিয়েছেন।

আমি :  তুই এটা বোধহয় শুনিসনি ।নেহরুর আগে বা হয়তো তাঁর সাথে থাকাকালীনও, সামাজিক প্রজাপতি এডউইনার অনেক অভিজাত ইংরেজ আর আমেরিকান পুরুষদের সাথে সম্পর্ক ছিল ,এমনকি যৌন সম্পর্ক, অভিজাত থেকে মিডিয়া হাউসের মালিকদের সঙ্গে আর তাও মেয়ের জন্মের পরে।  তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নেহরুর পক্ষে তার সাথে ফ্লার্ট করা সহজ ছিল।

বন্ধুনি : আমি ইনডিয়াকে ডিফাইন করতে আরেকটা পয়েন্ট দিচ্ছি । যখন ইরফান খান, হিউ গ্রান্ট আর কেট ব্ল্যানচেটকে নিয়ে এই বিষয়ে একটা ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল,  তখন এটার শুটিঙ ভারতের গোপন ধমকানিতে  নাটকীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের কংগ্রেস সরকারগুলো এই ঘটনাটা লুকিয়ে রাখতে  হয়েছিল। শাসকদের ভয় ছিল গ্রামীণ ভোটব্যাংক। কিন্তু একই সময়ে তারা সম্পূর্ণভাবে বা সম্ভবত অসতর্কতার সাথে এটি অভিজাতদের কাছ থেকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের অবশ্য এতে কোন সমস্যা ছিল না । ওই লুকোছাপা থেকেই আরম্ভ হলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরাচার ।

আমি : নেহেরুর ভূমিকায় ইরফান খান অসাধারণ অভিনয় করতো । কেন যে লোকটা এতো তাড়াতাড়ি মারা গেল !

বন্ধুনি : এডউইনার চেয়ে কেট ব্ল্যানচেট হাজারগুণ সুন্দরী । এলিজাবেথ ফিল্মটায় কতো ভালো দেখাচ্ছিল ওনাকে। উনি তো অস্ট্রেলিয়ান, ইংরেজদের মতন ইংরেজি বলতে হয়েছিল । যাই হোক না কেন, কিন্তু  নেহরু সেসময়ে  ‘বামপন্থী’ তরুণদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নকল করে । ওনার প্রেমের গল্প, যদিও স্বর্গীয় নয়, অবশ্যই আকর্ষণীয় আর আনন্দদায়ক ।

আমি : তোকে একটা কথা মানতেই হবে । যাঁরা প্রায়ই নেহরুর যুগকে ভারতীয় গণতন্ত্রের সোনালি সময় বলে দাবি করেন তাঁদের সম্ভবত বুঝতে হবে যে দুর্ভাগ্যবশত, নেহেরুর উত্তরাধিকার আরও বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে যে পচন তৈরি হয়েছিল তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে পরপর কংগ্রেস সরকারের রাজত্বে । নেহেরুর উন্নয়ন বা শাসনের মডেল যা কংগ্রেস কয়েক দশক ধরে কেন্দ্র আর রাজ্যের স্তরে গর্বের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার আর দায়িত্ব নির্ধারণ করা দরকার কারণ ভারতের নাগরিকদের দুর্নীতি, অদক্ষতার জন্য বিশাল মূল্য চোকাতে হচ্ছে ।  স্বজনপ্রীতি শাসনের নেহেরু মডেলের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে ; যে সরকারই গদিতে বসুক তারা স্বজনপ্রীতির মডেলটা দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। এটা বললে ভুল হবে না যে আমাদের শাসন ব্যবস্থার তিনটি প্রধান অসুখের শিকড় –- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অদক্ষতা, নেহেরু যুগে অঙ্কুরিত  হয়ে এখন মহীরুহ হয়ে গেছে ।

বন্ধুনি : স্বাধীনতার পরপরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতীয় কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা, যাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছিল।“কৃষি আর লাখ লাখ মানুষের খাদ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে পরে । ভারতে  খাদ্যের উৎপাদন,  প্রতি একর ফলন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিন্তু বিপজ্জনকভাবে কয়েক বছর ধরে গোপন করা হয়েছিল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লক্ষ লক্ষ টন বিনামূল্যে বা ডাম্প করা খাবারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কিছু মন্ত্রীর বরং লাভ হচ্ছিল।  চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষ থেকে স্পষ্টতই, নেহরুর সময়ে   কোনও উপযুক্ত শস্যভাণ্ডার বা স্টোরেজ ব্যবস্থা ছিল না। এইভাবে দুর্ভিক্ষ,   শস্য ফটকাবাজ আর মজুতদারদের টাকার ভাঁড়ার উপচে তোলে ।

আমি : প্রকৃতপক্ষে, নেহরুর শহুরে মানসিকতা এবং গ্রামীণ ভারতের সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি দক্ষ শাসন মডেল স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শহুরে মন প্রতিফলিত হয়। নেহরু, বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মতো, শহুরে ছিলেন। তাদের শহরের বাইরে রাজনীতিবিদরা পানি ছাড়া মাছের মতো। এই কারণেই কৃষিকে, যদিও হাজার হাজার পৃষ্ঠা, লক্ষ লক্ষ শব্দ, এবং বিভিন্ন বিশাল প্রকল্প, যেমন সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বা গ্রো মোর ফুড ক্যাম্পেইন দেওয়া হয়েছে, পর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়া হয়নি… যেমন নেহরু পরিকল্পনা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং তা ছাড়া সাধারণ কৌশল, তারা ছোট কারিগরি স্কুল থেকে শুরু করে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত শত শত বিভিন্ন প্রকল্পে চলে কিন্তু তারা তাদের অগ্রাধিকার বা লক্ষ্যে খুব বেশি অশুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখায়; বুদ্ধিবৃত্তিক এবং তারপরে কঠিন প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ভিত্তির খুব অভাব… সম্পাদনে খুব বেশি ত্রুটি যাতে অনেক, সম্ভবত, বেশিরভাগ লক্ষ্য এবং ভার্চুয়াল ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটি ঘাটতি হয়েছে।

বন্ধুনি : নেহেরু মদ-মাংস খেতেন ?

আমি : নেহেরু  ওয়াইন আর শ্যাম্পেন পছন্দ করতেন, বি.কে.নেহেরুর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী । কমিউনিস্ট দেশগুলোর জন্য নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে  তিনি অনড় ছিলেন। নেহেরু যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডির সাথে দেখা করতে যান, তখন বি কে নেহরুকে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনও হুইস্কি বা জিন নয়; শুধুমাত্র ওয়াইন আর শ্যাম্পেন।  নেহেরু খুব অসুস্থ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই তিনি নিজেও শ্যাম্পেন ককটেল গিলেছিলেন । বি.কে.নেহেরু লিখেছেন যে নেহেরু সেরিন একটি বড় গ্লাস চোঁচোঁ করে খেয়ে বললেন, এর স্বাদ খুব ভাল, আরও  এক গ্লাস দাও ।

বন্ধুনি : আমি একটা পয়েন্ট দিচ্ছি ।দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে, গান্ধীজির প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব ভি কল্যাণম, গান্ধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে আজ দেশে দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান মাত্রার জন্য দায়ী করেছেন। এই গান্ধীবাদী, যিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন, দাবি করেছেন, পন্ডিত নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। মনমোহন সিংয়ের মতোই সৎ। বর্তমান দুর্নীতির জন্য আমি মনমোহন সিংকেও দায়ী করি। মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতিবাজদের  রক্ষা করেছেন। তাই আমি বলি তারা সবাই দুর্নীতিকে মদদ দিয়েছে। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, আপনার উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া । কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, তাকে, আপনার উচিত অবিলম্বে বরখাস্ত করা ।  ভারতের স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যে, গান্ধীজি পঞ্চাশটি চিঠি পেয়েছিলেন, যার মধ্যে দশটিতে  দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কল্যাণম অভিযোগ করেছেন, তখন তিনজন ব্যক্তি খুব দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন, পন্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টিটি কৃষ্ণমাচারী আর পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কাইরন । কিন্তু নেহেরু তাদের বরখাস্ত করেননি।  আমি এখন ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির জন্য নেহেরুকে দায়ী করি।”

আমি : বুঝলি, আলটিমেটলি,বিউটি অ্যান্ড দি বিস্টের ব্যাপার । কিংবা ব্যাঙ আর রাজকুমারী । ওই দুজনের আর নেহেরু ও কৃষ্ণমেননের প্রেমকে অনুমোদন করে বলল, তোমরা নাস্তিক বলে হিন্দু দেবী-দেবতার খবর রাখো না । জানো, পুরাণের সূর্য আর চন্দ্রের গল্প ?  চন্দ্র দক্ষের সাতাশটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু  কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করে সঙ্গম করেছিল । দেবগুরু বৃহস্পতি প্রেমে অভিভূত হয়ে নিজের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী মমতা অন্তস্বত্বা থাকা সত্বেও তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল। আবার ঋগ্বেদে আছে রুদ্রদেব তার নিজের মেয়ে উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।

বন্ধুনি :  আচ্ছা, এই সতীত্ব নিয়ে এরকম দুশ্চিন্তা ইউরোপ-আমেরিকায় তো নেই ? ইনডিয়াকে নয়, এই ব্যাপারটা ভারতবর্ষকে ডিফাইন করে ।

আমি : আরে বলিসনি ! মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে  যখন মেয়েদের নৈতিকতা সম্পর্কে শেখানো হয়, তখন প্রায়ই সহানুভূতি, দয়া, সাহস বা সততার কথা বলা হয় না। বলা হয় সতীচ্ছদ বা যোনিচ্ছদ নিয়ে । আমি কাজের সূত্রে আরব দেশগুলোতে গেছি । সতীচ্ছদের দেবতা আরব দেশগুলোতে জনপ্রিয়। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো বা গোপন নাস্তিক হও, কোন ধর্মের তা বিবেচ্য নয়,  পুরুষরা প্রত্যেকেই সতীচ্ছদের দেবতার পূজা করে। সতীচ্ছদ, যা সবচেয়ে অপলকা অংশ, যার ওপর কুমারীত্বের দেবতা বসে আছেন, তাকে  অক্ষত রাখার জন্য যা কিছু সম্ভব করে ওদের দেশের কর্তাবাবারা৷ সতীচ্ছদের দেবতার বেদিতে,  কেবল  মেয়েদের শারীরিক পরিপূর্ণতা আর  আনন্দের অধিকারই নয়, যৌন নিষেধের মুখে তাদের ন্যায়বিচারের অধিকারকেও বলি দেয়া হয় । কখনও কখনও  তাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, সম্মানের নামে । অনেক পরিবার তো  তাদের মেয়েদের মেরেও ফ্যালে, জাস্ট সতীচ্ছদের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য। পুরো সমাজ মনে হয় একটা পাতলা সতীচ্ছদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ।

বন্ধুনি : কোনো-কোনো বাঙালি ফ্যামিলিরও অমন ছুয়াছুত আছে । হরিয়ানা সাইডে গ্রামে তো সুহাগ রাতের পর বাড়ির বাইরে চাদর টাঙিয়ে রক্তের ছোপ দেখানো হয় পাবলিককে ।

আমি : যাকগে,  তুই গড আর গডেসদের গল্পটা কনটিনিউ কর ।

বন্ধুনি : তার চেয়ে অপ্সরাদের গল্প শোনো । অপ্সরা বলে তো আর কিছু হতে পারে না, তাই গল্পগুলো বেশ ইনটারেস্টিঙ।

আমি : আরে, কী যে বলিস ! অপ্সরা হতে পারে না তো তোমাদের পলিটিশিয়ানগুলো কাদের প্রেমে হাবুডুবে খেয়েছে আর এখনও খাচ্ছে ? টিভি আর ফিল্মের নায়িকাদের দেখেছো ? অপ্সরাদের চেয়ে সুন্দরী ।

বন্ধুনি : শোনো না, বলছি তো অপ্সরাদের কাহিনি । চোখ বুজে কোনো ফিল্মের নায়িকাকে মনে করে নাও। পুরুরবা আর উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে। সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, আর গর্ভবতী হবার পর উনি গায়েব হয়ে যান। শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটা শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে রাজী হন । প্রথম, উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে উলঙ্গ না দেখেন, দ্বিতীয়, উর্বশীর বিছানার পাশে ছেলের মতন দুটো ভেড়া বাঁধা থাকবে আর কেউ যেম ভেড়াগুলোকে চুরি না করে। তৃতীয়,  উর্বশী একসন্ধ্যা শুধু ঘি খাবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে, উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, সঙ্গম করা চলবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি হন।  পুরুরবা আর উর্বশী পরম সুখে অনেক বছর একসঙ্গে বসবাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলো তারা জানত। তাই ছলচাতুরি  করে তার শর্তগুলো ভাঙাবার উপায় বের করে। একদিন রাতে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর ভেড়া দুটোকে চুরি করে । ভেড়াদের দেখতে না পেয়ে উর্বশী কাঁদতে-কাঁদতে পুরুরবাকে ভেড়া দুটোকে উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা উলঙ্গ অবস্থাতেই বিছানা থেকে  উঠে  বিশ্বাবসুকে ধরার জন্য দৌড়োয়।  এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আমি : মুনি-ঋষিরা ল্যাংটো হয়ে শুতো ? ইনডিয়ায় তো কেউ অমন শোয় বলে মনে হয় না । আমেরিকায় শোয়, ইংল্যাণ্ডে জেমস বণ্ড শোয় ।

বন্ধুনি :আরে, পুরোটা শোনো না । পুরুরবা তখন উর্বশীর খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে একটা পুকুরে পুরুরবা চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে, ’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দেব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব । এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাতের জন্য উর্বশী আর পুরুরবার মিলন ঘটতে থাকে। উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়,  আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।

আমি : তবে ? ভেবে দ্যাখ ! সামনের মারোয়াড়ি ফ্যামিলিতে একটা বউয়ের ছেলে হলো না বলে দুই ভাই মারামারি করে আলাদা হয়ে গেল !

বন্ধুনি : নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীও কম যান না । ওনার সম্পর্কেও অনেকে নানা কথা লিখে গেছে ওনার কাছের লোকেরা ।

আমি : হ্যাঁ, এমারজেন্সি, অপারেশান ব্লু স্টার, ঝুপড়ির মুসলমানদের খোজা বানানো, জিপগাড়ি স্ক্যাণ্ডাল । পরে, ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভাঙার পর, ইন্দিরা গান্ধী টাকার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই, সোভিয়েতরা তাঁকে উদ্ধার করেছিল। একটু আগে কথা উঠেছিল ভাসিলি মিত্রোখিনের, যিনি কেজিবি আর্কাইভসের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে মস্কো কীভাবে কংগ্রেসের কার্যক্রমে টাকা যুগিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধির ক্যাবিনেটেও সোভিয়েটের চর ছিল। ইতিহাস পড়েছিস ? মুঘল আমলে ছিল নজরানা, সেটাই স্বাধীনতার পর উৎকোচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরানার অ্যামাউন্ট দুর্নীতিবাজ কাজীদের  আদালতে মামলার ভাগ্য নির্ধারণ করতো । নজরানা দিতে না পারলে চাষীদের না খেয়ে মরতে হতো । অনেক সময়ে  একজন দরবারী বা মনসবদারের চতুর্থবার বিয়ে করা নির্ভর করতো নজরানার ওপর। জাহাঙ্গিরের আমলে নজরানার নোংরামি নিয়ে লিখে গেছেন নেদারল্যাণ্ডসের পর্যটকরা। ওই ব্যাপারটাই নেহেরুর বংশের লোকেরা চালিয়ে গেছে ।

বন্ধুনি : আপনি কী জানেন, বি জি দেশমুখ, যিনি ১৯৮৬-৮৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন, তিনি  আত্মজীবনীতে লিখেছেন: বোফর্স ঘটনার সূত্রপাত ইন্দিরা গান্ধীর শুরু করা প্যাঁচের  মধ্যে পড়ে । কংগ্রেস পার্টির জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য ওনার ছেলে সঞ্জয় তাকে আরও চেকনাই দিয়েছিল৷  ইন্দিরা, তিনি বলেছেন নির্বাচনের  জন্য আর দলের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য টাকা তোলা জরুরি মনে করেছিলেন। এর জন্য, তিনি রজনী প্যাটেল আর বসন্তরাও নায়েকের মতো অনুগত সমর্থকদের উপর নির্ভর করতেন। যখন ইন্দিরা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে টাকা যোগাড়ের আরও ভাল উপায় হল বিদেশী লেনদেন থেকে কাটমানি নেয়া। সঞ্জয় গান্ধী ১৯৭২ সাল থেকে একে আরও নিখুঁত ও পরিমার্জিত করে ফেলেছিল ।

আমি : জানি, জানি, তুইই তো বইটা দিয়েছিলিস ।সেই যুগের আরও দু’জন সমানভাবে অপ্রতিরোধ্য সাক্ষী হলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি  ভেঙ্কটারমন এবং শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। তার আত্মজীবনী মাই প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স বইতে, ভেঙ্কটারমন টাটার সঙ্গে তাঁর  কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। টাটা  বোফর্সের কাছ থেকে কংগ্রেস পার্টির কমিশনের প্রাপ্তি অস্বীকার করা কঠিন । কারণ টাটা অনুভব করেছিলেন যে ১৯৮০ সাল থেকে, শিল্পপতিদের টাকা দেবার জন্য যোগাযোগ করা হতো না । শিল্পপতিরা বুঝতে পেরেছিলেন  যে শাসক দল  কমিশন তুলছিলেন অস্ত্রচুক্তিগুলো থেকে । ব্যাপারটা তহবিল সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল, তাই বোফর্স যে ঘটবে তা জানা কথা। এই কেলেঙ্কারিতে, রাজীব আর অন্যদের বিরুদ্ধে কমিশন নেবার অভিযোগ ছিল, সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্সের কাছ থেকে । ভারত যখন সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনেছিল তখন কিকব্যাক নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। রাজীব সংসদে এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। যাইহোক, নেহেরু-গান্ধীরা কখনই ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে  বোফর্স কোম্পানি কেন মারিয়া এবং ওটাভিও কোয়াত্রোচির অ্যাকাউন্টে  ৭.৩  মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিল। 

বন্ধুনি : এই লোকটা স্ট্রেঞ্জ ! কোয়াত্রোচিরা এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে সরিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিল।  শেষে  চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল । বাজপেয়ী সরকার যুক্তরাজ্য সরকারকে এই অ্যাকাউন্টটি সিজ করতে বলেছিল, কিন্তু মনমোহন সিং সরকার লন্ডনকে তা প্রত্যাহার করতে আদেশ দেয়, যার ফলে কোয়াত্রোচিরা শেষ পর্যন্ত ৭.৩ মিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়ে যায়। ভারত যখন তার সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনছিল তখন কেন একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী কমিশন খেয়েছিল ? কেন সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিং সরকারকে কোয়াত্রোচিদের অ্যাকাউন্ট ডিফ্রিজ করতে আদেশ দিয়েছিলেন? 

আমি : ওই সময়ের আরেকটা ঘটনা হলো জাতিসংঘের খাদ্য’র জন্য তেল কর্মসূচির অধীনে ইরাকি তেল বিক্রির অ-চুক্তিমূলক সুবিধাভোগীদের বিষয়ে ভলকার কমিটির রিপোর্টে । তাতে বলা হয়েছে  যে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কংগ্রেসকে বেশ মোটা টাকা দিয়েছিলেন । মনে রাখা দরকার যে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ছিল জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কত্বকে সমর্থনকারী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি । 

বন্ধুনি : ভালো বলেছো ।ওনার কাটমানির গল্প ছাড়াও প্রেমের নানা কাহিনি শুনেছি আর পড়েছি । তরুণী আর যুবতী থাকাকালে, এমনকি বিয়ের পরেও একাধিক প্রেমে পড়েছিলেন । ইন্দিরার এসব প্রেম কাহিনি পাওয়া যায় তার জীবনী লেখিকা ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কের  ‘দ্য লাইফ অব ইন্দিরা নেহেরু গান্ধী’ বইতে। এছাড়া পাওয়া যায় নেহেরুর সচিব এম ও মাথাইয়ের আত্মজীবনীতেও।

আমি : হ্যাঁ, তোর কাছেই শুনেছিলাম । ১৯৩৬ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহেরু মারা যাওয়ার পর ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা করতে যান ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে তাঁর সাথে প্রেম হয় ফিরোজ গান্ধীর আর ১৯৪২ সালে  বিয়ে করেন তাঁকে । ফিরোজ গান্ধী ছিলেন  পার্সি । এ কারণে এ বিয়ে মেনে নিতে চাননি তার বাবা জওহরলাল নেহেরু। বিয়েতে আপত্তি ছিল মহাত্মা গান্ধীরও। তবে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি তাদের এ বিয়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটলেও ১৯৫০ সালের পর আর একসাথে থাকা হয়নি ফিরোজ-ইন্দিরার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ না করেই ভারতে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বাবা তাকে ভর্তি করে দেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন এক জার্মান শিক্ষকের। ওই শিক্ষক তাঁকে জার্মান ভাষা শেখাতেন। ১৯৫০ সালে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর থেকে ইন্দিরা তাঁর বাবার একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তাঁদের ‘তিন মূর্তি ভবনে’। এখানে  তিনি প্রেমে পড়েন তাঁর বাবার সচিব এম ও মাথাইয়ের। মাথাইয়ের সাথে তাঁর প্রেম চলে প্রায় ১২ বছর। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরার যোগ শিক্ষক ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর কাছে হেরে যান মাথাই। এসব ঘটনা ইতিহাসবিদ এস. গোপালের বইতে পাওয়া যায়। যেহেতু মাথাই দেখতে সুদর্শন ছিল না, সেদিক থেকে ধীরেন্দ্র ছিল অনেক বেশি সুদর্শন এক বিহারী যুবক। এরপর ইন্দিরার জীবনে আসেন দিনেশ সিং। সে প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনে গিয়ে আড্ডা দিতো ইন্দিরার সাথে। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রেম। দিনেশ সিং ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী। এর মধ্যে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্ক থাকাকালেই আরো একজনের সাথে প্রেম ছিল ইন্দিরার। তার নাম মোহাম্মদ ইউনুস। কে এন রাও তার ‘নেহেরু ডায়নাস্টি’ বইতে লিখেছেন, ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী মূলত ইন্দিরা-ইউনুসের ছেলে। কারণ সঞ্জয় মানেকাকে বিয়ে করায় ইউনুস ছিল ক্ষুব্ধ। একজন শিখ মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সে। ঘটনাটি মোহাম্মদ ইউনুসের লেখা ‘পারসন, প্যাশন অ্যান্ড পলিটিক্স’ বইতেও পাওয়া যায়।  এতসব সত্ত্বেও রাজনীতিতে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি ইন্দিরার। 

বন্ধুনি : ধ্যুৎ, গাঁজা, পলিটিশিয়ানদের অতো সময় আছে নাকি যে প্রেম করবে !

আমি : আর কী জানিস ? ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত  শব্দটা একটা ফাঁকা কথা । আমাদের ইসকুল-কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতির বইগুলো ফালতু । আমাদের দেশটাকে একদল  অলিগার্ক, বিগ বিজনেস আর  একটা সংকীর্ণ, স্বার্থপর, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অভিজাতরা  হাইজ্যাক করে নিয়েছে । একটা ছোট এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী যারা টাকাকড়ি লুট করার  জন্য শাসন করে । এই এলিটরা , দেশপ্রেম আর গণতন্ত্রের নামে, সমস্ত মূল্যবোধের নামে, যা একসময় প্রাচীন ভারতীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল,  পরিকল্পিতভাবে  ধ্বংস করেছে, কোষাগার লুট করেছে, আমাদের গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে আর পাবলিকের মাথায় হেগেছে । 

বন্ধুনি : আচ্ছা, সারদা কেলেঙ্কারিটা কী ব্যাপার ? ওটা কি সলভ হয়ে গেছে ? নাকি ধামাচাপা পড়ে গেছে ? জানেন না ? ওটা পশ্চিমবঙ্গের একটা পনজি স্কিমের নাম । 

আমি : পনজি মানে ?

বন্ধুনি : তাও জানেন না ? পনজি  হচ্ছে এক ধরনের কূট কৌশল যেখানে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা পুরনো বিনিয়োগকারীদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চার্লস পনজি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে এটা চালু হয়েছে। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। সঙ্গতভাবেই এ ধরনের ব্যবসার আইনি বৈধতা থাকে না। পঞ্জি স্কিমগুলোতে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অথবা প্রস্তাবনা। সহজে অর্থ আয় করার লোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারান। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়ার এমন পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস বেশ পুরনো। পঞ্জি স্কিমগুলো মূলত পিরামিড আকৃতির কাঠামোর হয়ে থাকে, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা, যারা স্কিমটি শুরু করেন। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো একটি পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। এই পিরামিডের যতই নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততই এর আকৃতিটি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। তবে পঞ্জি স্কিমগুলো থেকে গ্রাহকরা শেষপর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।

আমি : আমি বলছি, আমি বলছি । বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়েই সুদীপ্ত সেন গুছিয়ে তুলছিলেন তাঁর বেআইনি কাজের ভিত। ২০০৯ সাল থেকে সেবি  সারদার উপর নজরদারি শুরু করে। ২০১১ সালে তারা রাজ্য সরকারকে সারদার সন্দেহজনক গতিবিধির কথা জানায়। ২০১২ সালে সেবি সারদা সংস্থাকে বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে কাজ না করতে বলে, কিন্তু সারদা তাতে সাড়া দেয়নি। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সংস্থা ধসে পড়ার আগে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে গিয়েছে তারা। ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাপারে, জনমানসে সংস্থার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সারদা তথা সুদীপ্ত সেনের নজর ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস ও সে দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন পরিচিত মুখকে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ শতাব্দী রায়কে। সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন রাজ্যসভা সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে । তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক সাংসদ কুণাল ঘোষকে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও নিযুক্ত করা হয়। তিনি মাসে ১৬ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন।  আরেক তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর সঙ্গে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠী ছিল ঘনিষ্ঠ। তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্মী ইউনিয়নের শীর্ষে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই সারদায় টাকা খাটানোর পরামর্শ দিতেন। কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সিবিআই-কে একটি চিঠি লেখেন সুদীপ্ত সেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তিনি প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন। কুণাল ঘোষের চাপাচাপিতেই যে তিনি লোকসানভোগী মিডিয়া গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেন, এবং তাঁর ব্ল্যাকমেলের জন্যই বাজার দরের চেয়ে কম অর্থে একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, সে কথাও বলেছিলেন তিনি। তদন্ত শুরুর পর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সিবিআই গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে। মমতার নির্ভরযোগ্য সাথী, বর্তমান বিজেপি নেতা মুকুল রায়কেও জেরা করেছিল সিবিআই।সারদা কাণ্ডে সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হবার পর, গোটা সারদা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার পর, দেরাজ থেকে কঙ্কালের মত বেরিয়ে আসতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সারদার যোগ। নাম জডায়নি, এমন কোনও নেতার সংখ্যা হাতে গোণা। আর সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য তৃণমূলের ছোট-বড় নেতা কর্মীরা যে এই পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাও প্রকাশ্য হতে থাকে।সারদা কেলেংকারি ফাঁস হবার পর মমতা সরকার এর তদন্তে পুলিশের এক বিশেষ তদন্তদল গঠন করে। সে তদন্তদলের শীর্ষে ছিলেন রাজীব কুমার। অভিযোগ, বিশেষ তদন্ত দল সারদার সল্টলেকে অবস্থিত অফিস থেকে বেশ কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে ছিল একটি লাল ডায়েরি ও একটি পেন ড্রাইভ। এই দুটিতেই নাকি ছিল যেসব প্রভাশালীদের অর্থ দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম। সিবিআইয়ের বক্তব্য সিট এই দুটি জিনিস তাদের কাছে জমা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাজীব কুমারকে সন্দেহ করে তারা। সিবিআই রাজীব কুমারের বাড়িতে তল্লাশি করতে এলে, তা প্রতিক্রিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্র বাঁচানোর দাবিতে ৪৫ ঘন্টা ধর্নায় বসেন ধর্মতলা চত্বরে। মমতার এই প্রতিক্রিয়ার পর, লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভে কাদের নাম রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ ঘোরতর হতে থাকে। 

বন্ধুনি : আর নারদা কেলেঙ্কারি ?

আমি : পশ্চিমবঙ্গের দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রাজ্যের মানুষকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। এর একটি হলো সারদা এবং অন্যটি নারদ। এই দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলায় জড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। সরদাকাণ্ডে জড়িয়ে কারাদণ্ড ভোগও করেছেন তৃণমূলের সাংসদেরা। ম্যাথিউ স্যামুয়েল এবং তাঁর সহকর্মী অ্যাঞ্জেল আব্রাহাম, এই দুই জন মিলে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ৫২ ঘণ্টা ব্যাপী একটি স্টিং অপারেশন চালান। এই ভিডিও ২০১৬ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে আসে। এই স্টিং অপারেশনে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। গোপন ক্যামেরারূপী এই অস্ত্রে কিছু পরিচিত নেতাদেরই মুখ অভিযুক্ত হিসাবে জনসমক্ষে আসে। এই তালিকায় রয়েছেন, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, অপরূপা পোদ্দার, শঙ্কুদেব পণ্ডা, আইপিএস অফিসার এস এম এইচ মির্জা প্রমুখ। এই ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় এই তালিকাভুক্ত সবাই কিছু বিশেষ প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে টাকা নিয়েছেন। এদিকে, স্টিং অপারেশনে ব্যবহৃত ৮৫ লক্ষ টাকা ম্যাথিউ কোথা থেকে পেল, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে, ম্যাথিউ জানান যে তিনি সাংসদ কে. ডি. সিং-এর সংস্থার থেকে পেয়েছেন। ম্যাথিউয়ের বক্তব্যকে যাচাই করতে এ বিষয়ে আবার তদন্ত শুরু হয়। এই তদন্তে, ম্যাথিউর দাবিকে খারিজ করে দেয়। এরপরে, ম্যাথিউকে অনেকবার নোটিশ পাঠানো হলেও, ম্যাথিউর তরফ থেকে কোনো প্রকারের সাড়া পাওয়া যায়নি।এরই মাঝে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নারদা কান্ড নয়া মোড় নেয়। তৃণমূল দাবি করে যে, স্টিং অপারেশনের ফুটেজে তৃণমূল ত্যাগী ও বিজেপিতে যোগদানকারী মুকুল ও শুভেন্দুর ফুটেজ অনুপস্থিত। যদি বিজেপির তরফ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।উল্লেখ্য, সিবিআই-এর তরফে এই প্রথমবার নারদা মামলায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে প্রচারের আলোতে উঠে এসেছিল দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। সেদিন তারা তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ গ্রহণের ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল। সেই ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।  

বন্ধুনি : আরেকটা হয়েছিল রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি ? সেটাও পঞ্জি স্কিম ?

আমি : সেটা চিটফাণ্ড স্কিম । রোজভ্যালি  চিটফান্ড কাণ্ডে এবার সাজা ঘোষণার পালা। সংস্থার এক আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায়কে সাত বছরের কারাবাসের সাজা দিল নগর দায়রা আদালত। সেইসঙ্গে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাবন্দি থাকতে হবে তাঁকে। এই প্রথমবার রোজভ্যালি সংস্থার একাধিক মামলার মধ্যে একটিতে সাজা ঘোষণা হল।ভুয়ো সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা চলছিল রোজভ্যালির। শেয়ার ডিবেঞ্চার সংক্রান্ত একটি মামলায় সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু-সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ১৩ কোটি টাকা আর্থিক তছরূপের মামলার তদন্ত করছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট । তাদের দেওয়া চার্জশিটে ছিল ৯ জনের নামই। এরপর চার্জ গঠনের সময়ে অন্যতম অভিযুক্ত সংস্থার আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজেই কেলেঙ্কারির দায় নিজের কাঁধে নেন। ফলে তিনি একাই দোষী সাব্যস্ত হন। শুক্রবার তাঁকে ৭ বছরের জন্য কারাবাসের সাজা শোনাল নগর দায়রা আদালত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইতিমধ্যে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ৪ বছর কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে আর তিন বছর জেলে কাটাতে হবে তাঁকে।

বন্ধুনি : মলয়দা, সবচেয়ে কোরাপ্ট কারা জানেন ?

আমি :কারা ?

বন্ধুনি : অনেক, অনেক । সুরেশ কলমাডি ; ওনাকে মুম্বাইতে বলা হয়  ওয়ান ম্যান আর্মি। একশো কোটি টাকার বেশি একাই গেঁড়িয়েছে কলমাডি। কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারিতে তিহার জেলে ছিল ; এখন কোথায় জানি না । দুনম্বরে, আন্দিমুথু রাজা : টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? হ্যাঁ,  মুথু কুখ্যাত টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে ১৭৬০০০ কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিল । জেল-ফেল হয়নি, দিব্বি জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। তিন নম্বরে মায়াবতী :  সবাই জানে যে উনি  মুখ্যমন্ত্রীর পদের অপব্যবহার করে সফলভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। তাজ করিডরে রোজগার করেছেন, নিম্নবর্ণের লোকেদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন, লখনউতে বিশাল পার্ক করেছেন, পুরোটা সিমেন্টের, তাতে  হাতি, ওনার আর ওনার গুরুর মূর্তিতে ছয়লাপ। চার নম্বরে  লালু প্রসাদ যাদব: জোকারি করে বেশ জনপ্রিয় । পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে তিন হাজার কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিলেন আর জেল খেটেছিলেন । জেল মানে ফাইভ স্টার হাসপাতাল। পাঁচ নম্বরে শরদ পাওয়ার:  ভারতের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা , এককালে দাউদ ইব্রাহিমের গুরু । রামগোপাল ভর্মার ফিল্মে উনি একজন ক্যারেক্টার । জাল স্ট্যাম্প মামলায় জড়িয়ে ছিলেন যার মাধ্যমে  হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা হলেও তিনি মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাক্কা খিলাড়ি। ছয় নম্বরে ভি কে শশিকলা:  সুপ্রিম কোর্ট  অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল । কর্নাটকের জেলে ছিল বলে তামিলদের পার্টি বেশ চটে গিয়েছিল । তারপর ধরাধরি করে জেলেই ভালো ঘর আর খাবার-দাবারের ব্যবস্হা হয় । সাত নম্বর জয়ললিতা: তামিলরা ডাকতো আম্মা । বেঁচে থাকতে ওনার বিরুদ্ধে ৪৬টা দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছিল। কয়লা আমদানি কেলেঙ্কারি, তানসি জমির লেনদেন মামলার অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ,  আরও অনেক মামলায়  জড়িয়ে ছিলেন।আট নম্বরে বিএস ইয়েদুরাপ্পা: ঘুরেফিরে কর্ণাটকের  মুখ্যমন্ত্রী হয়, বেশ কয়েকটা জেলার  আকরিক লোহা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে  ছিল। দুর্নীতির দায়ে  মন্ত্রীর পদ খুইয়েছিল।নয় নম্বরে মধু কোডা: ভারতের সবচেয়ে দুর্নাম মন্ত্রীদের একজন। কোডার বিরুদ্ধে অবৈধ খনির ইজারা লাইসেন্স দিয়ে ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের অভিযোগ ছিল।  ক্ষমতায় থাকাকালীন জমানো সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছিল। দশ নম্বরে মুলায়ম সিং যাদব: আরেকজন মহা ঘোড়েল দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী যাকে  মায়াবতীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখনই অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তির মামলা হয়, তখনই মুলায়ম সিংয়ের নাম উঠে আসে।

আমি : ব্যাস দশজন ? আমি তো ভেবেছিলুম একশো জনের নাম বলবে । আচ্ছা মনমোহন সিংকে কী বলবে ? আমি তাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করি । উনি সোনিয়া গান্ধীর  ছদ্মনামের মতো আচরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদকে লজ্জা দিয়েছেন। কংগ্রেসের বিপক্ষদের আক্রমণ করার জন্য  সিবিআইকে লেলিয়ে  হেয় করেছেন। অনেক কেলেঙ্কারী, অনেক বিতর্ক, কিন্তু তিনি কখনই কোন কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেননি। অত্যন্ত যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উনি বোবা হয়ে সমস্ত নোংরামি সহ্য করেছেন আর একটি শব্দও বলেননি।

বন্ধুনি : আরে ওনার কথা বাদ দিন । সবাই জানে উনি নিজেকে পরিষ্কার রাখতে সফল । কিন্তু সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ছিলেন মানিক সরকার, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, নিজের গাড়ি-বাড়ি ছিল না । টাকার জোরে বিজেপি দখল করে নিলো ত্রিপুরা রাজ্যকে ।

আমি : কোরার সাইটে কোরাপ্ট কারা জানতে চাওয়া হলে একজন এই তালিকা দিয়েছে, তুই তাদের অনেককে বাদ দিয়েছিস । লোকগুলো হলো, জওয়াহারলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, সোনিয়া মাইনো ( গান্ধি ), রাহুল গান্ধি, প্রিয়ঙ্কা ভদ্রা, শরদ পাওয়ার, আহমদ প্যাটেল, পি চিদাম্বরম, কপিল সিবাল, অভিষেক সংভি, কমলনাথ, সুশীলকুমার শিন্দে, দেভে গউড়া, পৃথ্বীরাজ চৌহান, বসন্তরাও দাদা পাটিল, ডি.কে. শিভকুমার, এইচ, ডি, কুমারস্বামী, হুডা, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং ।

বন্ধুনি : সবচেয়ে ইনটারেস্টিঙ পশ্চিমবাংলার মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি পাওয়া। ২০১৮-তে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী এসএসসিতে চাকরি পেয়ে যান।  প্রথমে কোনও মেধা তালিকায় অঙ্কিতার নাম না থাকলেও ওয়েটিং লিস্টে অঙ্কিতার নাম প্রথমে চলে আসে। যার জেরে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির ববিতা সরকারের ওয়েটিং লিস্টে নাম ২০ থেকে ২১-এ চলে যায়। চাকরি হয় ওয়েটির লিস্টে ২০ পর্যন্ত। বঞ্চিত থেকে যাওয়া ববিতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আরটিআই করে অঙ্কিতার নম্বর জানতে চান। কিন্তু কোনও উত্তরই তিনি পাননি। শেষে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিলে এসএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার জানান, অঙ্কিতার বিষয় ভিত্তিক এবং অ্যাকাডেমিক স্কোর ৬১।  অন্যদিকে ববিতা সরকারের পার্সোনালিটি টেস্টে অংশ নিয়েছেন। তাঁর বিষয় ভিত্তিক, অ্যাকাডেমিক এবং পার্সোনালিটি টেস্টের স্কোর হল ৭৭। অর্থাৎ বেশি নম্বর পেয়ে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন ববিতা। অঙ্কিতা অধিকারী আদালতের রায়ে চাকরি খুইয়েছেন। তাঁকে ৪১ মাসের মাইনে ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 

আমি : তুই  আর্থিক কেলেঙ্কারির পাণ্ডাদের বাদ দিচ্ছিস কেন ? ওরা তো হাওয়ালার মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ।

বন্ধুনি : কারা ?

আমি : এক নম্বর, সত্যম কেলেঙ্কারি – ১৪০০০ কোটি । ২০০৯ সালের এই কর্পোরেট কেলেঙ্কারিটি ‘ভারতের এনরন কেলেঙ্কারি’ নামেও পরিচিত এবং এটিতে বি রামালিঙ্গা রাজু এবং তার সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। কোম্পানি স্বীকার করে যে তারা ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি অ্যাকাউন্টের জালিয়াতি করেছে। দুনম্বর, বিজয় মালিয়া – নয় হাজার কোটি । একটা সময় ছিল যখন মানুষ বিজয় মালিয়াকে ‘কিঙ অফ গুড টাইমস’  বলে ডাকত, কিন্তু আজ তার নামে ভালো কোনও কথা কারোর মুখ থেকেই বের হয় না। ২০১৬ সালে, মালিয়া দেশে প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে দেশ থেকে পলাতক হয়েছিলেন এবং ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়েছিলেন। বিজয় মাল্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।তিন নম্বর, কয়লাগেট কেলেঙ্কারি – ১.৮৬ লক্ষ কোটি ।কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।চার নম্বর,  বোফোর্স কেলেঙ্কারি – ৬৪ কোটি । এটা একটি বড় অস্ত্র-চুক্তি কেলেঙ্কারি যা ১৯৮০-৯০ -এর দশকে ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে ঘটেছিল। ১৯৮৬ সালে, ভারত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের ১৫৫ মিমি ফিল্ড হাউইটজার সরবরাহ করার জন্য সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্স এবির সাথে ১৪৩৭ কোটি টাকার (প্রায়) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আজকের সময়ে, বোফর্স কেলেঙ্কারির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।পাঁচ নম্বর, নীরব মোদী পিএনবি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ১১,৪০০ কোটি ।পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান অভিযুক্ত নীরব মোদী ও তাঁর ভাইপো মেহুল চোসকি। আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আগেই গত বছর জানুয়ারির শেষের দিকে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালান।  ১৪ মার্চ ৪৮ বছরের নীরব মোদীকে গ্রেফতার করে স্কটল্যান্ট ইয়ার্ডের পুলিশ ভারতে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করে। ছয় নম্বর, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি- ৩৬০০ কোটি । ভারতের কুখ্যাত প্রতিরক্ষা কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি এই প্রতারণা মামলা। এই মামলাটি ২০১০ সালের UPA সরকার এবং অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের মধ্যে ১২টি হেলিকপ্টার অধিগ্রহণের জন্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ভিভিআইপি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। চুক্তিটি ৩৬০০ কোটি টাকা মূল্যের ছিল।সাত নম্বর, হাওয়ালা কেলেঙ্কারি – ১৮ মিলিয়ন ডলার । হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারীটি জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছে। 

বন্ধুনি : হাওয়ালা ব্যাপারটা কী ? কেমন কে অপারেট করে একটু বুঝিয়ে বলুন ? হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে একবার আঠারো মিলিয়ন ডলার লেনদেনের খবর পড়েছিলাম। হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারিটিা জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। 

আমি : ‘হাওয়ালা’  শব্দটা আরবি । এর মানে, লেনদেন।  পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা আর ভারতীয় উপমহাদেশে একদল দালাল আছে যারা পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। চিরাচরিত ব্যাঙ্ক বা অর্থব্যবস্থায় যে টাকা লেনদেন হয়, হাওয়ালা হল তার সমান্তরাল  পদ্ধতি।  আগেকার কালে টাকা বা সোনা নিয়ে অনেকখানি  রাস্তা পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না । হাওয়ালা গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ, জঙ্গিরা নাশকতা চালাতে যে টাকাকড়ি যোগাড় করে কিংবা রাজনীতিবিদরা ভোটের সময় যে খরচ-খরচা করে, তার সিংহভাগ টাকা আসে এই কায়দায়। এদেশে তোলা ঘুষও বিদেশে যায় একই কায়দায় ।হাওয়ালায় একদল দালাল থাকে টাকা নেবার জন্য। এদের বলা হয় হাওয়ালাদার। ধরা যাক,  দুবাইয়ের হাওয়ালাদার কারও কাছ থেকে টাকা পেল। তখন সে যোগাযোগ করবে যেখানে টাকা পাঠাতে হবে, সেই দেশে নিজের এজেন্টের সঙ্গে। এ বার সেই এজেন্টকে টাকা পাঠানো হবে না, শুধু  ‘পাসওয়ার্ড’ দেওয়া হবে। এমন একটি শব্দ, যা মনে রাখতে হবে এজেন্টকে। যে লোকটাকে এজেন্ট টাকা দেবে, তাকেও বলে দেওয়া হবে ওই শব্দ। যার হাতে টাকাটা দিতে হবে সে ‘পাসওয়ার্ড’ এজেন্টকে বললে তবেই এজেন্ট  গ্রাহকেকে টাকাটা দেবে। প্রতিটা লেনদেনের ক্ষেত্রে হাওলাদাররা দুই শতাংশ কমিশন নেয়। মুখে-মুখে লেনদেন হয় বলে ব্যাঙ্ক বা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে এর কোনও প্রমাণ থাকে না। 

বন্ধুনি : হ্যাঁ। সরকারের অনেক লোকসান হয় । আবার রাজনীতিকরা আর কালোবাজারিরা হাওয়ালায় বিদেশে টাকা পাঠায় ।  ভারতে হাওয়ালা লেনদেনের ছবিটা ভয়াবহ। আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক আর বৈদ্যনাথনের মতে, ভারত গত ছয় দশকে কর ফাঁকি বাবদ দেড় লক্ষ কোটি ডলার হারিয়েছে। আর এর ৪০ শতাংশই হয়েছে হাওয়ালা লেনদেনের কারণে। হাওয়ালা অবৈধ । হাওয়ালা নিয়ে যা আইন আছে, তা খুব কড়া। কিন্তু হাওয়ালায় এত বিপুল টাকা দেওয়া-নেওয়া হয় যে, গোয়েন্দারা এখন তা বন্ধ করতে পারেনি। বিদেশে  অনেক ভারতীয় আছে, যাঁরা ব্যাঙ্ক মারফত টাকা পাঠায় না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশে হয়তো বেআইনিভাবে বসবাস করছে। ব্যাঙ্কে গেলে নাম-ঠিকানা দিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে হাওয়ালার আশ্রয় নিতে হয়। ভারতে হাওয়ালায় টাকা লেনদেন বেআইনি ঘোষিত হয়েছে দু’টো আইন মারফত। একটা হল ফেমা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০০ অন্যটা প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২। 

আমি : ইনডিয়াকে আরেকজনের মাধ্যমে ডিফাইন করি, কী বলিস ?আগের অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদাম্বারামকে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময় ঘুষ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের অর্থ আত্মসাত করেছিলেন । তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।২০০৭ সালে অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আইএনএক্স গ্রুপের দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মি. চিদাম্বারামের ছেলে কার্তি চিদাম্বারামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঐ বিনিয়োগের ছাড়পত্র পাইয়ে দেয়ায় আইএনএক্স’এর কাছ থেকে ঘুষ পেয়েছিলেন তিনি। আর্খিক লেনদেন বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করা সংস্থা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ২০১৮ সালে কার্তি চিদাম্বারামকে গ্রেফতার করে সিবিআই, কিন্তু পরে তাকে জামিনে ছাড়া হয়। তিনি ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের রাজ্য তামিল নাড়ুর একজন কংগ্রেস এমপি ।

বন্ধুনি : বুঝলেন,ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপোস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিব সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালু প্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপোস করেননি।

আমি : সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।

বন্ধুনি : কারেক্ট । যে বউটা নিজের চটি খুইয়ে চটিটা ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল তাকে তারিফ করতেই হয় ।

আমি : হ্যাঁ, খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছে । ওটা কিন্তু আসল ইনডিয়ার সংজ্ঞা । মাদার ইনডিয়া ।

বন্ধুনি : চটি মারার ব্যাপারটাকে নিম্নবর্ণের ক্রোধ হিসেবেও দেখা যায় । সাবলটার্ন ইনডিয়া ।

আমি : দুর্নীতি ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আর ভারতীয় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেঁদিয়ে গেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন একাডেমিয়া, ব্যবসা, ব্যাঙ্কিং, আইন প্রয়োগকারী আর অন্য রোজকার পরিষেবাগুলোয় ঘটে যাওয়া ব্যাপক দুর্নীতি আমাদের মতন মানুষের ঘাড়ে খাঁড়ার কোপের মতন নেমে এসেছে ।সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্নীতি  সামাজিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে আর অনেক ক্ষেত্রে এটা অনিবার্য আদর্শ হয়ে উঠেছে। আমি তো কলকাতা থেকে এসে ভোটার কার্ডটা ট্রান্সফার করাবার জন্য কতো দৌড়োদৌড়ি করলুম । তারপর শুনলুম যে ঘুষ না দিলে হয় না । 

বন্ধুনি :শেষ পর্যন্ত হয়েছে ?

আমি : তুই  রেশন কার্ড করিয়ে দেবার পর হয়েছে ।

বন্ধুনি : সউদি আরবে যাচ্ছো নাকি, ছেলের কাছে ? 

আমি : আরে হঠাৎ টপিক পালটে ফেললি ; এখনও তো কয়লা পাচার, গোরু পাচার, আরো নানা পাচার-কাহিনি আলোচনা হয়নি তো ! নাহ, আর কোথাও যাবো না ; ছেলেকে অবশ্য বলেছিলুম, একটা আরবি মেয়েকে বিয়ে কর, আরবের সবাই বেশ ফর্সা আর সুন্দরী, তাহলে আমরাও হজ করতে যাবো । মক্কা-মদিনা দেখা হয়ে যাবে। ও বলেছে ও আর কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে না । যাকে বিয়ে করেছিল তার গায়ে বিটকেল গন্ধ আর চেপে গিয়েছিল যে ওর ইউটেরাসে সমস্যা আছে, কোনোকালে মেন্স হয় না।

বন্ধুনি : ও বাবা, আমাদের বলেননি তো !

আমি : এসব আবার বলাবলির বিষয় নাকি । নাহ, আর কোথাও যাবো না । বিদেশের মরুভূমি দেখা হয়ে গেছে দুবাই, আবুধাবিতে, গ্র্যাণ্ড মসজিদ ঘোরা হয়ে গেছে । ইউরোপে তুষার দেখা হয়ে গেছে । যা-যা দেখার আর খাবার তা সেরে ফেলেছি। কতো মেমেন্টো জড়ো করা হয়েছে নানা দেশ থেকে, সেগুলো এখন সমস্যা । ধুলো পড়ে এমন হয়েছে যে চেনা যায় না। কলকাতা ছাড়ার সময়ে অনেক মেমেন্টো বিলিয়ে দিয়ে এসেছি আর আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেগুলো ফ্রিজে আটকানো ছিল সেগুলো ফ্রিজসুদ্ধ দিয়ে দিয়েছি । যৌবনে জড়ো করা সব জিনিস এখন ফালতু মনে হয়।

বন্ধুনি : বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রবণতা নিয়ে রিপোর্ট দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ তাদের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ সালে ভারতের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং ছিল ৮৫ তম স্থানে । ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান আরও কিছুটা নিচে নেমে গিয়েছে ৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সততার এই পরীক্ষায় ডেনমার্ক আর নিউজিল্যান্ড ১০০-র মধ্যে ৮৮ পেয়েছে ৷ আর ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসবে নিজেদের প্রমাণ দিয়েছে ৷ ভারত এই পরীক্ষায় মাত্র ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ৷ সারা বিশ্বে এই গড় ৪৩ শতাংশ৷ আর এই ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ টি দেশের গড় ৪৫ শতাংশ । ভারতের র‌্যাঙ্কিং এশিয়া-প্যাসিফিক গড়ের চেয়ে অনেক খারাপ । চিন ৪২ নম্বর পেয়ে ৭৮তম স্থান জায়গা করে নিতে পেরেছে৷ কোরোনা প্যানডেমিক কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ই নয়, এটি দুর্নীতিও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ 

আমি : জানি ।

বন্ধুনি : আরেকটা নতুন টার্ম শুনছি, কাটমানি। সেটা কী ? 

আমি : তুই জানিস না ? পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক পরিস্থিতি বলছে, ‘কাটমানি’ হল সেই টাকা যা কোনো সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে বা পরিষেবা পাইয়ে দিতে জনপ্রতিনিধি, মানে দাপুটে নেতার হাতে তুলে দিতে হয়। অর্থাৎ, সরকার নির্ধারিত মোট টাকা থেকে যে টাকা ‘কাট’ করে কাজের স্বার্থে প্রভাবশালীর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে, সেটাই ‘কাটমানি’। মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন সরকারি অর্থ বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মধ্যে সাহায্য হিসেবে বিতরণ করতে হলে এই উক্ত শ্রেণীর মাধ্যমে অর্থাৎ— ফুলনেতা, হাফনেতা , টেপিনেতা, ফুটিনেতা এনাদের হাতে কাটমানি হয়ে অবশেষে যতকিঞ্চিত, যার নামে সকারী খাতায় টাকাগুলো মঞ্জুর হয়েছে এর হাতে এসে পৌছায়।উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, কোনো সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১০০ টাকা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গ্রাহককে জানালেন, ওই টাকা পাওয়ার অনুমোদন পেতে তাঁকে ২৫ টাকা ‘চার্জ’ জিতে হবে। এই টাকা বেশির ভাগ সময়ই নিচু তলার রাজনীতিক থেকে উঁচু তলায় স্তরে স্তরে পৌঁছে যায়।

বন্ধুনি : সিন্ডিকেট ? সেটাও তো পশ্চিমবাংলার অবদান । কিন্তু ইনডিয়াকে ডিফাইন করে আই থিংক ।

আমি : সিন্ডিকেট নামের রাক্ষসগুলোর জনক কারা , এই প্রশ্ন তুললে দলগুলোর মধ্যে চাপানওতোর চলে । বামপন্থীরা বলে, তাঁদের জমানায় রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ছিল ।  তৃণমূল কংগ্রেস এসে  সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে । তৃণমূল কংগ্রেস বলবে, তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবস্থাটা পেয়েছে । কেন প্রতিটি দলই পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট বা সেরকম ব্যবস্থাকে তোল্লাই দেয়, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থায়। পশ্চিমবঙ্গে বড়ো শিল্প নেই, ফলে বড় মাপের কর্মসংস্থানও নেই। যা আছে,  তা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ।  এই অবস্থায়  রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে একটা দল । যে হেতু পশ্চিমবাংলায় চাকরি-বাকরি নেই তাই  রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সিন্ডিকেটে কাজ করতে হয় বেকার ছেলেদের । আবার, তাদের হাতে রাখতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো । ফলে, সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়ে  উপায় নেই।  এক নেতা একবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়লে সরকার পড়ে যাবে ।  সিন্ডিকেট থেকে বাড়ি তৈরির মাল আর শ্রমিক নিতে হয় । না নিলে বিপদ । চাকরির সমস্যার সমাধান না হওয়ায়  এই রাজনৈতিক হাতিয়ার প্রয়োগ করতে হয়। সিন্ডিকেটের নামে  জুলুম চলে। 

বন্ধুনি : সিন্ডিকেট ব্যাপারটা ঠিক কী ? একটু বুঝিয়ে বলুন ।

আমি : সিন্ডিকেটের একেবারে প্রাথমিক ধাপ হল, যখন কোনও পার্টির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন প্রোমোটাররা, তাঁকে সেই ওয়ার্ডের প্রভাবশালী নেতাকে ‘প্রণামী’ দিতে হয়, মানে মোগল আমলের সেই নজরানা। কী সেই ‘নজরানা’? দমদম সংসদীয় এলাকায় জায়গা বুঝে একটা থোক টাকা, সেটা দু’লক্ষ,তিন লক্ষ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। তারপরের ধাপ হল সিন্ডিকেটের বরাত। এখন এই মুহূর্তে দমদম এলাকায় সেই রেট চলছে ৩৫০-৩৭০ টাকা স্কোয়্যার ফিট। প্রোমোটারদের কথায়, এতে আবার রয়েছেন সেই দাদা-দিদিদেরই অনুগামীরা। তাঁদেরকে সেই টাকা দিতে হয়। তাঁরাই মূলত ইট-বালি-সিমেন্টের বরাত পান। এর অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। প্রমোটারদের চলতি কথায়, তা হল ‘সিন্ডিকেট কেনা’। এই অনুগামীদের বরাত না দিয়ে তাঁদেরকে একটা থোক টাকা দিয়ে দেওয়া হল। একেবারে কর্পোরেট কায়দায় চলে সিন্ডিকেট রাজ। কাউন্সিলরদের মধ্যেই যে সিন্ডিকেট নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। আর এরই ফায়দা লুঠছে এক শ্রেণির মানুষ।

বন্ধুনি : সরকার কনট্রোল করলেই তো পারে ?

আমি : সিন্ডিকেটকে কেন কনট্রোল করা উচিত, সেই প্রশ্নের একরকম উত্তর রাজারহাটে পাওয়া গেলে অন্যরকম উত্তর পাওয়া যাবে হলদিয়ায়। এক দিকে যেমন সিন্ডিকেটের জুলুমে বাড়িটাড়ি তৈরির খরচ বেড়ে যায়, ফলে ফ্ল্যাটের দাম ন্যায্য স্তরের তুলনায় বেশি হয়, অন্য দিকে বাড়ি তৈরির গুণমানও  ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, বাজারে  চাহিদা পড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে কাজে, ইঁট-বালি-সিমেন্ট-লোহার  সার্বিক চাহিদায়। অন্য দিকে, হলদিয়ার অভিজ্ঞতা বলবে, এই সিন্ডিকেটের জুলুমে এক বহুজাতিক সংস্থা বন্দরের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, আর তার ফলে বন্দর-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলে গেল প্রতিবেশী রাজ্যে। মানে, সিন্ডিকেটের জুলুমে যে শুধু কনট্রাক্টারের ক্ষতি হয়, তাই নয়— ক্ষতি হয় পুরো  রাজ্যের । সিন্ডিকেট প্রথা কনট্রোল করা অসম্ভব হয়ে গেছে । 

বন্ধুনি : প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তোলাবাজি, কাটমানি ও সিন্ডিকেট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেবে প্রশাসনের শীর্ষ মহল। বিরোধীরাও গলা চড়াবেন। ঠিক যেমন গত বুধবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ভাবী কাউন্সিলরদের সিন্ডিকেট ও তোলাবাজি নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাবে কি? আরও এক নির্বাচনের আগে সেটাই প্রশ্ন। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, গত ভোটে মমতা কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। দিনকয়েক চুপ ছিলেন নেতা-দাদারা। শোরগোল থিতিয়ে যেতেই যে কে সে-ই! পুরভোটের পরেও তেমনটাই হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, পুর পরিষেবার মাধ্যমেই বছরভর সব চেয়ে বেশি টাকা কামানোর কারবার চলে। মমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর অজানা নয়। জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমার এলাকায় কেউ ঘরবাড়ি করলে সমস্ত কিছু আমার থেকে কিনতে হবে, তা হবে না। কেউ ঘরবাড়ি করলেই আমাকে এত টাকা দেবে, তা-ও হবে না।

আমি :  এটা অক্সিমোরোন । গণতন্ত্র চাই । তাকে টিকিয়ে রাখতে অঢেল টাকা চাই ।

বন্ধুনি : আর তোলাবাজি ? কতোরকমের টার্ম যে ইনডিয়াকে ডিফাইন করে তার ইয়ত্তা নেই মাইরি ।

আমি : জানিস না ? তোলা মানে চাঁদা । বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বা রাস্তায় গাড়িটাড়ি থামিয়ে, চাঁদা আদায় । আজকাল বাজারে চাঁদা তোলার রসিদও বিক্রি হয় । রসিদ দেখিয়ে দিলে সন্দেহ কম হয় । তবে আবদার বদলে গিয়েছে হুকুমে। খুদেদের সরিয়ে ঢুকে পড়েছে বড়রা। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে একই সারিতে ঢুকে পড়েছে সরস্বতীও। সৌজন্যে চাঁদার জুলুম। আর তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সম্প্রতি হাঁসখালির ফুলবাড়িতে চাঁদার জুলুমবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের। অভিযোগ, তাঁর অনুগামীরা এক ট্রাক চালক ও খালাসিকে গাড়ি নিয়ে তাড়া করে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর জখম অবস্থায় ওই দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁদের ‘অপরাধ’ ছিল সরস্বতী পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি মতো তাঁরা চাঁদা দিতে পারেননি।

বন্ধুনি : আপনি তো গায়ক হতে চেয়েছিলেন ! ইনডিয়ার ল্যাঙ খেয়ে গেলেন ?

আমি : ঘায়ে খোঁচা দিস না । যারা  সাহিত্য, সঙ্গীত, ব্যবসা, রাজনীতি, খেলাধুলো, শিল্পকলা ইত্যাদিতে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে — তাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান মনে করার কারণ নেই। আমাদের মধ্যে অগণিত মানুষ আরও বেশি গুণ সম্পন্ন হলেও, তাদের বিকাশের সুযোগ, বাজারের সমর্থন বা সম্পদের অভাবে তারা ঢাকা পড়ে যায়। যদিও সাফল্য আর প্রতিভার মধ্যে সম্পর্কটা অস্পষ্ট,  গণসমাজ একটা মেধাতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করে, যা উল্টোটায় জোর দেয়, মানে যারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সর্বদা সবচেয়ে প্রতিভাবান। এর ফল বিষময়। সফলতা  যাদের গণমানসে এড়িয়ে যায়, তারা কেবল ব্যর্থতার  আঘাতগুলোকে সহ্য করে না,  তাদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার অপমানও সহ্য করতে হয়, কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ, বাজারের  সমর্থন আর সম্পদ নেই।

বন্ধুনি : কথাটা ঠিক । আচ্ছা গরু পাচারেও নাকি পলিটিশিয়ানদের হাত আছে ? দেশে গোমাংস বিরোধী একটা উন্মাদনা যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে, তেমনই খাদ্য নির্বাচনের স্বাধীনতা হরণকেও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ভাল চোখে দেখে না। নিজের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কারও উপর চাপানো ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থে রাজনীতি ও কূটনীতি পরিচালিত করার বদলে ‘এক ধর্ম, এক ভাষা, এক খাদ্য’কে সামনে আনা হচ্ছে, যার অর্থ হল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে । সাম্প্রতিক কালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আর আগে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং যখন ভারতে এসেছেন, তখন তাঁদের নিরামিষ খেতে দেওয়া হল, যা রুশ ও চিনা অতিথিরা ভাল ভাবে নেননি।

আমি : ভোট রাজনীতির সুবিধা তোলার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যবহার করে শাসকদল এবং তাদের ধ্বজাধারীরা সমাজের জটিল ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এর ফলাফল যে কী হতে পারে, সেটি সম্পর্কে তাঁদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এই ঘটনাপ্রবাহ এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতার পরিচয় দিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৯০-এর দশকে মুসলিম মৌলবাদের জোয়ারের সময়ে ভারতীয় মুসলমানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরমপন্থার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। কিন্তু বর্তমানে এই মানুষেরা ক্রমাগত পক্ষপাত এবং শাসানির শিকার হচ্ছেন। এই আক্রমণ তাঁরা আর কত দিন সহ্য করতে পারবেন, তা স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে ভাঙন ধরানোর ফলাফল যে মারাত্মক হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

বন্ধুনি : মুসলমানদের অবস্থাও শোচনীয়। তথাকথিত গো-রক্ষা গোষ্ঠীর লোকজন দ্বারা নির্যাতন এবং খুনের একাধিক ঘটনার পরে বর্তমানে মুসলমানদের নিধন করার জন্য খোলাখুলি ভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। গুরুগ্রামে মুসলমানদের শুক্রবারের নমাজ পাঠ বন্ধ করার জন্য ধারাবাহিক প্রচার চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের সর্বাধিক আধিপত্য বিশিষ্ট মতবাদ, ‘হিন্দুত্ব’, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত না হলেও প্রকৃত ইতিহাসের এক অর্ধশিক্ষিত ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে একটি উদ্ভট মতবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে যে, বর্তমানে দেশের মুসলিম অধিবাসীরা ব্যক্তিগত ভাবে সেই সকল নৃশংসতার জন্য দায়ী যা আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কোনও মুসলমান শাসক বা আক্রমণকারী দ্বারা করা। খ্রিস্টান জনসেবামূলক কাজ এবং বিদ্যালয়গুলির উপরে ধর্মান্তরকরণের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেড়শো বছর ব্রিটিশদের ‘খ্রিস্টান’ শাসনের পরেও কেন এ দেশের মাত্র ২% মানুষ এই ধর্মাবলম্বী সে বিষয়ে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

আমি : বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার অভিযোগে ভারতের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতারা সোচ্চার হয়ে উঠছেন৷ দলমত নির্বিশেষে লেখকরা দলে দলে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ অথচ সরকার এর পেছনে রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখছে৷ হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের শিক্ষাবিদ কালবুর্গি থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে৷ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর আর যুক্তিবাদী এমএম কালবুর্গী হত্যার মধ্যে  যোগাযোগ আছে, সেকথা সবাই জানে।

বন্ধুনি : ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু না কিছু ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে হচ্ছে৷ মৌলবাদী হিন্দুরা যার নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ’৷ প্রথমদিকে নাম ছিল রোমিও জিহাদ৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কিছুতেই এই‘লাভ জিহাদ’ মেনে নিতে পারছে না৷ কেন পারছে না ? কারণ, এটা তাদের মতে, ধর্মান্তর করা ছাড়া আর কিছুই না৷ এই অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম দম্পতির বাড়িতে গিয়ে চড়াও হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ৷ তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷

আমি :  ‘মৌলবাদ’ শব্দটার ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ  শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।

বন্ধুনি : আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক লিখিত সাহিত্যে নয়, পালা, পল্লিগান, যাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিস্তার আমরা দেখি, যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয় ও কখনো কখনো রাজপুরুষদের কাহিনি থাকলেও (মহাকবি ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ারের নাটকেও রাজরাজড়ার ও ভূত-প্রেতের কাহিনি আছে,  মর্মবস্তুর মধ্যে যা প্রধান ছিল, তা হলো মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারপন্থী মতবাদ। ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের আদিপর্ব’ নামক রচনায় বলেছেন, এ দেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল ।

আমি : কর্পোরেট বাজারও মৌলবাদ, তা ভুললে চলবে না ।  ধরে নেয়া হয় যে বাজারের সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত করবে আর  ফলাফল হবে আরো ভালো পণ্য, আরো বেশি বিক্রি, আরো বেশি মুনাফা আর এজন্য সবকিছুই বৈধ। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব কার উপর কেমন পড়লো কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমানের তথাকথিত ‘মুক্ত বাণিজ্য’র আদর্শ এই নয়া-উদারনীতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই বাজার মৌলবাদে এটি প্রায় একটি বিশ্বাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাজারের অদৃশ্য হাত সবসময়ই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। বাজার মৌলবাদ কার্যত পুরুষতান্ত্রিক। পুঁজিবাদ কার্যত পুরূষতন্ত্রের একটি রূপ। নারীবাদীদের অনেকেই বলেছেন পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্র সম্পূর্ণ একদেহ না হলেও দুই-এর সম্পর্ক নিবিড়। পুঁজি আর পিতৃতন্ত্রের যৌথতায় নারীর অধঃস্থনতার আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। 

বন্ধুনি : বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে হওয়া লোহাচুর কেলেঙ্কারির বিপুল আর্থিক দায় নিতে হল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে। বাম আমলে চীনে আকরিক লোহা রপ্তানির জন্য নেওয়া ঋণের বকেয়া (সুদ ও আসল মিলিয়ে) বাবদ ১৮৫ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫৩০ টাকা ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে সোমবার মিটিয়ে দিল খাদ্য দপ্তর। এই দপ্তরের অধীনস্থ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগম (ইসিএসসি) ২০০৫ সালে লোহা আকরিক রপ্তানির জন্য ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে লোহা আকরিক রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু চীন পর্যন্ত ওই লোহা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ। এই ঋণ মেটানোর জন্য বিপুল চাপ ছিল খাদ্য দপ্তরের উপর। ঋণ পরিশোধ না করে কোনও উপায় ছিল না। কারণ চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ না করলে ইসিএসসি-কে দেউলিয়া ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলির লেনদেন বন্ধ হয়ে যেত। চলতি বছরেই এটা করা হয়েছিল। তখন খাদ্য দপ্তরের অনুরোধে ছ’ মাস অ্যাকাউন্টে লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে অক্টোবরে। ২০১৬ সালের নতুন কেন্দ্রীয় আইনে ‘কর্পোরেট ইনসলভেন্সি রেজুলিউশন প্রসেস’-এর মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছিল।  সরকারি উদ্যোগে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার মূল দায়িত্ব ইসিএসসি-র। নভেম্বর মাস থেকে এই কাজ শুরু হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে ধান কেনার কাজই থমকে যেত। শুধু তাই নয়, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার পর ইসিএসসি-র স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নীলাম করে বকেয়া টাকা আদায় করতে পারত ব্যাংকগুলি। তাই আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও টাকা মেটাতে হয়েছে। এর জন্য নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে নিগমকে। ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে খাদ্য দপ্তর। গত বেশ কয়েক মাস ধরে ঋণ মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলির সঙ্গে আলোচনা চলছিল। রাজ্য সরকার চেয়েছিল সুদ ছাড়া বকেয়া ঋণের আসল অংশটুকু পরিশোধ করতে। তা হলে ১৫৬ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা দিতে হত। কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলি তাতে রাজি না হওয়ায় একসঙ্গে প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা দিতে হল। পুরো ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজনৈতিক মদতে চলা ‘লুটপাটের’ গুনাগার দিতে হল তাঁদের সরকারকে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির টাকার ভাগ বামফ্রন্টের বড়-ছোট শরিকদের কাছে গিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন দে-র দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। টাকা পরিশোধ করার জেরে দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজ কিছুটা ব্যাহত হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। লোহা আকরিক কেলেঙ্কারির তদন্তে আরও গতি আনার জন্য সিআইডি-কে খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির মামলায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সিআইডি একমাত্র জেরা করেছিল প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন দে-কে। তিনি খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী ছাড়াও ইসিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু রাজনৈতিক মদতের যে অভিযোগ তুলেছেন, সেই প্রসঙ্গে নরেনবাবু এদিন বলেন, সিআইডি তো আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি লিখিতভাবে তাদের নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। সিআইডি তাতে সন্তুষ্ট হয় বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর দাবি। নরেনবাবু দাবি করেন, তিনি যখন সমবায় দপ্তর থেকে খাদ্য দপ্তরের দায়িত্বে আসেন, তখন লোহাচুরের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’ হয়ে গিয়েছে। খাদ্য দপ্তরে তাঁর পূর্বসূরি প্রয়াত কলিমুদ্দিন শামসের সময়ে লোহাচুর রপ্তানির বিষয়টি হয়েছিল বলেও তিনি দাবি করেছেন। এই মামলার তদন্তে খাদ্য দপ্তর আরও গতি আনতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে নরেনবাবু বলেন, যা ইচ্ছা তাই করুক। লোহাচুর কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিআইডি ইতিমধ্যে আদালতে একাধিক চার্জশিট পেশ করেছে। মামলার শুনানিও চলছে। এই মামলায় তৎকালীন নিগমের শীর্ষ পদে থাকা দুই আইএএস আধিকারিক দেবাদিত্য চক্রবর্তী ও এস সি জামির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। 

আমি : ইসলামী মৌলবাদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে মুসলমানদের একটি আন্দোলন হিসেবে  যারা অতীতকে ধারণ করে এবং ধর্মের মূলে ফিরে যেতে  চায় এবং একইভাবে জীবনযাপন করে যেভাবে নবী মুহাম্মদ   ও তার সাহাবীগন জীবনযাপন করতেন। ইসলামী মৌলবাদীরা ইসলামের প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) এর “আক্ষরিক এবং মৌলিক ব্যাখ্যা” সমর্থন করে, এবং তাদের জীবনের প্রতিটি অংশ হতে, তাদের ধারণা আনুযায়ী “বিকৃত” অনৈসলামিক প্রভাব দূর করতে চায় ।

বন্ধুনি: ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার একটি দীর্ঘ দিনের সমস্যা। মূলত এ ক্ষেত্রে ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’র কাজ করে পশ্চিমবঙ্গ। বিএসএফ সূত্রে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে চোরা পথে গরু এসে পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। এর পর রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা দিয়ে ওই গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, ও বিএসএফের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে বলেও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর। পাচার রুখতে সক্রিয় হয় কেন্দ্র। বিএসএফের দাবি, সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোয় আগের চেয়ে গরু পাচার অনেক কমেছে। ২০১৩-১৪ সালে প্রায় কুড়ি লক্ষ গরু পাচার হয়েছিল। বিএসএফের যুক্তি, পাট গাছের দৈর্ঘ্য সাত থেকে দশ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওই উচ্চতাকে কাজে লাগায় গরু পাচারকারীরা। পাটগাছের উচ্চতার কারণে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গরু নিয়ে পালালে চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে আলো ফেললেও ক্ষেতের মধ্যে থাকা গরুদের গতিবিধি বোঝা সম্ভব হয় না। অন্য স্থানে নজরদারি বাড়ানোয় এখন অধিকাংশ গরু পাচারের ঘটনা পাটের ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই হচ্ছে। বিএসএফের ডিজি ডি কে পাঠক বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই এলাকায় পাট চাষ হয়ে থাকে। তাই সীমান্ত এলাকায় পাট চাষ বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি।’’ বিএসএফ চাইছে, কেন্দ্র যেন বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করে পাটচাষিদের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করে দেয়।

আমি : তুই বোধহয় জানিস না, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে গরুকে সেটার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে শুধু মাথা জলের ওপরে ভেসে থাকে। আর এভাবেই গরুগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর জলে। গরু পাচারের অভিনব আর নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে গরুপাচারকারীরা। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান সীমান্ত লাগোয়া বীরভূমের বেশ কয়েক’টি জায়গা থেকে ফের পাচার শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ। সম্প্রতি মুরারই ২-এর বিডিও-র কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লিখিত অভিযোগের পেয়ে বিডিও কৃষ্ণকান্ত ঘোষ পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। পাচার রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীও। বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা-সীমান্তের অর্থনীতি চার পায়ে হাঁটে, বিধানসভা ভোটের আগে সেই তত্ত্বই বীরভূমে ফের স্বমহিমায়। এলাকাবাসীর মত, সীমান্ত এলাকায় পুলিশ-বিএসএফের যৌথ নজরদারির জেরে কয়েক মাস কিছুটা হলেও গরু পাচারে ভাটা পড়েছিল। তবে পাচার কখনই থেমে থাকেনি বলে অভিযোগ। ইদানীং সেটাই আড়ে-বহড়ে বাড়তে শুরু করেছে বলে মত এলাকাবাসীর। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলছেন, ‘‘মুরারই-মিত্রপুর রাস্তার উপর দিয়ে দিনের আলোয় গরু হাঁটিয়ে পার করানো হচ্ছে। পুলিশকে ফোনে সে সব জানানো সত্ত্বেও তৎপরতা নজরে আসেনি।

বন্ধুনি : কয়লা পাচার ?

আমি : খনি অঞ্চলে বেআইনি কয়লা খনন চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূলত তিন পদ্ধতিতে এই কয়লা চুরি চলে। প্রথমত, ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে অবৈধ খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইসিএলের বন্ধ বা চালু খোলা মুখ খনিতে গভীর সুড়ঙ্গ (স্মার্ট হোল) বানিয়ে কয়লা তোলা হয়। তৃতীয়ত, ইসিএলের কয়লা ডম্পার বা রেলের পরিবহণের সময়ে কয়লা নামিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠনের পরে ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা কমেছে। কিন্তু অন্য সব পদ্ধতিতে এখনও চুরি চলছে।বারাবনির জামগ্রাম, গৌরান্ডি, মদনপুর, সরিষাতলি এলাকাতেও অবৈধ কয়লার কারবার রমরম করে চলছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। যার জেরে মাঝে-মধ্যে ধসের ঘটনাও ঘটছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু উপাধ্যায় দাবি করেন, বামেদের সময় থেকে চলে আসা এই অবৈধ কারবার চলছে এখন কিছুটা রোধ করা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। পাপ্পু বলেন, “আমরা পুলিশের কাছে এই চুরি বন্ধের দাবি করেছি। তা না হলে এক দিন সবাই তলিয়ে যাব।” জামুড়িয়ার কাটাগড়িয়া জঙ্গল, পরিহারপুর ।

বন্ধুনি : পুলিশ ধরপাকড় করে না ?

আমি : আরে, গরু ও কয়লা পাচার কান্ডে এবার রাজ্যের ৬ পুলিশকর্মীকে নোটিস পাঠাল সিবিআই  । তাদের মধ্যে একজন ডিএসপি পদ মর্যাদার অফিসার ও রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে গরু পাচারকারী তদন্তের ডিআইজি সহ বিএসএফের ৪ অফিসারকে নোটিশ পাঠায় সিবিআই। যে চারজনকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ডিআইজি ছিলেন। উল্লেখ্য কয়েক মাস ধরেই কয়লা গরু পাচারকা কান্ডে তৎপর সিবিআই। দফায় দফায় সারা রাজ্য জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিবিআই । বর্তমানে কয়লা ও গরু পাচার নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। এ ভাবেই পাচার হচ্ছে কয়লা। বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর এলাকার বিভিন্ন খাদান থেকে সাইকেলে কয়লা চাপিয়ে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বীরভূমের ভীমগড় স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। তার পর ট্রেনে যাত্রীবাহী ট্রেনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাচারের কয়লা নামানো হয় বলে অভিযোগ। নিত্য দিন এমন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায় না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি ।

বন্ধুনি : এখন বারাবনি ও সালানপুরে কয়লা চুরির রমরমা সবচেয়ে বেশি। এর পরে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, কুলটি ও আসানসোলের কিছু এলাকায় চলছে এই চুরি। সালানপুরের বনজেমাহারি, সংগ্রামগড়, ডাবর কোলিয়ারি লাগোয়া এলাকায় খাদান গড়ে কয়লা তুলছে চোরেরা। বনজেমাহারি রেল সাইডিং থেকেও কয়লা চুরি যাচ্ছে। বারাবনির রসুনপুর এলাকা থেকেও চোরেরা কয়লা কাটছে। সাইকেল, গরুর গাড়ি বা মোটরবাইকে চাপিয়ে এই কয়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া অবৈধ ডিপোয়। রূপনারায়ণপুরের দেশবন্ধু পার্ক লাগোয়া এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, চোরেরা অবৈধ কয়লা পুড়িয়ে তা বস্তাবন্দি করে জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে। সেই কয়লা পোড়ানোর জেরে দূষণে তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন বলে ওই বাসিন্দাদের অভিযোগ। তাঁদের কথায়, “এই দূষণে শ্বাস নিতে পারি না। ঘরের দরজা-জানালা খোলা থাকলে হাঁফ ধরে যায়।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশকে অনেক বার বলেও কিছু হচ্ছে না।”

আমি : কয়লা পাচার-কাণ্ডে ধৃত ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ড লিমিটেড এর সাত জন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্তাকে পাঁচ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠাল আদালত। বৃহস্পতিবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী এই নির্দেশ দিয়েছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, বর্তমান ও প্রাক্তন মিলিয়ে কোলের এই সাত ইসিএল আধিকারিককে বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে ডেকে অনেক ক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁদের জবাবে অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান ইসিএল আধিকারিক এসসি মৈত্র। পাশাপাশি, ইসিএলের তিন প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত ব্যানার্জি, অভিজিৎ মল্লিক এবং তন্ময় দাস। তন্ময় দাস আগে ইসিএলের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন। এ ছাড়া ম্যানেজার নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন মুকেশ কুমার। নিরাপত্তা আধিকারিক রিঙ্কু বেহেরা ও দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।

বন্ধুনি : কয়লাগেট কেলেঙ্কারি কিন্তু কয়লা পাচার কেলেঙ্কারি থেকে আলাদা । কয়লাগেট কেলেঙ্কারিতে সরকারের ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল । কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।

আমি : গণধর্ষণ ? 

বন্ধুনি : ১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবায় একটি টীকাকরণ কর্মসূচি সেরে তিন জন স্বাস্থ্য আধিকারিকের একটি দল কলকাতায় ফিরছিলেন।এই দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত জেলা গণমাধ্যম বিভাগের উপ-আধিকারিক অনিতা দেওয়ান, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক উমা ঘোষ এবং ইউনিসেফের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন দিল্লি কার্যালয়ের প্রতিনিধি রেণু ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছে বানতলায় পৌঁছান তখন ৪-৫ জন যুবক স্থানীয় ক্লাবের কাছে তাদের গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। গাড়ির চালক অবনী নাইয়া তাদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালাতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি উলটে যায়। এই সময় আরও ১০-১২ জনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা গাড়ির একজন আধিকারিককে টেনে বার করে। আগের দলটি অন্য দুই আধিকারিককে বার করে। গাড়ির চালক তাদের বাধা দিতে যান, কিন্তু ব্যর্থ হন। দলটি গাড়ির চালককে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আধিকারিকদের কাছের একটি ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। একজন আধিকারিক তাদের বাধা দিতে যান। ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুলিশ গিয়ে আধিকারিকদের নগ্ন দেহ উদ্ধার করে। তাদের ক্যালকাটা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের আপদকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়ে। প্রথম দিকে তাদের মৃত মনে করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুজন বেঁচে ছিলেন। তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। একজন মহিলা ডাক্তার জনৈক আধিকারিকের যোনিতে একটি ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। আহত ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দেহে ভারী অস্থের ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।  আক্রমণকারীরা তার পুরুষাঙ্গটি পিষে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ জুন, সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। 

আমি : হাঁসখালি গণধর্ষণের কাণ্ড শুনেছিলাম ?

বন্ধুনি : হাঁসখালি গণধর্ষণ কাণ্ডে ধীরে ধীরে নিজেদের তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে শুরু করে দিলো সিবিআই। হাইকোর্ট দ্বারা তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পরই তাদের আসরে নামতে দেখা যায়। গতকাল হাঁসখালি কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা তথা তৃণমূল নেতা সমরেন্দ্র গোয়ালিকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন তাকে চার দিনের সিবিআই হেফাজতের রায় দিলে রানাঘাট মহকুমা আদালত। তবে এসকল বিষয়কেও ছাপিয়ে এদিন আদালতে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দাবি করল সিবিআই। হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ডে প্রথম থেকেই নিরুদ্দেশ ছিল মূল অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা সমরেন্দ্র গোয়ালি। তবে শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে সে। এরপর বেশ কয়েকবার সিবিআইয়ের তলবের মুখে পড়তে হয় তাকে এবং গতকাল তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এলাকার শক্তিশালী নেতা হওয়ায় মৃত্যুর পরপরই ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া ওই কিশোরীর দেহ সৎকার করা হয়। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য ধর্ষণকারীর বাবা কিশোরীর পরিবারকে মামলা না করার হুমকি দেন। ফলে ঘটনার পর চার দিন কিশোরীর বাবা কোনো কথা না বললেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চাইল্ড লাইনের সহযোগিতায় হাঁসখালি থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও গা ঢাকা দেন ধর্ষণকারীর বাবা সমরেন্দ্র গয়ালি ।

আমি : বর্ধমানের কালনায় গণধর্ষণের শিকার হলেন এক আদিবাসী গৃহবধূ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে গভীর রাতে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদলে ছিলেন এক মহিলাও। আক্রান্ত বধূকে হাসপাতালে ভর্তি করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে কালনা থানা সূত্রে। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘর থেকে কোনও কাজে বেরিয়েছিলেন মহিলা। আগে থেকেই বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। মহিলা বেরোতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। গলায় ছুরি ধরে মুখ বেঁঝে নিয়ে যায় নিরালা জায়গায়। সেখানে মহিলাকে একে একে ৩ জন ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের মধ্যে ছিলেন এক মহিলাও। তার সামনেই বধূকে ধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। মহিলা জানিয়েছেন, বেশ কিছুক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে রাতের অন্ধকারে কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। তবে চোখ বাঁধা থাকায় দুষ্কৃতীদের কাউকেই দেখতে পাননি। মহিলা বাড়ি ফিরলে তাঁকে কালনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিজনরা। খবর যায় থানায়। ঘটনায় গণধর্ষণের ধারায় অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। 

বন্ধুনি : নতুন ক্যামেরা দেখানোর নাম করে এক নাবালিকাকে ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল গাইঘাটায়। ধর্ষণে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক নাবালকের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেনি। এরপরই সেই নাবালিকার খোঁজে বের হয় তার পরিবারের লোকেরা। সেই নাবালিকার বাবা দাবি করেছেন, যে ঘরে এই ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে খুব জোরে গান চালানো ছিল মিউজিক সিস্টেমে। যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে। 

আমি : বাঞ্চোৎ বাঙালি ছোঁড়াগুলো কাউকেই ছাড়ে না !

বন্ধুনি : ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি আদিবাসী অধ্যুষিত বীরভুম জেলার লাভপুর থানা এলাকার মধ্যে সুবলপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এর আগে, ২০শে জানুয়ারি সালিশি সভার “তলবে” অত্যাচারিতা এবং তার প্রেমিককে ধরা হয় এবং সারা দিনরাত আটকে রাখা হয়, তাদের একটি গাছে বেঁধে লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর ক্যাঙ্গারু আদালত তাদের ৫০,০০০ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেয়েটি যখন জরিমানা দিতে অক্ষম হয়, তখন গণধর্ষনের আদেশ দেওয়া হয়।নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত নেতার নেতৃত্বে গ্রাম স্তরের স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান গ্রাম সভা সালিশি সভা নামে একটি ক্যাঙ্গারু আদালতের আয়োজন করেছিল । সালিশি সভার প্রধান সুনীল সোরেনও এই ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। 

আমি : এবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে । প্রমাণ লোপাটে ওই মহিলার গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা ৷ হাঁসখালিতে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই নামখানার এই ঘটনা রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ৷ নির্যাতিতা ওই মহিলা বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে নামখানা থানার পুলিশ

বন্ধুনি : অভিযুক্তরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানোয় বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার পুটিয়াকান্দির ১৭ বছরের এক কিশোরী ভারতে নিয়ে আসে। পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন দূর করতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা বাগদার হরিহরপুরে আসে সে। শরিফুল মল্লিক নামে এক যুবকে তাকে কাজ জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই কিশোরী।বাগদা পুলিশ বলছে, শরিফুল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধপথে ভারতে আসে ওই কিশোরী। সেখানে যাওয়ার পর ১৪ অক্টোবর  শরিফুল মল্লিক ও তার সঙ্গী মহসিন বিশ্বাস কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। গ্রামের বাসিন্দারা কিশোরীকে ধর্ষণের এই খবর থানায় পৌঁছে দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের এবং দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

আমি : মেয়ে পাচার ?

বন্ধুনি : জানা যায়, এই নিয়ে ১৫ বার বিয়ে করতে যাচ্ছিল অভিযুক্ত। এসিপি ইস্ট শুভেন্দ্র কুমার জানান , “রাহুল সরকার ওরফে রাজু ওরফে সফিয়ুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক থানায় অভিযোগ রয়েছে। মূলত ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। শিলিগুড়ি থানা, ভক্তিনগর থানা, মেটেলি ও হলদিবাড়ি থানাতেও অভিযোগ রয়েছে। মূলত প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে মেয়েদের পাচার করত সে। জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনজন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে। পুলিশের অনুমান এই ঘটনার পেছনে বড় কোনও পাচার চক্র জড়িত। 

আমি : কন্যা ভ্রূণ বা কন্যাশিশু হত্যার কারণে পাঁচ কোটি মেয়ে ভারত থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে, যেখানে বহু পুরুষ বিয়ে করার মতো মহিলাই পাচ্ছেন না – আর তার জেরে সারা দেশ জুড়ে জন্ম হচ্ছে সংগঠিত নারী-পাচার চক্রের। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার সুযোগে বিয়ে করেন ৭৫টি, বিয়েকে হাতিয়ার করে পাচার করেন ২০০জন নারীকে৷ কেউ আবার পাচার করেন কিশোরীর টিকটক তারকা হবার স্বপ্নকে ভাঙিয়ে৷ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য‌ এবং গোটা ভারতের মধ্য‌ে সংযোগের কাজ করে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য‌ের ১৯টি জেলা রয়েছে এবং ২৩টি শহর রয়েছে যার জনসংখ্য‌া এক লক্ষেরও বেশি। সব চেয়ে বড় শহরগুলি হল, কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও হাওড়া — এই শহরগুলি পাচার হয়ে যাওয়ার বড় কেন্দ্র। এই শহরগুলিতে বেশ কয়েকটি পরিচিত ‘লালবাতি’ এলাকা রয়েছে যেখানে দেহ ব্য‌বসার কথা সুবিদিত। অন্য‌ দিকে রাজ্য‌ের গ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলে দারিদ্র, শোষণ ও বঞ্চনা এখনও রয়ে গিয়েছে। সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য‌ রয়েছে, রয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার বাতাবরণও। এই দারিদ্রপীড়িত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে জীবনধারনের জন্য‌ স্থায়ী রোজগারের ব্য‌বস্থা নেই, তা পাচারকারীদের শিকার ধরার আদর্শ জায়গা। এই রাজ্য‌ের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের আন্তজার্তিক সীমানা রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ও ভঙ্গুর অবস্থানের জন্য‌ এ রাজ্য‌ শুধু আন্তর্রাজ্য‌ পাচার নয় বরং আন্তর্জাতিক পাচারের উল্লেখযোগ্য‌ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত। এক দিনে এই পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অঞ্চল চিহ্নিত করে তাদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাদের পাল্টা নেটওয়ার্কের মোকাবিলা করা খুবই দুষ্কর।

বন্ধুনি : চোলাই ?

আমি : চোলাই মদ মূলত ইথাইল অ্যালকোহল। আবগারি দফতর ও চোলাইয়ের কারখানাগুলির থেকেই জানা গিয়েছে, মদের আকর্ষণ বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পিরিডিন জাতীয় জৈব খার, মিথানল, ইউরিয়া এমনকী কীটনাশক বিষও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজকাল। তাতে চোলাই খাওয়ার পর অল্প সময়েই নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। নেশার বহর বা়ড়তেই বেড়ে চলেছে খদ্দেরও সংখ্যাও। কিন্তু দিনের পর দিন বিষাক্ত এই মদের জেরে শরীরে থাবা বসাচ্ছে নানা মারণ রোগ। নষ্ট হচ্ছে চোখ। এমনকী অনেক সময়ই নেমে আসছে মৃত্যু। চোলাইয়ের শিকার যাঁরা, তাঁরা অনেকেই এ সব জানেন। তবু ছাড়তে পারেন না। অনেকে আবার এ সব জানেনও না। দিনের পর দিন নেশার বিষ শরীরে ঢুকে চলেছে সামান্য সুখানুভবের হাত ধরে।গৃহস্থ বাড়ির মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতেই চোলাই তৈরি হয়। গ্রামে নানা পদ্ধতিতে তৈরি হয় চোলাই। আগে নিম্নমানের চাল দিয়ে ভাত তৈরি করে নেওয়া হয়। তারপর তাতে বাখড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাখড় হল এক ধরনের মিষ্টি যা মূলত চোলাইয়ে ইস্ট-এর কাজ করে। অর্থাৎ চটজলদি ভাত পচাতে সাহায্য করে। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে। এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল। কেউ কেউ আবার পচা ভাতের বদলে চিটে গুড় বা চিনির গাদার সঙ্গে বাখড় মিশিয়ে তৈরি করেন চোলাই। এখন নেশার বহর বাড়িয়ে এই মদের খদ্দের বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রাসয়নিক দ্রব্য। ইউরিয়া, পিরিডিন থেকে মিথানল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বন্ধুনি : ধৃতদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিলিতি ব্র্যান্ড মদের স্টিকার লাগানো বোতল ও ৩২ লিটার নকল মদ উদ্ধার করেছে আবগারি দফতর। এ ছাড়া, মিলেছে মদ তৈরির উপকরণও। জেলা আবগারি দফতরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট শম্ভু রায় বলেন, “ধৃতেরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলিতি মদের বোতল জোগাড় করে তাতে নতুন করে ওই কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে নকল মদ ভরে বিক্রি করত। এই মদ খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, তা দেখা হচ্ছে। আবগারি দফতরের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছেন, রাহুল ও তাঁর বাবা নিজের বাড়িতে ওই নকল মদ বানাতেন। বিলিতি মদের খালি বোতল জোগাড় করতেন। বিভিন্ন মদের ব্র্যান্ডের নকল স্টিকার ও হলোগ্রামও মজুত ছিল তাঁদের কাছে। নকল মদ বানিয়ে পুরনো বোতলে নতুন করে ভরে নকল স্টিকার ও হলোগ্রাম বোতলে লাগিয়ে দেওয়া হত। লক্ষ্মণ তাঁদের বানানো মদ বিভিন্ন ধাবা ও দোকানে বিক্রি করতেন। বাঁকুড়ার ধলডাঙায় গোপাল বাঙালের একটি ধাবা রয়েছে। ওই ধাবাতেও এই নকল মদ বিক্রি হত। আবগারি দফতরের এক কর্তা জানান, এই কারবারের খবর গোপন সূত্রে পেয়ে প্রথমে লক্ষ্মণকে আটক করে জেরা করতেই তিনি সব ফাঁস করে দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ধরপাকড়ে নামে আবগারি দফতর। প্রথমে রাহুলের বাড়িতে অভিযান চলে। সেখানে নকল মদ, মদ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৩০ লিটার স্পিরিট, দুই লিটার ক্যারামেল-সহ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার হয়। পাশাপাশি প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন বিলিতি মদের ব্র্যান্ডের স্টিকার ও নকল হলোগ্রাম এবং বহু পুরনো মদের খালি বোতল পান আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা। উদ্ধার হয়েছে বেশ কয়েক বোতল দিশি মদও। 

আমি : পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অধ্যাপকের বেশে রাজনৈতিক দালালরা ছাত্রভর্তিতে তোলাবাজি,পরীক্ষায় পাশ করানোর নামে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া,ছাত্রীদের হেনস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বামপন্থী-তৃণমূলী বুদ্ধিজীবীরা। শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ কাঞ্জিলাল ছাত্রীকে পরীক্ষায় পাশ করাতে দশ হাজার টাকা চাইছেন,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অংশুমান কর একাধিক ছাত্রীকে হেনস্থা করছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফিডেন্সিয়াল একাউন্ট এর টাকা নয়ছয়ের পরেও দিলীপ সরকারের মতো ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার পদে পুনর্বহাল হচ্ছেন।

বন্ধুনি : ভিন রাজ্য থেকে বিভিন্ন পন্য বাংলাদেশে আমদানি- রপ্তানি হয় বসিরহাটের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে। ইট, বালি, পাথর, ফল, ফুল, সবজি, তেল বিভিন্ন কাঁচামাল যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকেও এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে যায় বিভিন্ন পন্য। এই যাতায়াতের পথে বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে থাকেন পণ্যবাহী ট্রাক চালকরা। টোল ট্যাক্স বা পৌরকরের মতো বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে যাতায়াত করতে হয় ট্রাক গুলোকে। কিন্তু ট্রাক চালক ও খালাসিদের অভিযোগ, ‘বিভিন্ন নিয়মী কর ছাড়াও নতুন করে কর ধার্য করা হয়েছে এই আমদানি রপ্তানির ট্রাকগুলোর উপর। সেখানে বসিরহাট ব্রিজ থেকে ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার অব্দি যেতে একটা অংকের টাকা দিতে হয় ট্রাক গুলিকে। তার কোনোটিতে লেখা ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’, কোনোটিতে ‘কর্মহীন শ্রমিক বাঁচাও কমিটি’ কোনোটি ‘বর্ডার গাইড’। এই রকম বিভিন্ন নামে বিল ছাপিয়ে ট্রাক গুলির উপর থেকে কর আদায় করে বেশ কয়েকটি ছেলে। মূলত বসিরহাট থেকে ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে কল বাড়ি, কালীবাড়ি মোড় এইসব অঞ্চলগুলোতে বাঁশ ফেলে ট্রাক আটকানো হয়। এরপর ট্রাকচালকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি বিল। যদি টাকা না দেওয়া হয় তাহলে ট্রাক যেতে দেওয়া হয় না। ট্রাক চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয় বলে জানান ট্রাক চালক সুরিন্দর সিং। তবে স্থানীয় ট্রাক গুলোর ক্ষেত্রে মাসোহারার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য একটি পরিচয় পত্রের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। সারা বাংলা ট্রাক মালিকদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষ জানান, ‘এই সবটাই হয় স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থনে। পুলিশই জুলুম করে টাকা নেয়। এটা সীমান্তে আসা ট্রাক গুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ট্রাক ড্রাইভাররা বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। আমরা একাধিক অভিযোগ করে ফল পায়নি। তাই আজ ধর্মঘটের পথে।’ সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক পিছু ভিন্ন ভিন্ন মূল্য ধার্য করা রয়েছে। খালি ট্রাক গেলে ২০০ টাকা, পাথর বোঝাই গাড়ি ১৩০০ টাকা, আলু, পটল, পেঁয়াজের মতো আনাজ বা সবজির গাড়ি পিছু ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। আরও জানা গিয়েছে, প্রত্যেকদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০টির বেশি পণ্যবাহী গাড়ি এখান দিয়ে যাতায়াত করে। তাহলে যদি প্রত্যেক গাড়ি থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ বা ১৫০০ করে টাকা নেওয়া হয় তাহলে দিনে কয়েক লক্ষ টাকা উঠছে। মাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে সিন্ডিকেট। তবে সিন্ডিকেটের দাবি, ‘এই টাকার একটা অংশ ভোগ করছে সিন্ডিকেট। অন্য অংশ যায় পার্টির ফাণ্ডে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নেতা জানান, ‘বছর খনেক আগে থেকে গরু পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই নতুন ব্যবসা চালু হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে বসিরহাটেরই এক শীর্ষ নেতা। যার অঙ্গুলি হেলনেই হয় সমস্ত কিছু। দীর্ঘদিন ধরে বসিরহাটে গরু পাচারের হোতা ছিলেন তিনি। গরু বন্ধ হতেই এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সাম্প্রতিক এক বস্তা সোনার বার সমেত ধরাও পড়েছিলেন তিনি। সোনা ছাড়াও প্রশাসনের নাকের ডগায় ভিন্ন বেআইনি কারবার চালিয়ে আসছেন তিনি।’ তবে এনিয়ে প্রশাসনের কাছে কোনও অভিযোগই নেই বলে জানান বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার। তবে তদন্ত করে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এনিয়ে রা বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু এই ঘটনাকে তোলাবাজির লেটেস্ট নিদর্শন বলে আক্ষা দিয়েছেন। তার কথায়, ‘এর আগেও সিপিএম তোলাবাজি করত তবে সেটা আন-রেজিস্টার ছিল। এখন এটা স্বীকৃত তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজে পরিণত হয়েছে।’ 

আমি : পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ড ?

বন্ধুনি : ২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ প্রথমে মহিলার অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে । সংবাদমাধ্যমের চাপে শেষপর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করে পার্কস্ট্রিট থানা। সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় মহিলা সঠিক অভিযোগ করছেন না। এরপর তৎকালীন পুলিস কমিশনারও মহিলার বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। তৎকালীন পুলিসকমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সাংবাদিকদের বলেন, `নাথিং হ্যাপেনড`। তদন্তের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘটনাটিকে সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন।পরে অবশ্য গোয়েন্দারা ধর্ষণের প্রমাণ পান, কিন্তু তারপরেই সরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা প্রধানকে।আদালতে ধৃতদের যে চার্জ পড়ে শোনানো হয়, তাতে তিন অভিযুক্ত – সুমিত বাজাজ, রুমন খান ও নাসির খান – সবার বিরুদ্ধেই গণধর্ষণ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে মারধর ও হুমকির অভিযোগও রয়েছে ।মূল অভিযুক্ত কাদের খান এবং আরও একজন এখনও ফেরার রয়েছে।

আমি : পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাব থেকে ওই মহিলাকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্তরা তার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি, তাদের গাড়ি থেকে পাওয়া ধর্ষণের প্রমাণ, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ । অন্যান্য শহরে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের কথা শোনা গেলেও কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে রাজপথে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি গাড়িতে গণধর্ষন করা হচ্ছে, পুলিশের নজরে পড়ছে না, আবার ভোররাতে একটা থানার কাছেই গাড়ি থেকে ধর্ষিতাকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে– এটা একটা বিরল ঘটনা । তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলে দেন যে সরকারের বেকায়দায় ফেলার জন্য ঘটনাটা সাজানো হয়েছে । পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও প্রায় একই বয়ান দেওয়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, তখনই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রাথমিক তদন্তে গণধর্ষনের প্রমাণ পাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী যেটাকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, সেটাকে গণধর্ষণ বলে দেওয়াতে কয়েকদিনের মধ্যেই কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বদলি করা হয় কলকাতার প্রথম মহিলা গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’ মন্তব্যের পরে কয়েকজন রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই মহিলা যৌনকর্মী কী না – সেই ইঙ্গিতবাহী প্রশ্ন করেছিলেন। কংগ্রেসের এক মহিলা সাংসদ আবার সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা কোনও ধর্ষণ নয়, ওই মহিলা আর তাঁর ক্লায়েন্টদের মধ্যে দরদাম নিয়ে অশান্তি করেছিলেন ।  এই মামলায় সরকারের দায়সারা মনোভাবের জন্য সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ।

বন্ধুনি : সাড়ে চার বছরের বেশি পালিয়ে পালিয়ে থেকেও লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত পুলিসের জালে ধরা পরে গেল পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও তাঁর সঙ্গী আলি। কিন্তু কীভাবে পুলিস দুজনের খোঁজ পেল? গতমাসে পুলিস জানতে পারে বিহার-নেপাল সীমান্তের গ্রামে রয়েছে । কাদেরের পরিবারের সদস্যদের উপর নজর রাখতে শুরু করে পুলিস। তাঁদের ফোন ট্র্যাক করে পুলিস।  দেখা যায় দিল্লির একাধিক নম্বর থেকে ফোন আসছে কাদেরের বাড়িতে।বিভিন্ন মাধ্যমে দিল্লিতে টাকাও পাঠাচ্ছেন কাদেরের পরিবারের সদস্যরা। পুলিস নিশ্চিত হয় দিল্লি বা সংলগ্ন এলাকাতেই লুকিয়ে আছে কাদের আর আলি। একাধিক ফোন নম্বর ব্যবহার বাড়িতে যোগাযোগ করছে। এরপরেই গাজিয়াবাদে কাদের আর আলির ডেরার খোঁজ মেলে। সেখান থেকেই দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিস।

আমি : মানে কী ধরণের অসৎ মানুষ নেই যারা পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ; একেবারে ওপর থেকে নিচেতলা পর্যন্ত । পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত পরিবর্তনের সরকারের এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্নীতির কেলেঙ্কারির খবরে সাধারণ মানুষ দিশেহারা ; আবার এই সাধারণ মানুষদের কারণেই ঘটেছে ঘটছে ঘটেছিল নানা রকম কেলেঙ্কারি। বছরের পর বছর ধরে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের রাজনীতিবিদদের বালি, কয়লা আর গরু চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রথম দিকে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। বিভিন্ন উপায়ে চাঁদা তোলাকেও স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে—এটা নিয়ে  কেউ বিশেষ কথা বলে না । “কাট-মানি” – নামের  ঘুষ,  এই অনন্য শব্দ  এখন বাংলা অভিধানে ঢুকে পড়েছে। 

.

বন্ধুনি :  ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) আশানুরূপ কাজ না করার পরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে তার দলের সদস্যদের নাগরিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কাট-মানি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষায় দুর্নীতি কাট-মানির পাহাড় ডিঙিয়ে দূর্নীতির অন্য পারে চলে গেছে।আমরা এটাও মেনে নিই যে আমাদের অনেক রাজনীতিবিদই দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা উত্তেজিত হই – বা মেজাজ খারাপ করি কিন্তু আমাদের মতন নিম্ন-মধ্যবিত্তের  মানদন্ড প্রয়োগ করেও পশ্চিমবঙ্গের হাল আমলের  দুর্নীতি পিলে চমকে দেবার মতন। আর সাধারণ বাঙালি এখন ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ-বিরক্ত কারণ ব্যাপারটা ঘটেছে-ঘটছে-ঘটেছিল শিক্ষার ক্ষত্রে ।

.

আমি : এটা এখন কমবেশি প্রমাণিত যে, সরকার গত ১০ বছরে সরকারি স্কুলে হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ করেছে মেধার ভিত্তিতে নয়, নগদ টাকা নিয়ে, আর আমরা টিভিতে দেখেছি একজনের টাকার গোলাপি-সবুজ পাহাড়। আবেদনকারীরা পোস্টগুলোর জন্য যে বাধ্যতামূলক পরীক্ষা দিয়েছিল তার প্রকৃত ফলাফল গোলমাল করে দেয়া হয়েছিল ।  এমনকি যারা ফাঁকা উত্তরপত্র জমা দিয়েছিল তাদেরও চাকরি দেওয়া হয়েছিল –৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ক্যাশ টাকা নিয়ে, কতো টাকা দিতে হবে-হয়েছে তা  প্রাথমিক ,মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে বিদ্যালয়ের চাকরির  উপর নির্ভর করে।

বন্ধুনি : হাটে হাঁড়ি ভাঙার জন্য বেশিরভাগ কৃতিত্ব কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের, যিনি উদ্যোগ এবং সাহসের সাথে ব্যাপারটা অনুসরণ করেছিলেন এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে ডেকেছিলেন। পচা আশ্চর্যজনকভাবে গভীর এবং আশ্চর্যজনকভাবে উঁচুতে যায়। রাজ্য স্কুল বোর্ডের শীর্ষ সদস্যদের অনেকেই এখন কারাগারে, বিচারের অপেক্ষায়। এছাড়াও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী; কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি তার “ঘনিষ্ঠ বন্ধু” অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে 50 কোটি টাকারও বেশি নগদ এবং গয়না জব্দ করেছে।

আমি : পঞ্চাশ কোটি টাকা আসলে জিনিসের মাপকাঠিতে খুব সামান্য পরিমাণ। অল্প সময়ের টিএমসি রাজনীতিবিদদের যাদের কথা তাদের আশেপাশের বাইরের কেউ শুনেনি তারা সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির সাথে তিরিশ-চল্লিশ কোটি টাকা অবৈধ অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। দল ও সরকারের সিনিয়র ব্যক্তিরা কতটা বড় হয়ে উঠতে পারে, তা কেউই ভাবতে পারবেন না। কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্কুলশিক্ষকের নিয়োগকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে এবং এমনকি এই নিয়োগকারীদের এখন পর্যন্ত তাদের অর্জিত বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

বন্ধুনি : এখানে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে এবং প্যান্ডোরার বাক্সটি সম্ভবত মাত্র একটু খোলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এবং দেখাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মৌলিক পাটিগণিত করতে পারে না। তারা বলতে পারে না, ব্ল্যাকবোর্ডে ১১-র সঙ্গে ২৬ যোগ করলে কতো হয় । এই মূর্খরা যাদের শিক্ষা দিচ্ছে তাদের ভাগ্য কি হবে?

আমি : পড়েছি কাগজে ।

বন্ধুনি :  এই লোকেরা কি  শিক্ষকতাও করে, অর্থাৎ যে কাজগুলির জন্য তারা মোটা  বেতন পায় ?  স্কুল শিক্ষকের একটা সুরক্ষিত সরকারী বেতন রয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে তিনি যখন খুশি কাজ করতে যেতে পারেন এবং পাশাপাশি একটি ব্যবসা বা চাঁদাবাজির র‌্যাকেট চালাতে পারেন। এটি এখন জানা গেছে যে বর্তমানে কারাগারে থাকা টিএমসি নেতার মেয়ে একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন, কখনও কাজে যাননি, এবং তাঁর উপস্থিতি রেজিস্টার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হতো।

আমি : পড়েছি কাগজে ।

বন্ধুনি : প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর কোনো না কোনো ধরনের প্রত্যাশা থাকে যে সে তার বিনিয়োগ থেকে লাভ করবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যদি হাজার হাজার মানুষ তাদের বাবা-মায়েরা তাদের সঞ্চয়ের সব কিছু বাজি ধরে থাকে, তাহলে এটা স্পষ্ট যে তারা বিশ্বাস করে এটা একটি সার্থক বিনিয়োগ। যেমন ধরুন, পুরুষ স্কুল শিক্ষক অনেক বেশি যৌতুক চাইতে পারেন। তিনি আনন্দের সাথে একটি পিরামিড স্কিমের অংশ হয়ে উঠবেন যেখানে তিনি অন্য লোকেদের কাজের জন্য সুপারিশ করেন এবং কাট-মানি নেন। প্রকৃতপক্ষে, ঘুষের জন্য একটি চমৎকার তহবিল নেটওয়ার্কও আছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি ঘুষ প্রদানের জন্য একটি উচ্চ-সুদে ঋণ পেতে পারেন, চাকরি পেতে পারেন এবং তারপরে তা পরিশোধ করতে আপনার রাজস্ব স্ট্রীম তৈরি করতে পারেন। এই সমস্তই চরম চূড়ান্ততার একটি স্ব-চিরস্থায়ী প্রক্রিয়াকে ট্রিগার করে যার কোন শেষ থাকতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী যে কেউ তাদের সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠানোর উপায় নেই, তাদের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আমি : তার চেয়েও বড় কথা, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে দুর্নীতি শুধু স্কুল শিক্ষার জায়গাতেই সীমাবদ্ধ । কয়েকদিন আগে, রাজ্যের ষাটটি পৌরসভার দ্বারা অন্তত ৫০০০ লোককে অবৈধভাবে নিয়োগ করার অভিযোগে একজন  টিএমসি রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এটা খুবই সম্ভব যে প্রতিটি বিভাগে সরকারি চাকরি বিক্রি হয় । একজন লোক যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে ইচ্ছুক হন, তাহলে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য আপনি কত টাকা দিতে পারেন? একজন কনস্টেবলের চাকরির জন্য বিনিয়োগের সম্ভাব্য রিটার্ন একজন স্কুল শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি। একজনকে যা করতে হবে তা হল এলোমেলো নিরপরাধদের হয়রানি করা, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া এবং ক্ষমতায় থাকা দলের সদস্য ও সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত প্রকৃত অপরাধের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ক্রিমিনালদের বাঁচানো।

বন্ধুনি : এমন একটি সমাজের কথা ভাবুন যেখানে আপনি আপনার সন্তানদের যে স্কুলে পাঠান, সেই স্কুলের শিক্ষকরা, আপনি অসুস্থ হলে যেসব সরকারি হাসপাতালে যান, সেই নার্সরা, যে পুলিশ আপনাকে রক্ষা করার কথা, ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা যাদেরকে আপনি যা কিছু বাঁচাতে ডাকেন তারা, আপনার আমার আত্মীয় । অথচ সবাই ঘুষের মাধ্যমে  চাকরি পেয়েছে আর এমন একটা সিস্টেমের প্রচার করছে যাতে  যোগ্যতার  কোনও গুরুত্ব নেই। পশ্চিমবঙ্গ হয়তো ডিস্টোপিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমি : মানস দাসের ‘বাংলাদেশ ওয়র’ পড়েছিস ? উনি লিখেছেন যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুর্শিদাবাদের জোতদার আর পয়সাঅলারা তাদের ছাদে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েছিল ।

বন্ধুনি : হ্যাঁ, অনেকে ইন্দিরা গান্ধীর শাপশাপান্ত করেছিল জানি । ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভার ফখরুদ্দিন আলি আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল । তাছাড়া মইনুল হক চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, জয়নাল আবেদিন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, গোলাম ইয়েজদানি ওরা খোলাখুলিভাবে বিরোধিতা করেছিল । মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করেছিল ।

আমি : আসলে অনেকের আত্মীয়স্বজন পাকিস্তানের উঁচু পদে চাকরি করতো, এখনও করে ।

বন্ধুনি : এও তো একধরণের দূর্নীতি । মানে, নৈতিক দায়-দায়িত্ববোধ ছিল না লোকগুলোর । কেন জানেন ? সাধারণ অর্থে যে কোন ‘নীতি-বিগর্হিত কর্ম’কেই দুর্নীতি বলা হয়। এক্ষেত্রে ‘নীতি’ শব্দের অর্থ নিছক ‘Policy’ নয়। নীতি হল ‘ethics’, অর্থাৎ এমন এক ‘সদর্থক মূল্যবোধ’, একমাত্র বিবেকের কাছেই যা দায়বদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এই ‘বিবেকনির্ভর মূল্যবোধ’ সমাজকে ধারণ করছে আর সেই কারণেই একে ‘ধর্ম’ বলা চলে। আর এখানেই ‘অপরাধ’ মানে Crime ও ‘দুর্নীতি’র মানে Corruption-এর  মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভেদ চোখে পড়ে। অপরাধ আইনের শাসনকে লঙ্ঘন করে আর আইনের সাহায্য নিয়েই আদালত অপরাধীকে দণ্ড দেয়। কিন্তু দুর্নীতি সরাসরি আইনের বিরোধীতা করে না। সেটি ব্যাধির মত নিঃশব্দে আইনের নজর এড়িয়ে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আর সমাজের নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। এই প্রক্রিয়া এত মন্থর গতিতে অগ্রসর হয় যে অনেকসময় বাইরে থেকে সেটাকে অনুভব করা যায় না।

আমি : কালো টাকা ? 

বন্ধুনি : ভারতে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থকে কালো টাকা বলা হয় কালো টাকাও এমন যেটির ওপর কর আরোপ করা হয়নি । বিদেশী ব্যাঙ্কগুলিতে ভারতীয়দের দ্বারা গোপনে জমা করা অর্থের কোনও নির্দিষ্ট জ্ঞান নেই , তবে মিঃ আর. বৈদ্যনাথন অনুমান করেছেন যে এর পরিমাণ প্রায়  ৭,২৮০,০০০ কোটি টাকা।

আমি : দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য লোকপাল-লোকায়ুক্ত  হয়েছিল । তাদের সম্পর্কে তো কিছু শুনি না ।

বন্ধুনি : ২০১৩ সালের লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইনে রাষ্ট্রপতির সম্মতিদানের পাঁচ বছর পর একজনের নাম চূড়ান্ত হল। ব্যাপারটা এখনও ঝুলে আছে । একবার দেখে নেওয়া যাক বাকি লোকপালদের কীভাবে বাছাই করা হবে এবং তাঁরা কীভাবে কাজ করবেন । সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ”দেখা যাচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীর, মণিপুর, মোঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, পুডুচ্চেরি, তামিল নাড়ু, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা, পশ্চিম বঙ্গ এবং অরুণাচল প্রদেশ লোকায়ুক্ত/ উপ লোকায়ুক্ত নিয়োগ করেনি।

আমি : দুর্নীতির খবর ছাপার ফলে সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছে । খুনও হয়েছে অনেকে ।

বন্ধুনি : ২০২২ সালে গোটা ভারতে মোট ১৯৪ জন সাংবাদিককে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করা হয়েছে যার মধ্যে ৭ জন মহিলা সাংবাদিকও রয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৮ জন । বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এজেন্সি, রাজনৈতিক নেতা, কুখ্যাত অপরাধী ও সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীদের দ্বারা এই সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। কখনও এফআইআর দায়ের, কখনও পুলিশ দিয়ে সমন পাঠিয়ে, কখনও দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশনে আটক করে, কখনও গ্রেফতার করে, আবার কখনও সরাসরি শারীরিক হামলা করে বা প্রাণঘাতী হামলার হুমকি দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমি : আচ্ছা, মহাভারতে আছে,  জরাসন্ধের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণ জরাসন্ধকে হত্যা করার জন্য ভীম আর অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে জরাসন্ধের কাছে গিয়েছিলেন।  তিনজনই ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ছিলেন। জরাসন্ধ এই তিনজনের হাতে অস্ত্রব্যবহারের চিহ্ন দেখে প্রকৃত পরিচয় জানতে চাইলে, কৃষ্ণ তাঁদের প্রকৃত পরিচয় দেন। এরপর জরাসন্ধের সাথে ভীমের মল্লযুদ্ধ হয়। ভীম অনেক বার জরাসন্ধকে পরাজিত করেন , কিন্তু প্রতিবার জরাসন্ধ বেঁচে উঠে দাড়ান । এরপর কৃষ্ণের ইশারায় ভীম বিচ্ছিন্ন হওয়া দেহকে মিলিত হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করলে জরাসন্ধ মারা যায় । সেটা কি দুর্নীতি নয় ?

বন্ধুনি : ওই ভাবে খুঁজলে মহাভারতে প্রচুর দুর্নীতি পাবেন । বলাই হয়, যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে ।

দুই

ব্রিটিশদের আগমনের আগে এদেশে এত নৈরাজ্য আর কখনো ছিল না। ভারতের কোথাও সাধারণত দুর্নীতি ও দারিদ্র্য দেখা যায়নি। যদি বলা হয় দারিদ্র্য, সাধারণ রাজনীতি ও প্রশাসনিক দুর্নীতি ব্রিটিশদের দান, তাহলে তাতে অত্যুক্তি হবে না । ব্রিটিশরা ভারতে এলে তারা ভারতকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যশালী দেখতে পায়। এমন একটি দেশে ব্রিটিশরা প্রতারণা, অনৈতিকতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যগুলি দখল করে, অমানবিক কর আরোপ করে, কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য ও অনাহারের গর্তে ঠেলে দেয় এবং ভারতের সমস্ত সম্পদ ও জাঁকজমক লুট করে ব্রিটেনকে ধনী করে। তারা মাদ্রাজ, কলকাতা এবং বোম্বেতে হিন্দু শাসকদের কাছ থেকে বাণিজ্য পদ ভাড়া করে এবং অনুমতি ছাড়াই সেখানে তাদের কামান ও সৈন্য মোতায়েন করে। ১৭৫৬ সালে, যখন বাংলার নবাব এমন আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং ব্রিটিশ দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ ও দখল করেন , তার এক বছর পরে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধে অংশ নেন।আমি বাংলাকে পরাজিত করে দখল করি এবং এক নবাবের সাথে আরেক নবাবের যুদ্ধ করে লুটপাট শুরু করি। মাত্র এক বছরে ক্লাইভ ১১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঘুষ নিয়ে বার্ষিক ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার চাঁদা নিতে শুরু করেন। তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু ব্রিটেনে চাকরির বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করা হয়। উইল ডুরা লিখেছেন, ভারত থেকে ২০ লাখ টাকার পণ্য কেনা হয় এবং ব্রিটেনে এক কোটি টাকায় বিক্রি হয়। ব্রিটিশরা আওধের নবাবকে তার মা ও দাদীর ধন লুট করে ব্রিটিশদের 5 মিলিয়ন ডলার দিতে বাধ্য করে, তারপর এটি দখল করে এবং 2.5 মিলিয়ন ডলারে অন্য নবাবের কাছে বিক্রি করে।

নবাবের বিরুদ্ধে মির্জাফরসহ জগৎশেঠের গোপন ষড়যন্ত্রে অমিচাঁদেরও বড় হাত ছিল । পরে যখন ক্লাইভের সঙ্গে মির্জাফরযখন চুক্তির আলোচনা চলছিল, তখন অমিচাঁদ ব্রিটিশদের হুমকি দেন যে সিরাজ-উদ-দৌলার পদত্যাগের পর প্রাপ্ত রাজকোষের পাঁচ শতাংশ তাকে না দিলে তিনি নবাবের কাছে সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করবেন। অমিচাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য দুটি চুক্তি প্রস্তুত করা হয়েছিল। একটি জাল, যেখানে অমিচাঁদকে পাঁচ শতাংশ শেয়ার রাখার জন্য গৃহীত হয়েছিল; দ্বিতীয় মূল, যেখানে এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন জাল চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। তারপর ক্লাইভ তাতে ওয়াটসনের স্বাক্ষর নকল করলেন, অমিচাঁদকে জাল চুক্তি দেখালেন, তাকে বোঝালেন। সমসাময়িক ইতিহাসবিদ ওরমি বলেছেন যে সিরাজ-উদ-দৌলার পদত্যাগের পর, যখন অমিচাঁদকে আসল পরিস্থিতি বলা হয়েছিল, তখন এই আঘাতের কারণে তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পরে তিনি মারা যান। কিন্তু, ঐতিহাসিক বেভারিজের মতে, তিনি আরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন, যার প্রমাণ হল তিনি ফাউন্ডলিং হাসপাতালে দুই হাজার পাউন্ড দান করেছিলেন, যার সাহায্য ‘কলকাতার কালো ব্যবসায়ী’ দেওয়ালে গৃহীত হয়েছে। তিনি লন্ডনের ম্যাগডালেন হাসপাতালেও অনুদান দিয়েছেন।

প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত, উৎকোচ  আর দুর্নীতি মানবসমাজকে চারিদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আর এখনও সমসাময়িক পৃধিবীর জটিল   সমস্যা। দ্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে, দুর্নীতি হলো “ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা অসৎ বা প্রতারণামূলক আচরণ, সাধারণত ঘুষের সাথে জড়িত” ।  এই শব্দটা  এসেছে  লাতিন corruptus থেকে, যার মানে “মানুষকে কলুষিত করা  এবং ধ্বংস করা ।”   যেহেতু বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এটা এমন এক সমস্যা,  যা সমাধান করা অসম্ভব হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির মাত্রা অনুমান করা কঠিন, কারণ এই ধান্দাবাজি বেশ লুকিয়ে করা হয়। সমস্যাটা বিভিন্ন চিন্তকের দ্বারা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আর এর কোনও মান্যতাপ্রাপ্ত সংজ্ঞা নেই। ঘুষ আর দুর্নীতি   ব্যক্তিগত লাভের জন্য সাধারণত সরকারি  অফিসে হয়, যদিও বেসরকারি স্তরে আয় করার জন্যও হয়, ভয় দেখিয়ে, যেমন, কারোর বিরুদ্ধে গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা তোলা ।  অসৎ আচরণের সর্বজনীন নিন্দা সত্ত্বেও দুর্নীতি একটা সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়;-এর দ্বিতীয় ভাগে বালক-বালিকারা জেনে যায় অসততা কাকে বলে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারী কর্তৃত্বের অপব্যবহার হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

অপরাধ ও দুর্নীতির এই প্রভেদ সম্পর্কে প্রাচীন ভারতের মানুষ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে অপরাধ ‘ধর্মনাশ’ করে কিন্তু দুর্নীতির ফলে ধর্মের ‘গ্লানি’ ঘটে। প্ৰাচীন ভারতের ঐতিহাসিক আয়ুর্বেদগ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’য় ‘গ্লানি’ শব্দটিকে ‘বিকৃতি’ অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘ধাতুবৈকল্য’ অর্থাৎ ‘বায়ু’, ‘পিত্ত’, ‘কফ’ প্রভৃতির বিকার থেকে দেহে যে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, একথাও সেখানে বলা হয়েছে। অতএব এই মন্তব্যের সূত্র ধরে দুর্নীতিকে একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সমাজ নেই যে সমাজকে এই ব্যাধি আক্রমণ করেনি। প্রাচীন ভারতীয় সমাজও এই রোগের ব্যতিক্রম ছিল না। বেদ-অধ্যয়ন শেষ করার পরে উপনিষদের প্রবীণ ঋষি তরুণ স্নাতকদের বলেছিলেন, “যানি অনবদ্যানি কর্মাণি তানি সেবিতাব্যানি নো ইতরানি” (কঠোপনিষদ) – অর্থাৎ, “নিন্দনীয় নয়, এমন কর্মই শুধু করবে। তদ্ভিন্ন অন্য কোন কর্ম করবে না।” অতএব, ‘নিন্দনীয় কর্ম’ প্রাচীন ভারতেও ছিল এবং সেটার বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ছিল। এই নিন্দনীয় কর্মের মধ্যে  এমন কিছু কাজ ছিল, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যে একটি বিশেষ শব্দের সাহায্যে অপরাধকে দুর্নীতি থেকে পৃথক করা হয়েছিল। ‘সুত্তনিপাত’গ্রন্থে (১০৬.২.৭০, ৪১) অপরাধমূলক বৃত্তিগুলিকে বলা হয়েছিল ‘সাহস’। অতীতে যারা এ-ধরণের কাজ করে জীবন নির্বাহ করত, সেই ‘অপরাধজীবী’ (অর্থাৎ ভাড়াটে দস্যু, পেশাদার খুনী প্রভৃতি) লোকেদের বলা হয়েছিল ‘গূঢ়জীবী’। তারা ‘কূটযুদ্ধ’ ও ‘গুপ্তহত্যা’য় বিশেষ পারদর্শী ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ‘তস্কর’ (চোর-ডাকাত), ‘গ্রন্থিছেদক’ (গাঁটকাটা), ‘গৃহভেদক’ (সিঁধেল চোর/ burglar), ‘অবরোধক’ (ঠগী বা ঠাঙাড়ে), ‘নৃশংসিন’ (খুনী) ইত্যাদি নানা ধরণের অসামাজিক লোকেদের কথা পাওয়া যায়। টাকা নিয়ে কাজ করবে, এরকম ‘পেশাদার গুন্ডা’র অভাব তখনও ছিল না। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক ‘জাস্টিন’ , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সৈন্যদের “Robbers and brigands of the day” আখ্যা দিয়েছিলেন। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের আনুগত্য কেনা যেতো (“ধাতুবাদোপার্জিতেন দ্ৰবিণেন চণিপ্রসূ”, ৮ম অধ্যায়, ২৫৩-৫৪, পরিশিষ্টপর্বন)। অবশ্য দুর্নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের কোন সঠিক প্রতিশব্দ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না। ‘অধার্মিক’ শব্দটা এক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। অধার্মিক ব্যক্তি শুধু সমাজের শৃঙ্খলাভঙ্গ করে না, সে ‘শাস্বত এক মহাজাগতিক শৃঙ্খলা’ (ঋত) ভঙ্গ করে। এর জন্য তাকে ‘পাপের ভাগী’ হতে হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যা করে, সেটা পাপও নয়, আবার অপরাধও নয়। ‘হীন স্বার্থান্বেষণ’ থেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্ম ।

বর্তমান দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, দুর্নীতির দুটো পরস্পর সম্পৃক্ত স্তর রয়েছে। সেই স্তরভেদ অনুযায়ী দুর্নীতি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ (individualistic) কিংবা ‘সাংগঠনিক’ (organized) চরিত্রের হতে পারে। প্রাচীন ভারতে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’, ‘সাংগঠনিক’ ও ‘মিশ্র’ – এই তিন ধরণের দুর্নীতি ছিল। ‘কথাসরিৎসাগর’ (৩৮.৪৭) গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, ‘প্রপঞ্চবুদ্ধি’ নামের একজন ব্রাহ্মণ স্বয়ং রাজাকেই ঘুষ দিয়েছিল। ‘মহাভারতের’ ‘কালকবৃক্ষীয় উপাখ্যানে’ (সভাপর্ব, ১২০; ৭) একজন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গোপনে বিপুল সোনাদানা নিয়েছিল। ক্ষমতাধারী লোকেদের ‘উপধা’ (লোভনীয় বস্তুতে স্পৃহা) যে কতখানি মারাত্মক হতে পারে, ‘অর্থশাস্ত্র’ রচয়িতা ‘কৌটিল্য’ সেকথা বিলক্ষণ জানতেন। তাই অর্থশাস্ত্রে আমলাদের ‘উপধা পরীক্ষা’ (অর্থশাস্ত্র, ৪, ৪) করতে বলা হয়েছে।

 ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’ এমন অনেক ‘অর্থগৃধ্ন আচার্য’দের (তীর্থীক) কথা বলেছে (২.২৪১) যারা লোভনীয় পারিশ্রমিকের বদলে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করতেন ( এখন আমরা যা পশ্চিমবঙ্গে দেখছি )। এছাড়া ‘ভূয়া ওজন ব্যবহার’ (তুলাবিষম), ‘ভেজাল মাল সরবরাহ’ (পেটকম), ‘ক্রেতাকে ঠকানো’ (পিঙ্ক) ইওত্যাদি প্রাচীন ভারতেও অবাধে চলত (অর্থশাস্ত্র, ৪,২৩)। তখন ন্যায়-বিভাগেও এরকম কাজকারবার চালু ছিল। এখনকার মতন তখনও বিচারকরা অনেক সময়ে ধনী ব্যক্তিদের সপক্ষে রায় দিয়ে  বিচার প্রক্রিয়ার সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতো । স্মার্তরা তাকে ‘প্রকাশ্য তস্করতা’ (বৃহস্পতি স্মৃতি) আখ্যা দিয়েছিলেন।

বিচারকগণ যে উৎকোচের দ্বারা প্রলুদ্ধ হয়ে অবিচার করেন না, এটা বোধহয় আশা করতে পারি?” ‘মনুসংহিতা’র লেখক তাই বিচারককে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন –

“ধর্ম এব হস্তো হস্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিত।

তস্মাৎ ধর্মো ন হন্তব্যো মানো ধর্মো হতোন্বধোৎ॥”

অর্থাৎ, “ধর্মকে বধ করলে তা স্বয়ং প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়,  আবার একে রক্ষা করলেই এ নিজেই রক্ষা করে। অতএব হে বিচারক, কদাচ স্বধর্মকে বিসর্জন দিওনা।”

 ‘নারদস্মৃতি’তে (৪.১১.১) ‘নিক্ষেপ’ বা ‘উপনিধি’র কথা বলা হয়েছিল, যেটার সোজা বাংলা মানে হয় – ‘পরের গচ্ছিত সম্পত্তি বেহায়ার মতন কব্জা করে নেয়া’। ‘পরদূষণ’ বা ‘পৈশূণ্য’ (vilification) করে অন্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করাও তখন কিছু লোকের কাজ ছিল! ‘মহাভারতে’ (শান্তিপর্ব, ১৫.৪) এই ধরণের লোকেদের ‘নৃশংসবাদিন’ বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের সাংগঠনিক স্তরে যে সব দুর্নীতি প্রচলিত ছিল, সেগুলো আরো সুক্ষ ও সুদূরপ্রসারী ছিল। কৌটিল্যীয় ‘অর্থশাস্ত্র’ এরকম বহু দুর্নীতিকে অঘোষিত ‘রাষ্ট্রনীতি’তে পরিণত করেছিল। সেখানে রাজাকে ‘সংঘভেদ’ (দল – ভাঙ্গানো), ‘গূঢ়পুরুষ অভিনিবেশ’ (গুপ্তচর লাগানো, প্রয়োজনে তাঁরা রাজদ্রোহী ব্যক্তিকে গোপনে হত্যা করতেন), ‘বিষপ্রয়োগ’ প্রভৃতি করতে বলা হয়েছিল। অতিরিক্ত করভার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোন অমাত্যকে ‘রাক্ষস’ বা ‘যক্ষ’ সাজিয়ে প্রজাদের মনে আতঙ্ক গড়ে তোলার  সুপারিশ অর্থশাস্ত্রে করা হয়েছিল।

চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সরকারী কর্মচারীরা দু’ভাবে বড় লোক হয়। তারা হয় সরকারের সাথে প্রতারণা করে অথবা প্রজাদের উপর অত্যাচার করে’। অর্থশাস্ত্রের দু’টি অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, জিহবার ডগায় মধু থাকলে তা চেটে না থাকা যেমন অবাস্তব, তেমনি অবাস্তব হলো সরকারী তহবিল লেনদেন করে এতটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা’।

কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সেজন্য লিখেছেন,

সরকার হইলো কাল,

খিল ভূমি লিখে লাল।

বিনা উপকারে খায় ধুতি

তিন 

৩১০০ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে, প্রাচীন মিশরের প্রথম রাজবংশ তার বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত ছিল। প্রাচীন গ্রীকরা “দুর্নীতি” শব্দটিকে একাধিক অর্থে প্রয়োগ করত । দুর্নীতি ব্যাপারটা তাদের কাছে ছিল সততা বা নৈতিক গুণ হারানোর ব্যাপার। প্রাচীন গ্রীকরা  বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির কথা বলেছে।

মূল্যবোধের  বিরুদ্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং অসততার অভিযোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটা কেবল নৈতিকতা আর সাধুতার বিষয় নয়। পঞ্চম শতাব্দীর গ্রীক সভ্যতায় যে দুর্নীতি প্রচলিত ছিল তা ছিল গণতন্ত্রের অবদান। সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীক কবিরা ওডিসিতে শিক্ষা দেবার সময় বলতেন যে উপহার ছাড়া রাজকীয় বা অভিজাত দরবারে উপস্থিত হওয়া উচিত নয় এবং উপহার প্রত্যাখ্যান করা বুদ্ধিহীনের কাজ ।

 উসমানিয় রাজত্বের সময়ে, দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে, অপরাধীদের বিচার করার জন্য দায়ী কর্মীরা তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যও দায়ী ছিল না, এবং পর্যায়ক্রমে এই সরকারি কর্মকর্তারা অঞ্চলগুলোয়  ঘুরত। তাদের ক্ষতিপূরণের মধ্যে ছিল ফৌজদারি জরিমানা এবং স্থানীয় করের অংশ।  সপ্তম এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ব্যাপারটা বদলে যায় আর । বার্কির লেখা A Case of Corruption within the Ottoman Bureaucracy প্রবন্ধে  ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত পতনের কারণ হয়েছিল তার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সমীক্ষাটি ইঙ্গিত করে যে  অটোমান কর্মকর্তাদের মধ্যে  দুর্নীতির বিষয়টা সেই সময়ে গোপন ছিল না । তাদের নথিতে অটোমান কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি শুরু করেছিল, বিশেষ করে ব্যাবসা-বাণিজ্যে । উসমানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং সম্পদের অপব্যবহার সমাজে এতটাই প্রচলিত ছিল যে তা সমসাময়িক নাটকেও প্রতিফলিত হয়েছিল  । পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ অটোমান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল। গুন্ডুলি সমসাময়িক উসমানীয় কর্মকর্তাদের অবিশ্বস্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত, লুঠতরাজকারী, বীভৎস, লম্পট এবং ভীতু  হিসাবে চিত্রিত করেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা আর  যোদ্ধার চরিত্রে  যে সমস্ত খারাপ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে সেগুলি তাদের মধ্যে ছিল বলেই সাম্রাজ্যটির অবসান হয় । ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত সাম্রাজ্যজুড়ে বসবাসরত ১,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ আর্মেনীয় হামিদলান গণহত্যায় মারা যায় ।

 প্রাচীন রোমের রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতি বেশ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল।  জুলিয়াস সিজার, যিনি ১০০ থেকে ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্য  করেছিলেন,  দুর্নীতিগ্রস্ত সেনেটকে নির্মূল করতে আর নতুন রোম গড়তে খুনোখুনি আর সোনাদানা খরচসহ যে কোনও উপায় ব্যবহার করার জন্য কুখ্যাত। রোম সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক দুর্নীতিকে খারাপ মনে করা হয়নি । পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি দুর্নীতিকে মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং দৈহিক কুফলগুলোকে রাজত্যকে দুর্বল করে দিচ্ছিল । রোম যখন খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করলো তখন টেন কমাণ্ডমেন্টস গুরুত্ব পেলো । কিন্তু ক্রমশ চার্চও দুর্নীতিতে আক্রান্ত হলে, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের দরুন, রোমান ক্যাথলিক চার্চে  দুর্নীতির স্পষ্ট নিন্দা আরম্ভ হয় । দুর্নীতি সবসময় রোম সাম্রাজ্যের  সমস্যা ছিল । রোমের প্রজাতন্ত্র গড়ে উঠে ছিল দুর্নীতির ওপর। রোমানদের বিজয়গুলো দুর্নীতি দ্বারা চালিত হতো। প্রকৃতপক্ষে, রোম সাম্রাজ্য তার সবচেয়ে খারাপ সময়েও তার প্রজাতন্ত্রের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল ।  এখনকার দৃষ্টিতে রোমান  প্রজাতন্ত্র ছিল একটি মাফিয়া রাষ্ট্র এবং সেনেট তার কাউন্সিল অফ ডন। সাম্রাজ্য একটা  স্বৈরাচারের অধীনে  দুর্নীতিগ্রস্ত, বহুভুজ আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, যেখানে বেশিরভাগ লোকেরা কেবল নিজেদের আর তাদের আত্মীয়স্বজনদের লাভের কথা ভাবতো। “ন্যায়বিচার” বিক্রি হতো রোমান সাম্রাজ্যে ।  জনসাধারণের জন্য তা ছিল  বিনোদন ।

​সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক পতন মূলত ভেতরে-ভেতরে দুর্নীতি আর উৎকোচের দরুন ঘটেছিল। তাইতো ভেঙে পড়তেই অজস্র কোটিপতির উদয় হলো ।  এটা এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বা  নিকারাগুয়া এবং তানজানিয়ার মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের অনুকরণ করেছিল, তারা দুর্নীতিতে ভরপুর ছিল। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো, বড় এবং ছোট, বাজারমুখী  দুর্নীতির  কারণে দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের কাঠামো ভেঙে গেছে,  রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী সহ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা তাদের সরকারি পদ হারিয়েছে; এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শ্রেণী পালটে গেছে, যেমন পাকিস্তানে আর মালয়েশিয়ায়।  ব্যাপক ও নিয়ন্ত্রণহীন  দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যহত করে আর রাজনৈতিক বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করে। তার সঙ্গে দুর্নীতির ফলে  সম্পদের অপচয় হয়, সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হ্রাস পায় আর সরকারের প্রতি অবিশ্বাস বেড়ে যায়। উত্তর আমেরিকা আর আফ্রিকার বেশিরভাগ্ দেশ এই রোগে আক্রান্ত।দুর্নীতি দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বলদের উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে, ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের মতো পরিষেবাগুলিো থেকে বঞ্চিত হয় ।

বর্তমান কালখণ্ডে বিশ্ব অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবার সাথে সাথে দুর্নীতিও বেড়ে গেছে। যেহেতু উৎকোচ ব্যাপারটা গোপনে ঘটে, তাই বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির মাত্রা এবং পরিধি অনুমান করা কঠিন।  বিশ্বব্যাংকের অনুমান  যে আন্তর্জাতিক ঘুষ প্রতি বছর মার্কিন ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা বৈশ্বিক জিডিপির ২% এবং মোট বৈশ্বিক সাহায্য বাজেটের ১০ গুণের সমতুল্য।।  নিম্নস্তরের ঘুষখোর সরকারি কর্মী থেকে শুরু করে কোটি কোটি ডলার হাপিশ-করা জাতীয় নেতার স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ছিনতাই করে চলেছে। আবহমানকাল ধরে দুর্নীতি মানুষের ছায়াসঙ্গী। যেহেতু দুর্নীতির উৎপত্তি মানুষের মধ্যেই, তাই বাইরের জগতে এর সমাধানের সূত্র মিলবে না এবং যতদিন সমাধান সূত্র না পাওয়া যায়, ততদিন আদর্শ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা মানুষের আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে থাকবে। 

দুর্নীতি একটা বিশ্বব্যাপী ঘটনা যা সমাজকে দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যায়, উন্নয়নে বাধা দেয় এবং বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। তাছাড়া রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে, যার কাজ করা উচিত জনস্বার্থে । আইনের শাসনের অবনতি এবং জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়, যা আমরা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যক্ষ করে চলেছি । পানামা পেপারস প্রকাশ করেছে কিভাবে ভারতসহ সারা বিশ্বের ধনী লোকেরা তাদের চুরি-করা টাকাকড়ি বাইরের নানা দেশের অ্যাকাউন্টে জমা করে রেখেছে।  ২০১৬ সালে হওয়া পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে অনেক ভারতীয় সেলিব্রিটি এবং ধনকুবের ব্যবসায়ীদের  নাম জড়িয়েছে। পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স লিক এর ঘটনায় ভারত সরকার গোপন অর্থের সন্ধান পেয়েছে, ভারতীয় মুদ্রায় এই পরিমাণ ২০,৩৫৩ কোটি টাকা। দেশের মানুষকে কালোটাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসা মোদি সরকার আজও  কোনও সাফল্য পায়নি। 

চার

এ-কালের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ‘দুর্নীতি’র প্রশ্নটি এত গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে যে সেটির উপস্থিতি ও প্রভাব সম্পর্কে কোন ধরনের প্রশ্নের অবকাশ নেই। অবচেতন মনে দুর্নীতিকে আমরা বোধহয় একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছি। তাই দুর্নীতির ‘পরিভাষা’ ও দুর্নীতির ‘মাত্রা নির্ধারণ করবার নিরিখ’ সম্পর্কে আমরা খুব একটা কৌতূহলী নই। অথচ দুর্নীতি বিষয়ক যে কোনও তাত্বিক আলোচনা করতে গেলে দুর্নীতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য প্রথমেই দুর্নীতির সহজ পরিভাষাটি জানা দরকার।  অনেকে মনে করেন প্রাক-ইসলামিক ভারতে দুর্নীতির বিবরণ পাওয়া গেলেও মূলত এদেশে মোটাদাগে দুর্নীতির সূত্রপাত হয় ইংরেজ শাসনামলে। সব ইংরেজ লর্ডরা দুর্নীতিবাজ না হলেও তারা এদেশে যে শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল তা দুর্নীতির বেলাগাম সমারোহ ঘটায়। চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের দরুন চাষির উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদা যেমন, আবওয়াব, তুহুরি, দস্তরি, ভেট, নজরানা, বেগার, সালামি ইত্যাদি নামে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করতো।                

দুর্নীতি ব্যাপারটা দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে বোঝায় । যেহেতু দুর্নীতি একটা জটিল ব্যাপার, কোনো একটা মাত্র  তত্ত্ব এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু দুর্নীতি কেন হয়? ব্যক্তিগত লোভকে প্রায়ই সরকারি দুর্নীতির প্রাথমিক কারণ হিসাবে আমরা জানি , তবে এটা ব্যক্তি আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে জটিল সম্পর্কের অতি-সরলীকরণ। চিন্তকরা  বেশ কয়েকটা তত্ত্ব তৈরি করেছেন যা এই সম্পর্কগুলোকে বিনির্মাণ করতে সহায়তা করে। 

অর্থশাস্ত্রে দুর্নীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি তত্ত্ব হল ‘প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেল’ মানে আসল ঘুষখোর এবং ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমস্যা’ মানে দালাল ঘুষখোর । প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেল অনুমান করে যে দালালরা (সরকারি কর্মকর্তা) মূল ঘুষখোরের (জনসাধারণ, সংসদ বা তত্ত্বাবধায়ক যেই হোক না কেন) স্বার্থ রক্ষা করে। বাস্তবে, দালালদের স্বার্থ প্রায়ই মূল ঘুষখোরের  স্বার্থ থেকে আলাদা হয় । দালালরা নিজের লাভ দেখতে চায় আর মূল ঘুষখোর হয়তো তার নিজের বা রাজনৈতিক দল বা আর্থিক সংগঠনের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় । কলকাতায় আমরা একজন যুবতির বাড়িতে কোটি-কোটি দুহাজার টাকার গোলাপি নোটের পাহাড় দেখলুম ; জানতেও পারলুম যে যুবতিটি মূল ঘুষখোর নন – যে প্রৌঢ়ের সঙ্গে যুবতিটি সম্পর্কিত, সেও সম্ভবত মূল ঘুষখোর নয় । তত্ব এখানে পৌঁছে আটকে যায় । 

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস বলেছেন, দুর্নীতি হল ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। অর্থনীতিবিদ আই. সিনিয়র  একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি এমন একটা কাজ যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে, তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, এতে করে দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এই কাজে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটির হাতে থাকে আসল চাবিকাঠি । 

আরেক  দুর্নীতির তত্ব হলো, “আইনানুগ দুর্নীতি”, মানে যারা আইন বানায় তারা নিজেরা যাতে ফেঁসে না যায় তাই আইনটাতেই ফাঁকফোকর রাখে বেরিয়ে যাবার জন্য । মজার ব্যাপার হলো  নিজেদের রক্ষা করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইন প্রণেতাদেরর হাতেই থাকে । ভারতে নির্বাচনের জন্য শিল্পপতিরা খোলাখুলি যেমন টাকা দেয় তেমনই লুকিয়ে দেয় যাতে ভবিষ্যতে দল বা লোকটা কাজে লাগে ।  একবার নির্বাচিত হলে, একজন রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন,  একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে সাহায্য করার জন্য এমন নিয়ম বা আইন পাশ করাতে চেষ্টা করেন যার লক্ষ্য  কোম্পানিটার আর্থিক চাপ কমানো।  সীমাহীন আর্থিক সহায়তা এবং স্বচ্ছতার অভাব একটা সমস্যা, কারণ প্রার্থীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবৈধভাবে কাজ না করলেও, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত অনুদানের ব্যবস্হা রাজনৈতিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় । এইভাবে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিগ্রস্ত কারণ নির্বাচনী প্রচারের জন্য ব্যক্তিগত লেনদেনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্হা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রভাবের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়।

আরেকটি তত্ব হলো, ইনফ্লুয়েন্স পেডলিঙ । ইনফ্লুয়েন্স পেডলিং হল সরকারে একজনের প্রভাব বা কর্তৃপক্ষের সাথে সংযোগ ব্যবহার করে অন্যের জন্য সুবিধা বা অগ্রাধিকার পাইয়ে দেবার অভ্যাস, সাধারণত টাকাকড়ির বদলে। ভারতে অস্ত্র কেনার সময়ে আমরা এই তত্বটা সহজে বুঝতে পারি । ‘হক ১১৫ অ্যাডভান্স জেট ট্রেনার’ বিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে দু’টি ব্রিটিশ সংস্থা রোলস রয়েস এবং ব্রিটিশ এয়ারোস্পেস সিস্টেমসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল সিবিআই। পাশাপাশি, মামলা করা হয়েছে রোলস রয়েস ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর টিম জোনস এবং দুই ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ী সুধীর চৌধুরি ও তাঁর ছেলে ভানু চৌধুরির বিরুদ্ধেও। সিবিআইয়ের অভিযোগ, ২০০৪ সালে ওই বিমান কেনার সময়ে পদের অপব্যবহার করেছিলেন আমলাদের একাংশ। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান জোন্স, সুধীর, ভানু এবং ব্রিটিশ এয়ারোস্পেসের প্রতিনিধি। এছাড়া ২০০৯ সালে ৭৫ টি মৌলিক প্রশিক্ষণ বিমান (basic trainer aircraft) কেনা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে বিমান বাহিনীর (Air Force) অজ্ঞাতপরিচয় কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Defence Ministry) এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী সঞ্জয় ভাণ্ডারি (arms dealer Sanjay Bhandari) ও সুইজারল্যান্ডের বিমান নির্মাতা পিলাটাস এয়ারক্রাফট লিমিটেডের (Swiss-based plane-maker Pilatus Aircraft Ltd) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে সিবিআই (Central Bureau of Investigation)।  এই বিমান কেনার চুক্তিতে সিবিআই ৩৩৯ কোটি টাকার তছরুপের অভিযোগ এনেছে।  দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকায় অভিযুক্ত সঞ্জয় ভাণ্ডারি ও অন্যদের মালিকানাধীন সম্পত্তিতে অভিযান চালায় সিবিআই (CBI)। সিবিআই সূত্রের খবর, আরও বহু জায়গাতেই অনুসন্ধান ও তল্লাশি চলছে। এফআইআরে, সিবিআই দক্ষিণ দিল্লির পঞ্চশীল পার্কে অস্ত্র বিক্রেতা সঞ্জয়ের মালিকানাধীন অফসেট প্রিন্টারের (Offset India Solutions Pvt Ltd) নামও উল্লেখ করেছে। সঞ্জয় ভান্ডারির ​​কার্যকলাপের উপর তদন্তের প্রথম ক্ষেত্রই প্রস্তুত হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। সুইস মৌলিক প্রশিক্ষণ বিমান (BTA) ভারতের অধিগ্রহণের বিষয়ে জড়িত ছিলেন তিনি। লন্ডনে ব্যবসায়ী রবার্ট বঢরার (Robert Vadra) জন্য বেনামী বা ভুয়ো মালিকানাধীন বাড়ি কেনার অভিযোগে ভাণ্ডারির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই তদন্ত চলছে। সুইস বিমান সংস্থাকে ভাণ্ডারির অফসেট ইন্ডিয়া সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড (Offset India Solutions Pvt Ltd) কোম্পানি ঠিক কোন ধরনের পরিষেবা দিত তাও খতিয়ে দেখছে তদন্তকারীরা ।

অতি সম্প্রতি, যৌথ কর্ম তত্ত্ব  ( Collective Action Theory ) একটি বিকল্প তত্ব হিসাবে আলোচিত হচ্ছে,  যে কেন পদ্ধতিগত দুর্নীতিকে  বেআইনি করে দেওয়া সত্ত্বেও টিকে থাকে এবং কেন দুর্নীতি কিছু দেশে অন্যান্য বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করে। যৌথ কর্ম তত্ত্ব ঐতিহ্যগত প্রধান-এজেন্ট ( Principal Agent )  সম্পর্কের বাইরে চলে যায় ।  বিশ্বাসের মতো বিষয়গুলোকে  গুরুত্ব  দেয় আর  ব্যক্তিরা লক্ষ্য রাখে যে অন্য লোকেরা কেমন আচরণ করছে ।  তাত্ত্বিকরা সিস্টেমিক দুর্নীতিকে একটি সমষ্টিগত সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করেন, কারণ লোকেরা একই পরিস্থিতিতে অন্যরা কী করবে তার উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব আচরণকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। দুর্নীতি যখন একটি সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়, তখন সবাই একে সহজভাবে কাজ করার উপায় হিসেবে দেখতে শুরু করে। জনগণ ব্যাপক দুর্নীতির নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু তারা দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় কারণ তারা বিশ্বাস করে যে  দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় একমাত্র সৎ ব্যক্তি হওয়ার কোনো মানে হয় না । এই ধরনের পরিবেশে, প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেলের উপর ভিত্তি করে দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা কার্যকর হবে না, কারণ এমন কোন “আদর্শ ক্ষমতাধর” নেই যারা দুর্নীতি বিরোধী নিয়মাবলীকে কড়া হাতে প্রয়োগ করবে।

আরেকটি তত্ব হলো Game Theory,  যা সরকারী ক্ষেত্রের দুর্নীতির ব্যাপকতা ব্যাখ্যা করে । এই তত্ত্বটি অর্থশাস্ত্র থেকে বক্তব্য ধার করে তৈরি এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত সিদ্ধান্ত নেবার যুক্তি দেয়। বিশেষ করে, দুর্নীতি একটি যুক্তিযুক্ত গণনা প্রণালীর অংশ এবং একটি অবিচ্ছেদ্য এবং প্রায়শই গভীরভাবে প্রোথিত পদ্ধতি যার দ্বারা লোকেরা সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রেক্ষাপটে, ব্যক্তিরা একটি  ( Prisoner’s Dilemma ) “বন্দীর দ্বিধা”-র মুখোমুখি হয়, যা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর যুক্তিবাদীতার মধ্যে একটি দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করে । ফেঁসে যেতে পারে ভেবে ঘুষদানকারী বা গ্রহণকারী  অসুবিধার আশঙ্কা করে । তার মনে হয় যদি সে ঘুষ দিতে বা নিতে  অস্বীকার করে অথচ  অন্য লোকেরা একই পরিস্থিতিতে দিব্বি সেটা করছে তাহলে  সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।  মানে,  যদি দুর্নীতির উপায় অবলম্বন না করে তাহলে অন্যেরা যে সুবিধা পায় তার থেকে কম পাবে ।

বন্দীর দ্বিধা হল গেম থিওরিতে বিশ্লেষণ করা একটা খেলা। এটা  চিন্তার ভালো-খারাপ পরীক্ষার ব্যাপার যা দুটি সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী এজেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে: প্রত্যেকে পারস্পরিক সুবিধার জন্য সহযোগিতা করতে পারে বা পৃথক পুরস্কারের জন্য তাদের সঙ্গীর সঙ্গে (“খারাপ”) বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে ।  বন্দীর দ্বিধা আমাদের দেখায় যে নিছক সহযোগিতা সবসময় একজনের স্বার্থে হয় না।বন্দীর দ্বিধাদ্বন্দ্বের দৃশ্যকল্পটি নিম্নরূপ কাজ করে: দুই সন্দেহভাজনকে একটি অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তারা এখন একটি থানায় পৃথক কক্ষে রয়েছে, একে অপরের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। সরকারি উকিল আলাদাভাবে তাদের এই কথাগুলো বলেছেন:

এক : আপনি যদি স্বীকার করেন এবং অন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন, যিনি স্বীকার করেন না, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে এবং আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন।

দুই : আপনি যদি স্বীকার না করেন কিন্তু অন্য সন্দেহভাজন স্বীকার করেন, তাহলে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে এবং প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ  সাজা চাইবে।

তিন : যদি আপনারা দুজনেই স্বীকার করেন, আপনাদের দুজনকে কম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

চার : যদি আপনারা কেউই স্বীকার না করেন, তাহলে আপনাদের দুজনের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হবে এবং এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সন্দেহভাজনদের কি করা উচিত? এটি বন্দীর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সারমর্ম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ভারতের মতো বেশিরভাগ দেশে, ঘুষের দোষে দোষী সাব্যস্ত হলে, ঘুষখোর এবং ঘুষদাতাদের সমানভাবে শাস্তি দেওয়া হয় (সমন্বিতভাবে)। অন্যদিকে, চীন, জাপান এবং রাশিয়ার মতো দেশে, ঘুষদাতার চেয়ে ঘুষখোর প্রায়শই  কঠোর শাস্তি পায়। এই প্রেক্ষাপটে, চিন্তকরা  মনে করেন ভারতকে হয়রানিমূলক ঘুষের জন্য  শাস্তি দেয়া বন্ধ করা উচিত কারণ ঘুষদাতাদের ঘুষের রিপোর্ট করার কোন প্রণোদনা থাকে না । এই প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে, ঘুষ নেওয়ার পরে, ঘুষদাতা এবং ঘুষখোর আর একই নৌকায় থাকে না, তাই রিপোর্ট করবে কিনা তা তাদের পছন্দ হতে পারে। ঘুষদাতারা রিপোর্ট করে উপকৃত হতে পারে কারণ তারা তাদের টাকা ফেরত পেতে পারে । ঘুষখোররা ঘুষ হারানোর এবং  শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকি নেয় । 

যদিও প্রাগুক্ত প্রস্তাব তাত্ত্বিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে, ঘুষের ঘটনার বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। উদাহরণস্বরূপ, ঘুষদাতারা যারা রিপোর্ট করাকে বেছে নেয় তাদের ভাবতে হবে যে ঘুষখোর লোকটা সুযোগ পেলেই  প্রতিশোধ নেবে ।  এছাড়াও,  যারা সরকারী কর্মকর্তাদের  নিয়মিত ঘুষ দেয় তারা রিপোর্ট করার মাধ্যমে তাদের সুনাম এবং ভবিষ্যতের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে। রিপোর্ট করার জন্য এবং রিপোর্টিং না করার জন্য এই সমস্ত কারণগুলিকে গণনা করা দরকার। 

আরেকটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক তত্ব ( Institutional Theory ). দুর্নীতির একটি প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক সংস্কৃতি সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতিকে স্বাভাবিকীকরণের দিকে নিয়ে যায় এবং আনুষ্ঠানিক দুর্নীতিবিরোধী নিয়ম লঙ্ঘন বা উপেক্ষা করার জন্য দায়মুক্তির দিকে পরিচালিত করে। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, সমষ্টিগত এবং সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন, যেমন সংস্কার জোট বা সমমনা সংগঠনগুলির সক্রিয় জোট। এই পন্থাগুলিকে প্রায়ই “সম্মিলিত কর্ম” উদ্যোগ বলা হয়।প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব অনুযায়ী  সরকারী খাতে দুর্নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য দেশ এবং সরকারী প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যবহার করে, যেমন আইনের প্রাক-বিদ্যমান শাসন, সুসংজ্ঞায়িত দুর্নীতি-বিরোধী নিয়মাবলী, এবং প্রয়োগকারীর ক্ষমতাসহ স্বাধীন দুর্নীতি-বিরোধী প্রতিষ্ঠান।  দুর্নীতি বোঝার ক্ষেত্রে, প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আলোচনায় নিয়ে আসে এবং দুর্নীতিবিরোধী কাঠামোর অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজে দুর্নীতি প্রবেশ করতে পারে তা বোঝার জন্য একটি শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে। প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব বিবেচনা করে যে দুর্নীতি ব্যাপারটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র, নকশা এবং স্বচ্ছতাকে কীভাবে ও কতোটা প্রভাবিত করে। একই সাথে, তা  স্বীকার করে যে দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং লিঙ্গের মধ্যে সম্পর্কগুলো মোটেই সহজ নয় ।

 রাজনৈতিক দুর্নীতির “প্রাতিষ্ঠানিক” তত্ব অনুযায়ী  দুর্নীতি ব্যক্তিগত স্তরে ঘটতে পারে, এটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রকৃতির ক্ষেত্রেও হতে পারে যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে গঠন করা হয় যা তাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় ।  দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হল ভারতে রাজনৈতিক প্রচারণার ব্যক্তিগত অর্থায়ন।ভারতের রাজ্যগুলিতে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সাধারণ নাগরিক, ব্যক্তিগত কর্পোরেশন এবং সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো বিভিন্ন ব্যক্তিগত উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এইভাবে এমন  ঘটতে দেখা যায় যে, একবার নির্বাচিত হলে, একজন রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন, কোনো প্রাইভেট কোম্পানিকে নিয়ম টপকাতে সাহায্য করে আর কোম্পানিটার আর্থিক চাপ কমিয়ে দেয়। এই ব্যাপারে আমরা আমবানি-আদানিদের নাম শুনি । বোঝাই যাচ্ছে সীমাহীন আর্থিক সহায়তা আর স্বচ্ছতার অভাব একটা জটিল সমস্যা কারণ প্রার্থীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবৈধভাবে কাজ না করলেও, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত অনুদানের অনুশীলন রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য সংবেদনশীল। এইভাবে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিগ্রস্ত কারণ “নির্বাচনী প্রচারের জন্য ব্যক্তিগত তহবিল গ্রহণের প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রভাবের উপর নির্ভর করে”।

দুর্নীতি ভারতে একটা ভয়ংকর সমস্যা , এতটাই, যে লোকেরা একে স্বাভাবিক হিসাবে গ্রহণ করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, পশ্চিমবঙ্গে, ব্যাপারটা নতুন উচ্চতা স্পর্শ করেছে। ভারতের যেকোন রাজ্যে,  কোনও সরকারি অফিসে গেলে, আপনার কাজ করার জন্য, সংশ্লিষ্ট লোকটি জানিয়ে দেবে কতো টাকা দিতে হবে । সবাই দেয় বলে আপনিও দেবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, আপনি যদি কোনও সরকারি অফিসে যান, সংশ্লিষ্ট কর্মী বা অফিসার খোলাখুলি বলবে না কতো টাকা চাই ; সাধু সেজে বসে থাকবে , কাজও করবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গে চোরদের সম্মানের খুব অভাব।  প্রকাশ্যে ঘুষ চাইবে না, কোনো কাজ করবে না। যাইহোক, প্রকল্পগুলি অনুমোদন করা হয়, প্রকল্পের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হয়, এবং সরকারী দপ্তর থেকে নিয়মিতভাবে স্বাক্ষর করা হয়,  প্রকল্পের কোনো বাস্তবায়ন ছাড়াই। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, যা আগে অজানা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশও এই Collective Action Theory-র আওতা থেকে বাদ যা্য় না । সব রাজ্যেই পুলিশ বাহিনী দুর্নীতিগ্রস্ত । যে রাজ্য যতো ধনী সেই রাজ্যে পুলিশ ততো দুর্নীতিগ্রস্ত ।  পুলিশকে একজন অপরাধীও ঘুষ দিয়ে এনকোয়ারি বন্ধ করিয়ে দিতে পারে । অনেক রা্জ্যে পুলিশকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে অপরাধিরা লকাপেই মারা পড়েছে ।

আরেকটি তত্ব হলো Greasing The Wheels Theory ; এই তত্ব অনুযায়ী বিশ শতকের প্রথমার্ধে মনোবিজ্ঞানের  আচরণগত কার্যকারিতা প্রয়োগ করে দুর্নীতির সামলানোর চেষ্টা হয়েছে।  রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, দুর্নীতির কার্যকারিতাবাদী ব্যাখ্যা দুর্নীতিকে ‘চাকায় তেল দেয়ার’ উপায় হিসাবে দেখেছে, বিশেষত বিনিয়োগকারী এবং কোম্পানিগুলির জন্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, দুর্নীতি হল  নিয়ন্ত্রন, সম্পদ বণ্টন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরির মাধ্যমে দ্রুত তেল দিয়ে মসৃণ কায়দায় বেরোনোর উপায়। ধীরুভাই আমবানি এই উপায়ে একটা পুরো ফ্যাক্ট্রি গুজরাতে এনেছিল, অর্থমন্ত্রী আর মন্ত্রকের আমলাদের চাহিদা অনুযায়ী তেল দিয়ে। তার কারণ তখনও পর্যন্ত নেহেরুর নানা রকমের আমদানি নিয়মকানুনে কাজ আটকে যেতো ।

পাঁচ

পশ্চিমবঙ্গ এখন দুর্নীতি-উৎকোচ আর নানা রকম ঘুষের আখড়া । স্কুলের চাকরি থেকে ত্রাণের ত্রিপল; বালি-পাথর-কয়লা থেকে গরু; নির্মাণ সামগ্রী থেকে হাসপাতালের শয্যা, যে দিকেই চোখ পড়বে, সর্বত্রই লুটপাট আর ঘুষখোরি । এই রাজ্যে দুর্নীতির একটি নির্দিষ্ট ছক এখন অতি স্পষ্ট— সেই ছকটির নাম রেন্ট সিকিং বা খাজনা আদায়। যেখানে যাঁর হাতে যতটুকু ক্ষমতা, তিনি তা ব্যবহার করে কোনও না কোনও অন্যায়কে চলতে দিচ্ছেন— বস্তুত, সেই অন্যায়কে প্রত্যক্ষ সুবিধা করে দিচ্ছেন— এবং বিনিময়ে খাজনা আদায় করে চলেছেন। এই ক্ষেত্রে ‘খাজনা আদায়’টি অন্যায়, কারণ জমি, বাড়ি বা যন্ত্রপাতির মতো ন্যায্য মালিকানায় থাকা সম্পদ নয়, এই ক্ষেত্রে খাজনা আদায় করা হয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষমতা থেকে, যার মালিকানা তাঁদের নয়। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনিয়মকে চলার পরিসর তৈরি করে দেন, এবং তার বিনিময়ে সেই বেনিয়ম থেকে উপার্জিত অর্থের বখরা পান। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়াটি এখন সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে— প্রকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সমান্তরাল একটি কাঠামো। শাসক দলের এমন কোনও নেতার সন্ধান পাওয়া এখন দুষ্কর, যিনি সচেতন ভাবে এই অন্যায়ের বাইরে থাকেন, থাকতে চান। এই প্রবণতার মূল্য চোকাতে হয় রাজ্যের সাধারণ মানুষকে। দুর্নীতির দুর্বিপাকে ঘুরে মরাই পশ্চিমবাংলার মানুষেরা  ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, দুর্নীতি এমন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে কোন মন্ত্রবলে? গত চল্লিশ বছরে যা  পশ্চিমবঙ্গে বারে বারেই শোনা গিয়েছে—তা হলো,  শাসক দলের হয়ে রাজনীতিই এখন এই রাজ্যে চাকরি-বাকরি পাবার একমাত্র উপায় ।  চল্লিশ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে “পার্টি করি”, মানে যা কিছু অনৈতিক সেইসব কম্মো করে বেড়াই।  শাসক দলের খুরের দাগ নিজের পোঁদে লাগাতে পারলেই খাজনা আদায়ের যন্ত্রে লেগে যাও। পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদির ঝামেলা নেই— , খাজনার ভাগ পেলেই তারা তুষ্ট।  বড় মাপের কর্মসংস্থান হতে পারে, এমন কোনও উৎপাদনশীল ক্ষেত্র এই রাজ্যে নেই। সবাই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালিয়েছে। টোপ ফেললেও গিলছে না । ফলে, রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরা ছাড়া  উপায়া নেই।  বহু বছর ধরে বেঙ্গালুরু, দিল্লি-নয়ডা-গুরুগ্রাম, অথবা হায়দরাবাদ, মুম্বই— ভারতের যে কোনও বড় শহরে উচ্চপদে যারা চাকরি করছে তাদের  মধ্যে বাঙালির অনুপাত চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই বলে অদক্ষ শ্রমিকরাও ভিনরাজ্যে গিয়ে বাসা বেঁধেছে।

পশ্চিমবঙ্গের এখনকার দুর্নীতি আসলে  প্রশাসনের উন্নয়ননীতির ব্যর্থতা থেকে জন্মেছে ।  পঞ্চায়েতের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, তার অঙ্কটা বিশাল। এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের ভাগ পাওয়ার লোভেই পঞ্চায়েত ভোটে জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রার্থীরা, সেজন্যই এত খুনোখুনি হয় এই নির্বাচনে। নাহলে, একজন পঞ্চায়েত সদস্যর মাসিক বেতন হাজার তিনেক টাকা, এই সামান্য টাকা বেতনের কাজের জন্য কেউ এতটা মরিয়া হয়ে ওঠে না । ১৯৭৮ সালে যখন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তখন থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের টাকা আসতে শুরু করে। একেকটা প্রকল্পের জন্য কয়েকশো কোটি টাকাও আসে, আর প্রকল্পের সংখ্যাও কম নয় । বরাদ্দকৃত এই বিপুল অর্থে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দেখিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। তিনি হিসাব দিয়ে বলেছিলেন কেন্দ্র একটা প্রকল্পে যত অর্থ বরাদ্দ করে, তার ৮০ শতাংশ আর শেষ মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছয়ই না।  পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি বামফ্রন্ট আমল থেকেই হয়ে আসছে। তাই সেই সময়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন্য হিংসার আশ্রয় নিত দলগুলি। পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাই জড়িত আছেন, কেউ কম কেউ বেশি । কোনও দল বলতে পারবে না যে তাদের পঞ্চায়েত সদস্যরা দুর্নীতি করেন না। 

পঞ্চায়েত স্তরের দুর্নীতিটা চালু হয়েছিল বামফ্রন্টের আমল থেকেই। তখনই পঞ্চায়েতকে ঘিরে দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কিভাবে দুর্নীতি হয় পঞ্চায়েতে? গ্রামাঞ্চলে এখন সবথেকে বড় দুর্নীতির জায়গা হচ্ছে আবাস যোজনা। এই প্রকল্পে একেকটি পরিবার পাকা ঘর তৈরির জন্য এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা করে পায়। এই অর্থ পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সদস্যকে দিতে হয় ১০ শতাংশ অর্থ। এটাই চলতি রেট। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া, বাড়ির সামনে রাস্তা করিয়ে দেওয়া, ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা – এসব থেকেও প্রচুর আয় করেন একেকজন পঞ্চায়েত সদস্য। পঞ্চায়েত সদস্যদের আরেকটা বড় রোজগারের পথ হল বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট প্রদান করা। হাজার হাজার মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান, তাদের রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। সেটার জন্য টাকা নেওয়া হয়। 

পঞ্চায়েত সদস্যদের সম্প্রতি আরেকটা বড় রোজগারের পথ হয়ে উঠেছে গ্রাম্য সালিশিগুলো । পারিবারিক ঝামেলাতেও মাথা গলান পঞ্চায়েত সদস্যরা। আর সেখানে বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হল যে পক্ষ বেশি অর্থ দিতে পারবে, রায় তার পক্ষেই যাবে। আবার সাধারণ মানুষও দুর্নীতিতে যুক্ত থাকে অনেক সময়ে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প, যে প্রকল্প ‘১০০ দিনের কাজ’ হিসাবেই পরিচিত, সেখানে রাস্তা বা পুকুর না কেটেই তার জন্য বরাদ্দ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে গ্রামের যে বাসিন্দা টাকা পাচ্ছেন, তার আর পঞ্চায়েত সদস্যর মধ্যে আধাআধি ভাগ হয় টাকাটা।

 বিবিসির প্রতিবেদন জানিয়েছ, একেক জন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তার পাঁচ বছরের মেয়াদে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করে , এবং এটা শুধুমাত্র সরকারি প্রকল্পগুলোর টাকা গ্রামের মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার বদলে। এর বাইরে তো রাস্তা তৈরি বা অন্যান্য কাজের বরাদ্দ যারা পায়, সেইসব ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা তোলে পঞ্চায়েত সদস্যরা। অথচ তাদের সরকারী বেতন মাত্র হাজার তিনেক টাকা, তো এই বিপুল অর্থের হাতছানি যেখানে, সেখানে খুনোখুনি-মারামারির আশ্রয় তো নেবেই। আবার পঞ্চায়েত সদস্যদের নিজস্ব বাহিনীও থাকে। এরা ভোটের সময়ে তাদের ‘দাদা’র হয়ে কাজ করে আর বছরভর নানা সিণ্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকে। কংগ্রেস আমল বা বামফ্রন্ট আমলেও এই বাহিনী ছিল। তাদের কখনও বাস-মিনিবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে রোজগারের পথ করে দেওয়া হয়েছিল, কখনও রিকশা-অটোরিকশার পারমিট করিয়ে দিয়ে আয়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে, আর এখন নির্মাণ সিণ্ডিকেটের মতো আইন বহির্ভূত, সমান্তরাল অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়। বিনিময়ে ভোটের সময়ে হুমকি-লেঠেলবাজি আর সন্ত্রাস করানো হয় এই লুম্পেন বাহিনীকে দিয়েই।

ছয়

সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত দেশ  স্বপ্নে দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর এমন কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে দুর্নীতিই প্রথম ও শেষ কথা। দুর্নীতির সেই সমস্ত দেশের ভিত ।  ট্রান্সপারেন্সির এক জরিপে দেখা যায় যে, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই হিসাবটি করা হয় ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতি মুক্ত সে দেশের পয়েন্ট তত বেশি। হিসাবে দেখা যায় যে, সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সোমালিয়া। এ দেশের পয়েন্ট ১০০ তে মাত্র ১০। এরপর কয়েকটি দেশের পরে আছে সিরিয়া। এর পয়েন্ট মাত্র ১৩। এরপর ১৪পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান করছে লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। এরপর ইরাকের আছে ১৭, লেবাননের আছে ২৮।

 আরব বিশ্বের নয়টি দেশ ও ভূখণ্ডে (ফিলিস্তিন) গত বছর দুর্নীতির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে মনে করে সেখানকার সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে গভীর সংকটে পড়া লেবানন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের অবস্থা বেশি খারাপ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, প্রায় ১১ হাজার অংশগ্রহণকারীর মতামতের ভিত্তিতে পাওয়া জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া অন্য দেশ ও ভূখণ্ড হলো আলজেরিয়া, মিসর, জর্ডান, মরক্কো, ফিলিস্তিন, সুদানতিউনিসিয়া। অংশগ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ এসব দেশে গত বছর দুর্নীতি বেড়ে গেছে বলে জানান । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানালের মতে,  ‘আরব বসন্ত’ শুরুর পর প্রায় অর্ধদশক পেরিয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী  দুর্নীতির পরিমাপে দেখা গেছে, সরকারি খাতের দুর্নীতি কমাতে বিভিন্ন সরকারের প্রচেষ্টা নিয়ে এখনো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর অধিকাংশ নাগরিক মনে করেন, সম্প্রতি এসব দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তা ও পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেবাননের ৯২ শতাংশ, ইয়েমেনের ৮৪ শতাংশ, জর্ডানের ৭৫ শতাংশ মনে করেন দেশগুলোতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিপরীতে মিশরের ২৮ শতাংশ ও আলজেরিয়ার ২৬ শতাংশ মনে করেন তাঁদের দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। জরিপে যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইয়েমেনি ও প্রায় অর্ধেক মিশরীয় বলেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়েছে। একই কথা বলেন তিউনিসিয়ার ৯ শতাংশ ও জর্ডানের ৪ শতাংশ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী।

জরিপ প্রতিবেদনের রচয়িতা কোরালাই প্রিং বলেন, তাঁরা লেবাননের দুর্নীতি পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন। গভীর রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে দেশটি ২০১৪ সালের মে থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট ছাড়াই চলছে। কোরালাই আরও বলেন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জনগণ যে শুধু দুর্নীতি রোধে সরকারি প্রচেষ্টাতেই তাঁদের প্রচণ্ড অসন্তোষ জানিয়েছেন তা-ই নয়, বরং সরকারি খাতজুড়ে দুর্নীতির উচ্চহারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। শান্তি ও সমৃদ্ধি আর সৌন্দর্যের জন্যে একসময় যে দেশকে বলা আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড, আজ সেই দেশ এক বিভীষিকার নাম। সোমালিয়ার নাম শুনলেই সবার চোখে ভাসে যুদ্ধ বিগ্রহ আর জলদস্যুদের কথা। অথচ সোমালিয়ার রাজধানী শহর মোগাদিসুর রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সেমালিয়াতে জলদস্যু ‘ব্যবসা’ এখন রমরম করছে। দুবাই এবং অন্যান্য দেশে থাকা সোমালিরা বিনিয়োগ করছে এই ব্যবসায়। সোমালি জলদস্যুদের লুট করা টাকায় বন্দর ঈলে বিশাল-বিশাল ভিলা এবং হোটেল তৈরি হয়েছে। এক সময়কার গরীব জেলেরা এখন মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকাচ্ছে। দলে দলে দরিদ্র জেলে ছেলেরা জলদস্যু দলে নাম লেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই ব্যবসার আসল লোকজনেরা রয়েছে পর্দার আড়ালে । অন্য সব ব্যবসার মতই জলদস্যুদের হাতে টাকার খুব সামান্য অংশই যায়। বেশিরভাগ অংশটাই চলে যায় নেপথ্যের কারবারীদের কাছে। দুর্নীতি দেশটির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। নানা রকমের সমস্যায় নিমজ্জিত সোমালিয়া বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এদেশের মাত্র ২৯ শতাংশ ছেলে-মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে। অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, মুক্তিপণের এক দেশ হয়ে উঠেছে  সোমালিয়া।

আরেকটা দেশ হলো সুদান যেখানে মানবাধিকার বলতে কিচ্ছু নেই। এখন আবার দেশ দখলের জন্য দুই সেনাপ্রধানের যুদ্ধ চলছে । দুর্নীতি, গণমাধ্যমের উপর আঘাত, অস্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার সংগঠনগুলির ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ, এমনই নানা অভিযোগে বিদ্ধ দক্ষিণ সুদানের সরকার। অভিযোগ অবশ্য আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরে বহু প্রতিবেদনে বার বার উঠে এসেছে সুদানের ভয়াবহ প্রসঙ্গ৷ এমনকী সে দেশে  রয়েছে গোপন জেল ! বহু মানবাধিকার কর্মীকে সেই সমস্ত জেলে দীর্ঘদিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু কোনও অভিযোগই মানতে রাজি নয় সুদান সরকার৷ সরকারের দাবি, সুদানের মানবাধিকার নাকি বিশ্বের বহু দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে। যদিও গণহত্যা’র কারণে সুদানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল আন্তর্জাতিক আদালত। তবে ওই পর্যন্তই। যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আফ্রিকান কমিশন অন হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটসের মতো সংগঠন বারংবার তাদের প্রতিবেদনে সুদানের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করেছে। উঠে এসেছে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা। ছাত্র, বিরোধী রাজনীতিক, মানবাধিকার কর্মী সবাইকে আটকে রেখে সুদান হয়ে উঠেছে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। এমনকী মানুষকে শায়েস্তা করতে গরিবের খাবার রুটির দামও মারাত্মক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরেকটা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ, যে দেশটার নাম বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী আইসিস-এর কথা। আর শুধু কি সন্ত্রাস, সিরিয়া দেশটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধুই দুর্নীতি। প্রায় এক যুগ ধরে সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। এদিকে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে সেনা উপস্থিতি নিয়ে চরম উত্তেজনা চলছে। কখনও আইসিস-রাজ, কখনও বা শাসক আসাদ-গোষ্ঠীর অত্যাচার, সিরিয়ার মানুষের জীবন কার্যত নরকযন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। এমনকী দুর্নীতিতে এতটাই নিমজ্জিত সে দেশ, যে জনসাধারণকে ওষুধ কিনতে হয় ঘুষ দিয়ে। বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন কম হয়নি সে দেশে। কিন্তু তা প্রতিহত করতে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি আসাদ। বেকারত্ব, দুর্নীতি, মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের বাধা, সিরিয়ায় এখন বাশার আল-আসাদের ‘একনায়কতন্ত্র’ চলছে। সেইসঙ্গে ‘আইসিস’ নামের আতঙ্ক। 

বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের অধিকাংশ শিশুর পেট ভরে ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী একটা সময় বলেছিলেন, ‘পরবর্তী খাবার কখন পাওয়া যাবে তা নিয়ে সবসময়ই অনিশ্চয়তায় থাকে দেশটির লাখ লাখ শিশু৷ আমি একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, যেখানে শিশুরা ক্ষুধায় এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, তাঁরা কাঁদতেও পারছিল না।’ সেই দেশটির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি। ইয়েমেন যুদ্ধে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে, ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ হয়েছে ঘরহারা। আরও হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছে অপুষ্টিতে ও রোগে ভুগে। আহমেদ বাঘিলি নামে একটি মেয়েকে যখন ইয়েমেনের হোডাইডা শহরের আল থাওরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন ১৮ বছরের মেয়েটির ওজন ছিল মাত্র ১১ কেজি। সহজে চোখ খোলা রাখতে পারত না সে। দাঁড়াতেও পারত না। অথচ সেই দেশেই যুদ্ধের জন্যে কেনা হয় কোটি-কোটি ডলারের অস্ত্র। তাতেও পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত সৌদি আরবকে গোয়েন্দা তথ্য ও জেট বিমানের জ্বালানি সরবরাহ করে আসছে। এসব তথ্য ব্যবহার করে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব, উঠেছে এমন অভিযোগও। কিন্তু দুর্নীতি কমবে কবে, মানুষ একটু শ্বাস নেবে কবে? জানে না কেউ।

এরপর আফগানিস্তান ! সারা দেশটাই দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ আর সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে রয়েছে। মানুষের সামান্যতম মৌলিক অধিকারও আজ সে দেশে নেই। আফগানিস্তানে লাগামছাড়াভাবে বাড়ছে দুর্নীতি। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বলছে, আফগানিস্তানে প্রতি বছর আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার দুর্নীতি হচ্ছে, যা দেশটির আফিম বাণিজ্যের প্রায় সমপরিমাণ। আফগানরা ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চেয়েও দুর্নীতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষগুলো করের মতন ঘুষ দিয়ে আরেও পঙ্গু হচ্ছে সে দেশে। তালিবানি শক্তি আর সরকারের দিশাহীনতা, আফগান মানুষদের সুখ-শান্তি কবে ফিরবে, তা বলা কঠিন। আমেরিকার নিদারুণ ‘দাদাগিরির’ও শিকার রুগ্ন আফগানিস্তান।

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

লুই ফার্দিনাঁ সেলিন ও উইলিয়াম বারোজ : মলয় রায়চৌধুরী

লুই ফার্দিনাঁ সেলিন ও উলিয়াম বারোজ : মলয় রায়চৌধুরী

.

এক

.

লুই ফার্দিনাঁ সেলিন সম্পর্কে তাঁর জীবনীকার মার্লিন টমাস লিখেছেন, “ব্যাপক অর্থে তিনি ছিলেন একজন কবি। তিনি আমাদের শতকের  অমানবিক ঘটনাবলীর একজন সাক্ষীও ছিলেন। সেলিনের পাঠবস্তু  হলো ‘যুদ্ধ, মৃত্যু এবং যৌনতা’ কিন্তু সেগুলো কেবল তাঁর পাঠবস্তু; প্রকৃতপক্ষে তাঁর বিষয় হলো ঘৃণা। বিশেষ করে, মানুষের অবস্থার প্রতি ঘৃণা ।” ১৯৪৯ সালে, সেলিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি “শতাব্দীর সবচেয়ে অভিশপ্ত লেখক ঘোষিত হবেন।” আবার, ১৯৬১ সালে,  সেলিন একটি কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন:  “আমি জীবিতদের মধ্যে  সবচেয়ে বড় জারজ!” অবশ্য   চার্লস বুকোস্কি বলেছিলেন সেলিন “২০০০ বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক” । সেলিন  ছিলেন একজন সাহিত্যিক প্রতিভা, এবং তাঁর আটপৌরে ফরাসি বুলির ব্যবহার (তাঁর সময়ের মার্সেল প্রুস্ত-উপাসক প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ), উপবৃত্তের  অবাধ প্রয়োগ বিশ শতকের  সবচেয়ে স্বতন্ত্র সাহিত্য শৈলীগুলির একটি তৈরি করতে সফল হয়েছিল।

.

প্যাসকেল ইফরি লুই-ফার্দিনান্দ সেলিনের  জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট (১৯৩৪ এবং ১৯৮৮)-এর দুটি ইংরেজি অনুবাদের তুলনা করেছেন –  সেলিন তাঁর স্বাতন্ত্র্যসূচক লেখার শৈলীকে  ‘যৎসামান্য সঙ্গীত’ বলে অভিহিত করেছিলেন আর তাঁর প্রথম অনুবাদক জন মার্কসকে তাঁর  অত্যন্ত প্রভাবশালী উপন্যাসের প্রাথমিক সংস্করণের গদ্যের ‘নাচের’ ছন্দের মতন ধারণা প্রকাশ করার চেষ্টা করতে উৎসাহিত করেছিলেন, যা মার্কস একেবারেই করেননি, বা পারেননি, যা তাঁর অনুবাদ থেকে স্পষ্ট। যাইহোক, রাল্ফ ম্যানহেইমের দ্বিতীয় অনুবাদটি পাঠ্যের মূল শৈলীর প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছে। ম্যানহেইমকে মার্কসের করা অনেক ভুল সংশোধন করতে হয়েছিল এবং মার্কসের ব্রিটিশ ইংরেজিকে আমেরিকানাইজ করে সেলিনের কাজের চেতনার সাথে তাল মিলিয়ে বইটিকে অনুবাদ করতে হয়েছিল । 

.

ব্রিটেনের সেন্সরশিপ – রক্ষণশীল সমাজের সরল লজ্জা – মার্কসের জন্য  সমস্যা ছিল, যেমন, ‘শিট’, ‘হতাশাগ্রস্ত গুদ’’, ‘অ্যাঁড়’ এমনকি  সৈন্যদের ‘হাত মারা’ সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিলেন মার্কস। সেলিনের তিনটে ফুটকি বা এলিপসিস প্রয়োগের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে তিনি বহু জায়গায় সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন। ম্যানহেইমের পুনরুদ্ধারের কাজের দরুন সেলিনের ফরাসি কেমন করে পড়া উচিত সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা হয়, তবে অনুবাদ অবশ্যই সবসময় সমস্যা তৈরি করে। এর সাথে যোগ করতে হয় বিশেষ অসুবিধা যা এই জাতীয় মৌলিক এবং যুগান্তকারী কাজের অনুবাদে  অবশ্যই আনতে হয় । 

.

পাসকাল ইফরি স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছেন যে ম্যানহেইমের অনুবাদটাও আদর্শ নয়, কিন্তু… কিন্তু ৫৪ বছর ধরে ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’-এর অনুবাদ যাঁরা ইংরেজিতে পড়েছেন বা জন  মার্কসের ইংরেজি থেকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন, তাঁদের ৫৪ বছর ধরে নিকৃষ্ট এক সংস্করণকে সেলিনের উপন্যাসের গদ্য বলে মেনে নিতে  হয়েছিল। তাহলে কীভাবে সেলিন মার্কিন লেখক ও বিট আন্দোলনের  ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিলেন, যাদের বেশিরভাগই  জন মার্কসের অনুবাদ পড়েছেন এবং সেলিন নয়? পাসকাল ইফরির মতে সেলিনের ‘বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি’ লেখকদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লেখার শৈলী নয়। সেলিনকে সম্ভবত কেউ নালিশও করেনি যে মার্কসের অনুবাদে ‘জার্নি টু দি এন্ড অফ দি নাইট’ অনুপস্হিত।

.

দুই

.

লুইস ফার্দিনাঁ সেলিন, যাঁর পিতৃদত্ত নাম লুইস-ফার্দিনাঁ দেসতুশ, জন্মেছিলেন ১৮৮৪ সালে ফ্রান্সের কোরবিভয়েতে । ১৮৮৪ সালে প্যারিসের শহরতলিতে  জন্মগ্রহণকারী সেলিন ছিলেন একমাত্র সন্তান। তাঁর মা তাঁদের ফ্ল্যাটের একতলায় একটা অন্তর্বাসের দোকানের মালিক ছিলেন, আর তাঁর বাবা  বীমা কোম্পানিতে  কেরানির কাজ করতেন । অন্তর্বাসের দোকানটা ১৮৯৭ সালে লাটে উঠে যাবার পর ১৮৯৯ সাল নাগাদ তাঁরা প্যারিসে চলে যান আর দ্রুত অবস্হা ফেরানোর চেষ্টা করেন । তরুণ সেলিনের জীবন কষ্টকর ছিল না। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডগুলো তরুণ লুইকে বুদ্ধিমান কিন্তু অলস শিশু হিসেবে বর্ণনা করে।  একটি স্কুলের প্রতিবেদনে তাঁর বাবা-মায়ের “দুর্বলতা”কে তাঁদের সন্তানের বিকাশের প্রতিবন্ধক হিসেবে সমালোচনা করা হয়েছে। তাঁকে  পরপর একটা স্কুল থেকে বের করে অন্য স্কুলে ভর্তি করানো হতো, অথচ  কোন আপাত কারণ ছাড়াই তাঁকে আবার আগের স্কুলে ভর্তি করা হতো।

.

লুইয়ের মা, মার্গুরাইত গুইলো, একজন শীতল আর অমিশুকে ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এটা তাঁর মাতামহী, সেলিন গুইলো, যিনি লুইকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, তাঁর অবদান। লুই পরে নিজের পরিচয় ঢাকতে দেশতুশ পদবি বাদ দিয়ে সাহিত্যিক হিসাবে সেলিন নামটা নিয়েছিলেন। লুইয়ের বাবা ফার্নান্দও ছিলেন একজন জটিল চরিত্রের মানুষ।  যে বছর ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দেফ্রুজকে  রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, লুই ফার্দিনাঁ সেলিন সেই বছর জন্মান । ক্যাপ্টেন দ্রেফুজ সম্পর্কে ফরাসি ক্যাথলিকরা এমন  গল্প  তৈরি করেছিল যা ফরাসি জাতিকে বিভক্ত করে  ইহুদি বিদ্বেষের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফার্নান্দও  বিশ্বাস করতেন যে দ্রেফুজ লোকটা বিশ্বাসঘাতক।

.

 ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফুজ ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীতে কর্মরত  উদ্ধত আর্টিলারি অফিসার।  ধর্মে ইহুদি। ইহুদি-বিরোধী ফরাসি সেনাবাহিনীতে যাদের যোগদান ছিল নিতান্তই নগন্য। সামান্য যে কয়জন ইহুদি সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে পদমর্যাদায় ও সাহসীকতায় দ্রেফুজই ছিলেন অন্যতম। আর সে কারণে ইহুদি-বিদ্বেষী সেনা অফিসারদের প্রতিহিংসার শিকার হন দ্রেফুজ। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে  বন্ধ ঘরে সাতজন বিচারকের সামনে  আলফ্রেড দ্রেফুজের কোর্ট-মার্শাল হবার সময়   জাল সাক্ষ্য প্রমাণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন বিচারকরা। শেষ অবধি দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । প্রকাশ্যে দ্রেফুজের সামরিক পোশাক খুলে নিয়ে কেড়ে নেয়া হয় সামরিক বাহিনীতে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাওয়া সব  পদক। সেনারা তাঁর তলোয়ার ভেঙে ফেলে। তাঁর অধস্তন সৈন্যদের সামনে দ্রেফুজকে কয়েক মাইল দৌড় করানো হয়। দৌড়ানোর সময় সৈন্যরা ইচ্ছেমতো তাঁকে পিটতে আর যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। তাঁর এক সময়ের সহকর্মী অফিসাররা  তাঁর গায়ে থুথু ছোঁড়ে। এরপর জাহাজে করে দ্রেফুজকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়  কুখ্যাত ‘শয়তানের দ্বীপ’ বা ‘ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ। ঘটনা এখানেই থেমে যেতো, ফরাসি জনগণ আর পাঁচটা বিচারের মতো এটিও হয়তো ভুলে যেতো যদি না সাহিত্যিক এমিল জোলা এই রায় নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করতেন।  সরকারকে খোঁচা দিয়ে মানহানির এমন একটা মামলায় নামতে সরকারকে বাধ্য করলেন জোলা, যাতে দ্রেফুজের বিচার আবার নতুন করে শুরু হয়। জোলা ‘লা অরোরে’ পত্রিকায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে রীতিমতো একটা খোঁচা-মারা চিঠি প্রকাশ করলেন। ‘অপরাধী’ শিরোনামে, বড়-বড় অক্ষরে চিঠিটি ছাপাও হলো। ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানকে বিদ্রুপ করার কারণে জোলার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়। রায়ে জেলের সাজা দেয়া হলে জোলা ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। কিন্তু এর মধ্যেই জোলার চিঠির প্রভাব হল ব্যাপক। সমাজের এক শ্রেণী, সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা, ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরু থেকে শুরু করে সমাজের পৃষ্ঠপোষকরা, সেনাবাহিনীর পক্ষে সমর্থন দিতে থাকে। আবার উল্টোদিকে, সমাজতন্ত্রী ও উদারপন্থী লোকজন ও বুদ্ধিজীবীরা দ্রেফুজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। ফলে সরকার নতুন করে দ্রেফুজের মামলা শুরু করতে বাধ্য হলো। ডেভিলস আইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে আনা হলো দ্রেফুজকে। তাঁর সেই শক্তপোক্ত, গর্বোদ্ধত চেহারা তখন আর নেই। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, শরীর প্রায় কঙ্কালসার। দ্রেফুজের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় । দ্রেফুজ মামলা ফরাসি লেখকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অর্ধ-ইহুদি, মার্সেল প্রুস্ত, দ্রেফুজের পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য আনাতোল ফ্রাঁসেকে অনুরোধ করেছিলেন ।

.

এই রাজনৈতিক ঘটনা বালক লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের মনে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি সারাজীবন ইহুদি-বিদ্বেষে ভুগেছেন । যেটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয় তা হল ইহুদি সম্পর্কে সেলিনের কুৎসিত মতামতগুলো তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাসে তেমন ছিল না । তাঁর  ক্রোধ এবং  বিদ্বেষ কোথা থেকে পয়দা হয়েছিল তা স্পষ্ট টের পাওয়া যায় না। যখন তিনি প্যারিসের কিছু নাৎসি দখলদারদের সাথে বসে খাবার খেতেন আর আড্ডা মারতেন, তখনও কিন্তু ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন আর  অনেক বিশিষ্ট ইহুদি বুদ্ধিজীবী যুদ্ধের পরে সেলিনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। অনুমান করা হয় যে সেলিনের রাজনৈতিক পুস্তিকাগুলোতে ব্যক্ত মতামত  তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া–– বিশেষ করে তাঁর বাবার কাছ থেকে। তাঁর বাবা নিজের যৌবনের সাহিত্য-শিক্ষা ও লেখক হবার পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে তার ব্যর্থতার জন্য ইহুদি এবং গুপ্ত-ভাতৃসঙ্ঘের সদস্যদের দায়ী করেছিলেন । সার্ত্রের মতো  লেখকরা সেলিনের তীব্র ইহুদিবিদ্বেষের কারণে   তাঁকে লেখক হিসেবে বিবেচনার অযোগ্য বলে  ঘোষণা করেছিলেন। 

.

তিনি তিনটি ইহুদি-বিরোধী প্রচারপত্র প্রকাশ করেন :  শিরোনাম ছিল ‘ট্রাইফেলস ফর এ ম্যাসাকার’ (ব্যাগেটেলস পউর আন ম্যাসাকার), ‘স্কুল ফর কর্পসেস’ (এল’কোলে দেস ক্যাডাভ্রেস) এবং ‘এ ফাইন মেস’ (লেস বেউক্স ড্রপস)—বই তিনটির কারণে তিনি উগ্র দক্ষিণপন্হী হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছিলেন  যারা পপুলার ফ্রন্ট, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আধুনিকতার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। যদিও তিনি  কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি, তাঁর অপ্রতিরোধ্য বর্ণবাদী ইহুদি-বিরোধী জাতিবাদ, জার্মানদের সঙ্গে সহযোগীতাবাদী কার্যকলাপ এবং ফরাসি জাতির প্রতি স্বঘোষিত বিতৃষ্ণার কারণে ভিচি শাসনামলের শেষের দিকে তাঁকে শত্রুপক্ষের লেখকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল । জানুয়ারি ২০১১ সালে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী ফ্রেদেরিক মিতেরঁ সংস্কৃতির জাতীয় উদযাপন উপলক্ষে বিখ্যাত ফরাসি লেখকদের তালিকা থেকে লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের নাম প্রত্যাহার করে নেন । এই  সিদ্ধান্তের কারণে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটে। অনেকে মিতেরঁর হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। আবার অনেকে সেলিনের পক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন যে তিনি এক বিরল সাহিত্যিক প্রতিভা এবং তাঁকে অবশ্যই লেখক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ।

.

ফ্রান্সে ইহুদি-বিরোধিতা বহু কালের । ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মতে ভলতেয়ার অন্ধকার ছড়িয়ে গেছেন, আলো নয়। তিনি খ্যাতনামা দার্শনিক হলেও প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন  বর্ণবাদী এবং ইহুদি-বিরোধী যিনি হিটলারকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। প্যারিসে তাঁর মূর্তি অপসারণের জন্য বহুকাল ধরে দাবি করছিলেন জনসাধারণ। ভলতেয়ারের ‘লেট্রিস ফিলোসফিক্স’, ‘ডিকশনেয়ার ফিলোসফিক’, এবং কাঁদিদ’, এবং  তাঁর আরও  কয়েকটি কাজ, ইহুদি আর ইহুদি ধর্মে সম্পর্কে নেতিবাচক  মন্তব্যে ঠাশা। ভলতেয়ারের ইহুদি-বিরোধী মতামত ফ্রান্সের জনগণের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল ।

.

 খোলাখুলিভাবে কয়েকটা ইহুদি-বিরোধী  উপন্যাস শতাব্দীর শুরুতে প্রকাশিত হয়েছিল, যা দ্রেফুজ মামলার প্রভাবে উদ্ভূত অতি-জাতীয়তাবাদী অনুভূতির তরঙ্গকে প্রতিফলিত করেছে। যেমন, পল অ্যাডামের ‘দি এসেন্স অব দি সান( ১৮৯০), লিয়ঁ ক্লদেলের ‘ওয়ানডারাইঙ জিউয়েস. ( ১৮৯৭), লিয়ঁ দদেত-এর ‘দি কান্ট্রি অব পার্লিয়ামেন্টারিয়ানস’ ( ১৯০১) এবং   ‘দি ফাইট’ ( ১৯০৭ )। এই সমস্ত উপন্যাসে দেখানো হয়েছে যে  ইহুদি হল এক জঘন্য ষড়যন্ত্রকারী, জাতির নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে এবং নৈতিকতাকে কলুষিত করে। একই সময়ে মরিস দনে লিখেছিলেন ‘দি রিটার্ন ফ্রম জেরুজালেম’ ( ১৯০৪ ) নামে একটি ইহুদি-বিরোধী নাটক । সেলিনের মতনই ‘জিলেস’( ১৯৩৯)-এর লেখক পিয়ের দ্রিউ লা রশেল জার্মানদের অধীনে ‘ইহুদি-বিরোধী’  রাজনীতির সঙ্গে আপস করেছিলেন। ওয়ালটার বেনিয়ামিন একে বলেছেন  ফ্যাসিবাদী “রাজনীতির নান্দনিকীকরণ” ।

.

খ্রিস্টধর্মীদের গির্জার  শিক্ষায় ইহুদিদের প্রতি শত্রুতা চতুর্থ শতাব্দীতে সেন্ট অগাস্টিন থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে মার্টিন লুথার পর্যন্ত লাগাতার প্রবাহিত হয়েছে। বাগ্মী এবং প্রচারক খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা  ইহুদিদেরকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং প্রভুর হত্যাকারী হিসাবে শিক্ষা দিতেন। শয়তানের সঙ্গী এবং ইডেন উদ্যানের সাপের জাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। গির্জার লিটার্জি, বিশেষ করে ক্রুসিফিকেশনের গুড ফ্রাইডে স্মরণের জন্য শাস্ত্রীয় পাঠ, এই শত্রুতাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।

.

প্যারিসে তাঁর অস্থির যৌবনের কারণে, লুইকে ১৪ বছর বয়সে বিদেশে পাঠান তাঁর বাবা ।  ইংল্যান্ড এবং জার্মানিতে থাকার দরুন সেখানকার ভাষাগুলো সেলিনের ভ্রমণ আর  ফ্রান্সের দখলের সময়  কাজে লেগেছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে জার্মান দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য পড়তে সাহায্য করেছিল, বিশেষত শেক্সপিয়র এবং জোসেফ কনরাড, যাঁদের রচনাগুলো  তাঁর লেখক-জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।

পেশায় চিকিৎসক, সেলিন তাঁর সৃষ্টিশীল  প্রতিভার জন্য প্রশংসিত হলেও,  অন্যভাবে  পরিচিত তাঁর ইহুদি-ঘৃণা এবং মানববিদ্বেষের  জন্য।  ইহুদি-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি সেলিন ; তাঁর সময়ের সবচেয়ে কট্টর ইহুদি-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোতে তাঁকে ঘন ঘন দেখা যেত। ইহুদি-বিরোধী পত্রিকায় পঁয়ত্রিশটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লাগামহীন ইহুদি বিরোধিতা জার্মান লেখক আর্নস্ট জাঙ্গার (১৮৯৫-১৯৯৮) কেও আতঙ্কিত করেছিল,  যখন তাঁরা দখলকৃত প্যারিসে ছিলেন।সেলিন তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় ভ্রমণে কাটিয়েছেন; সর্বনাশের দূত হিসাবে, ব্যাপারটা তাঁর জন্য ছিল একধরনের রাজনৈতিক ছুটি, আধুনিক বিশ্ব থেকে অব্যাহতি পাবার উপায়। একটি পুস্তিকায় সেলিন লিখেছিলেন—

 .
“মানুষের প্রকৃত বন্ধু কি? ফ্যাসিবাদ। শ্রমিকের জন্য কে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে? ইউএসএসআর নাকি হিটলার? অবশ্যই হিটলার। আপনার চোখে  লাল রঙের গু ছাড়াই সবকিছু আপনাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ছোট দোকানদারের  কে সবচেয়ে বেশি উপকার করেছে?  থোরেস নয়, হিটলার করেছে ! আমাদের যুদ্ধে যেতে কে বাধা দিচ্ছে?  হিটলার ! সমস্ত কমিউনিস্টরা (ইহুদি বা ইহুদিবাদী) ভাবে,  ক্রুসেডে গলা টিপে মারার জন্য ,আমাদের মৃত্যুর দিকে পাঠাচ্ছে, । হিটলার  মানুষকে বড় করতে চাইছেন, তিনি জীবনের পক্ষে, তিনি মানুষের জীবন এবং এমনকি আমাদের কথাও চিন্তা করেন। তিনি আর্য।”

.

১৯১২ সালে সেলিন অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু ১৯১৪ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর হাত গুরুতরভাবে জখম হয়ে যায়, যার দরুন তাঁকে সৈন্যবাহিনীর জন্য  অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।যুদ্ধের সময় তিনি লন্ডন ও আফ্রিকায় যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফ্ল্যান্ডার্সের যুদ্ধে সামনের সারিতে থাকাকালীন তার বাহুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন সেলিন । ভয়ে যে ডাক্তাররা হাত বাঁচানোর চেষ্টা করার বদলে কেটে ফেলবে, সেলিন এনেস্থেশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যাতে তিনি ডাক্তারদের কাজ দেখতে পান । তাঁর শ্রবণশক্তির গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল। তবে বীরত্বপূর্ণ আচরণের জন্য একটি পদক দিয়ে সামরিক বাধ্যবাধকতা থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার ডান হাত সারা জীবন আংশিকভাবে অবশ হয়ে গিয়েছিল আর একটা কানে কম শুনতে পেতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অশ্বারোহী অফিসার হিসেবে মাথার ক্ষতের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থেকে ১ জুলাই, ১৯৬১-এ সেলিন মারা যান।

.

যুদ্ধের পর সেলিন  অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের জন্য  বিশেষ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে ডাক্তারি শেখেন । চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর  থিসিস ছিল ডক্টর ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েস (১৮১৮-১৮৬৫) এর জীবন সম্পর্কে গবেষণা। লন্ডনে থাকার সময়ে ১৯১৫ সালে সেলিন সুজান নেব্যু নামে এক যুবতীকে বিয়ে করেন আর ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময়ে স্ত্রীকেও ছেড়ে দেন। ১৯১৯ সালে বিয়ে করেন এডিথ ফোলেকে ; তাঁকে এবং তাঁদের মেয়ে কোলেতকে ছেড়ে চলে যান ১৯২৫ সালে লিগ অফ নেশানসের চাকরিতে যোগ দিতে। তৃতীয়বার বিয়ে করেন ১৯৩৬  সালে  নর্তকী লুসেত আলমানজোরেকে যাঁর বয়স ছিল ২৩ এবং লেখকের ৪১, যদিও ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ অন্য আরেক নৃত্যশিল্পী এলিজাবেথ ক্রেগকে উৎসর্গ করেছিলেন । লুসেত  সেলিনের  মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে  ঈর্ষান্বিত স্বামীর সাথে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা,  ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। লুসেত সেলিনের নাম তার আগে শোনেননি,  একটা নাচের আসরে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল, যেখানে লুসেত মহড়া দিচ্ছিলেন।সেলিন ১৮ বছরের বড় ছিলেন এবং এর আগে দুবার বিয়ে করেছিলেন কিন্তু  বন্ধু হয়ে উঠতে অসুবিধা হয়নি । “আমি আমার বাকি দিনগুলো তোমার সাথে কাটাতে চাই,” সেলিন তাঁকে  প্রথম চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি মারা গেলে আমার আত্মাকে সংরক্ষণ করার জন্য আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি।”

.

দ্বিতীয় স্ত্রী এডিথ ফোলেকে এই চিঠিটি লিখে ছেড়ে চলে যান সেলিন—-

“তোমাকে কিছু খুঁজে পেতে হবে যাতে তুমি প্যারিসে স্বাধীনভাবে থাকতে পারো । আমার জন্য, আমি সম্ভবত কারো সাথে থাকতে পারি না –- আমি তোমাকে কাঁদিয়ে এবং দুঃখী করে আমার পিছনে টেনে নিয়ে যেতে চাই না, তুমি আমাকে বিরক্ত করেছ – আমার সাথে ঝুলে থেকো না। আমি  তোমার সাথে  বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে বরং খুন করে ফেলব – এটি জেনে নাও আর যোগাযোগ, কোমলতা দিয়ে আমাকে  বিরক্ত কোরো না – তার বদলে  জীবনকে তোমার পছন্দ মতো সাজিয়ে নাও। আমি একা থাকতে চাই, একা, একা, আধিপত্য বা কারো তত্ত্বাবধানে নয়, ভালোবাসতে চাই না: মুক্ত। আমি বিয়েকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, আমি এতে থুতু ফেলি। আমার জন্য এটা একটা কারাগারের মতো যেখানে আমি মারা যাচ্ছি।”

.

১৯২৪  সালে  মেডিকেল ডিগ্রি পেয়ে সেলিন ১৯২৭ পর্যন্ত লিগ অফ নেশনসের জন্য চিকিৎসা মিশনে ছিলেন।   লিগ অফ নেশনস -এর জন্য কাজ করার সময় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা জুড়ে ভ্রমণের সুযোগ পান।১৯২৫ সালে, বাবা-মায়ের আস্তানা চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যান। ১৯৩১ সালে চাকরি নেন এক মিউনিসিপ্যাল ​​ক্লিনিকে । সেখানে তিনি অত্যন্ত গরিব আর দুস্হদের চিকিৎসা করার সময়ে তাদের বুলির সঙ্গে পরিচিত হন। সেই সময় থেকে  জীবনের শেষ পর্যন্ত ,  আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও  অভাবীদের চিকিৎসা করেছেন আর উপন্যাসের মাল-মশলা সংগ্রহ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে  অন্যের কষ্ট থেকে অর্থ উপার্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

.

তিন

.

১৯২৯ সালে তিনি  উপন্যাস লেখা শুরু করেন। সেই বই,’জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’( ১৯৩৪ ) প্রকাশের সাথে-সাথে  সেলিনকে একজন শীর্ষ এবং উদ্ভাবনী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল । তিনি আক্রোশের সঙ্গে যুদ্ধ-বিরোধী এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী অবস্থান নিয়ে  নৈরাজ্যবাদী হিসাবে একই সঙ্গে নিন্দিত ও সমাদ্রিত হলেন। উপন্যাসের নায়ক-কথক, বারদামু, একজন মানুষের অত্যাচার-জর্জরিত জীবনের মানে এবং অস্তিত্বের মর্মার্থের জন্য আশাহীন অনুসন্ধানের গল্প, একটি তীব্র এবং বিচ্ছিন্ন শৈলীতে লেখা, যা  লেখককে বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের প্রধান উদ্ভাবক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বারদামু চরিত্রটি সেলিনের নিজের অভিজ্ঞতার কাছে  ঋণী,  তার স্রষ্টার মতোই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর-পর এক সাহিত্য কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে। সমর্থন সত্বেও গঁকুর পুরস্কার পেতে ব্যর্থ হয়, যদিও বামপন্হীদের, বিশেষত লুই আরাগঁ (১৮৯৭-১৯৮২) এর মতো  লেখকদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল, যাঁরা লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের ইহুদি-বিদ্বেষ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।

.

তাঁর উপন্যাসের নিরলস হতাশা, নৈতিকতা, ক্রোধ এবং কামোত্তেজকতা কিছু সমালোচককে বিরক্ত করেছে, যাঁরা তাঁর অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপত্তি করেন অথচ তাঁরা সেলিনের গদ্যের লিরিসিজমের প্রশংসা করেন। অন্যান্য সমালোচকরা সেলিনের বেদনাদায়ক আস্ফালনে একটি বিদ্রোহী মানবতাবাদ খুঁজে পান এবং তাঁর বিদ্রোহকে বিশ্বের অসহনীয় মন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও এটা সত্য যে অন্যান্য লেখকরা উন্মাদনা এবং ক্রোধের মতো বিষয়গুলিকে মোকাবেলা করেছিলেন, কিন্তু সেই  উপস্থাপনাগুলির বেশিরভাগই শিক্ষিতদের ভাষায় লেখা হয়েছিল এবং ঐতিহ্যগত উপন্যাস ফর্মের সীমাবদ্ধতায় আটক ছিল। সেলিনের অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি-উপন্যাসের ভাষা ও রূপকে এর থিমের সাথে এবং চরিত্রের সাথে মেলানোর জন্য-একটি সাহিত্যিক রূপ হিসাবে উপন্যাসের নতুন ব্যাখ্যার দিকে পরিচালিত করেছে।  পরিমার্জন এবং রীতির পুরোনো মানদণ্ডে  চরিত্রগুলোর কথাবার্তা প্রলাপ সুলভ মনে করাকে নাকচ করে দিতে পেরেছিলেন সেলিন। আঁদ্রে জিদ  বলেছিলেন: “সেলিন যা লেখেন তা বাস্তবতা নয়, বরং হ্যালুসিনেশন, যা বাস্তবতা থেকে পয়দা হয়।” ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ ঔপন্যাসিক ম্যাভিস গ্যালান্ট লিখেছিলেন “সেলিনের অন্ধকার নৈরাজ্যবাদ”, “তাঁর রাস্তাছাপ ভাষার ব্যবহার, রহস্য এবং মৃত্যুর হাতছানি উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানাটান ঘটনা বাম এবং ডান উভয়ের কাছেই ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়; দুপক্ষই এতে পতন, নোংরা গণতন্ত্রের অবসান, অসুস্থ ইউরোপের মৃত্যু সম্পর্কে একটি ভবিষ্যদ্বাণী পায়।”

.

সেলিনের লেখক-বিরোধীতায় এমন কিছু ছিল যা এক ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং পরবর্তীতে অনেক পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি কখনো  তাঁর পাঠকদের ওপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেননি, বিশেষ করে শিল্প বা সাহিত্য করছেন বলে দাবি করেননি ; তিনি কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি বা একাডেমিক শব্দ ব্যবহার করেননি; এবং তিনি তাঁর সময়কার ঔপন্যাসিকদের কয়েকজনের লেখা পড়েছেন বলে দাবি করেননি। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সাহিত্য সমাজের সমস্যাগুলি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভাল হতে পারে, আপনি যদি সত্যিকারের ভাল করতে চান তবে আপনাকে একবারে একজন রোগীর ব্যক্তিগত অসুস্থতাগুলিকে উপশম করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। “আমি দারিদ্র্যের মধ্যে শুরু করেছিলাম, এবং এভাবেই আমি শেষ করছি।” সেলিনের তিক্ত, বিস্তৃত, নারকীয় কল্পনার কালো হাসির ঝলক না থাকলে, সম্ভবত  হেনরি মিলার,  বিট আন্দোলন, জাঁ জেনে, কার্ট ভনেগাট, নাথানিয়েল ওয়েস্ট, হুবার্ট সেলবি, টমাস পিনচন, উইলিয়াম গ্যাডিস-এর মতন লেখক পাওয়া যেতো না।

.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যেহেতু ফ্রান্স মূলত জার্মান বাহিনীর দখলে ছিল, সেলিন বেশ কিছু পুস্তিকা লিখেছিলেন যেগুলিকে ইহুদি বিরোধী বা ইহুদিদের প্রতি নেতিবাচক হিসাবে দেখা হয়েছিল।১৯৪৪ সালের জুন মাসে মিত্রবাহিনী নরম্যান্ডিতে নামলে, সেলিন প্যারিস থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন কারণ তিনি আঁচ করেছিলেন যে তাঁকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে, একটি ন্যায্য বিচার প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং সম্ভবত তাঁর ইহুদি বিরোধীতা এবং সাম্যবাদের প্রতি শত্রুতার কারণে শত্রুর সাথে সহযোগিতা করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। সেলিন আর তাঁর তৃতীয় স্ত্রী, ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে প্যারিস ছাড়ার পরে, তাঁর ফ্ল্যাটে ভাংচুর করা হয়েছিল,  নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল তাঁর লাইব্রেরি আর কাগজপত্র । ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে, সেলিন জার্মান শহর সিগমারিংজেনে বসবাস আরম্ভ করেন। 

.

যদিও প্রথমদিকে বামপন্থী রাজনীতিকদের একজন প্রিয় লেখক ছিলেন, কিন্তু  সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের পর সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা দেখে হতাশ হয়ে পড়েন আর  ‘মেয়া কুলপা’ ( ১৯৩৭ ) রচনায় তা স্পষ্ট করেন । পরে তিনি ধর্মান্ধভাবে ইহুদি-বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলেন, যা লিখে তিনটি  প্যামফ্লেট প্রকাশ করেন: ‘গণহত্যার মামুলিপনা’ ( ১৯৩৭ ), ‘মৃতদেহের স্কুল’ ( ১৯৩৮ ) এবং ‘সুন্দর চাদর’ ( ১৯৪১ )।  এই পুস্তিকাগুলোতে সেলিন ফরাসিদেরও  আক্রমণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময়, সেলিন অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবাতে তালিকাভুক্ত হন, কিন্তু ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের পতনের পর তিনি সহযোগিতা আর প্রতিরোধ দুটো শিবিরকেই  প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরিবর্তে বেজোনসে একটি ডিসপেনসারিতে কাজ করতে ফিরে যান। তাঁকে জার্মান খোচর হিসেবে অভিযুক্ত করা হবে এই ভয়ে, তিনি ফ্রান্সের মিত্রবাহিনীর মুক্তির সময় জার্মানির মাধ্যমে ডেনমার্কে পালিয়ে যান, যেটি তখন মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার  মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ডেনমার্কে তাঁকে এক বছরেরও বেশি সময় জেলে পোরা হয়েছিল। সেসময়ে ফরাসি কর্মকর্তারা তাঁকে জার্মান খোচরগিরির জন্য অভিযুক্ত করেছিল এবং তাঁর প্রত্যর্পণের দাবি করেছিল।

.

১৯৪৫ সালের এপ্রিলে,  ফরাসি আদালত নাৎসি সহযোগী হিসাবে সেলিনের গ্রেপ্তারের জন্য  পরোয়ানা জারি করে। যখন কোপেনহেগেনে ফরাসি কর্মকর্তারা সেলিনকে অবিলম্বে নির্বাসিত করার দাবি জানায়, তখন ডেনিসরা তাকে চৌদ্দ মাস এবং তার স্ত্রীকে দুই মাসের জন্য কারারুদ্ধ করে সাড়া দেয়। খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য, সেলিনকে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। চার মাস পরে সুস্থ হয়ে উঠলে, তাঁকে এই শর্তে মুক্ত করা হয়েছিল যে তিনি ডেনমার্কে থাকবেন, যেখানে তিনি ১৯৫১ সালের এপ্রিলে সাধারণ ক্ষমা না হওয়া পর্যন্ত  ছিলেন।

.

১৯৪৮ সালে তিনি প্যারিসের শহরতলি মিউদঁতে ডিসপেনসারি খোলেন, আর অবসর সময়ে লেখালেখি আরম্ভ  করেন।  সেলিন  ডাক্তার হিসাবে কাজ করার সময় উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম কাজ, জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট  , লিখতে  সময় লেগেছিল পাঁচ বছর। ১৯৩২ সালে এটি শেষ হলে, এক হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি দুটি ফরাসি প্রকাশনা সংস্থা, গ্যালিমার এবং ডেনোয়েলের কাছে জমা দেন । গ্যালিমার বইটিকে খুব বিতর্কিত বলে মনে করে, কিন্তু রবার্ট ডেনোয়েল, একজন নতুন প্রকাশক, যিনি আরও বেশ কয়েকটি বিতর্কিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছিলেন, সেলিনের উপন্যাসটা ছাপেন। তাঁর  সাহিত্যিক আর চিকিৎসা জীবন আলাদা করার জন্য, দেশতুশের বদলে সেলিন ছদ্মনামে উপন্যাস প্রকাশ করেন।‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ নাইট’ প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় ; আখ্যানবস্তু হলো , একজন মানুষের নির্যাতিত এবং অর্থের জন্য আশাহীন অনুসন্ধানের প্রয়াস, একটি ভাঙাভাঙা ফরাসি গদ্যে সাধারণ মানুষের বুলিতে লেখা যা তাঁকে  চিহ্নিত করেছিল বিংশ শতাব্দীর ফরাসি সাহিত্যের প্রধান উদ্ভাবক হিসেবে। তারপর লেখেন ‘ডেথ অন দ্য ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’, ( ১৯৩৬ ), যে উপন্যাসে মানুষের মূল্যবোধহীনতা,  সৌন্দর্য ও শালীনতা-বঞ্চিত একটি পৃথিবীর একইরকম অন্ধকার চিত্রিত হয়েছে। 

.

সেলিনের অসূয়াপূর্ণ, রহস্যঠাশা ও  কৌতুকভরা ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ এর প্রকাশনা  ফরাসি সাহিত্য জগতে  আঘাত তরঙ্গ তুলেছিল যা তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক এবং শৈল্পিক অবনমন থেকে ভুগছিল। এর সাহসী  প্যারিসীয় বুলি, অপভাষা,  অশ্লীল, মজার, রাস্তাছাপ বাক্য একসাথে যুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, শিল্পবাদ, এবং হেনরি মিলার যাকে  বলবেন, বিশ শতকের জীবনের “এয়ারকন্ডিশন্ড দুঃস্বপ্ন”, তাকে উপস্হাপন করেছেন সেলিন। উপন্যাসটি তখন থেকে একটি উজ্জ্বল এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ, যদিও তিক্ত এবং প্রায়শই অসন্তুষ্ট, তবু তা  আধুনিক অবস্থার  ভাষ্য। গদ্যটি পাঠকের মস্তিষ্কে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডের মতো, ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ফুটো করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়, বাক্য এবং শব্দ গজিয়ে ওঠে ছত্রাকের মতন। উপন্যাসটি ব্যাকরণের দাসত্ব  এবং বাক্য গঠনের ভাঙ্গা হাড়ের নিয়ম ছেড়ে রৈখিক আখ্যানকে বিকৃত করতে করতে এগোয়।

.

যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে জানায় যে ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’- এর রাশিয়ান অনুবাদ থেকে রয়্যালটি পাঠাবে না তখন সেলিন ১৯৩৬ সালে দেশটিতে যান। সেই সফরের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি । ফলস্বরূপ, সেলিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে চারটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ  লিখেছিলেন । দেশটিকে বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে একটি দুষ্ট একনায়কত্ব বলে অভিহিত করেন। সেলিনের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকরা নোংরা অবস্থায় বাস করত আর তারা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নতুন শাসক শ্রেণী– কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা শোষিত হচ্ছিল ।

.

চার

.

সাহিত্যে সেলিনের অবদান প্রাথমিকভাবে তাঁর রোগিদের ফরাসি বুলির ব্যবহার —যার মধ্যে বঞ্চিত ও রুগ্ন মানুষের সমস্ত ক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহা ও অপ্রচলিত চক্রান্ত সম্পর্কিত উদ্বেগ বুনেছেন লেখক। তাঁর উপন্যাসগুলো দীর্ঘ এবং অশোধিত প্রথম-ব্যক্তি বর্ণনা এবং বিচ্ছিন্ন প্লট নিয়ে গঠিত, যা প্রায়ই পাঠককে বিভ্রান্ত করে। সেলিনের  উপন্যাসের বর্ণনাকারীরা যেন ভ্রান্ত, বেপরোয়া মৌখিক আক্রমণ করে, হিংস্র হাস্যরসে আনন্দ পায়, এবং আফ্রিকার জঙ্গল থেকে ডেট্রয়েটের কারখানায় পৌঁছে যায় এক লপ্তে । তার অসংযত ভাষা হল ফরাসি স্ল্যাং, গালমন্দ, রাস্তার ব্যাকরণহীন  প্রলাপের এক অনন্য সংমিশ্রণ।  তার  প্লেটগুলো অম্লীয় ব্যঙ্গ দ্বারা সজ্জিত। সেলিনের কাজকে প্রায়শই আর্তুর র‌্যাঁবো  এবং শার্ল বদল্যারসহ আগের লেখকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে । কেউ কেউ যুক্তি দেন যে সেলিনের উপন্যাসগুলো তাদের ক্রোধ এবং হীনমন্যতায় অতুলনীয়। সেলিন তাঁর উপন্যাসে ফরাসি গালমন্দ ব্যবহার করেছেন উজ্জ্বল প্রভাবের জন্য, যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর সময়ের ইংরেজি অপভাষা ব্যবহার করেছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত “সঠিক” ভাষা এবং “অপভাষার” মধ্যে একটি পার্থক্য বজায় ছিল, লেখকরা  পার্থক্যগুলো মানতেন।সেলিনের পর কোনো সৃষ্টিশীল গদ্যকার আর সেসব মানেন না ।

.

প্যারিসের একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাঁকে  ক্ষমা করার পর  ১৯৫১ সালে তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান। ফিরে গিয়ে তিনি আবার ডাক্তারি শুরু করেন আর পাসাপাশি লেখালেখি করতে থাকেন। তাঁর শেষ কাজগুলো যথাক্রমে, ‘ক্যাসল থেকে ক্যাসেল’ (১৯৫৭ ), ‘নর্ড’ ( ১৯৬০), এবং ‘রিগাদুন’ ( ১৯৬৯ ) যা আসলে একটি ট্রিলজি,  জার্মানির ভেতর থেকে দেখা  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে চিত্রিত করেছেন। সমালোচকদের মতে শক্তি এবং শৈলীতে তাঁর দুটি বিখ্যাত প্রাথমিক উপন্যাসের সমান  এই ট্রিলজি । অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘গুইগনোল’স ব্যাণ্ড ( ১৯৪৪ ), কাসে পাইপ ( ১৯৪৯ ) , ‘শুটিঙ গ্যালারি’ এবং ‘কনভারসেশানস উইথ প্রফেসর ওয়াই’ ( ১৯৫৫)। সম্প্রতি সেলিনের ‘গুয়েরে’ বা ‘যুদ্ধ’ নামের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে।

.

১৯৩০-এর দশকে সেলিনের  খ্যাতি বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের বছরগুলোতে এবং পরে তাঁর ক্রমবর্ধমান মানববিদ্বেষের কারণে কিছুটা হ্রাস পায়। আসলে তাঁর কাহিনিগুলোতে নিরলস হতাশা, নীতিহীনতা, ক্রোধ এবং কামোত্তেজক প্রকাশভঙ্গী  কিছু সমালোচক গ্রহণ করতে পারেননি , যাঁরা একদিকে সেলিনের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপত্তি করেন অথচ তাঁর গদ্যের লিরিসিজমের প্রশংসা করেন। আবার কিছু সমালোচক সেলিনের বেদনাদায়ক পাঠবস্তুতে  একটি বিদ্রোহী মানবতাবাদ খুঁজে পান এবং তাঁর বিদ্রোহকে বিশ্বের অসহনীয় মন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।তিনি এত শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন যে তার কাজটি অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশ বছর পরে যখন সেলিনের নাম মুছে ফেলা হয়েছিল তখনই ফরাসিরা তার জীবন এবং কাজের প্রকাশের অনুমতি পেয়েছিল। যখন তার লেখা জনসাধারণের কাছে উপলব্ধ হয়, তখন পাঠকরা জানতে পেরেছিলেন যে সেলিন একজন দক্ষ গদ্য-শিল্পী ছিলেন যাঁর ভাষা এবং উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষাগুলো সারা বিশ্বের লেখকদের প্রভাবিত করেছে।

.

লুই ফার্দিনঁ সিলিনের ঘনান্ধকারে আচ্ছন্ন দৃষ্টিপ্রতিভার দ্বারা অনুপ্রাণিত ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার লেখকদের মধ্যে জাঁ জেনে,স্যামুয়েল বেকেট, অ্যালাইন রবে-গ্রিয়ে, জাঁ পল সাত্রে, হেনরি মিলার, কার্ট ভনেগাট, জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম বারোজ, ফিলিপ রথ উল্লেখ্য। মানব অস্তিত্বের  অন্ধকার মোচড়গুলো সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি সার্ত্রের উপন্যাস নজিয়া, যা অস্তিত্ববাদের পথনির্দেশক কাজ, এবং লা জালুসি, অ্যালাইন রবে-গ্রিয়ের আবেশী স্বামীর চিত্রায়নকে অনুপ্রাণিত করেছিল। “সেলিন আমার প্রুস্ত!” বলেছেন ফিলিপ রথ। “প্রত্যেক লেখকই তাঁর কাছে ঋণী,” বলেছেন কার্ট ভনেগাট।সিলিন  একটি উদ্ভাবনী এবং স্বতন্ত্র সাহিত্য শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। মরিস নাদেউ লিখেছেন: “ইংরেজি ভাষার জন্য জেমস জয়েস যা করেছিলেন,  পরাবাস্তববাদীরা ফরাসি ভাষার জন্য যা করার চেষ্টা করেছিলেন, সিলিন অনায়াসে এবং বিশাল পরিসরে তা অর্জন করেছিলেন।আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের এক অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয় । নিজের উপন্যাসে  বুর্জোয়াদের “অতিপ্রাকৃত” ভাষা বর্জন করে, তিনি সাধারণ মানুষর দ্বারা পথ-চলতি ফরাসি বুলি ব্যবহার করেছেন। সেলিনের কাজকে জেমস জয়েসের আধুনিকতাবাদী, চেতনাপ্রবাহ শৈলীর  সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়; এর অশ্লীলতার জন্য মিলার; হেমিংওয়ে তার স্থুলতার জন্য, যা ফরাসি ভাষায় আরও বেশি ঝাঁকুনি দেয় যেখানে বাক্যগুলো সাধারণত ইংরেজির চেয়ে দীর্ঘ হয়। সেলিন এবং হেমিংওয়ের মধ্যে মিল এখানেই শেষ নয়। দুজনেই সামনের দিকে আহত হয়েছিলেন, ইতালিতে হেমিংওয়ে তাঁর ১৯ তম জন্মদিনের কয়েক সপ্তাহ আগে, আর ২০ বছর বয়সে ফ্রান্সে সেলিন। উভয়ই বিশ্ব ভ্রমণকারী ছিলেন এবং প্যারিসের রাস্তার জনগণের সঙ্গে মিশে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। উভয়েই আধুনিকতাবাদী গদ্য স্টাইলিস্ট ছিলেন, তাঁরা যে ভাষায় লিখেছেন তার উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন। এমনকি তাঁরা একে অপরের কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান।

.

যদিও এটা সত্য যে অন্যান্য লেখকরা উন্মাদনা এবং ক্রোধের মতো ব্যাপারগুলোকে নিজেদের লেখালিখিতে মোকাবেলা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের উপস্থাপনাগুলোর বেশিরভাগই শিক্ষিতদের ভাষায় বোনা হয়েছিল এবং চিরাচরিত উপন্যাসের আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ ছিল। সেলিনের অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি-উপন্যাসের ভাষা ও রূপকে এর থিমের সাথে এবং চরিত্রের সাথে মেলানোর জন্য-একটি সাহিত্যিক রূপ হিসাবে উপন্যাসের নতুন আঙ্গিকের দরোজা খুলে দিয়েছে । পাঠকরা  পরিমার্জন এবং রীতির সুরক্ষার বাইরে চরিত্রগুলোর অদ্ভুত আচরণ ও কথাবার্তার সঙ্গে প্রথমবার  পরিচিত হয়েছে। 

.

পাঁচ

.

লুই-ফার্দিনাঁ সেলিনের কয়েকটা নতুন  উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া গেছে, একটার নাম, “গুয়েরে” বা “যুদ্ধ,”। সম্প্রতি ফ্রান্সে, গ্যালিমার তা প্রকাশ করেছে। উপন্যাসটিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে, সেলিনের মস্তিষ্কের সবকিছু আছে আর  এর  ভাল এবং মন্দ নিয়ে অনেক পুনরুজ্জীবিত যুক্তি আবির্ভূত হয়েছে, তাঁর সাহিত্যিক মূল্যকে তাঁর রাজনৈতিক প্যাম্ফলেটিয়ারিংয়ের জঘন্য ইহুদি-বিরোধিতা থেকে আলাদা করা যায় কিনা এবং কীভাবে উপন্যাসটির মূল্যায়ন করা উচিত তা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছ। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাগুলিতে, কথক মৃতদেহের পাশে শুয়ে আছে, যখন একজন সৈনিক—যার বর্ণনার চেতনা প্রমাণ করবে— যে তার কান মাটির সাথে রক্তে আটকে গেছে এবং বিস্ফোরণের শব্দে তার মাথা কেঁপে উঠছে, অবাক হচ্ছে যে সে আহত হয়েছে কিনা। এমনকি তার কর্তিত শরীরের সাথে বাহু তখনও জুড়ে আছে কিনা ; কাছাকাছি, দুটি ইঁদুর খাবারের সন্ধানে আরেকটি মৃতদেহের পিঠের ঝোলায় হুড়োহুড়ি করছে। সৈনিকটা,  নিজের মগজে, স্থায়ীভাবে, কামানের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বন্ধুত্ব সৈন্যরা মরিয়া অনুসন্ধানে মৃত্যুর মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও তীব্র উপলব্ধি সম্ভবত সেলিনের এই বইয়ের আগে লেখা হয়নি। যুদ্ধকালীন  ট্রেঞ্চের অন্যান্য বিখ্যাত বর্ণনাকে  অবাস্তব  মনে হতে পারে। যেমন হেমিংওয়ের “এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস”-এ স্ব-সচেতনভাবে কাব্যিক। এরিখ মারিয়া রেমার্কের “অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট,” এক ধরণের পরিশীলিত বিতর্ক।

.

নতুন  পাণ্ডুলিপি — “লন্ড্রেস” বা “লন্ডন” । সেটা “গুয়ের” এর সিক্যুয়েল সহ আরও দুটি বইয়ের প্রকাশও আসন্ন। এগুলো সেলিনের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মতো একই সময়ে লেখা৷ পাণ্ডুলিপিগুলো ১৯৪৪ সালে হারিয়ে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে, যখন  সেলিন জানতে পেরেছিলেন  যে তাঁকে ফ্রান্সে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সেসময়ে তিনি প্রথমে জার্মানি, তারপর ডেনমার্কে পালিয়ে যান । পাণ্ডুলিপিগুলো কারোর কাছে থেকে যায় । ২০২০ সালে, বামপন্থী দৈনিক ‘লিবারেশন’-এর প্রাক্তন থিয়েটার সমালোচক জাঁ-পিয়ের থিবাউদাত পাণ্ডুলিপিগুলো খুঁজে পান। (সেলিনের স্ত্রী, যিনি কপিরাইটের মালিক, আগের বছর একশ সাত বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন।)। “গুয়েরে” পুরোটা যুদ্ধের বিষয়ে নয় ; বরং যুদ্ধের আগের পরিস্হিতি সম্পর্কে। বর্ণনাকারীকে  কেবল ফার্দিনাঁ হিসাবে দেখানো হয়েছে, সে তার আঘাত থেকে হাসপাতালে সেরে উঠছে — সহানুভূতিশীল এবং কামুকভাবে, প্রথমে একজন নার্সের আকর্ষণে , তার চিকিৎসা হয়। কষ্ট এবং মৃত সৈন্যদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে। তারপর এক পতিতার সুশ্রষা তার দেহের আকাঙ্খাকে সুস্হ করে তোলে । 

.

১৯৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর সময়, সেলিন সমসাময়িক ফরাসি সাহিত্যে একটি একক স্থান তৈরি করে গেছেন ।  অন্যান্য লেখকদের উপর তাঁর প্রভাবের জন্য তিনিব্যাপকভাবে পরিচিত কারণ সেলিন উপন্যাসের রূপ কী হতে পারে তার  নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে গেছেন। ‘সেলিন অ্যান্ড হিজ ভিশন’ গ্রন্থে , এরিকা ওস্ট্রোভস্কি উল্লেখ করেছেন যে সেলিনের কাজ “একটি নতুন স্বর তৈরি করেছে, একটি সাহিত্যিক পরিবেশ যা আধুনিক সাহিত্যভাষার একটি সম্পূর্ণ এলাকাকে বিস্তৃত করে এবং জাতীয় সীমানা বা ব্যক্তিগত অভিযোজন এবং পটভূমির সীমা অতিক্রম করে চলে যায়।” নিরলস মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদের জন্য কার্ট ভনেগাট থেকে ফিলিপ রথ পর্যন্ত লেখকরা সেলিনকে শ্রদ্ধা করেন। সেলিন লিখতে শুরু করলেন ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’, তার প্রথম উপন্যাস, ১৯২৯ সালে, যখন তিনি প্যারিসের শহরতলির শ্রমিক শ্রেণীর একটি পাবলিক ক্লিনিকে একজন ডাক্তার হিসাবে কাজ করছিলেন।

.

উপন্যাসগুলোর উত্তমপুরুষ ফার্দিনাঁ বারদামু হলেন একজন তরুণ প্যারিসীয় মেডিকেল ছাত্র যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটায় স্বেচ্ছায় ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। শত্রুর সাথে তাঁর প্রথম মোকাবেলার সময় তিনি টের পান  যে যুদ্ধের কোন মানে হয় না এবং তাঁকে এই নরক থেকে বেরোতে হবে। নিশাচর অনুসন্ধান মিশনে একা, তিনি লিয়ঁ রবিনসন নামে একজন ফরাসি গার্ডের সাথে দেখা করেন কেননা সেও জার্মানদের দ্বারা বন্দী হতে চায় যাতে  যুদ্ধ শিবিরের একজন বন্দীর আপেক্ষিক নিরাপত্তায় যুদ্ধ এড়িয়ে বসে থাকতে পারে। বারদামু আর রবিনসন একটা ফরাসি শহরে ঢোকে কিন্তু সেখানে আত্মসমর্পণ করার মতো কোনো জার্মান অধিকারীর খোঁজ পায় না৷ হতাশ হয়ে তারা তাদের আলাদা পথে চলে যায়।

.

বারদামু যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় আর সামরিক পদক পায়। প্যারিসে সুস্থতার ছুটিতে, বারদামু লোলা নামে একজন আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক নার্সের সাথে দেখা করে যার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। তারা একটা চিত্তবিনোদন পার্কে বেড়াতে যায়্ । সেখানে বরদামু শুটিং গ্যালারিতে  স্নায়ুবৈকল্য আক্রান্ত হয়। সে লোলাকে বলে যে সে যুদ্ধ চায় না  কারণ সে কোন কিছুর জন্য মরতে চায় না। লোলা তাকে বলে সে কাপুরুষ আর তাকে ছেড়ে চলে যায়।

.

বারদামু মুসিনের সাথে সম্পর্ক শুরু করে, যিনি একজন বেহালাবাদক। যাইহোক, তিনি শীঘ্রই বারদামুকে ছেড়ে চলে যান উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী আর্জেন্টিনীয়দের কাছে,  যারা যুদ্ধ থেকে টাকাকড়ি কামিয়েছে। তাকে একটা হাসপাতালে ভর্তি  করা হয়। হাসপাতালে বৈদ্যুতিক থেরাপি হয়  আর ডাক্তাররা দেশপ্রেমিক মনোরোগবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ। অবশেষে তাকে চাকরির জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

.

বারদামু ফরাসি ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় যায় যেখানে তাকে জঙ্গলের ভেতরে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের  দায়িত্বে রাখা হয়। এখানে  ফরাসি প্রশাসনে তার সহকর্মী আলসাইডের সাথে বন্ধুত্ব হয়। বারদামু দেখতে পায় যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রটা কেবল একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর, এবং বারদামু যার জায়গায় এসেছে তিনি হলেন রবিনসন। রবিনসন তাঁকে বলেন যে কোম্পানিটা তার কর্মচারী এবং স্থানীয়দের সাথে জোচ্চুরি। রবিনসন রাতে লুকিয়ে চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ পর, বারদামু জ্বরে আক্রান্ত হয় আর জ্বরের ঘোরে বাণিজ্য কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোম্পানির সাথে প্রতারণা করার শাস্তির ভয়ে, বারদামু উপকূলে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বারদামুকে জ্বরের ঘোরে প্রলাপগ্রস্ত দেখে,আশেপাশের গ্রামের লোকেরা তাকে একটা স্প্যানিশ উপনিবেশে নিয়ে যায় যেখানে একজন যাজক তাকে গ্যালি স্লেভ হিসেবে জাহাজের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। জাহাজটা নিউইয়র্ক রওনা হয় যেখানে বারদামুকে তার জ্বর না কমা পর্যন্ত সবায়ের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বারদামু কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে। কাজের সূত্রে তাকে ম্যানহাটনে পাঠানো হয়। সে লোলার খোঁজে যায় এবং অবশেষে তাকে খুঁজে পায়। সে তখন বেশ বড়োলোক আর  পরিত্রাণ পেতে আগ্রহী।  সে তাকে একশ ডলার দিলে,চলে যায় ডেট্রয়েটে কাজের সন্ধানে।

বারদামু  ফোর্ড মোটর কোম্পানির অ্যাসেম্বলি লাইনে নিযুক্ত হয়। বারদামু কাজটাকে ক্লান্তিকর এবং অমানবিক মনে করে। বারদামু মলি নামের বেশ্যার প্রেমে পড়ে। যুবতীটি তাকে তার সাথে আমেরিকায় সংসার করতে বলে কিন্তু বারদামু জড়িয়ে পড়তে চায় না। সে যে পরিস্থিতির মধ্যেই থাকুক না কেন তা থেকে পালানোর চেষ্টা করে । বারদামু ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে ডাক্তারির প্রশিক্ষণ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

.

প্যারিসে ফিরে, বারদামু তার ডাক্তারি পড়া শেষ করে এবং লা গারেন-রেন্সির অন্ধকার (কাল্পনিক) উপশহরে ডাক্তারি শুরু করে। বাসিন্দারা বেশিরভাগই খুব গরিব। তাকে ফিস দেবার সামর্থ নেই বললেই চলে। বারদামু অনাকাঙ্খিত গর্ভপাত আর যাদের রোগ সারছে না তাদের চিকিৎসায় গুরুত্ব দেয়। তার রোগীদের মধ্যে রয়েছে মাদাম অঁরুইল আর তার স্বামী যার মা, ঠাকুমা তাদের বাড়ির পিছনে একটি ঝুপড়ির মধ্যে থাকে ।  তারা বুড়িকে হত্যা করার জন্য রবিনসনকে ভাড়া করে কিন্তু সে তার জন্য যে বারুদের ফাঁদ পাতে তা তার মুখেই ফেটে গিয়ে তাকে অন্ধ করে দেয়।

.

 বারদামু প্যারিসের উপকণ্ঠে  পাগলাগারদের আশ্রয়ে চাকরি খুঁজে পায়। পাগলাগারদের পরিচালক, ডাক্তার ব্যারিতঁ, বারদামুর থেকে ইংরেজি শেখা নেওয়া শুরু করেন।  ব্যারিতঁ মনোচিকিৎসার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে আর বারদামুকে  দায়িত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। ব্যারিতঁর চিকিৎসালয়ে বারদামুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে একজন নার্স সোফির সঙ্গে।

.

রবিনসন বারদামুর সাথে দেখা করে বলে  যে আর মাদেলঁ ক্রিপ্টে তাদের লাভজনক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কারণ সে আর মেয়েটার ভালবাসা চায় না। বারদামু তাকে নিজের আশ্রয়ে থাকার অনুমতি আর সামান্য কাজ দেয়। মাদেলঁ রবিনসনকে খুঁজে বের করে আর হুমকি দেয় যে তাকে বিয়ে না করলে  পুলিশে ধরিয়ে দেবে । সোফি, পরামর্শ দেয় যে সে, বারদামু, রবিনসন আর মাদেলঁ একসঙ্গে  ডাবল ডেটে গেলে ব্যাপারটার সুরাহা হবে। চারজন মিলে একটা কার্নিভালে যায় কিন্তু ট্যাক্সি করে চিকিৎসালয়ে ফেরার  সময় রবিনসন মাদেলঁকে বলে যে সে তার সাথে থাকতে চায় না কারণ সে  প্রেম ব্যাপারটাকে ঘেন্না করে। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয় আর  মাদেলঁ   রবিনসনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। রবিনসন মারা যায়। ঘটনার ফলে বারদামুর মনে হয় যে সে  মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো ধারণা খুঁজে পাননি।

.

‘ডেথ অন দ্য ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’ উপন্যাসে ফার্দিনাঁ বারদামু,  সেলিনের অল্টার ইগো যা জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট উপন্যাসে আছে, এই উপন্যাসটা তার আগের পর্ব। প্যারিসের একজন ডাক্তার, দুস্হদের চিকিৎসা করে কিন্তু তারা বারদামুকে  খুব কমই ফিস দেয় অথচ  সমস্ত সুযোগ নেয়। কাহিনি রৈখিক  নয় তবে সময়ের সাথে সাথে বারদামু আগের স্মৃতিতে ফিরে যায় আর প্রায়ই কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ায়, বিশেষ করে ফার্দিনাঁর যৌন কর্মকাণ্ডে। শৈলীটা ইচ্ছাকৃতভাবে রুক্ষ । বাক্যগুলো প্রতিদিনের প্যারিসীয় ট্র্যাজেডিকে উপস্হাপন করতে আরও কঠিন হয়ে ওঠে: জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম, অসুস্থতা,যৌনরোগ, পরিবারের দুর্ভাগ্য, মূর্খতা,বিদ্বেষ,লালসা এবং লোভে জর্জরিত নিচের তলার জনসাধারণ।

জীবনের শেষ দশ বছর তিনি  প্যারিসের বাইরে, মিউদঁতে ডাক্তারি করে কাটিয়েছিলেন সেলিন,  ১৯৬১  সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, যখন স্ট্রোকে মারা যান। এই বাড়িতেই বিট আন্দোলনকারী উইলিয়াম বারোজ, অ্যালেন গিন্সবার্গ আর গ্রেগরি কোরসো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

.

ছয়

.

‘জার্নি’, এবং পরবর্তী ‘ডেথ অন দ্য ইন্সটলমেন্ট প্ল্যান’  এর অনুবাদের মাধ্যমে, সেলিন আমেরিকানদের ক্রুদ্ধ বিতৃষ্ণার প্রয়োজন মেটানোর জন্য  সাধারণভাবে উপলব্ধ মান হয়ে ওঠেন। ১৯৫০ এর দশকে ম্যাককার্থি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী বিদ্রোহে তিনি একজন পথপ্রদর্শকের জায়গা নিয়ে নেন। ব্যাপারটা বিটনিক আর হিপিদের কাউন্টার কালচার হয়ে মার্কিন সমাজে চলতে থাকে, অতিপপাকৃত উদ্দীপকের মতন,  অ্যালেন গিন্সবার্গ প্যারিস রিভিউতে একটি সাক্ষাত্কারে  সেলিনের মহত্ত্ব ঘোষণা করেন। জ্যাক কেরুয়াক  ‘ডেজোলেশান অ্যাঞ্জেলস’ বইতে স্বীকার করেছেন  যে তিনি আংশিকভাবে সেলিনকে অনুকরণ করেছেন। উইলিয়াম বারোজ, সেলিনের একজন স্বঘোষিত প্রশংসক, ‘নেকেড লাঞ্চ’ উপন্যাসে আত্ম-বিদ্বেষের ওগরানিতে সেলিনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেনন, যেমনটা ‘নস্যা’ বইতে সার্ত্র করেছিলেন। এই জোরালো  প্রশংসা মার্কিন শহুরে নরকের অধিবাসী  ঔপন্যাসিকদের দ্বারা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আরও সাধারণভাবে, নতুন অনুবাদ এবং বিদ্যায়তনিক অধ্যয়নসহ সেলিন ইংরেজি ভাষায় শুধুমাত্র  পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন না, তবে সর্বনাশের কিম্ভূতকিমাকার ও অপ্রচলিত সাহিত্য সাধনার সাথে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ব্যাপক হয়ে উঠেছে। ফিরে ফিরে সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হন লুই ফার্দিনাঁ সেলিন।

.


সেলিন আর উইলিয়াম বারোজের পারস্পরিক সাক্ষাৎকার ঘটে ১৯৫৮ সালের ৮  জুলাই । বারোজের সঙ্গে ছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ আর গ্রেগরি কোরসো।সেলিম তাঁর  তৃতীয় স্ত্রী আর বেশ কয়েকটা কুকুরের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম প্যারিসের  শহরতলি মিউদঁতে থাকতেন। সেন নদীর  বাঁক আর প্যারিস থেকে দূরে সুদৃশ্য এলাকায় বড়ো দোতলা বাড়িতে থাকতেন। রোগিদের কাছ থেকে তো বিশেষ ফিস পেতেন না । বাড়ি করতে পেরেছিলেন উপন্যাস বিক্রির টাকায়। সাক্ষাৎকারের সময়, যখনই কোনো সমসাময়িক সাহিত্যিকের উল্লেখ করেছিলেন বিট আন্দোলনকারীরা, সেলিন একবাক্যে তাদের নাকচ করে দিচ্ছিলেন। যে লেখকের নামই বারোজ উল্লেখ করেছেন, সেলিন মন্তব্য করেছেন “ওহ, ও কিছুই নয় … প্রতি বছর সাহিত্যের পুকুরে নতুন ছোট মাছ দেখা যায়।জাঁ পল সার্ত্রে কিছুই নয় ! জাঁ জেনে  কিছুই নয় !” বারোজ তাঁকে মরফিনের প্রতি নিজের আসক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন।অ্যালেন গিন্সবার্গ পরে হাসাহাসি করেছিলেন  যে তাঁদের সাহিত্য-নায়ক টের পাননি যে গিন্সবার্গ ইহুদি । সেলিনের সঙ্গে দেখা করার এই অভিযান ছিল অ্যালেন গিন্সবার্গের পরিকল্পনা, যিনি কারও কাছ থেকে সেলিনের ঠিকানা পেয়েছিলেন। 

.

বারোজ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আমরা অবশেষে একটা বাস খুঁজে পেলাম যেটা ফরাসি ট্রানজিট দিকনির্দেশের ঝরনার কাছে আমাদের ছেড়ে দেয়। টাউট ড্রয়েট, মেসিউরস, এই শহরতলির আশেপাশে আমরা আধ মাইল হেঁটেছি, শেষে সেলিনের ভিলা খুঁজে পেলাম। ভিলাটা দেখতে অনেকটা লস অ্যাঞ্জেলেসের উপকণ্ঠের ভিলাগুলোর মতন। হঠাৎ কুকুরদের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল, বুঝতে পারলাম ঠিক বাড়িতেই পৌঁছেচি। বড়-বড় কুকুর। সেলিন  কুকুরদের শান্ত করার জন্য চিৎকার করছিলেন, এবং তারপরে  ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে আমাদের ভেতরে আসতে ইশারা করলেন। উনি আমাদের দেখে খুশি হয়েছিলেন এবং স্পষ্টতই আমরা তা বুঝতে পারছিলাম। তাঁকে দেখতে হুবহু একজন পুরানো প্রতিক্রিয়াশীল দারোয়ানের মতন লাগছিল, তাঁর চারপাশে শাল পড়ে, আর তাঁর চারপাশে বেশ কয়েকটি স্কার্ফ ছিল, প্রায় তিন বা চারটি পুরানো স্কার্ফ, এবং সোয়েটার…আর তাঁর চপ্পল পায়ে কয়েক জোড়া মোজা।

.

আমরা  দোতলা বিল্ডিংয়ের পিছনে  পাকা উঠানে  টেবিল ঘিরে বসেছিলাম আর ওনার স্ত্রী, যিনি নাচ শেখাতেন – তাঁর  নাচের স্টুডিও ছিল বাড়িটায় – কফি নিয়ে এসেছিলেন। সেলিনকে ঠিক যেমনটি দেখতে আমরা কল্পনা করেছিলাম তিনি সেরকমই। তিনি একটি গাঢ় স্যুট পরেছিলেন,  গলায় স্কার্ফ আর গায়ে শাল  ছিল, এবং পাঁচ-ছয়টা কুকুর, ভিলার পিছনে একটি বেড়ার জায়গায় বাঁধা ছিল, সময়ে সময়ে ঘেউ ঘেউ  চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। 

.

বাড়িটা একটা বড় ম্যানসান..  ম্যানসান-ছাদের ব্যক্তিগত বাড়ি, খুব বড় ব্যক্তিগত বাড়ি ।  নীচে একটি কেন্দ্রীয় করিডোর এবং দুই পাশে বড় ফ্রেঞ্চ-জানালাওয়ালা কক্ষ। অ্যালেন জিজ্ঞাসা করেছিল যে কুকুরগুলো কখনও কাউকে মেরে ফেলেছে কিনা।  সেলিন জবাবে বলেছিলেন, “না, আমি শুধু গোলমাল এড়াবার জন্যই রেখেছি।” অ্যালেন তাঁকে কিছু বই, ‘হাউল’ এবং গ্রেগরি করসোর কাব্যগ্রন্হ আর আমার বই জাঙ্কি দিয়েছিল। সেলিনের কোন আগ্রহ দেখা গেল না । উনি বইগুলোর দিকে তাকালেন আর সেগুলো একপাশে রাখলেন। উনি যেভাবে বইগুলো স্পর্শ করেছিলেন এবং তাদের একপাশে রেখেছিলেন তা থেকে বলা যায় যে সেলিন আর কখনও তাদের দিকে তাকাবেন না। 

.

স্পষ্টতই তাঁর সময় নষ্ট করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না।  সেলিন নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ফরাসি লেখক বলে দাবি করেন, এবং বলেন কেউ তাঁর প্রতি মনোযোগ দেয় না। তবু, এমন কেউ-কেউ আছেন যাঁরা তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করতে চেয়েছিলেন। আমরা কে, বা বিট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। অ্যালেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি বেকেট, জেনে, সার্ত্রে, সিমোন দ্য বভোয়া, হেনরি মিশাউ প্রমুখদের  সম্পর্কে  কী ভাবছেন। তিনি সবাইকে বরখাস্ত করার জন্য তাঁর পাতলা, নীল-শিরাযুক্ত হাত নাড়িয়ে বললেন: “প্রতি বছর সাহিত্যের পুকুরে একটা নতুন মাছ আসে।”ওসব কিছুই নয়,  কিছুই নয়,  কিছুই নয়”।  

.

অ্যালেন জিগ্যেস করে “আপনি কি একজন ভালো ডাক্তার?” সেলিন বলেছিলেন: “আচ্ছা .. আমি…যুক্তিসঙ্গত।” অ্যালেন তারপর জিগ্যেস করে “প্রতিবেশীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো ?” উনি বলেন, “অবশ্যই না। ইহুদিদের কারণে আমি আমার কুকুরদের গ্রামে নিয়ে যাই। পোস্টমাস্টার আমার চিঠিগুলো নষ্ট করে দেয়। ওষুধের দোকান আমার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ দেয় না…।” ঘেউ ঘেউ করা কুকুরগুলো তাঁর কথায় বিরাম চিহ্ন দিল।

.

গিন্সবার্গ তাঁকে জিগ্যেস করল,  “আপনার রোগিরা কেমন আছে? আপনি একটি যুক্তিসঙ্গত জীবনযাপন করতে পারেন?” – জবাবে সেলিন বললেন, “না, আমার কাছে আসা বেশিরভাগই  মধ্যবয়সী মহিলা আর তারা কেবল একজন যুবকের সামনে তাদের পোশাক খুলতে চায়। তাহলে তারা কি আমার সামনে তাদের কাপড় খুলে ফেলতে চাইবে?” উনি বললেন, আপনি একটা দেশকে তখনই জানতে পারবেন যখন তার কারাগারের অভিজ্ঞতা হবে ।

.

আমরা সরাসরি সেলিন উপন্যাসে চলে গেলাম। এবং তিনি আমাদের বললেন যে ডেনরা কেমন গুয়ের তৈরি মানুষ । তারপর যুদ্ধের সময় বাইরে পাঠানোর একটি গল্প বললেন। জাহাজটা টর্পেডো করা হয়েছিল এবং যাত্রীরা পাগলের মতন দৌড়োদৌড়ি করছিল তাই সেলিন তাদের সবাইকে লাইন করে এবং তাদের প্রত্যেককে মরফিনের একটি বড় শট দেন যার ফলে তারা সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পুরো নৌকা জুড়ে বমি করে। 

.

লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের সঙ্গে দেখা করে প্যারিসের বিট হোটেলে ফিরে অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘ইগনু’ শিরোনামে এই কবিতাটা লেখেন। ‘ইগনু’ অভিধা  নির্দিষ্ট ধরণের ব্যক্তিকে বর্ণনা করে,  যিনি তাঁর অন্যান্য অসংখ্য গুণাবলীর মধ্যে, “শুধুমাত্র একবার এবং অনন্তকাল বেঁচে থাকেন এবং তিনি তা  জানেন” এবং “প্রত্যেকের বিছানায় তিনি ঘুমোন ।” গিন্সবার্গ ‘ইগনু’ কবিতায় তাঁর অনেককে  ইগনাসের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইগনাস শব্দটি লাতিন যার অর্থ আগুন । সংস্কৃত অগ্নি বলতে যা বোঝায়

.

অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর কবিতা ‘ইগনু’

তার ওপর আপনি  যদি আমাকে চেনেন তবে আমি আপনাকে একজন ইগনু ঘোষণা করব

ইগনু পৃথিবীর কিছুই জানে না

কারখানার একজন বিরাট  অজ্ঞ, যদিও তিনি হয়তো তার মালিক  বা তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন  এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থাপকও হতে পারেন

ইগনুর দেবদূতের জ্ঞান আছে আসলে ইগনু জোকারের আকারে দেবদূত

ডাবলু সি. ফিল্ডস হার্পো মার্কস ইগনাস হুইটম্যান একজন ইগনু

র‌্যাঁবো বালকদের প্যান্ট পরে স্বাভাবিক ইগনু

ইগনু অদ্ভুত হতে পারে যদিও দয়ালু ইগনুর মত নয় অদ্ভুত রোমাঞ্চের জন্য দেবদূতদের উড়িয়ে দেয়

একজন  জ্ঞানবাদী মহিলা তাকে ভালবাসে  অনেক মৃত কাকিমার জন্য খ্রিস্টের কম্পিত বীর্য  উপচে পড়ে

সে একজন বড় শিশ্নমানব ইগনুরা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের  পূজা করে

হলিউের খুকিদের  বা আইডাহোর একা মেরিদের  প্রচারকামী ঢ্যাঙাপায়ের  মহিলাদের আর  গোপন গৃহিণীদের

আরেক জীবনের  ইগনুকে চিনতে পেরেছেন আর তাদের প্রেমিকদের মনে রাখে

স্বামীরাও গোপনে তাদের বন্ধু ইগনুর প্রতি কোমল-হৃদয়

পুরানো দিনের বন্ধুত্ব যা ইচ্ছে করতে পারে অসতী-বউয়ের স্বামী লোকটা মাতাল কাঁপছে আর আনন্দে ডগমগ

ইগনু শুধুমাত্র একবার এবং অনন্তকাল বেঁচে থাকে আর সেটা সে জানে

সে সবার বিছানায় ঘুমোয়  সবাই ইগনুর  জন্য একা কেননা ইগনু আগেই একাকীত্বের কথা জানতো

তাই ইগনু  হলো শিশ্নের এবং মনের এক আদিম 

একইভাবে ইগনু প্রচুর থাক-থাক  ব্যক্তিগত বিমূর্ত অধিবিদ্যা  লিখেছেন

প্রতচ্ছবি যা চাঁদকে আঁচড়ে দেয় ‘বিদ্যুৎঝলকের-স্ফূলিঙ্গে’’ নগ্ন ভোজ ভাজা জুতা বিদায় রাজা

দেবদূতের ছায়া উল্টো দিকে হাত নাড়ছে

বুদ্ধিমত্তার ভোর টেলিফোনগুলোকে অদ্ভুত প্রাণীতে পাল্টে দেয়

সে তার রহস্যময় কাঁচি দিয়ে গোলাপ বাগান ছাঁটাই করে স্নিপ স্নিপ স্নিপ

ইগনু তার নিজের দীর্ঘ বিষাদ দিয়ে পার্ক এভিনিউকে রাঙিয়েছেন

আর ইগনু তার ক্ষয়িষ্ণু ঘরে  কালোদের হোটেলে  টাকপড়া প্যারিসের শক্ত চেয়ারে বসে হাসছে

ইগনু তার বুনো ন্যাতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কলোসিয়ামের পাশ দিয়ে হাঁটছে

কিটসের কবর থেকে একটা সপ্তপর্ণী পাতা এবং শেলির থেকে ঘাসের শীস তুলছে

কোলরিজ জানতেন যে তারা লন্ডনে মেহগনি টেবিল ঘিরে  মধ্যরাতে ফিসফিস করে  আলোচনা করে

পাশের রাস্তার ঘরে শীতকালে বৃষ্টির বাইরে কুয়াশায় ট্যাক্সিচালক তার হাত নাড়ায়

ইগনু হয়ে জন্ম চার্লস ডিকেন্স শিশুর হাহাকার শুনতে পান

ইগনু ব্রিজের নিচে রাত কাটায় এবং যুদ্ধজাহাজ দেখে হাসে

ইগনু উত্তর সাগরে বন্দুকবিহীন একটি যুদ্ধজাহাজ হারিয়েছে হায় মুহুর্তের ফুল

সে ভূগোল জানে যে সে সেখানে ছিল  বেরোবার আগে মারা যাবে

আরবীয় শোকপূর্ণ রসিকতার গুনগুন করতে থাকা দাড়িওয়ালা ইহুদি আবার জন্মায়

মানুষ যার কপালে একটা তারা আর তার মাথের পেছনে জ্যোতিচক্র

তার চুলে অমরত্বের চাঁদের আলো পাতার পতনে আনন্দে গান শুনছে

সুফি দরবারে এটেবিল-ওটেবিল করছেন সবথেকে সূক্ষ্ম আচরণের  সবচেয়ে মার্জিত কমরেড

তিনি এমনকি সেখানেও ছিলেন না

রাশিচক্রের নীল হাতাজামা আর জাদুকরের লম্বা চূড়াযুক্ত টুপি মাথায়

একটা লাল তারার নীচে মধ্যরাতে একটি  কুয়োর নীরবতার সাথে কথা বলেন

রকফেলার সেন্টারের লবিতে প্যান্ট সহ বা ছাড়াই মনোযোগী বিনয়ী খালি চোখ উৎসাহী

 জ্যাজ শোনেন যেন তিনি একজন  সাদা দেবত্বে আক্রান্ত নিগ্রো ইহুদি বিষণ্ণতায় ভুগছেন

ইগনু লোকটা স্বাভাবিক তুমি তাকে দেখতে পাবে যখন তিনি  বিমূর্তভাবে ট্যাক্সির ভাড়া মেটান

অসম্ভব সন্তের পাকানো তাড়া খুলে টাকা দিচ্ছেন

কিংবা তাঁর অদৃশ্য  পয়সা গুনছেন  সেই অদ্ভুত বাসচালককে দেওয়ার জন্য যার প্রশংসা করেন

ইগনু আপনাকে খুঁজে বের করেছে সে ঈশ্বরের দয়া চায়

আর  ঈশ্বর প্রতি দশ বছর  তার জন্য পৃথিবীকে ভেঙে দেন

তিনি দিনের প্রকাশ্য আলোয় বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেন যখন আকাশ নীল থাকে

তিনি হারলেমের একটি ঘরে ব্লেকের বিচ্ছিন্ন কণ্ঠস্বর সূর্যমুখীর আবৃত্তি শুনতে পান

তাঁর হাতা থেকে  সাত লক্ষ  পাগল পণ্ডিতে ঘেরা  বাদলা পোকারা উড়ে যায়

তিনি অনন্তকালে প্রবেশ করে উন্মাদ বিরতির পর মারা যেতে চান

বেঁচে থাকেন এবং একজন বয়স্ক সাধুকে শেখান বা একটি ভ্রু-জোকারের কাছে ভেঙে পড়েন

সমস্ত ইগনাস এক মুহূর্তের কথাবার্তায় একে অপরকে চিনে নেন আর একে অপর বুঝে ফেলতে পারেন

সারা মহাদেশ জুড়ে আজীবন বন্ধু হিসেবে রোমান্টিক চোখ মেলে খিলখিল হাসেন

দুঃখজনক মুহূর্ত ট্যাক্সিকে  বিদায় জানিয়ে শহরের অন্য দিকে দ্রুত চলে যান

দলের মধ্যে এক বা দুজন  গোমড়ামুখ  ইগনাস

ডাঙ্গারি-পরা একজন হাসিমুখ সন্ন্যাসী

একজন ডিমের কাপে তার ডিম ফাটিয়ে আনন্দে আত্মহারা

একজন সারা রাত ধরে রক অ্যান্ড রোল গানে চিউইঙগাম চিবোয়

পেটেনের অতিবৃষ্টি-অরণ্যে একজন নৃবিজ্ঞানী কোকিল

একজন সারা বছর জেলে বসে কর্মফল ঘোড়দৌড়ের বাজি ধরে

একজন ভৌতিক ফিল্মে  ইস্ট ব্রডওয়েতে মেয়েদের তাড়া করে

একজন তার প্যান্ট থেকে শুকনো আঙুর এবং পচা পেঁয়াজ বের করে

একজনের বিছানার নীচে   দর্শনার্থীদের আনন্দ দেওয়ার জন্য দুধেল ছাগল রয়েছে  বাজে কথা দিয়ে দেয়াল রাঙায়

কাঁকড়াবিছে হুইস্কি আকাশ ইত্যাদি যোগাড়  করে পারলে সে চাঁদও চুরি করবে 

 আমেরিকায় তা আগুন লাগিয়ে দেবে কিন্তু এগুলোর কোনোটাই ইগনু তৈরি করবে না

 আত্মাই সেই জিনিস  যা শৈলীকে তার চিন্তার কোমল আতশবাজি করে তোলে

পুরানো বন্ধুদের কাছে অদ্ভুত শহর থেকে চিঠির সৌহাদ্র্য

আর  বিদেশী বিছানায় সকালের নতুন দীপ্তি

ব্যক্তিগত হওয়ার  কমেডি তার গর্বিত দেবত্ব

এলিয়ট সম্ভবত  ইগনুদের মধ্যে এমন একজন যিনি খাবার সময় মজা করেন

প্যাটারসনের উইলিয়ামস মারা যাচ্ছেন এমন একজন  আমেরিকান ইগনু

বারোজ একজন  বিশুদ্ধ ইগনু  তার চুল কাটার  ক্রিম তার বাম আঙ্গুল

 প্রাথমিক বার্ধক্যজনিত কারণে কেটে ফেলা হয়েছে আধিভৌতিক বানান মনোবিশ্লেষণের সাথে প্রেমের মন্ত্র

তার  নেশাখোর জীবন এক মিলিয়ন ডলার দামের চেয়ে বড়ো কৃতিত্ব

সেলিন নিজেই গদ্যের একজন পুরানো ইগনু

আমি তাঁকে প্যারিসে দেখেছি নোংরা বুড়ো ভদ্রলোক

লম্বা চুলের কাশি সহ তাঁর গলায় তিনটি মোটা সোয়েটার

ঐতিহাসিক নখের নীচে বাদামী ছাঁচ

বিশুদ্ধ প্রতিভা  একটি ডুবন্ত জাহাজের ১৪০০ যাত্রীকে সারারাত মরফিন দিয়েছিলেন

”কারণ তারা সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল’

কে আশ্চর্যজনক আপনি ইগনু আমার সাথে যোগাযোগ করুন

বার্তা পাঠান পোস্ট টেলিগ্রাফ ফোন রাস্তায় অভিযোগ করে বা আমার জানালায় আঁচড় কেটে

আর  আমাকে একটা খাঁটি সংকেত পাঠান আমি বিশেষ ডেলিভারিতে উত্তর দেব

মৃত্যু এমন একটি চিঠি যা কখনো পাঠানো হয়নি

জ্ঞানের জন্ম ডাকটিকিট শব্দ  মুদ্রা সঙ্গম জেল ঋতু মধুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাইট্রাস অক্সাইডে

উজ্জ্বল জানালায় একটি স্বর্গীয় দিন আঁকা সমুদ্রের সোনার আলোর আলোকচিত্রের ইতিহাস

কালো মেঘের মধ্যে একটি চোখ

এবং তুর্কি বাসের জানালা থেকে দেখা যায় বালিয়াড়িতে একা শকুন

এটা নিশ্চয়ই একটা কৌশল । হাতে দুটি হীরা একটি কবিতা একটি দানছত্র

প্রমাণ করে আমরা স্বপ্ন দেখেছি এবং বুদ্ধিমত্তার দীর্ঘ তলোয়ার

যার জন্য আমি ছয় বছর বয়স থেকে আমার প্যান্টের মতো ক্রমাগত হোঁচট খাচ্ছি — বিব্রত হয়ে।

.

সাত

.

  ১৯৭৪  সালে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে , বিট আন্দোলনের লেখক উইলিয়াম বারোজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তিনি লুই-ফার্দিনাঁ সিলিন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন কিনা। বারোজ বলেছিলেন, , “হ্যাঁ, হয়েছি”। প্যারিস রিভিউ-এর সাক্ষাৎকারে বারোজ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “আমি সেলিনের ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ (১৯৩২ )  এবং ‘ডেথ অন দি ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’ (১৯৩৬) উপন্যাসের ভাষাশৈলী মার্কিনি ঢঙে প্রয়োগ করেছি ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯) উপন্যাসে। বারোজ বলেছেন, “আমি নিজেকে পিকারেস্ক ঐতিহ্যে স্থান দিই, টমাস নাস-এর ‘দ্য ফরচুনেট ট্র্যাভেলার’ ( ১৫৯৮ )  থেকে শুরু করে, পেট্রোনিয়াস-এর ‘স্যাটিরিকন’, এবং অবশ্যই, লুই-ফার্দিনাঁ সেলিন-এর ‘জার্নি টু দ্য এণ্ড অব দি নাইট’ পর্যন্ত। । 

.

পিকারেস্ক ঐতিহ্যে,   এক বা একাধিক নায়কের সত্যিকার বা কাল্পনিক যত্রতত্র যাত্রার  খাতিরে এগোয়, আর মুখোমুখি হয়  দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের বা বিপজ্জনক পথগমনের, শেষেরটাই বেশি ঘটে । একটি পিকারেস্ক আখ্যান সাধারণত  আত্মজীবনীমূলক বিবরণ হিসাবে উত্তমপুরুষে লেখা হয়। প্রধান চরিত্রটি প্রায়শই নিম্নবর্গের  বা সামাজিক শ্রেণীর হয়। তারা বুদ্ধিমত্তার সাথে এগিয়ে যায় এবং খুব কমই একই চাকরিতে বা পেশায় আটক থাকে। সামান্য  প্লট থাকে বা ছোটো-ছোটো ভিনিয়েট জুড়ে এগোয়। গল্পটা আলগাভাবে সংযুক্ত অ্যাডভেঞ্চার বা তার একটা শৃঙ্খলায় বলা হয়। 

.

এই জনারের উপন্যাস প্রথমে স্পেনে লেখা আরম্ভ হয়েছিল (স্পেনীয়:”পিকারেস্কো” অর্থাৎদুর্বৃত্ত,  বা “বদমাশ” ) । তারপর ১৭ এবং ১৮ শতকের ইউরোপে বিকাশ লাভ করেছিল। জনারটি এখনও আধুনিক সাহিত্যকে প্রভাবিত করে চলেছে। শব্দটি সাধারণত ব্যঙ্গাত্মক গদ্য কথাসাহিত্যের একটি উপশৈলীকে নির্দেশ করে এবং বাস্তবসম্মত, প্রায়শই হাস্যকর বিশদ বর্ণনা করে । ‘লাজারিলো ডি টর্মেস’, ১৫৫৪ সালে এন্টওয়ার্প এবং স্পেনে বেনামে প্রকাশিত  প্রথম পিকারেস্ক উপন্যাস । প্রধান চরিত্র লাজারিলো একজন দুর্বৃত্ত যে তার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে ভন্ডামীতে ভরা এক গরিব দেশে বসবাস করে ।  ইংরেজি-ভাষী বিশ্বে, ‘পিকারেস্ক’ শব্দটি স্প্যানিশরা যে সুনির্দিষ্ট ধারাকে চিহ্ণিত করেছিল, তার চেয়ে বেশি একটি সাহিত্যিক কৌশল বা মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে । ইংরেজি-ভাষায় অভিধাটি মূলত   একজন প্রতিনায়কের দুঃসাহসিক কিংবা সমাজ-বহির্ভূত ঘটনার বয়ান খাড়া করে।

.

 বারোজের জন্ম  ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিত্তশালী পরিবারে।  তাঁর প্রথম বই ‘জাঙ্কি : কনফেশানস অব অ্যান আনরিডিমড ড্রাগ অ্যাডিক্ট’ (১৯৫৩)। তাঁর উপন্যাস ‘নেকেড লাঞ্চ’ (১৯৫৯) সম্পর্কে আলোচক রবার্ট লোয়েল বলেছেন যে ‘এটা খুবই শক্তিশালি এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। গদ্য এবং কবিতার যে কোনো ভাল বইয়ের পাশাপাশি এর জায়গা,  এবং এমন জীবন্ত বই বহু বছর পর একজন আমেরিকান লিখলেন।’ বারোজের অন্যান্য বইগুলো-দ্য একস্টারমিনেটর (ব্রায়ান জিসিনের সঙ্গে, ১৯৬০), দ্য সফটমেশিন (১৯৬১), দ্য টিকিট দ্যাট এক্সপ্লোডেড (১৯৬২), দ্য ইয়েগ লেটারস (অ্যালান গিনসবার্গ-এর সঙ্গে, ১৯৬৩) এবং নোভা এক্সপ্রেস (১৯৬৪)। বারোজ আঠারোটি উপন্যাস ও নভেলা লিখেছেন, ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন এবং চারটি প্রবন্ধের সংকলন, এবং তাঁর সাক্ষাৎকার ও চিঠিপত্রের পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে; তিনি প্রথমদিকে উইলিয়াম লি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি অসংখ্য অভিনয়শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে কাজ করেছেন এবং রেকর্ডিংয়ে সহযোগিতা করেছেন, চলচ্চিত্রে উপস্থিত থেকেছেন এবং তাঁর  “শটগান আর্ট” সহ অজস্র ভিজ্যুয়াল আর্টওয়ার্ক তৈরি ও প্রদর্শন করেছেন।

.

বিশের দশকের গোড়ার দিকে থেকে উইলিয়াম বারোজ  নিয়মিত হেরোইন, কোকেন, মেথাডিন, পিয়োটি, অ্যাম্ফিটেমাইন আর গাঁজার মতন মাদক নেয়া আরম্ভ  করেন। যখন বারোজ তাঁর  ‘নেকড লাঞ্চ’ উপন্যাসের নায়কের মতো সঠিক  মাদক পাননি, তিনি পোকা মারার স্প্রে দিয়ে ইনজেকশন নিয়েছিলেন, আর কারখানার অ্যালকোহল পান করতেন। এমন মনে করার কারণ নেই যে বারোজ একটি অসুখী শৈশব থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন। লুই ফার্দিনাঁ সেলিন থেকে একেবারে আলাদা ছিল তাঁর জীবন।  তিনি ১৯১৪ সালে একটি বিত্তশালী সেন্ট লুই পরিবারে জন্মেছিলেন, যে প্রাসাদে ছিল তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ চাকর, একজন আইরিশ বাবুর্চি এবং একজন ওয়েলশ আয়া। পরের দুজন দৃশ্যত যুবকটির মাথায় অতিপ্রাকৃতের এমন বিশ্বাসযোগ্য গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে বারোজ বড়ো হয়েও  সেগুলো বিশ্বাস করতেন। বৈভবশালী বারোজ পরিবার, যারা ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ থেকে দিব্বি  বেঁচে গিয়েছিল, উইলিয়াম বা বিল বারোজ ছিলেন সেই পরিবারের উত্তরাধিকারী।  তরুণ বিলকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বোর্ডিং প্রতিষ্ঠান, সেন্ট আলামোস স্কুল, নিউ মেক্সিকোতে ভর্তি করা হয়েছিল।

.

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর বারোজের সঙ্গে নিউইয়র্কে জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং পরে নিল ক্যাসাডির সাথে পরিচয় হয় । তার আগে তিনি ইউরোপ সফর করেন।তাঁরা চারজনই লেখক হতে চাইছিলেন।  যখন ১৯৫৭ সালে কেরুয়াকের ‘অন দি রোড, প্রথম প্রকাশিত হলো তখন তাদের গোষ্ঠী “বিট জেনারেশন” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, যা ক্লাসিক সাহিত্যের মতো জ্যাজ ছন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। উভকামী, হেডোনিস্টিক, কম ভাড়া এবং আত্মাভিমানী বিটরা, ১৯৫০ এর দশকে একজন আমেরিকান সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় তার ছাঁচ ভেঙে ফেলতে পেরেছিল। 

.

বারোজের সমস্ত প্রাথমিক সাহিত্য পরীক্ষাগুলো অবশ্য নজর কাড়তে পারেনি। তিনি মেক্সিকোতে চলে যান যেখানে হেরোইন সহজে পাওয়া যেতো । মেক্সিকো সিটিতে এক  রাতে মাতাল অবস্হায় গুলি ছোঁড়ার টিপের দক্ষতা দেখাবার সময় বারোজ তাঁর আশ্চর্যজনক সহনশীল স্ত্রী জোয়ান ভলমারকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। বারোজ পরিবার দামি আইনজীবী নিয়োগ করেছিল আর বিলকে দুই সপ্তাহেরও কম জেলে থাকার পর মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তবু তিনি বিচারের সাজা এবং শীতল কারাগারের বিছানা সম্পর্কে কয়েকটি  অভিযোগ দর্জ করেছিলেন । ছাড়া পেয়ে বারোজ প্রথমে নিউইয়র্কে আর তারপর ট্যানজিয়ারে চলে যান । সেই সময়ে বারোজ দাবি করেন যে এক  “কুৎসিত আত্মা” জোয়ানকে হত্যা করতে বাধ্য করেছিল আর সেই কুৎসিত আত্মা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা হিসাবে আন্তরিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন।’জাঙ্কি ‘ বইটা প্রথমে পেপারব্যাক সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল যা ১৫০০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল।’দ্য নেকেড লাঞ্চ’ লেখেন তার পরেই,   জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ অনুসরণ করে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোস্ট অফিস বইটাকে অশ্লীল ঘোষণা করলে বারোজ মার্কিন কাউন্টার কালচারে নিজের জায়গা নিশ্চিত করে ফেলতে পারেন। ‘নেকেড লাঞ্চ’ উইলিয়াম লি-এর দুঃসাহসিক কাজ, বা দুঃসাহসিক কাজগুলোকে অনুসরণ করে, যে লোকটা বারোজের প্রতিরূপ, যে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে বিভিন্ন মার্কিন গন্তব্যস্থল হয়ে মেক্সিকো, ট্যানজিয়ার্স আর ইন্টারজোনের একটা সাই-ফাই সংস্করণ ভ্রমণ করে, এই কারণে যে ট্যানজিয়ার্স ১৯২৩ সালে  ইন্টারজোন ছিল।

.

বারোজ লিখেছেন, “আমি আতঙ্কজনক নির্ণয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি যে আমি কখনই লেখক হতে পারতাম না যদি না ওইভাবে জোয়ানের মৃত্যু  হতো, এবং এই ঘটনাটি আমার লেখাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে  তা উপলব্ধি করার জন্য লেখা জরুরি হয়ে উঠেছিল। আমি কুৎসিত আত্মার হুমকির সাথে বাস করি, এবং তার দখল থেকে, নিয়ন্ত্রণ থেকে পালানোর একটি ধ্রুবক প্রয়োজন।  জোয়ানের মৃত্যু আমাকে আক্রমণকারী, কুৎসিত আত্মার সংস্পর্শে এনেছিল এবং আমাকে একটি দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের মধ্যে চালিত করেছিল, যেখানে আমার  লেখা ছাড়া  আর কোন উপায় ছিল না।

.

বারোজ প্রচলিত উপন্যাসের কাঠামোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, “এরকম কাঠামো বাস্তবতাকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। ওগুলো নির্বিচারে কাঠামো। ওগুলোর মৌলিক বনেদ হল একটা শুরু, একটা মধ্য এবং শেষ, একজন সর্বজ্ঞ লেখক যিনি জানেন যে তার চরিত্রগুলো কী ভাবছে আর কী ঘটতে চলেছে, আর তারপরে অমন পরিকল্পনা অনুযায়ী অধ্যায়গুলো গড়ে তোলেন৷ এই ধরনের নির্মাণের হুকুমে চললে, প্রতিটি অধ্যায় সম্পর্কে আপনাকে প্রত্যাশায় নিমজ্জিত থাকতে হবে, সাসপেন্স তৈরি করতে হবে। প্রথম অধ্যায়ে যা ঘটছিল তাতে তৃতীয় অধ্যায়ে ফিরে আসার আগে মস্তিষ্ক আপনাকে পরবর্তী অধ্যায়টি চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। স্পষ্টতই, বাস্তবে এমনটি ঘটে না। এটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ।” 

.

যদিও প্রচুর পরীক্ষামূলক এবং অবিশ্বস্ত কথকদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, বারোজের বেশিরভাগ কাজ আধা-আত্মজীবনীমূলক, এবং প্রায়শই হেরোইন আসক্ত হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে নিয়েছেন।ব্রায়ন জিসিনের সাথে, বারোজ কাট-আপ নামে এক শৈলীকে জনপ্রিয় করে তোলেন, এটি একটি স্বল্পমেয়াদী সাহিত্যিক কৌশল, যা ‘নোভা ট্রিলজি’ (১৯৬১-১৯৬৪) এর মতো কাজগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেছেন। বারোজের রচনায়  রহস্য, জাদুবিদ্যা বা অন্যথায় যাদুকরী থিমগুলোও আছে, যা তাঁর জন্য একটি ধ্রুবক ব্যস্ততা ছিল, কথাসাহিত্য এবং বাস্তব জীবন, উভয় ক্ষেত্রেই ।

.

‘নেকেড লাঞ্চ’ এবং এর তিনটি  পরিশিষ্ট, ‘দ্য সফট মেশিন’, ‘নোভা এক্সপ্রেস’ এবং ‘দ্য টিকিট দ্যাট এক্সপ্লোড’-এ, বারোজ মানুষের লোভ, দুর্নীতি এবং অবজ্ঞার একটি জটিল এবং ভয়ঙ্কর রূপক বুনেছেন। অ্যালডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩২) এবং জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর ( ১৯৪৯ )-এর মতো, বারোজের এই চারটে উপন্যাস একটা নির্দিষ্ট ধরণের মন্দের বা মন্দের প্রবণতাকে বর্ণনা করে – যা বারোজ সমসাময়িক বিশ্বে বিশেষভাবে ক্ষতিকারক বলে মনে করেন – আর  তাদের উপস্হাপন করেন  এক ডিসটোপিয় ভবিষ্যতে, যেখানে,  তারা রাক্ষস হয়ে ওঠে এবং একটি অতিরঞ্জিত এবং ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে।

..

.

১৯৯৭ সালে ‘দি গার্জিয়ান’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম বারোজ বলেছিলেন, “আমার জীবনে একমাত্র ব্রায়ন জিসিনকে আমি শ্রদ্ধা করি । আমি অনেকের সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষণ করি, অনেককে পছন্দ করি, কিন্তু উনি একমাত্র মানুষ যাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি।” তার আগে ১৯৬৬ সালে ‘দি প্যারিস রিভিউ’ পত্রিকায় কনর‌্যাড নিকারবকারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বারোজ বলেছিলেন, “ ব্রায়ন জিসিন নামে এক বন্ধু, মার্কিন কবি ও পেইনটার, যিনি ৩০ বছর  ইউরোপে ছিলেন, আমি যতোদূর জানি, তিনিই প্রথম কাট-আপ টেকনিক প্রয়োগ করেছিলেন । তাঁর কাট-আপ কবিতা ‘মিনিটস টু গো’ বিবিসি থেকে প্রসারিত হয়েছিল, এবং সেটি তিনি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করেছিলেন । এই টেকনিকের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মায়, এবং আমি নিজেও তা নিয়ে নিরীক্ষা আরম্ভ করি । অবশ্য আপনি যদি ‘দি ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ এর কথা ভাবেন, সেটি ছিল প্রথম বিখ্যাত কাট-আপ-কোলাঝ, এবং ত্রিস্তঁ জারাও একই লাইনে কিছু কাজ করে গেছেন । একই আইডিয়া ডস প্যাসস ‘ইউএসএ’-র ‘দি ক্যামেরা আই’ তে প্রয়োগ করেছিলেন । আমার মনে হয়েছিল যে আমিও সেই একই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি । যখন  নিজের সামনে টেকনিকটা প্রয়োগ করতে দেখলুম, তখন তা ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়কর রহস্যোদ্ঘাটন।”

.

উইলিয়াম বারোজের বিখ্যাত বইগুলো, যেমন ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ), ‘দি সফ্ট মেশিন’ ( ১৯৬১, প্রথম সংস্করণে কাট আপ করা হয়েছে ), ‘দি টিকেট দ্যাট এক্সপ্লোডেড’ ( ১৯৬২, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ) এবং ‘নোভা এক্সপ্রেস’ ( ১৯৬৪, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ) কাট-আপ টেকনিক প্রয়োগ করে লেখা। কাট-আপ পদ্ধতিকে উইলিয়াম বারোজ বলেছেন তা হল  সাহিত্যে আণবিক বোমার আবিষ্কার । ‘দ্য নেকেড লাঞ্চ’ এবং অন্যান্য উপন্যাসে, উইলিয়াম এস বারোজ, প্লট এবং সুসঙ্গত চরিত্রায়ন পরিত্যাগ করে, একটি ভয়ঙ্কর আধুনিক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রিত করতে একজন মাদকাসক্তের চেতনা ব্যবহার করেছেন।

.

১৯৫৯ সালে ব্রায়ন জিসিন একদিন বিট হোটেলে নিজের ড্রইঙ নিয়ে কাজ করার সময়ে আকস্মিকভাবে কাট-আপ টেকনিক আবিষ্কার করেন । তাঁর নিজের কথায়,”ছবি আঁকার জন্য, এক তাড়া সংবাদপত্রের ওপরে রাখা, একটা বোর্ডের চারপাশ  ধারালো ছুরি দিয়ে কাটছিলুম, আর মনে হল, ছয় মাস আগে বারোজকে যা বলেছিলুম, যে ছবি আঁকার টেকনিককে লেখালিখিতেও সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে, তা স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি সংবাদপত্রের কেটে-ফেলা সদ্যপ্রসূত শব্দগুলো এলোমেলো সাজিয়ে একেবারে আলাদা একটা টেক্সট তৈরি করে ফেললুম, যা পরে প্রথম কাট-আপ হিসাবে আমার ‘মিনিটস টু গো’ ( ১৯৬০ ) কাব্যগ্রন্হে প্রকাশিত হয়েছে ।” ‘মিনিটস টু গো’ কবিতায় কোনো সম্পাদনা ও পরিবর্তন করা হয়নি, কাগজের ফালি সাজানোর পর শব্দগুলো যেমনভাবে সেজে উঠেছে, হুবহু তেমন করেই প্রকাশ করা হয়েছিল । ‘মিনিটস টু গো’ প্রকাশের পরে জিসিন কাঁচি-কাটা শব্দের পারমুটেশান কম্বিনেশান নিয়ে খেলেছেন । 

.

উইলিয়াম বারোজ সেসময়ে তাঁর ‘নেকেড লাঞ্চ’ বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করছিলেন, তাতে প্রয়োগ করলেন ব্রায়ান জিসিন আবিষ্কৃত কাট-আপ পদ্ধতি, এবং মার্কিন সাহিত্য জগতে তা হুলুস্হুল ফেলে দিল । তাঁর, বারোজের, পাণ্ডুলিপিতে কাট-আপ প্রয়োগ করার সময়ে জিসিন ও বারোজ দুজনে মিলে প্রয়োজনমতো সম্পাদনা ও পরিবর্তন করেছিলেন । বারোজের ‘নোভা ট্রিলজি’তেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু খেয়াল রেখেছেন যাতে তা অত্যন্ত দুর্বোধ্য ও অর্থহীন  হয়ে না যায় । এই পদ্ধতি প্রয়োগের দরুন ভাষাকে আক্রমণ করে টেক্সটে অন্তর্ঘাত ঘটানো ও রৈখিকতা ভাঙার সুবিধা হয়ে গেল কবি ও লেখকদের ।

.

যে নতুন গদ্য বা কবিতা কাট-আপ করে গড়ে ওঠে, জিসিন বলেছেন, তার শব্দেরা নিজস্ব নৃত্যভঙ্গিমা নিয়ে জেগে ওঠে, অর্থময়তার ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে বাক্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে, অথচ পুরোনো গদ্য বা কবিতায় এই ক্ষমতা তাদের ছিল না । জিসিন আরও বললেন, কবিদের কাজ হল শব্দদের মুক্তি দেয়া, আত্মনির্ভরশীলতা দেয়া । ভাবপ্রকাশের শব্দসমষ্টিতে শব্দদের শৃঙ্খলিত করা কবিদের কাজ নয় । কে বলেছে কবিদের কাজ চিন্তা করা ? কবিদের কাজ হল শব্দদের বুকে যে গান ভরা আছে সেগুলো তাদের গাইতে দেয়া । কবিদের “শব্দের মালিকানা” হয় না, “কোনো কবির নিজস্ব শব্দবন্ধ হয় না । কবে থেকে শব্দেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠল ?”

.

জিসিন বললেন, কাট-আপ পদ্ধতি কবি-লেখকদের  এনে দিয়েছে ধ্বনি ও দৃশ্যের কোলাজ, যে পদ্ধতি ছবি-আঁকিয়েরা বহুকাল ব্যবহার করছেন, ঠিক তাই ; একই পদ্ধতি দেখা যায় মুভি ক্যামরা বা স্টিল ক্যামেরায় তোলা ফোটোয় । পথে তোলা ফোটোগুলোতে পাওয়া যাবে অপ্রত্যাশিত পথচারীদের, তারা আকস্মিকভাবে দৃশ্যের ফ্রেমে কাট-আপ শব্দের মতন দেখা দেয় । খ্যাতনামা ফোটোগ্রাফাররা জানেন যে সবচেয়ে ভালো ফোটোগুলো আকস্মিকভাবে তোলা ; একই কথা বলবেন কবি-লেখকরা, যাকে অনেকে বলেন প্রেরণা । আকস্মিকতা ও তাৎক্ষণিকতা ভেবেচিন্তে হয় না, তা আপনা থেকে উদয় হয়, কাট-আপে পাওয়া অর্থময়তার ঢেউদের মতন, একখানা কাঁচির সাহায্যে । ব্রায়ান জিসিনের আলোচক মারিনা ক্যাশডান বলেছেন যে, বর্তমান যুগের কাট-আপ হল টুইটার ফিডগুলো । কাশডান বলেছেন যে জিসিন “সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে চেতনাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।”

.

আট 

.

সেলিন এবং বারোজের বহু ব্যাপারে মিল আছে । তাঁদের সৃজনশীলতার কেন্দ্রীয় গুরুত্ব হলো লেখা এবং শিল্পের মধ্যে জরুরি সম্পর্ক । সেলিন বিশ্বাস করেন যে ঠিক যেমন কিছু চিত্রশিল্পী, যেমন, ভ্যান গগ, বাস্তবজগতের  বস্তুদের ক্যানভাসে ‘স্হানান্তর’ করেন, তাঁর উপন্যাসও তেমনই কথ্য ভাষার আবেগকে লিখিত আকারে “স্থানান্তর” করে পৃষ্ঠায়  উপস্থাপনা করা হয়। এঁদের উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্যে প্যারানয়া আর বিভ্রমের উপস্হিতি স্পষ্ট এবং তা যে সাহিত্যের খাতিরে তাঁরা লেখায় এনেছেন, তা নয় । তাঁদের মস্তিষ্ক ওই ভাবেই কাজ করে । প্যারনোয়া একটি তীব্র উদ্বেগ বা ভীতিকর অনুভূতি এবং প্রায়ই তা নিপীড়ন, হুমকি বা ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত । প্যারানয়া  মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির সাথে ঘটতে পারে,  তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানসিক ব্যাধি । অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসগুলো দৃঢ় হয়ে গেলে প্যারানয়েড চিন্তাভাবনাগুলি বিভ্রান্তিতে পরিণত হতে পারে । তখন  একজন লোক বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে যে  তারা যা ভাবে বা অনুভব করে তা সত্য । কারণ শুধুমাত্র চিন্তাভাবনা প্রভাবিত হয়, ভ্রমজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে কাজ চালিয়ে যায় , তবে, তাদের বিভ্রমের ফলে তাদের জীবন সীমিত এবং বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ইহুদিবিদ্বেষের কারণে সেলিন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীকে হত্যা করার পর ‘কুৎসিত আত্মা’র খপ্পরে উইলিয়াম বারোজ মুক্ত হতে পারেননি প্যারানয়া আর বিভ্রম থেকে। বারোজ বলেছেন যে ‘নেকেড লাঞ্চ’ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায় ; যেখান থেকে পাঠক পড়বেন, সেখান থেকেই শুরু।

.

দুজনেই মিসানথ্রোপ, অর্থাৎ তাঁরা মানুষের চেয়ে  প্রাণীদের সাথে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করতেন, বিড়াল পছন্দ করতেন।সেলিন অন্যদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে চলতেন এবং একাকীত্ব খুঁজতেন। বারোজ বিপরীতভাবে, বহিরাগত এবং সমাজের প্রতি নিজের অসন্তোষ প্রকাশ্যে প্রকাশ করে গেছেন।সেলিন এবং বারোজ দুজনেই  প্যারানইয়া এবং মিসানথ্রোপে ভরা অন্ধকার জগতের দৃশ্য উপস্হাপন করেছেন। এটি আইকনোক্লাস্টিক হতাশাবাদের মতো ব্যাপার । সেলিন লিখেছেন, “মৃত মানুষ জীবিত মানুষের চেয়ে কম ভীতিকর”। বারোজের রচনায় এই উক্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে যখন তিনি বলেছেন যে “অসুস্থ ব্যক্তিরা ভালোদের তুলনায় কম ভীতিকর” । উভয়ই উদ্ভাবনী সাহিত্য কৌশলের সাহায্যে তাঁদের হতাশাকে সমাজ-সংসারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।শেষ পর্যন্ত, বারোজ এবং সেলিন উভয়ই নৈতিকতাবাদী ছিলেন, তাদের পরীক্ষামূলক শৈলী এবং প্রদাহজনক গদ্য বিংশ শতাব্দীর অযৌক্তিক সন্ত্রাসের সাথে মোকাবিলা করার উপায় হয়ে ওঠে। নোংরা রাজনীতি সত্ত্বেও, সেলিন মানবতার নৈতিক অধঃপতন এবং নৈতিক আপেক্ষিকতার একটি অবিচ্ছিন্ন ঘটনাক্রম তৈরি করে গেছেন।

.

বারোজ আদি আমেরিকানদের ‘ফ্রন্টিয়ার ব্যক্তিত্ববাদে’ বিশ্বাস করতেন, যাকে তিনি বলতেন, আপনার নিজের চরকায় তেল দিন যা আমেরিকার গৌরবময় সীমান্ত ঐতিহ্য।  আমলাতান্ত্রিক অত্যাচারকে উদারতাবাদের সমতুল্য মনে করতেন তিনি। সরকারী কর্তৃত্বকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করার আইন প্রণয়নকারী হস্তক্ষেপের  সমষ্টি হিসাবে দেখতেন। তাঁর জীবনীকার টেড মরগানের মতে,  জীবন যাপনের জন্য বারোজের দর্শন ছিল একটি অবাস্তব পথকে মেনে চলা, যা হবে বাধাবন্ধনহীন – মূলত পুঁজিবাদী ব্যবসায়িক বিশ্বের সাথে মিলে যায় বারোজের মতাদর্শ।

.

বরোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ থেকে  কবিতার আকারে লেখা এই গদ্যটা তুলে দিচ্ছি:-

.

“আমি কি তোমাদের সেই লোকটার কথা বলেছি
যে নিজের পোঁদকে কথা বলতে শিখিয়েছিল ?
ওর পুরো তলপেট ওপর-নীচে নাচতো,
বুঝলে, পেদে-পেদে বাক্যদের বের করতো ।
জীবনে এমন ঘটনা শুনিনি কখনও ।
বুদবুদময়, ভরাট, স্হির শব্দ ।
এমন শব্দ যার গন্ধ তুমি শুঁকতে পারবে ।
সেই লোকটা কার্নিভালে কাজ করতো, বুঝলে কিনা ?
আর যদি বলতে হয় তাহলে সেটা ছিল
একধরনের নবীন ভেন্ট্রিলোকিস্ট কারবার ।
কিছুকাল পর
পোঁদটা নিজের মনেই কথা বলতে শুরু করলো ।
কোনোরকম তৈরি না হয়েই
লোকটা মঞ্চে উঠে পড়তো..…
আর পোঁদটা ওর দিকেই চটজলদি
ঠাট্টা-ইয়ার্কিগুলো প্রত্যেকবার ছুঁড়ে মারতো ।
তারপর তাতে দাঁতের মতন কিছু গজালো…
সামান্য বেঁকা রসালো বঁড়শি
আর খাওয়া আরম্ভ করে দিলো ।
ও প্রথমে ভাবলো ব্যাপারটা বেশ মস্তির
আর তার চারিধারে কাজ গড়ে তুললো…
কিন্তু পোঁদটা ওর ট্রাউজার খেতে-খেতে
রাস্তাতেই কথা বলা আরম্ভ করে দিলে…
চেঁচিয়ে বলতে লাগলো : ও সমান অধিকার চায় ।
ওটা মাতাল হয়ে উঠতো, অনেক সময়ে, আর হেঁচকি তুলে কাঁদতো।
কেউই তা পছন্দ করতো না ।
আর ও চাইতো ওকে চুমু খাওয়া হোক
অন্য যে কোনও মুখের মতন ।
শেষ পর্যন্ত, ওটা সবসময় বকবক করতো,
দিন আর রাত ।
অনেকগুলো বাড়ি পেরিয়েও তুমি শুনতে পাবে ওকে,
পোঁদকে চুপ করার জন্য হুকুম দিচ্ছে চেঁচিয়ে…
ঘুষি পাকিয়ে ওটাকে থাবড়াচ্ছে…
মোমবাতি ঢোকাচ্ছে, কিন্তু…
কোনও ভালো ফল হতো না,
আর পোঁদটা ওকে বলল…
“শেষ পর্যন্ত, আমাকে নয়
চুপ করতে হবে তোমাকেই…
“কেননা আমরা তোমাকে
এখানে আর চাই না ।
আমি একই সঙ্গে কথা বলতে আর হাগতে চাই না ।”
তারপর থেকে, স্বচ্ছ জেলি বের করে
সকালে জেগে ওঠা আরম্ভ করল…
সারা মুখ জুড়ে গজানো
ব্যাঙাচির লেজের মতন ।
সেগুলো মুখ থেকে উপড়ে তুলতে লাগলো ও
আর টুকরোগুলো হাতে আটকে রইলো…
পেটরলের জ্বলন্ত জেলির মতন
আর বেড়ে উঠতে লাগলো ।
ফলে, শেষ পর্যন্ত, ওর মুখ বন্ধ হয়ে গেলো…
আর পুরো মাথা…
যেন আপনা থেকেই খসে পড়বে
চোখগুলো ছাড়া, বুঝলে কিনা ?
একমাত্র ব্যাপার ছিল যে
পোঁদটার দেখার ক্ষমতা ছিল না ।
ওর দরকার ছিল দুটো চোখ ।
শিরার সঙ্গে যোগাযোগ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল…
আর সেঁদিয়ে গিয়েছিল আর অবসন্ন হয়ে গিয়েছিল ।
ফলে, মস্তিষ্ক আর
নির্দেশ দিতে পারতো না ।
ওটা মগজের ফাঁদে আটকে পড়েছিল…
সিলবন্ধ করা ।
পরে, তুমি দেখতে পাবে…
চোখের পেছনে মগজের
নিরব, অসহায় যন্ত্রণা ।
আর তারপর শেষকালে
মগজ হয়তো মরে গেলো..
কেননা চোখ দুটো বেরিয়ে এলো…
ডাঁটির ডগায় কাঁকড়ার চোখের মতন
তাতে আর কোনও অনুভূতি ছিল না ।”

.

পিকারেস্ক উপন্যাসের চরিত্রদের মতন মিসানথ্রোপ এই কারণে দুঃখিত হয় যে তার নিজেরও  একই মানবিক ত্রুটি রয়েছে।এই ধরনের একজন ব্যক্তির নৈতিক প্রয়োজনীয়তা এত বেশি যে, ভালো এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে তার বোঝার মান অনুসারে, পৃথিবীতে বসবাসকারী অধিকাংশ লোকই বদমাশ । এই ব্যক্তিরা অন্যদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আচরণ করে, কর্মজীবনের সিঁড়িতে উঠে যায়, কিন্তু একই সময়ে তারা অন্যদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং অবজ্ঞা প্রকাশ করতে পারে। তারা অনুগত বন্ধু হতে পারে, কিন্তু সাবধানে তাদের চারপাশ থেকে ছেঁকে নিয়ে নৈকট্য গড়ে তোলে।  দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার এবং ফ্রেডরিখ নিটশেও  মিসানথ্রোপ হিসাবে বিখ্যাত। শোপেনহাওয়ার এমনকি সবার প্রতি অবিশ্বাসের আহ্বান জানিয়ে একটি ইশতেহার তৈরি করেছিলেন, কখনও অন্যদের কাছে খুব বেশি কিছু না বলতে, এমনকি  সেরা বন্ধুদের কাছ থেকেও গোপন রাখতে বলেছিলেন। ফ্রিডরিখ নিটশে সুপারম্যানের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, যাঁর সুপারম্যান সাধারণ ব্যক্তির থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ‘ঈশ্বর মৃত’। 

.

সেলিন এবং বারোজ দুজনেই যৌনতা এবং অশ্লীলতার উচ্ছৃঙ্খল বর্ণনার বৈশিষ্ট্যযুক্ত । তাঁদের উপন্যাসগুলো নতুন সাহিত্যিক নজির তৈরি করে হবু সাহিত্যিকদের আকর্ষণ করে। আধা-আত্মজীবনীমূলক উত্তমপুরুষে লেখা আখ্যান। তাঁদের কুড়োনো অপবাদ আর পরাবাস্তব চিত্রের ব্যবহার সমসাময়িক জনপ্রিয় বাস্তববাদী শৈলীর সাথে বিরোধপূর্ণ ছিল এবং তাঁরা শীঘ্রই কুখ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁদের প্রাথমিক প্রশংসা সত্ত্বেও,  জার্নি এবং নেকেড লাঞ্চ মূলধারার পাঠকদের তুলনায় অন্যান্য লেখকদের উপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। বারোজের গদ্য তুলনামূলকভাবে ‘কঠিন’ কিন্তু সেলিনের ‘ব্ল্যাক হিউমারের’ ও সেলিনের প্রতিভার কারণে ‘জার্নি’ ব্যতিক্রমী। প্রকৃতপক্ষে, অস্পষ্ট আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেটিকে সেলিন এবং বারোজ জনপ্রিয় করেছিলেন, সাহিত্যে তার পুনরুত্থান দেখা গেছে  ডব্লিউ জি সেবাল্ড, এনরিক ভিলা-মাটাস, পল অস্টার এবং ইয়ান সিনক্লেয়ারের কাজের মাধ্যমে । এর কারণ পাওয়া যায়  বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকার উপর সেলিনে আর বারোজের সাহিত্য-বক্তব্য । তাঁদের অত্যন্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো যে ইঙ্গিত করে তা হল যে জীবন এবং কল্পকাহিনী উভয়ের অভিজ্ঞতাই কেবল শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে, এবং সেই হিসাবে, দুটি একই বুদ্ধিবৃত্তিক স্থান ভাগ করে নেয়; একটি দার্শনিক ধারণা যা মার্সেল প্রুস্ত এবং টমাস ডি কুইন্সি যুক্তিযুক্তভাবে সাহিত্যে প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু যেখানে প্রুস্ত এই মানবিক অভিজ্ঞতাকে রোমান্টিসাইজ করেছিলেন এবং ডি কুইন্সি তাঁর স্বপ্নের মতো আফিম দর্শনে সত্যের সন্ধান করেছিলেন, সেলিন এবং বারোজ সত্য এবং কল্পকাহিনীর মধ্যে পার্থক্যের এই অস্পষ্টতাকে একটি দুঃস্বপ্ন হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, তাই  ‘জার্নি’ আর ‘নেকেড লাঞ্চ’ উপন্যাসে পাওয়া যায় চূড়ান্ত নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। যাইহোক, তা করতে গিয়ে তাঁরা উপন্যাসের একটি নতুন ধারণারও পথপ্রদর্শক;  ক্ষয়কর ও শ্লেষাত্মক ভাষায় লেখা, যা জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’-এ  বাস্তববাদী উপন্যাসের কাঠামো ভেঙে ফেলে শুরু করেছিলেন।

কনরাড নিকারবোকারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বারোজ জানিয়েছেন, “১৯৫০ নাগাদ আমি লিখতে শুরু করি; সে সময় আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স ছিল; কোনো দারুণ কিছু প্রেরণা ছিল বলে মনে হয় না। আমি সহজভাবে চেষ্টা করছিলাম সাংবাদিকতার ছকে সোজাসুজি নেশা আর নেশাড়িদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা লেখার।আমার কিছু করার ছিল না। রোজ আমাকে কিছু একটা করতে সাহায্য করছিল এই লেখালেখি। অভাবনিয় কিছু একটা ফল হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ‘জাংকি’ আসলে তেমন কিছু একটা বই নয়। সে সময় লেখালেখির ব্যাপারে আমি কমই জানতাম। মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আমি থাকতাম সিয়ার্স, রোবাক-এ। আমি চার পাঁচ মাস সেনাবাহিনিতে ছিলাম তখন জি.আই. বিল-এ সেখানে স্থানিয় অধিবাসিদের আঞ্চলিক ভাষা পড়ছি। আমার মেক্সিকোতে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল আমেরিকায় নেশার ব্যাপারে প্রচণ্ড ঘোঁট পাকানো একটা অবস্থা। মেক্সিকোতে নেশার বস্তু সহজলভ্য ছিল, তাই আমাকে ছুটে বেড়াতে হত না, আর পুলিশের চাপও ছিল না। ভাগ্যক্রমে অস্থির অবস্থা ছাড়াই আমি বেশিরভাগ দৃষ্টি বিভ্রমকারি ড্রাগ নিয়ে দেখেছি। এলএসডি-২৫ আমার কাছে মেসকালিন নেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত দৃষ্টিবিভ্রমকারি ড্রাগের মতোই এলএসডি আমাকে বর্ধিত সচেতনতা দিয়েছে, সত্যি বিভ্রম বদলে দিয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম। আপনি দরজার একটা গোল হাতলের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখবেন তা বৃত্তাকারে ঘুরছে, যদিও আপনি এব্যাপারে সচেতন যে এটা ঘটছে ড্রাগটা নেওয়ার জন্য। এছাড়াও ভ্যানগগিয় রঙ, ওইসব ঘূর্ণিসমেত আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চড়চড় শব্দ।”

.

বারোজ সেলিনের বাক্য গঠন শৈলীর এলিপসিস ( উপবৃত্ত ) প্রচুর ব্যবহার করেছেন।অ্যানি টোনার ইংরেজি সাহিত্যে Ellipsis-এর প্রয়োগ সম্পর্কে বলেছেন: “এলিপসিস হলো বাদ দেবার শৈলী : “অসমাপ্ত বাক্যের একটি শক্তিশালী অকল্পনীয় শক্তি থাকতে পারে। বলা যায় যে তাদের সম্পূর্ণরূপে খুলে ফেলার বদলে অতিরিক্ত মানসিক শক্তি তৈরি করে।” বারোজ aposiopesis ( নীরবতা )সহ এলিপসিস ব্যবহার করেছেন: পাঠকদের কল্পনাকে উসকে দেবার জন্য , বিশেষ করে বিষম চিন্তা-ভাবনা উদ্রেক করার জন্য। সেলিনই প্রথম নন যিনি উপন্যাসে এলিপসিস প্রয়োগ করেছেন। সেলিনের আগেও উপবৃত্তকে নিখুঁত হাতিয়ার মনে করা হয়েছে কেননা  আমরা কীভাবে চিন্তা করি এবং কথা বলি সে সম্পর্কে বিশেষভাবে  প্রকাশ করার জন্য এলিপসিসের প্রয়োগ জরুরি । ইংল্যাণ্ডে ১৮ শতকের শেষের দিকে,  ট্যাবলয়েড এবং জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোতে উপবৃত্তের প্রয়োগ এতই সর্বব্যাপী ছিল যে জেন অস্টেন তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলোতে উপবৃত্তকে উপহাস করেছিলেন এবং জর্জ এলিয়ট তাঁর  বইগুলো থেকে সেগুলো কেটে বাদ দিয়েছিলেন:  উপবৃত্তের ইতিহাস সম্পর্কে বইতে জানিয়েছেন অ্যান টোনার ।

.

অসমাপ্ত সংলাপ বা বাক্যের শেষে তিনটে ফুটকি বা ডট, যার দ্বারা এলিপসিস গড়ে ওঠে তা ইউরোপের আধুনিকতাবাদী লেখকরা অনেকেই ব্যবহার করেছেন, তবে সেলিন এবং বারোজ ব্যবহার করেছেন অনেক বেশি। জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেট এবং টি.এস.এলিয়ট-এর কাজে প্রায়শই উপবৃত্তগুলো পাওয়া যায়। আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে  ভার্জিনিয়া উলফ-এর মতো উপবৃত্তকে বোধহয় আর কেউ অতো  পছন্দ করেননি, যাঁকে তিনটি ছোট বিন্দু  এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, এক পর্যায়ে, তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাসের শিরোনাম রাখতে চেয়েছিলেন “দ্য … ভয়েজ আউট।”

.

এলিপসিস বা উপবৃত্তের ফুটকিগুলো বিভ্রান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, যন্ত্রণা, বা অনিশ্চয়তার সঙ্গে অলস বা খণ্ডিত কথাবার্তা নির্দেশ করে; বারোজের ক্ষেত্রে যেমন একজন মাদকাসক্তের অথবা  কাট-আপ প্রক্রিয়ায় তৈরি বাক্যে। সেলিনের উপন্যাসে  উপবৃত্তের সবচেয়ে সাধারণ ব্যবহার হল ট্রেলিং অফ (প্রযুক্তিগত শব্দ: অ্যাপোসিওপেসিস) নির্দেশ করা এবং উত্তেজনা তৈরি করা। তাছাড়া উপবৃত্তটির দুই দিকের শব্দ/বাক্য বিশেষ চিন্তার নির্দেশ করে। কিংবা সেলিন যখন চরিত্রের সংলাপে দ্বিধা দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেছেন তখন প্রয়োগ করেছেন।অনেক সময়ে তিনটে ফুটকির কাজ হলো  দেখানো  যে একটি চরিত্র ভয়ে কান্নাকাটি বা তোতলানোর সময় কথা বলার চেষ্টা করছে।

.

 সেলিনের এলিপসিস বা উপবৃত্তগুলো মিশ্রিত উদ্বেগ, আকস্মিক আঘাত, হতাশা এবং ক্লান্তির বার্তা পৌঁছে দেয় পাঠকের সংবেদে এবং তা এমনই যে এখনকার দিনে পাঠক  সম্ভবত  দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য ( post traumatic stress disorder ) হিসাবে নির্ণয় করবে। (সেলিন নিজেই তাঁর লেখার শৈলীকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাওয়া আঘাতের ফল হিসেবে  দায়ী করেছেন।) তাঁর গদ্যের শৈলীতে লেখক এবং পাঠকের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার প্রায় অসহনীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার অনুভূতিও রয়েছে — সেলিন  বলেছিলেন “আমার আগ্রহের বিষয় হলো পাঠকের স্নায়ুতন্ত্রে সরাসরি বার্তা পৌঁছে দেয়া ।” সেলিনের গদ্যে হাড়, পেশী, তরুণাস্থি কেটে ফেলা হয়েছে — যা বাকি আছে তা হল রক্ত এবং মজ্জা।

.

সেলিনের তিনটে ফুটকিসহ গদ্য —-

.

১) ““অঢেল গুদ, পেট, বাঁড়া, উঁচুনাক আর মাছি তুমি জানো না তাদের নিয়ে কী করবে… … কিন্তু হৃদয়? … খুব দুর্লভ! গত পাঁচশ কোটি বছরে অনেক মোরগ এবং গ্যাস্ট্রিক টিউব গুনতে হবে… কিন্তু হৃদয়? … আপনার আঙুলে কুলিয়ে যাবে…!”

.

২)“কাছাকাছি … এবং কাছাকাছি … তারা খুব শীঘ্রই সেতুতে আঘাত করবে … সর্বোপরি … এই ধরনের অযোগ্যতা টিকে থাকার জন্য খুব ভাল ছিল … কিন্তু পুরো দলটা বেশ দ্বিধায় ছিল …  এখানে একটা সামান্য ব্যাখ্যা  রয়েছে … ম্যাডাম রেমুসাত আর তাঁর মেয়ে…. আঁচিলের মধ্যে শুয়ে আছে, তাদের পেট গোবরে সমতল… তীরে… একটি বোমার গর্ত… তারা ড্যান্ডেলিয়ন বাছাই করতে আসবে… তারা সবাই কাদা দিয়ে ঢেকে গেছে ! … একটা পুরু স্তর … তারা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে … তারা নড়ছে না … মরে গেছে নাকি? হতে পারে. যাইহোক,  তাদের পেট সমতল ছিল … আমি তাদের সম্পর্কে আর কখনও শুনিনি … তারা শহরের অন্য প্রান্তে থাকত …”

.

সেলিন বলেছেন তিনটে ফুটকির কাজ হলো: ১ ) কমা এবং পূর্ণচ্ছেদের স্বাভাবিক বিরাম চিহ্নের পরিবর্তে বিরতি হিসাবে কাজ করা;  ২ ) পৃষ্ঠায় একটি চিহ্ন হিসাবে পরিবেশন করা যাতে উপস্থাপিত হওয়া চেতনার প্রবাহের রৈখিক, প্রকৃতির বিপরীতে খণ্ডিত ভাবনাকে তুলে ধরা যায় ; এবং ৩ ) লেখা তৈরি করার জন্য তার প্রোগ্রাম কার্যকর করা যা “সঠিক স্নায়ুতন্ত্রকে উসকে দিতে সফল হয়”।

.

’কনভারসেশানস উইথ প্রফেসর ওয়াই’ গ্রন্হে  সেলিন তাঁর শৈলীর সমর্থনে বলেছেন যে উপবৃত্তের মাত্রাধিক ব্যবহার এবং তার বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলি লিখিত ভাষায় মানুষের আবেগকে মূর্ত করার এক প্রচেষ্টা। সেলিন সাহিত্যকে কাগজের ওপরে মানুষের আবেগের মানচিত্র আঁকার শিল্প হিসাবে দেখেছিলেন। এই ধরনের মানচিত্র স্বাভাবিক থেকে আলাদা, এবং এটি আবেগকে বিকৃত করে। তিনি একে  জলেভরা টবে আংশিকভাবে নিমজ্জিত একটা সোজা ফুটরুলের দিকে তাকানোর সাথে তুলনা করেছেন। আলোর প্রতিসরণের কারণে আপনি ফুটরুলকে দেখেন যেন এটি ভেঙে গেছে। যদি আপনার লক্ষ্য হয় যে অমন অবস্হায় একটা সোজা ফুটরুলের যতটা সম্ভব নির্ভুল ছবি দেখার, তাহলে ফুটরুলটাকে জলে ডুবিয়ে দেওয়ার আগে আপনাকে সেটাকে এমনভাবে বেঁকিয়ে নিতে হবে যাতে প্রতিসরণের পরে সেটা সোজা দেখায়। আপনি যদি কাগজের টুকরোতে মানুষের আবেগকে যতটা সম্ভব সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চান, তাহলে পৃষ্ঠায় সেগুলি বর্ণনা করার আগে আপনাকে অবশ্যই সেগুলিকে “বেঁকতে” হবে৷ সেলিনের মতে,  আবেগকে বেঁকানোর হাতিয়ার হল শৈলী।

.

সেলিনের ‘কনভারসেশানস উইথ প্রফেসার ওয়াই’ বইতে এই বিষয়ে এই সংলাপ আছে —

“”ঠিক আছে !…আমার তিনটি বিন্দু ! লোকে কি কখনও তাদের জন্য আমাকে তিরস্কার করেছে ! তারা আমার তিনটি বিন্দু নিয়ে কটূক্তি করেছে !…’আহ ! ওর তিনটি বিন্দু !…আহ, ওর তিনটি বিন্দু !… সে তার বাক্য শেষ করতে পারে না !’ বইয়ের প্রতিটি বোকামি ! প্রত্যেকটি, কর্নেল!”

    “তাই?”

    “যাও! ছরররররর ! ছরররররর !…মোতো গিয়ে, কর্নেল ! আর তোমার মতামত কি, কর্নেল?”

    “এই তিনটে বিন্দুর বদলে, আপনি হয়তো কয়েকটা শব্দে লিখতে পারেন, আমি যা অনুভব করি  তাই লিখি !” 

বারোজের গদ্য বাংলায় অনুবাদ করা কঠিন । মূল গদ্যই তুলে দিচ্ছি এখানে । গদ্যের এই অংশে বারোজ বারোটা এলিপসিস বা উপবৃত্ত ব্যবহার করেছেন।কয়েকটিতে aposiopesis ( কথার মাঝখানে চুপ করে যাওয়া ) ব্যবহার করেছেন যাতে সেই অংশের গুরুত্ব পাঠককে আকৃষ্ট করে।

.

Probing for a vein in the junk-sick morning …Strictly from cough syrup … 

 A thousand junkies storm the crystal spine clinics, cook down the Grey Ladies … 

In the limestone cave met a man with Medusa’s head in a hat box and said, ‘Be careful,’ to the Customs Inspector … Freeze forever hand an inch from false bottom … 

Window dressers scream through the station, beat the cashiers with the fairy hype … (The Hype is a short change con … Also known as The Bill …) ‘Multiple fracture,’ said the big physician … ‘I’m Very technical …’ 

Conspicuous consumption is rampant in the porticos slippery with Koch spit … 

The centipede nuzzles the iron door rusted to thin black paper by the

urine of a million fairies … 

This is no rich mother load, but vitiate dust, second run cottons trace the bones of a fix … 

.

নয়

.

সেলিন  মারা যান মিউদঁতে, ১৯৬১ সালে । অপপ্রচার হতে পারে এই ভয়ে তাঁর স্ত্রী কোনো সংবাদসংস্হাকে সেলিনের মৃত্যর খবর দেননি । ১৯৬৮ সালে বাড়িটায় আগুন ধরে যায়, বা কেউ আগুন লাগিয়ে দেয়, যার দরুন সেলিনের সংগ্রহের সমস্ত কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়।

বারোজ   লরেন্স, কানসাসে ২ আগস্ট ১৯৯৭ সালে মারা যান। তার আগের দিন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনবার তাঁর হার্টের শল্যচিকিৎসা হয়েছিল ।

Posted in Uncategorized | Tagged , , | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

দস্তয়েভস্কির ধর্মদ্বন্দ্ব : মলয় রায়চৌধুরী

দস্তয়েভস্কির ধর্মদ্বন্দ্ব : মলয় রায়চৌধুরী

ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির বাবা, মিখাইল আঁদ্রিভিচ দস্তয়েভস্কি ১৮৩৯ সালে মারা যান, যখন ফিয়োদর সেন্ট পিটার্সবুর্গে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তেন । ফিয়োদরের বাবার মৃত্য সম্পর্কে তিনটি পরস্পরবিরোধী কারণের কথা শোনা যায় এবং সত্যটি আজও অজানা । প্রথমটি হল যে তাঁকে তাঁর জমিদারির চাষিরা খুন করেছিল, দ্বিতীয়টি হল যে স্ত্রী মারিয়া নেচায়েভার মৃত্যুর পর মিখাইল অত্যধিক মদ খেতেন যার দরুন তাঁর সিরোসিস হয়ে গিয়েছিল, তৃতীয় হল যে মিখাইল হার্ট অ্যাটাকে মারা যান । মিখাইলের মৃত্যু যদিও রহস্যে ঢাকা, তাঁর ছেলে আঁদ্রের রচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে স্ত্রী মারিয়ার মৃত্যুর পর মিখাইলের স্বাস্হ দ্রুত খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর সমস্ত রকমের প্রতিরোধ-শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন । তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের যাজক এবং তাঁদের আদিনিবাস ছিল লিথুয়ানিয়ার পিন্সকে, যা এখন বেলারুসের অন্তর্গত । লিথুয়ানিয়ায় তাঁর নামের উচ্চারণ ছিল মিখাইল । ফলত, শৈশব থেকে ফিয়োদরের মনে খ্রিস্টধর্মের ব্যাখা নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ পরিবারিক। বাঙালি হিন্দু লেখকদের কী এই ধরণের প্রশ্ন মনে জাগে না ?

মিখাইল ছিলেন মসকোয় গরিব রোগীদের মারিনস্কায়া হাসপাতালের ডাক্তার । ১৮২৮ সালে, যখন তাঁর দুই ছেলে, মিখায়েল আর ফিয়োদরের বয়স যথাক্রমে আট আর সাত বছর,  তিনি কলেজিয়েট অ্যাসেসরের পদে উন্নীত হন, যা তাঁকে আইনত অভিজাত শ্রেণির সদস্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং তিনি মসকো থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে  দারোভোয়েতে একটি ছোটো জমিদারি কেনেন ; সেখানে তাঁরা গ্রীষ্মাবকাশে গিয়ে থাকতেন । এই চাষজমির একটা পয়োনালিতে পাওয়া গিয়েছিল মিখাইলের মৃতদেহ ।  মৃতদেহ এই ভাবে পাওয়া,  ফিয়োদরের চরিত্রে ‘পাপবোধ’ বা ‘সিন’ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ক্ষত তৈরি করে দিয়েছিল, যেমনটা ক্যাথলিকরা খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য অনুশোচনা করেন ।

ফোবিদরের বাবার আরও ছয়টি সন্তান হয়েছিল : ভারভারা ( ১৮২২-১৮৯২ ), আঁদ্রেই ( ১৮২৫-১৮৯৭ ), লিউবভ ( ১৮২৯ সালে জন্মের পরই মারা যায় ), ভেরা ( ১৮২৯-১৮৯৬ ), নিকোলাই ( ১৮৩১-১৮৮৩ ) এবং আলেকসান্দ্রা ( ১৮৩৫ – ১৮৮৯ ) । মিখাইল ছিলেন সুশিক্ষিত  ও স্নেহময় মানুষ, কিন্তু তাঁর আচমকা চটে যাবার স্বভাব তাঁকে এমন করে তুলতো যে তখন তাঁকে অত্যন্ত কড়া মেজাজের ও অবিশ্বাসযোগ্য মনে হতো ।  যখন তাঁর মনের ভাব খারাপ থাকতো তখন মিখাইল জগতসংসারকে  তিক্তভাবে দেখতেন, উত্ত্যক্ত হয়ে যেতেন, সদাচার ভুলে যেতেন এবং আত্ম-সচেতনতা  থাকতো না । বাবার চরিত্রের তিক্ততা ও অন্তর্মুখীনতা বর্তেছিল ফিয়োদরের ওপর । 

মিখাইল  ছিলেন অত্যধিক ধার্মিক এবং তিনি ও স্ত্রী মারিয়া বাচ্চাদের গোঁড়া রুশ খ্রিস্টধর্মের ঐতিহ্য অনুসারী করে তুলতে চাইতেন, যার বৈশিষ্ট্য হল ভয়, কঠোরতা ও আনুগত্য । কাথলিক শব্দটি গ্রীক শব্দ কাথোলিকোস থেকে এসেছে, যার অর্থ সর্বজনীন কিন্তু রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ তাকে সর্বজনীন বলে মনে করে না। একই ধর্মের এরকম দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যা, ফিয়োদরকে শৈশবেই অবাক করেছিল ।বাচ্চাদের তিন-চার বছর বয়স থেকে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট পড়ে ও ব্যাখ্যা করে শোনাতেন তাঁদের মা-বাবা। পাশাপাশি, বাচ্চাদের আয়া  আলেনা ফ্রোলভ্‌না রাতে শোবার সময় তাদের খ্রিস্টধর্মীদের  বীরগাথা, রূপকথা ও কিংবদন্তির গল্প পড়ে শোনাতেন । 

১৮৩৭ সালে মারিয়া যক্ষ্মা রোগে মারা যান আর ফিয়োদরের ছোটো ভাই আঁদ্রেই এই সময়ের পর বাবার মধ্যে প্রভূত পরিবর্তন লক্ষ করেন । আঁদ্রেই লিখেছেন যে তাঁর মা মারা যাবার পর বাবার মধ্যে অদ্ভুত বদল ঘটতে থাকে, নিজের সঙ্গে এমন জোরে-জোরে কথা বলতেন যেন স্ত্রী মারিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন। আঁদ্রেই একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন যাতে তাঁর বাবা ফিয়োদরকে লিখছেন যে মারিয়ার মৃত্যুর ফলে গড়ে ওঠা নিজের অসীম দুঃখ আর যাতনা তাঁর সহ্যের অতীত হয়ে গেছে । ফিয়োদরের মনে হয়েছিল যে এই দুঃখ ও যাতনা তো আসলে খ্রিস্টের ! আঁদ্রেই-এর মতে, চরম একাকীত্ব তাঁর বাবাকে মদ্যপ আর প্রায়-উন্মাদ করে তুলেছিল । বাবার মৃত্যু সম্পর্কে তিনটি সম্ভাব্য কারণের মধ্যে চাষিদের হাতে খুন হওয়াকেই সত্য বলে মনে করেন আঁদ্রেই ; মিখাইলের বদমেজাজের কারণে একবার তিনি চিৎকার করে একজন চাষিকে অপমান করেছিলেন ; সেই চাষি অন্য চাষিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে খুন করেছিল তাঁর বাবাকে । ঘটনাস্হলে পুলিশ এসেছিল কিন্তু চাষিরা সবাই মিলে মোটা ঘুষ দেবার দরুন হত্যাকাণ্ড ধামা চাপা পড়ে যায় ; সরকারি নথিতে লেখা হয় যে মিখাইল হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন । 

মিখাইলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ আশি বছর অজানা ছিল । মিখাইলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও জানা যায়নি, তবে মৃত্যু ঘিরে যে রহস্য এবং বাবাকে হারানোর বিষাদ, ফিয়োদরের লেখালিখি ও বিশ্ববীক্ষার ওপর প্রভূত ছাপ ফেলেছিল । ফ্রয়েড বলেছেন যে দস্তয়েভস্কির মৃগীরোগ যেভাবে আচমকা দেখা দিয়েছিল তা তাঁর বাবার মৃত্যুর ঘটনাকে কিনারা করতে  ও সহ্য করতে গিয়ে মস্তিষ্কে ব্যাখ্যাহীন ছাপের দরুন,  সারাজীবন যাতনাটি ফিয়োদরের সঙ্গী ছিল। মৃগীরোগ তাঁর রচনার থিম, বিশেষ করে ‘দি ইডিয়ট’ উপন্যাসে । পিতৃহত্যা ও পিতৃস্হানীয়ের হত্যা এবং বাবা ও ছেলেদের পরস্পর সম্পর্ক দস্তয়েভস্কির থিমগুলোর অন্যতম, বিশেষ করে ‘দি ব্রাদার্স কারামাজোভ’ উপন্যাসে, যে রচনায় বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত অপরাধবোধ তাঁর ছেলেদের মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণ হয়ে ওঠে । উল্লেখ্য যে যিশুর পিতা হলেন ঈশ্বর ।

জার-শাসিত রাশিয়ায় ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি  এমন একটি জীবন যাপন করেছিলেন যা তাঁর উপন্যাসগুলোয় ভয়াবহভাবে  প্রতিফলিত হয়েছে : জটিল, উত্তেজনায় টান-টান এবং মানসিক অস্থিরতা ও প্রশ্নজালে জর্জরিত। মানুষের স্বভাবচরিত্র তাঁর উপন্যাসে বল্গাছাড়া পরিসর পেয়েছে, তারা যেন সেই লোকগুলোর মতন যারা নির্দিধায় যিশুর হাতে আর পায়ে গজাল ঠুকে ক্রুশকাঠে ঝুলিয়েছিল । দস্তয়েভস্কি দেখেছেন যে এই এরাই আবার পরস্পরের নির্মমতা, হিংস্রতা, ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রগাঢ় প্রেমে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ার আনন্দ আহ্লাদিত ও যন্ত্রণায় কাতর হয় ।  তাছাড়া মহৎ ব্যক্তির জীবনেও থাকতে পারে গোপন নোংরামির ঘা যেমন থাকে বহু যাজকের । 

বাবা মিখাইলের হাসপাতাল ছিল মস্কোর প্রায় বাইরে গরিবদের এলাকায় । হাসপাতালের ঘাসহীন মাঠে একা-একা ঘুরে বেড়াবার সময় নানা অসুখে-ভোগা রোগিদের যাতায়াত নিয়মিত দেখতেন ফিয়োদর, সেই ধরণের রোগী যারা যিশুর ছোঁয়ায় সেরে উঠতো । সেই সব লোকেরা বেশির ভাগ ছিল দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত  নিচুতলার মানুষ। সেই নিম্নবিত্ত এলাকায় বন্ধুহীন নিরানন্দ  কঠোর ও নিঃসঙ্গ  শৈশবের একাকীত্ববোধ, শৈশবের ফ্ল্যাটের দমবন্ধকরা পরিবেশ ফিয়োদরের মধ্যে গড়ে তুলছিল ভিন্ন একটি অ-বালক চারিত্র্য । তিনি যেন কাঁধে ক্রুশকাঠ বইবার একাকীত্ববোধে নির্বাসিত ।

নিউ ও ওল্ড টেস্টামেন্ট শোনার সময় থেকে ফিয়োদরের মনে আব্রাহামিক বাইনারি বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছিল । ঈশ্বর সম্পর্কে দ্বন্দ্ব থেকে  কখনও মুক্তি পাননি তিনি এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানার মতে, এই বিষয়ে দস্তয়েভস্কি একটি পুরো গ্রন্হাগারের বই পড়ে ফেলেছিলেন । “দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাস লেখার আগে, দস্তয়ভস্কি  একটি চিঠিতে বন্ধু এ. এন.মাইকভকে  লিখেছিলেন, “যে ব্যাপারে  আমি আমার সারা জীবন সচেতনভাবে বা অজ্ঞানভাবে যাতনা ভোগ করেছি—তা হলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব।” । অর্থাৎ যিশুর বাবার অস্তিত্ব। 

দস্তয়েভস্কির অধিকাংশ বই  খ্রিস্টান মতবাদের কাঠামোর মধ্যে লেখা হয়েছে, এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের ও অবিশ্বাসীদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে আলোকিত করেছে :  চূড়ান্ত ভাল এবং খারাপের দ্বন্দ্ব ।  দস্তয়েভস্কি বিশ্লেষণ করেছেন, যীশু খ্রিষ্টের “সত্য” উপলব্ধির ধাপে অন্তর্নিহিত মানসিক যন্ত্রণা এবং সেই সূত্রে জেগে ওঠা প্রশ্নাবলী । তাঁর সমালোচক বারদাইয়েভ-এর মতে , “দস্তয়েভস্কিকে  পৌত্তলিকদের মতো ঐশ্বরিক সমস্যার সমাধান করতে হয়নি, বরং তাঁকে ভাবতে হয়েছে মানবজাতির সমস্যা, ব্যক্তিমানুষের যন্ত্রণা,  আধ্যাত্মিক মানুষ হিসাবে একজন খ্রিস্টানের সমস্যা।” দস্তয়েভস্কি বলেছেন যে, বিবেকের স্বাধীনতার চেয়ে মানুষের জন্য আর কিছু প্রলুব্ধকর নয়। কিন্তু যাতনা ভোগার তার চেয়ে  বড় কারণ আর নেই । যিশু এই যাতনা ভোগ করেছিলেন।   ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বন্দ্বে একজন হিন্দু বা অনীশ্বরবাদী পাঠকের  জড়িয়ে পড়া এবং তার যাতনা বুঝতে পারা কঠিন কেননা হিন্দু তো জানে না শয়তান বলতে কাকে বোঝায়, তাই সে সহজেই নিজের দুষ্টু ছেলেকে ‘শয়তান কোথাকার’ বলে বকুনি দিতে পারে ।

দস্তয়েভস্কির ভাবুক সত্তার বিকাশ মোটামুটি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় । তাঁর কারাবাসের আগের ছোটো লেখাগুলো, যাতে লক্ষ করা যায় রুশ ও বিদেশি সাহিত্যিকদের প্রভাব , যদিও কিছু বৈশিষ্ট্য এবং শৈলীগত উদ্ভাবন যা পরে তাঁকে চিহ্ণিত করবে, তার আভাস সেগুলোয় স্পষ্ট ।   গোগলের দ্বারা সেন্ট পিটার্সবার্গের কেরানিদের অপমানজনক চরিত্রচিত্রণ  এবং তাদের ক্ষতিকারক পরিবেশের বর্ণনা যুবক দস্তয়েভস্কির ভালো লেগেছিল । দস্তয়েভস্কি নিজেও এই সমস্ত প্রান্তিক, হিংসুটে, ঝগড়ুটে লোকেদের সঙ্গে শৈশব থেকে পরিচিত ছিলেন; এরা যেন জুডাসের বংশধর। দস্তয়েভস্কির সেই সময়ের গল্পগুলোতে এই উপাদানগুলো এতো বেশি যে তিনি নিজেকে গোগলের শিষ্য হিসেবে চিহ্নিত করতেন। ই.টি.এ. হফমান- এর  গল্পের বৈশিষ্ট্যগুলো, বিশেষ করে  গথিক এবং রোমান্টিক মেলোড্রামা,  পছন্দ ছিল দস্তয়েভস্কির । তা সত্বেও, দস্তয়েভস্কিকে অমন প্রভাব থেকে যা আলাদা করে তা হল গরিব বর্গের লোকেদের যাতনার আর কষ্টের  কার্নিভালিস্ট অতিরঞ্জন ।

রুশরা যে ধর্ম সম্পর্কে গোঁড়া তা সোভিয়েত দেশ ভেঙে যাবার পর অর্থোডক্স চার্চের স্বমহিমায় ফেরা থেকে টের পাওয়া যায়, যখন কিনা ইউরোপের অন্যান্য দেশে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে । প্রকৃতপক্ষে, দস্তয়েভস্কি একটি গোঁড়া ধর্মীয় পরিবারে বেড়ে ওঠেন । উনি নিজেই বলেছেন, “আমি একজন ধার্মিক রাশিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমরা আমাদের পরিবারে আমাদের শৈশবকাল থেকেই গসপেলের কথা জানি। আমার কাছে, তা একটি গৌরবময় ব্যাপার। ” তিনি অবশ্যই বাইবেলের বিষয়বস্তুর সাথে ভালভাবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তাঁর নিষ্ঠাবান মা তাঁর সন্তানদের পড়তে এবং লিখতে শেখানোর জন্য শুধুমাত্র ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট ব্যবহার করতেন। 

দস্তয়েভস্কি তাঁর প্রিয় আয়ার কথাও বলতেন, যিনি  তাঁকে রাতে শুতে যাবার আগে এই  প্রার্থনা করতে বলতেন, , “আমি আমার সমস্ত আশা তোমার ওপরই রাখি, মাদার মেরি, আমাকে তোমার সুরক্ষা দিও ।” শৈশবে এই ধরনের  শক্তিশালী মহিলারা  সম্ভবত দস্তয়েভস্কির পরবর্তী লেখাকে প্রভাবিত করেছিল, যার কারণে তিনি নারী চরিত্রগুলোকে এমন ভূমিকা দিয়েছেন যা সত্য এবং সম্পূর্ণ ধার্মিক, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের সোনিয়া চরিত্রে। যদিও দস্তয়েভস্কির লালন -পালনের একটি বড় অংশ খ্রিস্টান পরিবারে ঘটেছিল,  তিনি মানুষের কঠোর স্বভাবচরিত্রের পরিচয়ও শৈশবেই পেয়েছিলেন। তাঁর বাবাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন বটে, কিন্তু তিনি মাতাল ছিলেন এবং পরে তাঁর অমানবিক আচরণের কারণে চাষিদের হাতে খুন হন, এটা তিনি জীবনে কখনও ভুলতে পারেননি । 

দস্তয়েভস্কি  পরিচিত সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কির দ্বারা প্রভাবিত “রাশিয়ান ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্টস”  দলে যোগ দেন। এই দলের মতাদর্শ সম্ভবত দস্তয়েভস্কির বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছিল, কারণ  বেলিনস্কি মনে করতেন যে “সমাজতান্ত্রিক হিসাবে, তাঁদের প্রথমে খ্রিস্টধর্মকে ধ্বংস করতে হবে, কেননা বিপ্লব অবশ্যই নাস্তিকতা দিয়ে শুরু হওয়া উচিত।” পরে, যদিও, দস্তয়েভস্কি আন্দোলনের এই শাখা থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন, তবু  অর্থোডক্স চার্চের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক অভিব্যক্তিতে পূর্ণ একটি ব্যক্তিগত চিঠির প্রচারের জন্য তাঁকে  গ্রেপ্তার করে কারাগারে চালান করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, দস্তয়েভস্কি মাদার মেরিকে এবং যিশুকে ভুলে গিয়েছিলেন। 

কারাগারে থাকাকালীন (যেখানে একমাত্র বই বাইবেল অনুমোদিত ছিল) মনে হয় দস্তয়েভস্কি একজন ঈশ্বর-বিশ্বাসী হিসেবে আবার নিজেকে আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন । শ্রীমতী ফনভিজিনকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: “আমি বিশ্বাস করি যে এর চেয়ে প্রিয়, গভীর, আরও সহানুভূতিশীল, যুক্তিসঙ্গত কিছু নেই। ত্রাণকর্তার চেয়ে বড়ো  এবং নিখুঁত পুরুষ আর কেউ নেই;  যদি কেউ আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারে যে খ্রিষ্ট সত্যের বাইরে, এবং যদি তারা খ্রিস্টকে বাদ দেয় তবে আমার উচিত হবে খ্রিস্টের সাথে থাকা।” 

ঈশ্বর ও যিশুকে বিশ্বাসের প্রকৃত পুনর্জন্ম দেখা গেল  ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’,’ ডেভিলস’,’ দ্য ইডিয়ট’ এবং ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর মতো উপন্যাসগুলোয়, যে রচনাগুলোতে অর্ধোডক্স চার্চের বক্তব্য স্পষ্ট এবং অবিচল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হল এই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম  সাইবেরিয়ায় কারাবাসের সময় ঘটেছিল, যেখানে দস্তয়েভস্কি পুরুষদের মধ্যে খারাপ হবার ক্ষমতা সম্পর্কে তথ্যের একটি বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। দস্তয়ভস্কি এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে একটি বিশ্বাস গড়ে তুলতে পেরেছিলেন যা একইসঙ্গে ঈশ্বর ও শয়তানের পরস্পরবিরোধের বনেদ ।

তার মানে দস্তয়ভস্কির কাছে ঈশ্বর-বিশ্বাসের  সমস্যা সত্যের স্বীকৃতি সমস্যা নয়, বরং তা সংশয়কে  দূর করে। সন্দেহে যন্ত্রনাক্ত দস্তয়েভস্কির আত্মপ্রশ্নের প্রাথমিক উৎস ছিল পৃথিবীতে এতো  যন্ত্রণা রয়েছে কেন, এবং কেমন করেই বা প্রেমময় ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে তা খাপ খায়। দস্তয়েভস্কি এই দ্বন্দ্বটি আইভান কারামাজভের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, “এমন নয় যে ঈশ্বরকে আমি মানি না, বোঝার চেষ্টা করো,  আমি এই জগতকে গ্রহণ করি না, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, ঈশ্বরের এই জগতকে, এবং এর সাথে একমত হতে পারি না।” ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’, যে উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি ঈশ্বরের প্রশ্ন নিয়ে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন, এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা “বিশ্বাস বনাম নাস্তিকতার” দ্বন্দ্বকে পরিণাম দিতে পারে ।  

প্রাথমিকভাবে তাঁর ভাই অ্যালোয়িশার “সক্রিয় স্নেহ”, দস্তয়েভস্কির মতে, বিশ্বাস । কিন্তু  জোসিমাকে তিনি উপস্হাপন করেছেন একটি ‘আদিরূপ’ হিসাবে , যার মাধ্যমে দস্তয়ভস্কি দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি “মানুষকে স্বীকার করতে বাধ্য করতে পারেন, যে, প্রকৃত খ্রিস্টধর্ম  বিমূর্ত বিশ্বাস নয়, বরং জীবনে গ্রহণযোগ্য উজ্জ্বল বাস্তবতা । এই খ্রিস্টধর্ম আছে নাগালের মধ্যে, এবং অর্থোডক্স চার্চের খ্রিস্টধর্মই রাশিয়ান ভূখণ্ডের সমস্ত মন্দ থেকে একমাত্র পরিত্রাণ । এই খ্রিস্টধর্ম রোমান ক্যাথলিকদের নয়, যারা স্পেনে মানুষদের খুঁটিতে বেঁধে পোড়াতো।  অ্যালিয়োশা এবং জোসিমা চরিত্র দুটি দস্তয়েভস্কির আগের উপন্যাসে বিশ্বাস বিষয়ক প্রচেষ্টার তুলনায় সফল এবং এই দুজন ধার্মিক চরিত্র হলো আদর্শ সৎকর্মের উদাহরণ । পক্ষান্তরে ধরা যাক, ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসের প্রিন্স মিশকিন, যে একজন মামুলি মূর্খ আর শেষ পর্যন্ত মূর্খ থেকে গেছে, কেননা  খ্রিস্টান হিসাবে তার বিশ্বাসে গড়ে ওঠেনি, সে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে গেছে। 

‘ব্রাদার্স কারমাজোভ’ উপন্যাসে ফিয়োদর কারমাজোভের ছেলেদের প্রত্যেককে দস্তয়েভস্কি নিজের চৈতন্যের একটি অংশ দিয়ে চিত্রিত করেছেন, যাতে তাঁর নিজের ভেতরের ঝগড়া তাদের মুখ দিয়ে করাতে পারেন এবং বিশ্বাসের যাতনার বিশ্লেষণ করতে পারেন । অ্যালোয়িশা, তাঁরই এক ছেলের নাম যে এই উপন্যাস লেখার সময়ে মারা যায় । চরিত্রটি দস্তয়েভস্কির আধ্যাত্মিক দিকের প্রতিফলন,  যে দস্তয়েভস্কির আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমর্থন করে । দিমিত্রি তাঁর চরিত্রের আবেগময় দিক, যার কন্ঠে সব সময় দস্তয়েভস্কির প্রিয় কবিতা শোনা যায়, আর যার আর্থিক দুরবস্হা লেখকের সঙ্গে মিলে যায়, যিনি লিখেছিলেন “রুবলগুলো কাঁকড়ার মতন এদিক-ওদিক পালায়” । স্মেরদিয়াকভ চরিত্রটি  দস্তয়েভস্কির মতনই জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা ও তিক্ততা ভোগ করেছে ; দস্তয়েভস্কি এই চরিত্রের মাধ্যমে রাশিয়ায় যুবকদের বিপ্লবী নৈতিকতা বিশ্লেষণ করেছেন । আইভান হলো সব ভাইদের মধ্যে একজন বুদ্ধিজীবী, যার মাধ্যমে দস্তয়েভস্কি নিজের দার্শনিক ও ধর্ম-সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো ঝালাই করার সুযোগ পেয়েছেন । যদিও আইভানের চরিত্র দস্তয়েভস্কির সঙ্গে মেলে না, কিন্তু পরস্পরবিরোধী ভাবনাগুলোকে তিনি কাটাছেঁড়া করতে পেরেছেন, বিশেষ করে আইভানের দীর্ঘ ‘দি গ্র্যাণ্ড ইনকুইজিটর’ বক্তব্যের  মাধ্যমে, যাকে দস্তয়েভস্কি বলেছেন কবিতা ।

অ্যালিয়োশার চরিত্রে প্রদর্শিত বিশ্বাসের মাধ্যমে মূলত আইভান কর্তৃক ঈশ্বরের বৌদ্ধিক নিন্দা  প্রতিহত করেছেন দস্তয়েভস্কি । তবুও, নাস্তিকতার সমর্থনে আইভানের দৃষ্টিভঙ্গি নিহিত রয়েছে  মানবজাতির প্রতি তার ভালোবাসায় — দস্তয়েভস্কির যৌবনের রাজনীতি যা তাঁকে কারাগারে বন্দী করেছিল এবং ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। আইভান তর্ক দিচ্ছে স্রষ্টার বিরুদ্ধে,  কেননা সে মানুষের যন্ত্রণাভোগে বিপর্যস্ত । দুজন কারামাজভ ভাইয়ের মতামতের দ্বন্দ্ব মানুষের আত্মার মধ্যে পাওয়া যায়, সেখানে চলছে সতত সংগ্রাম । অদ্ভুত ব্যাপার  হল যে সৌন্দর্য যেমন রহস্যময় তেমনি ভয়ঙ্কর। ঈশ্বর এবং শয়তান সেখানে অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রটি হলো ব্যক্তি-এককের মস্তিষ্ক । দুটি তর্কবিন্দুতে আইভান  অ্যালিয়োশার বিরোধিতার প্রয়াস করে, তা হলো, নির্দোষদের কষ্টভোগ এবং অদম্য সাহসের ধারণা, মূলত  ইচ্ছার স্বাধীনতা বা খ্রিষ্টধর্মে যাকে বলা হয়েছে ‘মানুষের ফ্রি উইল’। বলাবাহুল্য এই দুই তর্কবিন্দু দস্তয়েভস্কির সারাজীবনের ক্ষত হয়ে কাজ করেছে মস্তিষ্কে ।

শিশুদের যন্ত্রণাভোগ আইভানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে অযৌক্তিক এবং অন্যায়, এবং আলিয়োশার কাছেও তা ক্ষতিকর। আইভান স্বগতোক্তির মাধ্যমে  শিশুদের নির্যাতনের ভয়াবহ উদাহরণ উপস্হাপন করে এবং তার দ্বারা বুঝে উঠতে চায় অ্যালিয়োশা কেমন করে অমন নির্যাতনের সঙ্গে তার ঈশ্বরপ্রেম মেলাতে পারে।  অ্যালিয়োশার অপরিসীম দয়ার প্রতি আবেদন করার তর্কে আইভান এইভাবে যুক্তি দেয়: “কল্পনা করো যে তুমি  মানুষকে সুখী করার, তাদের শান্তি ও বিশ্রাম দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে মানব-নিয়তির একটি পরিকল্পনা  তৈরি করলে, অথচ সেই পরিকল্পনায় অপরিহার্যভাবে দেখা গেল একটি ক্ষুদ্র জীবনকে  অত্যাচারে জর্জরিত করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তুমি কি সেক্ষেত্রে অমন পরিকল্পনার স্হপতি হতে রাজি হবে ?” আইভানের মতে ‘ফ্রি উইল’  আলোচনায় পাঠক ঈশ্বর সম্পর্কে আরেকটি সমস্যার সন্মুখীন হয় যা বিদ্যায়তনিক নাস্তিকতার অন্যতম প্রধান নীতির উপর আঘাত করে।  মানুষের পতনের কারণ হিসেবে আইভান মনে করে যে ঈশ্বর দোষী, এবং তাঁর প্রতি অবিশ্বাসের  যুক্তিও খাড়া করে : “মানুষের অস্তিত্বের রহস্য কেবল বেঁচে থাকা নয় ; বরং কোনও উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকা । খ্রিস্টের উক্তি স্মরণীয়, “নট বাই ব্রেড অ্যালোন।”এ-ও দস্তয়েভস্কির নিজস্ব অন্তরদ্বন্দ্ব ।

অ্যালিয়োশা আইভানের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যিশুখ্রিষ্টের উদাহরণ দেয়, যিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন।  দূরদর্শিতা হিসেবে এই ধারণাটিকে  অ্যালিয়োশা ব্যাখ্যা করে যে ‘প্রত্যেকেরই সবার প্রতি দায় আছে  ।’ যে-কোনো অপরাধবোধ, এবং ফলস্বরূপ যে-কোনো  যাতনাভোগ, প্রত্যেক ঈশ্বর-বিশ্বাসীর কাছে একই হওয়া উচিত, কারণ আমরা সবাই অ্যাডাম ও ইভের আদি পাপের জন্য দোষী। আর যদি আমরা সেই দায়িত্বকে প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করি তাহলে যন্ত্রণাভোগকে ভবিষ্যতে দূর করতে পারি । অ্যালিয়োশার বক্তব্যের  প্রতিক্রিয়ায় দস্তয়েভস্কি যা লিখেছেন তা তাঁর সবচেয়ে গভীর দার্শনিক মতামত  হিসাবে সূত্রায়িত করেছেন বিভিন্ন ভাবুক । এটি কাহিনির ভেতরে কাহিনি টেকনিকে লেখা এবং  আইভানের কবিতা ‘দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ নামে বিখ্যাত স্বগতোক্তি । 

“দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর” নামের গদ্যটি, যাকে দস্তয়েভস্কি বলেছেন কবিতা, তা  উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম সুপরিচিত অনুচ্ছেদ, কারণ মানুষের প্রকৃতি ও স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা এবং মৌলিক অস্পষ্টতা নিয়ে তাতে তর্কবিতর্ক করা হয়েছে। দীর্ঘ স্বগতোক্তিতে, ‘দি গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ এই ধারণাগুলো সমর্থন করেন: “কেবল শয়তানের নীতিগুলিই মানবজাতির সার্বজনীন একীকরণের দিকে পরিচালিত করতে পারে: মানুষকে রুটি দিন, তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করুন এবং বিশ্বকে শাসন করুন; যীশু নিজেকে নির্বাচিতদের একটি ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন , যখন কিনা ক্যাথলিক চার্চ নিজেদের কাজের উন্নতি করে, এবং সমস্ত মানুষকে তার আওতায় আনে। গির্জাগুলো ঈশ্বরের নামে বিশ্ব শাসন করে, কিন্তু তা আসলে শয়তানের নীতি অনুসরণ করে ;  মানুষকে উচ্চ মর্যাদা-সম্পন্ন মনে করা ছিল যিশুখ্রিস্টের ভুল ।” ‘দি ইনকুইজিটর’ স্বগতোক্তিটি নিজেদের রচনায় আলোচনা করেছেন বা উদ্ধৃতি দিয়েছেন নোয়াম চমস্কি, আলডস হাক্সলি, ডেভিড বেন্টলি হার্ট, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস, ক্রিশ্চিয়ান ফিলোস্ট্র্যাট, ইরভিন ডি ইয়ালম, পিটার ব্রুক, হেলেনা ব্লাভিটস্কি, লুই আলথুসার, ওরহান পামুক প্রমুখ ।

শুরুতে ছিল অল্প স্বাধীনতা , যা কিছু  ভালো তাকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, অথচ তা  পাপের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে না ; শেষ পর্যায়ের স্বাধীনতা ছিল বড়ো মাপের, ঈশ্বরকে পাবার স্বাধীনতা, ঈশ্বরের বুকে ঠাঁই পাবার স্বাধীনতা । মানুষের মর্যাদা এবং তার বিশ্বাসের মর্যাদার জন্য দুটি স্বাধীনতারই স্বীকৃতি প্রয়োজন : সত্যকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা এবং সত্যের স্বাধীনতা ; কিন্তু বাঁধনহীন  কল্যাণ, যা একমাত্র সত্য, তা অশুভের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে। এই সেই ট্র্যাজেডি যা  দস্তয়েভস্কি যাচাই  এবং অধ্যয়ন করেছেন । আর এতে রয়েছে খ্রিস্টধর্মের রহস্য । ফলে  এটি আইভানের যুক্তিকে নস্যাৎ  করে, কেননা অশুভের জন্য যদি  স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়, তাহলে মানুষের কারণেই দুষ্টতা এবং যন্ত্রণা ঘটে, আর তাই ঈশ্বরকে দোষ দেওয়া যায় না। তবে স্বাধীনতারও প্রয়োজন আছে, যাতে আমরা ঈশ্বরের ভালবাসাকে গ্রহণ করে তাঁকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি। এমন একটি জগতের অস্তিত্ব সম্ভব নয় , যা একই সঙ্গে মুক্ত এবং ভাল, কারণ মানুষের খুঁত তা হতে দেবে না। পৃথিবী বজ্জাতিতে ঠাশা আর কৃপণ, কারণ তা মুক্তির বনেদে দাঁড়িয়ে । তবু, সেই মুক্তি বা উত্তরণ মানুষের এবং তার জগতের সমগ্র মর্যাদা দিয়ে গঠিত। যাই হোক, পাঠবস্তুর ছকের ভেতরে দস্তয়েভস্কি বিতর্কটা তোলেননি । তিনি অ্যালিয়োশার কাজকারবারের  মাধ্যমে  স্বাধীন-ইচ্ছার কূটাভাসের জবাব দিয়েছেন । তত্ত্ব থেকে অনুশীলনে গেছেন।  দস্তয়েভস্কি  দেখিয়েছেন প্রেমের আকাঙ্খা, যা কিচ্ছু করে না এবং কেবল আত্মসমর্পণ করে, তার সঙ্গে সক্রিয় প্রেম যা বাঁচিয়ে তোলে,  তার পার্থক্য আছে । 

যদিও দস্তয়েভস্কি খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে নিজের সন্দেহগুলো যাচাই করতে-করতে এগিয়েছেন, তাঁর দ্বন্দ্বকে কিন্তু  বিশ্লেষণ করেছেন চরিত্রগুলোর মাধ্যমে । শেষ পর্যন্ত  এটা স্পষ্ট হয় যে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঈশ্বরের উপস্থিতির  প্রত্যয়ের মধ্যে নিহিত। তাঁর উপন্যাসের সমাপ্তির সময়  চরিত্রগুলোকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যে বোঝা যায়,  ‘‘ভালো’’ বা পছন্দসই চরিত্রগুলোকে তিনি ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যখন কিনা  “মন্দ” ব্যক্তিরা সর্বশক্তিমানের বিরোধিতা করে। ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসের শেষান্তে আমরা দেখি  অ্যালিয়োশা, মিতিয়া এবং কোলিয়া সকলেই বিশ্বাসী হিসাবে উপস্হাপিত, আর তাদের সকলের প্রতিই পাঠক সমবেদনা বোধ করেন । কিন্তু ধূর্ত এবং ক্ষতিকর স্মারদিয়াকভ আত্মহত্যা করে, যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে  সবচেয়ে ধর্মদ্রোহী বিদ্রোহ। ‘ডেভিল’ উপন্যাসে  কিরিলভ এবং নিকোলাই আত্মহত্যা করে, আর তারা রচনাটির  সবচেয়ে নিন্দনীয় চরিত্র। দস্তয়েভস্কি  সাধারণত তাঁর নায়কদের ঈশ্বরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হিসাবে উপস্হাপন করেন, কিন্তু খলনায়কদের উপস্হাপন করেন নাস্তিক হিসেবে । পাঠক কী নির্ণয় নেবেন তা তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেন ।

এছাড়াও তাঁর উপন্যাসগুলোতে খ্রিস্টান পাঠকদের জন্য পাতা আছে কিছু ছোটখাট ফাঁদ, যা দস্তয়েভস্কির মনোভাব ও বিশ্বাসকে মেলে ধরে । যেমন সুপারম্যান তত্ত্ব, অন্যায় খ্রিস্টানদের নমুনা, অর্থোডক্স চার্চের বাড়াবাড়ি, পাপের জয় এবং  “আলোর” প্রতি চরম ও প্রকৃত আত্মসমর্পণ। ১৮৭৮ সালে এন. এল. ওজিমভকে  একটি চিঠিতে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন: “এখন ধরে নিন ঈশ্বর বলে কিছু নেই কিংবা আত্মার অমরত্ব নেই। এখন আমাকে বলুন, যদি আমি নিছক পৃথিবীতেই মারা যাই, তাহলে আমি কেন (যতোদিন না আইন আমাকে ধরে ফেলছে,  নিজের চাতুর্য আর তৎপরতায় ) সৎভাবে জীবন যাপন করব এবং ভাল কাজ করব?  অন্য একজনের গলা কাটবো না, ছিনতাই করব না, আর চুরি করব না?” 

এই সুপারম্যান তত্ত্ব, প্রাথমিকভাবে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ রাসকোলনিকভে প্রতিষ্ঠিত, ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রকাশ করা সন্দেহের ফল, যার জন্য রয়েছে প্রচুর গর্ববোধ । তত্ত্বটি  রাসকোলনিকভকে বিনা প্ররোচনায় দুই নারী এবং  একটি সম্ভাব্য অনাগত শিশুকে হত্যা করার অনুমতি দেয়। উচ্চতর সত্তা হিসাবে, সে তাদের জীবন নিতে পারে, যাদের জগতে দরকার নেই, যারা না থাকলেও চলে । একই যুক্তি ব্যবহার করে কিরিলভ ঈশ্বরের কাছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আর নিজের জীবন শেষ করে ফেলার প্রস্তুতিতে বলে যে , “যদি ঈশ্বর থাকেন, তাহলে সবকিছুই তাঁর ইচ্ছা, এবং আমি তাঁর ইচ্ছা ছাড়া নিজে থেকে কিছুই করতে পারি না। যদি ঈশ্বর না থাকেন , তাহলে সবকিছু আমার ইচ্ছা, এবং আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করতে বাধ্য। ” এই আশ্চর্যজনক অহংকার কিরিলভের যিশুখ্রিস্টে অবিশ্বাস  থেকে উদ্ভূত, তার বদলে কিরিলভের রয়েছে নিজের প্রতি অটুট বিশ্বাস  :

“আপনি যদি নিজেকে গুলি করেন, তাহলে আপনি ঈশ্বর হয়ে যাবেন, তাই না? 

“হ্যাঁ, আমি ঈশ্বর হয়ে যাবো।” 

এই তত্ত্বটি অবশ্য দস্তয়েভস্কি তাঁর প্লটের  বিকাশে নিজেই খণ্ডন করেছেন। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর রাসকলনিকভ নিজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না । যদিও তার বিকৃত তর্ক তার জঘন্য কাজের জন্য একটা যুক্তি খাড়া করতে চেয়েছে , কিন্তু তার কোন কাজ ভুল  আর কোন কাজ ঠিক, সেগুলোর মানদণ্ডের অনুভূতি মুছে ফেলতে রাসকলনিকভ অক্ষম। প্রথম-প্রথম সে গতানুগতিকভাবে জীবন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, নিজের চতুর কৌশল উপভোগ করে এবং এই  উপসংহারে পৌঁছোয়  যে, সে একজন সুপারম্যান। তা সত্বেও, নম্রস্বভাবের সোনিয়া যখন রাসকোলনিকভের বোধবুদ্ধিকে কাটাছেঁড়া করে, আর তাকে তার আত্মার নিম্নতম স্তরে নিয়ে যায়, তখন সে স্বীকার করে যে সে দোষী, সে অপরাধ করেছে এবং খারাপ কাজ করেছে এবং তার ক্ষমা দরকার। দস্তয়েভস্কি সুপারম্যান তত্ত্বটি খারিজ করে দেন সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোয় মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে,  যতক্ষণ না তারা খ্রিস্টধর্মের সত্য এবং আলোকে স্বীকৃতি দেয় ততোক্ষণ তারা যাতনায় ভোগে। 

দস্তয়েভস্কির রচনায় প্রস্তাবিত আরেকটি ধারণা, যা ঈশ্বরে বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে তা হলো অসাধু খ্রিস্টানদের উদাহরণ। পাঠবস্তুতে এমন ব্যাপার পুরে দিয়েছেন তিনি, যেগুলো বিশ্বাসের ভিত্তিকে নড়িয়ে দিতে পারে । যেমন, অ্যাদেলায়াদা ইভানোভনা, “স্বামী ফিয়োদর পাভলোভিচের হাতে তিন বছরের শিশু মিত্যাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালালো  গরিব একজন চার্চ-ছাত্রের সঙ্গে ।” তক্ষুনি প্রশ্ন ওঠে, এ কেমনতর, যে, খ্রিস্টধর্মের ছাত্র পালিয়ে যায় অন্যের স্ত্রীর সাথে, যে কিনা এক শিশুর মা ! লক্ষনীয় যে স্বামীর নাম ফিয়োদর । এই অসঙ্গতিকে   দস্তয়েভস্কি ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসে আরও স্পষ্ট করেছেন  রাকিতিন চরিত্রটির বিকাশের মাধ্যমে । রাকিতিন, একজন সন্ন্যাসী হয়েও উপন্যাসের  নাস্তিক চরিত্রদের তুলনায় ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আরো তীব্রভাবে কাজ করে । অ্যালিয়োশার সবচেয়ে দুঃখের সময়ে, যখন তার বড়ো ভাই সদ্য  মারা গেছে, রাকিতিন অ্যালিয়োশাকে  খাবার-দাবার, মদ আর গ্রুশেঙ্কাকে এগিয়ে দিয়ে লোভ দেখায় । তাছাড়া, রাকিতিন ক্রমাগত ঝামেলা আর পরচর্চায় জড়িয়ে পড়ে, শেকসপিয়ারের ইয়াগোর ছোটো নমুনা যেন । বজ্জাত আর নকল  খ্রিস্টানরা সম্ভবত দস্তয়েভস্কির মানসিক যাতনা । দস্তয়েভস্কি যেন নোংরা চরিত্রগুলোকে সৃষ্টিই করেন যাতে উপন্যাসে তাদের আলোচনা করে মুখ বন্ধ করে দেয়া যায় । 

দস্তয়েভস্কির কাছে এই ধরনের সমস্যা তথাকথিত ধার্মিক লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং খবরদারি সংস্হা হিসেবে চার্চের  (বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চ)  বাড়াবাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে । দস্তয়েভস্কি ক্রমাগত সমালোচনা করেছেন  যাজকদের আরামদায়ক জীবনধারা আর উৎসবের মতন ব্যাপারের প্রতি তাদের তড়িঘড়ি অনুমোদনকে ।  ফিয়োদর পাভলোভিচ,  ফাদার সুপিরিয়রের খাবারের সময়ে ঢুকে পড়ে বিরাট তর্ক আরম্ভ করে , সংস্থার সমগ্র সংগঠনকে নিন্দা করে । বলে,  হে যাজকমশায়,  আপনি সমাজে নিজের সততা প্রমাণের চেষ্টা করেন,  সমাজে ভাল কাজ করার প্রদর্শন করেন, অন্যান্য লোকের খরচে একটা মঠে খাসা থাকেন, জানি, এর জন্য কোনো পুরষ্কারের আশা করেন না–অথচ আপনি সেই খাটুনিকে একটু কঠিন মনে করেন। ওই বোতলগুলো দেখুন যেগুলো চার্চের পাদ্রিরা এনে দিয়েছেন আর কারা কাকে এই সব দিয়েছে ? রাশিয়ার গরিব চাষিরা খেতমজুররা। একবার যদি দস্তয়েভস্কি কোনও চরিত্রের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম-কথিত সত্যের জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে পরবর্তী সমস্যা দেখা দেয় ঈশ্বরকে নিয়ে — সেই সত্যকে দৃঢ় করা এবং তাকে  বজায় রাখার সমস্যা । 

পরিশেষে, দস্তয়ভস্কি দ্বারা প্রস্তাবিত ঈশ্বর সম্পর্কিত  সমস্যা হল পাপ করার ক্রমাগত তাগিদ আর অমন কাজে জড়িয়ে পড়ার লোভ ।  মিত্যা স্বীকার করে, “যদিও আমি শয়তানকে অনুসরণ করছি, আমি তোমার পুত্র, হে প্রভু।”  এখানে, এই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার মধ্যে রয়েছে ভুল পথে এগোনো, যে, ঈশ্বরই হলেন পিতা, যাঁর প্রতি আমাদের অনুগত হওয়া উচিত, যদিও আমরা বারবার ভুল করতে পারি। 

যদিও দস্তয়েভস্কির লেখায় স্পষ্টভাবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সেই বিশ্বাসকে বজায় রাখার মানসিক লড়াইয়ের সাথে মোকাবিলা করে, তার চূড়ান্ত উপসংহার প্রশ্নাতীত — তা হলো এই যে, যদিও মানুষ হিসাবে আমরা ঈশ্বরবিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারি, এমনকী অনুমিত অসঙ্গতিগুলি আমাদের আলোড়িত করতে পারে , বিশ্বাসী হিসাবে তাঁর কৃপায় আমাদের তুচ্ছ অজ্ঞতা সত্বেও আমরা তা করি  । ‘দ্য ব্রাদার্জ কারমাজভ শেষ হয়  যিশুর পুনরুত্থান সম্পর্কে তার সহপাঠীদের আশায় । খ্রিষ্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসের একটি উপযুক্ত পৃষ্ঠভূমি এখানে উপস্হাপন করেন দস্তয়ভস্কি।  অনেকসময়ে দেখা গেছে,  বিতর্কের যে উদ্ভাসগুলো দস্তয়েভস্কি আলোচনা করছেন, তিনি যেন নিজেই ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। দস্তয়ভস্কির পাঠক এবং তাঁর বিতর্কের সাক্ষী হিসাবে খ্রিস্টানরা ‘দি ইনকুইজিটরের’ মতো যুক্তি খাড়া করতে পারছেন, এবং যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসের কাছাকাছি হতে পারছেন । যাইহোক, দস্তোয়েভস্কির অভিপ্রায়কে বুঝে ওঠার জন্য, পাঠককে মনে রাখতে হবে তিনি যিশুর মহিমান্বয়ন করেছেন অবিরাম । 

Posted in Uncategorized | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

হাংরি আন্দোলন ( ১৯৬১ থেকে ১৯৮৭ )

হাংরি আন্দোলন : মলয় রায়চৌধুরী

১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে । হাংরি আন্দোলনের ‘হাংরি’ শব্দটি আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখন্ডে। ‘হাংরি’ মানে খাওয়া নয় ; সাওয়ার হাংরি টাইম মানে ‘পচনরত কালখণ্ড’।

উপরোক্ত রচনাদুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল ওসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। এখানে বলা ভালো যে আমি কলাকাতার আদি নিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে যেভাবে খোলসা হয় তা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

ওই চিন্তা ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই হাংরি নামে আমরা একটা আন্দোলন আরম্ভ করব। ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন। দাদার চাইবাসার বাড়ি, যা ছিল নিমডি নামে এক সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, সে-সময়ে হয়ে উঠেছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়, এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমরা এই চারজনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।

ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদের ওপর অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম-স্পেসিফিক বা সময় কেন্দ্রিক। কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্থানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে।

১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই জন্যেই, ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাস্বত্বাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক-ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চন্ডী বা শিব বা কালিকা বা শীতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখন্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতারা নন। তার কারণ সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।

ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্থানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড। একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে, সময়কে একটি মাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে। বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সেসময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোসটি উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালি সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবি লেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়রেখাটিতে। একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি, ‘কাউন্সিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর সচিব এ.বি.শাহ, ‘পি.ই.এন ইনডিয়ার অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকরের কাছ থেকে।

আমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল। ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্থানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচন্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি, রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে (হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিরী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে। একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময় কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিড়ে আলাদা হয়, উত্তর ঔপনিবেশিক আমলে আবার স্থানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দন কাঠামো থেকে নিস্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। তা নাহলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবি আঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন।

হাংরি আন্দোলনের সময়কাল বেশ দীর্ঘ। ১৯৬১ থেকে আটের দশকের মাঝামাঝি  পর্যন্ত। এই আন্দোলন একটিমাত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শহরের ঘটনা নয়, তাই চেষ্টা করব সমগ্র যুগকে একটি পরিসরে তুলে আনার। হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেক বই আছে, কিন্তু এর আগে সেই বিস্তৃত কালখণ্ডের যুবক-যুবতীদের কর্মকাণ্ডকে ‘হাংরি যুগ’ হিসাবে চিহ্ণিত করে কোনো বই লেখা হয়নি । যে বইগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ।  হাংরি আন্দোলন সক্রিয় ছিল বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর  পত্রিকার মাধ্যমে, যেমন প্রতিদ্বন্দী, চিহ্ণ, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, ফুঃ, ঋত্বিক, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র, ক্ষুধার্ত সময়, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবোট, কুরুক্ষেত্র, পাগলা ঘোড়া, দ্রোহ, বিকল্প, দন্দশূক, সময়সূত্র, যুদ্ধযাত্রা, মন্বন্তর, এখন এই রকম, অনার্য, পাখি সব করে রব ইত্যাদি,  এবং  আশির দশকের শেষ পর্যন্ত কলকাতাসহ উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার তরুণ কবি-লেখকরা সেই যুগকে করে তোলেন মহামিলন-ক্ষেত্র ।

সদস্যরা ছিলেন : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,  সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই,  করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অলোক গোস্বামী, মলয় মজুমদার, রাজা সরকার, কিশোর সাহা, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কুশল বাগচী, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিকাশ সরকার, নির্মল হালদার, সূর্য মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি রায়, অরুণেশ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ রাউত, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, সুনীতা ঘোষ,  রবীন দত্ত, সেলিম মুস্তফা, রবিউল, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সাত্বিক নন্দী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, স্বপন চক্রবর্তী, সুবীর মুখোপাধ্যায়, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, নির্মল হালদার, সৈকত রক্ষিত, রবীন্দ্র মল্লিক, বিজন রায়, স্বপন মুখোপাধ্যায়  প্রমুখ । .

এই  সময়ে শতাধিক ছাপান আর সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, অধিকাংশই হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, কয়েকটা দেয়াল-পোস্টারে, তিনটি একফর্মার মাপে, এবং একটি (যাতে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি ছিল) কুষ্ঠিঠিকুজির মতন দীর্ঘ কাগজে। এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ, এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের প্রকল্প। ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই, মাইকেল মধুসুদন দত্তর প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার। পরে, কবিতা পত্রিকা সমগ্র, কৃত্তিবাস পত্রিকা সমগ্র, শতভিষা পত্রিকা সমগ্র ইত্যাদি দুই শক্ত মলাটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের এই নন্দনতাত্ত্বিক হাহাকারটিকে। পক্ষান্তরে, ফালিকাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো দিলদরাজ বিলি করে দেয়া হতো, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাকঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতাবোধের গর্ব। সেই সব ফালিকাগজ, যারা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই সংরক্ষণ করার বোধ দ্বারা তাড়িত ছিলেন না, এবং কারোর কাছেই সবকটি পাওয়া যাবে না। ইউরোপীয় সাহিত্যে নশ্বরতাবোধের হাহাকারের কারণ হল ব্যক্তিমানুষের ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রদান। যে ট্র্যাজেডি-ভাবনা গ্রেকো-রোমান ব্যক্তি এককের পতনযন্ত্রণাকে মহৎ করে তুলেছিল পরবর্তীকালের ইউরোপে তা বাইবেলোক্ত প্রথম মানুষের ‘অরিজিনাল সিন’ তত্ত্বের আশ্রয়ে নশ্বরতাবোধ সম্পর্কিত হাহাকারকে এমন গুরুত্ব দিয়েছিল যে এলেজি এবং এপিটাফ লেখাটি সাহিত্যিক জীবনে যেন অত্যাবশক ছিল।

আমরা পরিকল্পনা করেছিলুম যে সম্পাদনা ও বিতরণের কাজ দেবী রায় করবেন, নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সংগঠিত করার দিকটা দেখবেন দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আর ছাপা এবং ছাপানোর খরচের ভার আমি নেব। প্রথমেই অসুবিধা দেখা দিল। পাটনায় বাংলা ছাপাবার প্রেস পাওয়া গেল না। ফলে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে যে বুলেটিন প্রকাশিত হল, তা ইংরেজিতে। এই কবিতার ইশতাহারে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি আরেকবার বেরোয়। ১৯৬২ সালের শেষাশেষি সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। দাদার বন্ধু উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন। আমার বন্ধু সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় যোগদেন। সুবিমল বসাকের বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পান্ডা, মনোহার দাশ যোগ দেন। তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখত। দেবী রায় লক্ষ্য করেন নি যে পুলিশের দুজন ইনফর্মার হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বই পত্র, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে।

এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রদিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধ:স্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।

ইতোপূর্বে ইযংবেঙ্গলের সাংস্কৃতিক উথাল-পাথাল ঘটে থাকলেও, বাংলা শিল্প সাহিত্যে আগাম ঘোষণা করে, ইশতাহার প্রকাশ করে, কোন আন্দোলন হয়নি। সাহিত্য এবং ছবি আঁকাকে একই ভাবনা-ফ্রেমে আনার প্রয়াস, পারিবারিক স্তরে হয়ে থাকলেও, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়নি। ফলত দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের সম্পর্কে বানানো খবর পরিবেশিত হওয়া আরম্ভ হল। হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বেরোল যুগান্তর দৈনিকে। আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হল দি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। হেডলাইন হল ব্রিৎস পত্রিকায়। সুবিমল বসারের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী আর নেপালি ভাষায় পারিজাত হাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন। আসামে ছড়িয়ে পড়ল পাঁক ঘেটে পাতালে পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে। ছড়িয়ে পড়ল বগুড়ার বিপ্রতীক এবং ঢাকার স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর পত্রিকাগুলোর সদস্যদের মাঝে, এবং মহারাষ্ট্রের অসো পত্রিকার সদস্যদের ভেতর। ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীরা (বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার প্রমুখ) জানতেন না যে আমি কেন প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলুম। ফলে তাঁরাও আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজিতে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে।

যার-যেমন-ইচ্ছে লেখালেখির স্বাধীনতার দরুন হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠবস্তুতে যে অবাধ ডিক্যাননাইজেশান, আঙ্গিকমুক্তি, যুক্তিভঙ্গ, ডিন্যারেটিভাইজেশান, অনির্ণেয়তা, মুক্ত সমাপ্তি ইত্যাদির সূত্রপাত ঘটে, সেগুলোর যথার্থ সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন তখনকার বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, যাঁরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তনতন্ত্রের বিরোধীতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ। তাঁদের ভাবনায় মতবিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন। মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যে কোন আদল ও আদরাকে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধীতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে বলে অনুমান করে নেয়া হয়, তা যদি সাহিত্যকৃতি হয় তাহলে সাহিত্যিক মননবিশ্বে, যদি রাজনৈতিক কর্মকান্ড হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবয়বে। এখানে বলা দরকার যে, পশ্চিমবাংলায় তখনও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেনি। তখনকার প্রতিবিম্বিত বিদ্যায়তনিক ভাবাদর্শে, অতএব, যারা মতবিরোধের দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছিল, অর্থাৎ হাংরি আন্দোলনকারীরা, তারা অন্যরকম, তারা অপর, তারা প্রান্তিক, তারা অনৈতিক, তারা অজ্ঞান, তারা সত্যের মালিকানার অযোগ্য। বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতা ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব। অজ্ঞানের চিন্তাভাবনাকে মেরামত করার দায়, ওই তর্কে, সুতরাং, সত্য মালিকের।

প্রাগুক্ত মেরামতির কাজে নেমে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি আন্দোলনের তুলনা করতে চাইছিলেন পাঁচের দশকে ঘটে যাওয়া দুটি পাশ্চাত্য আন্দোলনের সঙ্গে। ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে। তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে তাঁরা এমনভাবে উল্লেখ ও উপস্থাপন করতেন, যেন এই তিনটি একই প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন। আমার মনে হয় বিদ্যায়তনিক ভাবনার প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে সীমিত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতা, অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন। যার দরুণ সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে। যে-সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তি এককদের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের প্রয়াস তাঁরা করতেন না। প্রতিস্ব-বিশেষের পাঠবস্তু কেন অমন চেহারায় গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্ব-পীড়ন ঘটাচ্ছে তার পাপে পাঠবস্ত-গঠনে মনস্তাত্ত্বিক ও ভাষানকশা কীভাবে ও কেন পাল্টাচ্ছে, আর তাদের আখ্যান ঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বদলে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা (ফিল গুড) নামক সাবজেকটিভ খপ্পরে পড়ে পাঠক-সাধারণকে সেই ফাঁদে টানতে চাইতেন। যে কোনও পাঠবস্ত একটি স্থানিক কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল। কৌমনিরপেক্ষ পাঠবস্ত অসম্ভব।

কেবল উপরোক্ত দুটি পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ঘটনা নয়, ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য যে আন্দোলনগুলো ঘটেছিল, যেমন নিমসাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী এবং ধ্বংসকালীন, তাদের সঙ্গেও হাংরি আন্দোলনের জ্ঞান-পরিমন্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, চিন্তার-আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষণী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্থাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্নাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্ক বিন্যাসের অনুষঙ্গ, অভিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়ীতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্থানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্নায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্থনা, দেশজ অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টী পীড়াপুঞ্জ ইত্যাদি ব্যাপারে গভীর ও অসেতুসম্ভব পার্থক্য ছিল। ষাটের দশকের ওই চারটি আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি প্রতিসন্দর্ভের যে-মিল ছিল তা হল এই যে পাঁচটি আন্দোলনই লেখকপ্রতিম্ব থেকে রোশনাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাঠবস্তর ওপর। অর্থাৎ লেখকের কেরামতি বিচার্য নয়, যা বিচার্য তা হল পাঠবস্তুর খুঁটিনাটি। লেখকের বদলে পাঠবস্তু যে গুরুত্বপূর্ণ, এই সনাতন ভারতীয়তা, মহাভারত ও রামায়ণ পাঠবস্তু দুটির দ্বারা প্রমাণিত।

অনুশাসন মুক্তির ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল হাংরি আন্দোলন, যে, তারপর থেকে পত্রিকার নাম রাখার ঐতিহ্য একবারে বদলে গেল। কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দালনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, ফুঃ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি। অবশ্য সাহিত্য শিল্পকে উন্মার্গ আখ্যাটি জীবনানন্দ দাশ বহু পূর্বে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও হাংরি আন্দালনের সময় পর্যন্ত তিনি তেমন প্রতিষ্ঠা পান নি। জেব্রা নামকরণটি ছিল পাঠকের জন্যে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে হাংরি পাঠবস্তুর দিকে এগোবার ইশারা। হাংরি আন্দোলন সংঘটিত হবার আগে ওই পত্রিকাগুলোর নামকরণেই কেবল এলিটিজম ছিল তা নয়, সেসব পত্রিকাগুলোর একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। বুর্জোয়া মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা, যে কারণে নিম্নবর্ণের লেখকের পাঠবস্ত সেগুলোর পৃষ্ঠায় অনুপস্থিত, বিশেষ করে কবিতা। আসলে কোন-কোন রচনাকে ‘টাইমলেস’ বলা হবে সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে।

‘টাইমলেস’ কাজের উদ্বেগ থেকে পয়দা হয়েছিল ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ ভাবকল্পটি, যা উপনিবেশগুলোয় চারিয়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ। এই ভাবকল্পটির দ্বারা কালো, বাদামি, হলদে চামড়ার মানুষদের বহুকাল পর্যন্ত এমন সম্মোহিত করে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদী নন্দনভাবনা যাতে সাহিত্য-শিল্প হয়ে যায় উদ্দেশ্যহীন ও সমাজমুক্ত, যাতে পাঠবস্তু হয়ে যায় বার্তাবর্জিত, যাতে সন্দর্ভের শাসক-বিরোধী অন্তর্ঘাতী ক্ষমতা লুপ্ত হয়, এবং তা হয়ে যায় জনসংযোগহীন। হাংরি বুলেটিন যেহেতু প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, তা পরের দিনই সময় থেকে হারিয়ে যেত। নব্বইটির বেশি বুলেটিন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পক্ষেও ও বুলেটিনগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।

যে কোন আন্দোলনের জন্ম হয় কোন না কোন আধিপত্য প্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না। যে কোন কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে-কটির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কর্তৃক ১৯৬৩-র শেষ দিকে এবং ১৯৬৪-র প্রথমদিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসুও নিজের খরচে প্রকাশ করেছিলেন বুলেটিন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে থাকা সত্ত্বাধিকার বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক যা সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা এদেশে এনেছিল। ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পার্সোনাল পজেশান ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না।

হাংরি আন্দোলনের কোন হেড কোয়ার্টার, হাইকমান্ড, গভর্নিং কাউনসিল বা সম্পাদকের দপ্তর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পাদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকা দপ্তরটি নতুন বাড়িতে উঠে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপলি, অসমীয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল। এখনও মাঝে মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন, যখন কিনা আন্দোলনটি চল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে গিয়েছে।

বিয়াল্লিশ বছর আগে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল করা ত্রিভাষিক (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি) হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দর্ভের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্থাপন করতে চাইছে তা স্পষ্ট করার জন্যে। তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে:

১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সুবিমল বসাকের আঁকা বেশ কিছু লাইন ড্রইং, যেগুলো ঘন-ঘন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার দরুণ তাঁকে পরপর দুবার কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরলেন অগ্রজ বিদ্বজ্জন এবং প্রহারে উদ্যত হলেন, এই অজুহাতে যে সেগুলো অশ্লীল। একই অজুহাতে কফিহাউসের দেয়ালে সাঁটা অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার আমরা যতবার লাগালুম ততবার ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হল। বোঝা যাচ্ছিল যে, কলোনিয়াল ইসথেটিক রেজিমের চাপ তখনও অপ্রতিরোধ্য। হাংরি আন্দোলনের ১৫ নম্বর বুলেটিন এবং ৬৫ নং বুলেটিন, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারের, যাকে বলে স্লো বলিং এফেক্ট, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমাদের অজ্ঞাতসারে ক্রুদ্ধ করে তুলছিল মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের এসট্যাবলিশমেন্টকে। আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে ইশতাহার দুটিকে অলমোস্ট প্রফেটিক বলা যায়। এরপর, যখন রাক্ষস জোকার মিকিমাউস জন্তজানোয়ার ইত্যাদির কাগুজে মুখোশে ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ বার্তাটি ছাপিয়ে হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের, বাণিজ্যিক লেখকদের পাঠান হল, তখন সমাজের এলিট অধিপতিরা আসরে নামলেন। এ ব্যাপারে কলকাঠি নাড়লেন একটি পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিক, তাঁর বাংলা দৈনিকের বার্তা সম্পাদক এবং মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের খোরপোষে প্রতিপালিত একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিকের কর্তাব্যক্তিরা।

১৯৬৪ এর সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী। এই অভিযোগে উৎপল কুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইসু হয়ে থাকলেও, তাঁদের প্রেপ্তার করা হয়নি। এরকম একটি অভিযোগ এই জন্যে চাপান হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্নিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালেখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দফতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল।

অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিস্কপ্রসূত ছিল জানি না। তবে অ্যাডভোকেট জেনারেল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর তৈরি এমন সিরিয়াস অভিযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে। তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। আমার বিরুদ্ধে মামলাটা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে। অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিয়েছিল ।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে তেমন নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই আমার বিরুদ্ধে সমীর বসু আর পবিত্র বল্লভ নামে দুজন ভুয়ো সাক্ষীকে উইটনেস বক্সে তোলা হয়, যাদের আমি কোন জন্মে দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে কতই না আলাপ-পরিচয়। এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা। আমার কৌশুলিদের জেরায় এরা দুজন ভুয়ো প্রমাণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে, বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাই জ্যোতির্ময় দত্ত, তরুণ সান্যাল আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। বহু সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম, কিন্তু এনারা ছাড়া আর কেউ রাজি হননি। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে, চল্লিশ বছর পর ব্যাপারটা অবিশ্বস্য মনে হয়। সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম-ড্রামা।

তেরটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে। বিচারকের মাথার ওপর হলদে টুনি বালবটা ছাড়া আলোর বালাই ছিল না জানালাহীন ঘরটায়। অবিরাম ক্যাচোর-ক্যাচোর শব্দে অবসর নেবার অনুরোধ জানাত দুই ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা। পেশকার গাংগুলি বাবুর অ্যান্টিক টেবিলের লাগোয়া বিচারকের টানা টেবিল, বেশ উঁচু, ঘরের এক থেকে আরেক প্রান্ত, বিচারকের পেছনে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর ফোকলা-হাসি রঙিন ছবি। ইংরেজরা যাবার পর চুনকাম হয়নি ঘরটা। হয়ত ঘরের ঝুলগুলোও তখনকার। বিচারকের টেবিলের বাইরে, ওনার ডান দিকে, দেয়াল ঘেঁষে, জাল-ঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বিচারাধীনদের জন্যে, যারা ওই খাঁচার পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকত। খাঁচাটা অত্যন্ত নোংরা। আমি যেহেতু ছিলুম জামিনপ্রাপ্ত, দাঁড়াতুম খাঁচার বাইরে। ঠ্যাঙ ব্যথা করলে, খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে।

পেশকার মশায়ের টেবিলের কাছাকাছি থাকত গোটাকতক আস্ত-হাতল আর ভাঙা-হাতল চেয়ার, কৌঁসুলিদের জন্যে। ঘরের বাকিটুকুতে ছিল নানা মাপের, আকারের, রঙের নড়বড়ে বেঞ্চ আর চেয়ার, পাবলিকের জন্যে, ছারপোকা আর খুদে আরশোলায় গিজগিজে। টিপেমারা ছারপোকার রক্তে, পানের পিকে, ঘরের দেয়ালময় ক্যালিগ্রাফি। বসার জায়গা ফাঁকা থাকত না। কার মামলা কখন উঠবে ঠিক নেই। ওই সর্বভারতীয় ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে, ছারপোকার দৌরাত্মে, বসে থাকতে পারতুম না বলে সারা বাড়ি এদিক-ওদিক ফ্যা-ফ্যা করতুম, এ-এজলাস সে-এজলাস চক্কর মারতুম, কৌতুহলোদ্দীপক সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে পড়তুম। আমার কেস ওঠার আগে সিনিয়ার উকিলের মুহুরিবাবু আমায় খুঁজে পেতে ডেকে নিয়ে যেতেন। মুহুরিবাবু মেদিনীপুরের লোক, পরতেন হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ক্যাম্বিশের জুতো, ছাইরঙা শার্ট। সে শার্টের ঝুল পেছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর সামনে দিকে কুঁচকি পর্যন্ত। হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ করা ফিকে সবুজ রঙ্গের দশ-বারটা ব্রিফ, যেগুলো নিয়ে একতলা থেকে তিনতলার ঘরে-ঘরে লাগাতার চরকি নাচন দিতেন।

আমার সিনিয়র উকিল ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার চন্ডীচরণ মৈত্র। সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোন রকম ধারণা ছিল না বলে লেবার কোর্টের উকিল সতেন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখতে হয়েছিল। চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড ছিলুম কেস চলার সময়ে, তার ওপর কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাই ছিল না। খরচ সামলানো অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল।

আদালত চত্বরটা সবসময় ভিড়ে গিজগিজ করত। ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে “সাক্ষী চাই? সাক্ষী চাই? এফিডেফিট হবে।” বলে-বলে চেচাত মক্কেল যোগাড়ের ধান্দায়। সারা বাড়ি জুড়ে যেখানে টুলপেতে টাইপরাইটারে ফটর ফটর ট্যারাবেকা টাইপ করায় সদাব্যস্ত টাইপিস্ট, পাশে চোপসানো মুখ লিটিগ্যান্ট। একতলায় সর্বত্র কাগজ, তেলেভাজা, অমলেট, চা-জলখাবার, ভাতরুটির ঠেক। কোর্ট পেপার কেনার দীর্ঘ কিউ। চাপরাসি- আরদালির কাজে যে সব বিহারিদের আদালতে চাকরি দিয়েছিল ইংরেজরা, তারা চত্বরের খোঁদলগুলো জবরদখল করে সংসার পেতে ফেলেচে। জেল থেকে খতরনাক আসামিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন একটু সময়ের জন্যে সরে যেত ভিড়টা। তারপর যে কে সেই। সন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের সামাজিক সংঘাতক্ষেত্র হিসেবে আদালতের মতন সংস্থা সম্ভবত আর নেই। 

সাক্ষ্যাদি শেষ হবার পর দুপক্ষের দীর্ঘ বহস হল একদিন, প্রচুর তর্কাতর্কি হল। আমি খাঁচার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে। রায় দেবার দিন পড়ল ১৯৬৫ সালের আঠাশে ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে গেছি। যুগান্তর দৈনিকে ‘আর মিছিলের শহর নয়’ এবং ‘যে ক্ষুধা জঠরের নয়’ শিরোনামে প্রধান সম্পাদকীয় লিখলেন কৃষ্ণ ধর। যুগান্তর দৈনিকে সুফী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় চন্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকলেন আমায় নিয়ে। সমর সেন সম্পাদিত ‘নাউ’ পত্রিকায় পরপর দুবার লেখা হল আমার সমর্থনে। দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে সমাজ-বিশ্লেষণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। ধর্মযুগ, দিনমান, সম্মার্গ, সাপ্তাহিক হিন্দুস্থান, জনসত্তা পত্রিকায় উপর্যুপরি ফোটো ইত্যাদিসহ লিখলেন ধর্মবীর ভারতী, এস. এইচ. বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, ফনীশ্বর নাথ রেণু, কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, রমেশ বকশি প্রমুখ। কালিকটের মালায়ালি পত্রিকা যুগপ্রভাত হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করল। বুয়েনস আয়ার্স-এর প্যানারোমা পত্রিকার সাংবাদিক আমার মকদ্দমা কভার করল। পাটনার দৈনিক দি সার্চলাইট প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র। বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করল জার্মানির ক্ল্যাকটোভিডসেডস্টিন পত্রিকা, এবং কুলচুর পত্রিকা ছাপলো সবকটি ইংরেজি ম্যানিফেস্টো। আমেরিকায় হাংরি আন্দোলনকারীদের ফোটো, ছবি-আঁকা, রচনার অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল সল্টেড ফেদার্স, ট্রেস, ইনট্রেপিড, সিটি লাইটস জার্নাল, সান ফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক, র্যামপার্টস, ইমেজো হোয়্যার ইত্যাদি লিটল ম্যাগজিন। সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্কের এভারগ্রিন রিভিউ, আর্জেনটিনার এল কর্নো এমপ্লমাদো এবং মেকসিকোর এল রেহিলেতে পত্রিকায়। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় টিটকিরি মারা ছাড়া আর কিছু করেন নি বাঙ্গালি সাহিত্যিকরা।

ভুয়ো সাক্ষী, রাজ সাক্ষী আর সরকারি সাক্ষীদের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করে আমার পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য নাকচ করে দিলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক। দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদান্ড ধার্য করলে তিনি। আমি হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করার জন্যে আইনজীবির খোঁজে বেরিয়ে দেখলুম যে খ্যাতিমান কৌঁসুলিদের এক দিনের বহসের ফি প্রায় লক্ষ টাকা, অনেকে প্রতি ঘন্টা হিসেবে চার্জ করেন, তাঁরা ডজনখানেক সহায়ক উকিল দুপাশে দাঁড় করিয়ে বহস করেন। জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন সদ্য লন্ডন-ফেরত ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। তাঁর সৌজন্যে আমি তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মৃগেন সেনকে পেলুম। নিজের সহায়কদের নিয়ে তিনি কয়েক দিন বসে তর্কের স্ট্রাটেজি কষলেন। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই আমার রিভিশন পিটিশানের শুনানি হল। নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিলেন বিচারক টি. পি. মুখার্জি। ফিস ইন্সটলমেন্টে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন করুণাশঙ্কর রায়।

হাংরি আন্দোলন চল্লিশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা। সমীর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি (আমার দাদার নামের মিলটা কাজে লাগান হয়েছে) ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’ নামে একটা বই বের করেছেন। তাতে অন্তর্ভূক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না। শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, বিনয়, সমীর, দেবী, সুবিমল, এবং আমার রচনা তাতে নেই। অনিল, করুণা, সুবিমলের আঁকা ছবি নেই। একটিও ম্যানিফেস্টো নেই। বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ংকর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ।

তিন

বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অভিজিৎ পাল একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, এবাদুল হক সম্পাদিত ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকায়, তা থেকে উল্লেখ্য অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে :

বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । 

১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট ।

৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট ।

৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে ।

৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। 

৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । 

৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্হীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্হীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর ।

৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে ।

৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন ।

১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।

১১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে । তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি । এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্হের কাহিনির অনুকরণে ; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে । আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের । সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল । বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’ । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন । যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হ ‘আমার চাবি, ইত্যাদি । তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন ।

১২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ । হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য । পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন ।

১৩ ) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন । ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি  আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল । হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে । তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে । সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে । তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন ।

১৪ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল । রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই । নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি । রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে । হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা । এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

১৫ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা ; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন । হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন । যোগসূত্র খোঁজাল কথা বললেন । শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন । এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন । তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট । যেমন অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল ।

১৬ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো । কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা । হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা । ভঙ্গুরতার কথা । তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা । হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব ।

১৭ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা । তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা । গুরুগম্ভীর কবিতার কথা । নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা । যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা । তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল । এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না । উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা ।

১৮ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্হিতাবস্হার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন । পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে ; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন ।

১৯ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন । বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের । অভেদের সন্ধান করলেন । একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন । বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন । উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি ।

২০ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা হা্রণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে । ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না ; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না ; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন । তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হগুলি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, পদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা । যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস । যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন । হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে  তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে ।

২১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম । উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে । বামপন্হী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে । যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে । পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

২২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি । পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে ।

২৩ ) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্হিতি পরিলক্ষিত হয় । পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে । যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন,  প্রমুখ ।

২৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল ; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল । সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন । শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো । ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন ।হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন । শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না । শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’ । তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন । পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন ; সম্পূর্ণ কাব্যগণ্হ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই ।

চার

দেবেশ রায় প্রথম বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলন থেকে নকশাল আন্দোলনের দিকে সময় একটা বীক্ষার মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছিল, কিংবা এই ধরণের কোনো কথা, তারপর অনেকেই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ভাবনার একটা যোগসূত্র খুঁজতে চেয়েছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রফিক উল ইসলাম জিগ্যেস করেছিলেন যে দুটো আন্দোলনের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা । সুনীল বলেছিলেন যে নকশাল আন্দোলনে অনেক মহৎ আত্মত্যাগ হয়েছিল, অনেক তরুণ মারা গিয়েছিল । 

আমার মতে দুটোর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা সময়-পরিসরের রেশের । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আর পুলিশ ওনাদের রাতের মিটিঙের কথা জানতে পেরে স্টুডিও ভাঙচুর করে যাবতীয় পেইনটিঙ নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল, করুণা আর ওদের ছবি আঁকার দলের যুবকরা আগেই খবর পেয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, অনিল দিল্লিতে আর তারপর এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে আমেরিকায় ; করুণা চুলদাড়ি কামিয়ে, চেহারা পালটিয়ে সপরিবারে পাটনায়, সেখানে দাদা করুণাকে একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিয়েছিলেন । আমার কাকার মেয়ে পুটি উত্তরপাড়ার বাড়ির বড়োঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, তার কারণ যে নকশাল যুবকটিকে পুটি ভালোবাসতো তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল । 

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আমার এক মাসের সাজা হয়ে গিয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৫ আর কলকাতা হাইকোর্টে উকিলের খোঁজে আমি নানা লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছিলুম । জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন ফেরা ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে কপি নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে আসতে হচ্ছিল, তাঁর বাড়িতে,  লোহাপট্টিতে, যাতে কলকাতা হাইকোর্টে রেজিস্ট্রারের দপতরে জমা দেয়া যায় । এদিকে কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নানা জায়গায় রাত কাটাই, পকেট ফাঁকা হয়ে যায় আদালতের কাজে আর দুবেলা খেতে । অনেককাল স্নান না করলে যে নিজের গা থেকে নিজেরই মাংসের গন্ধ বেরোয় তা তখন জেনেছিলুম । বন্ধুবান্ধবরা, সুবিমল বসাক ছাড়া, সবাই হাওয়া ।

তার মাঝেই ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ খাদ্য আন্দোলনে সারা বাংলা বন্ধ ডাকা হয়েছিল, মনে আছে । তখনকার কলেজ স্ট্রিট এখনকার মতন ছিল না, একেবারে ফাঁকা থাকতো, দিনের বেলাকার মিছিল সত্বেও, সন্ধ্যে হলেই অন্ধকার । বস্তুত, পুরো কলকাতাই একেবারে আলাদা ছিল । রণবীর সমাদ্দারের একটা লেখায় পড়েছিলুম যে নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত সময়টা হলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ ; আর কোলকাতা হাইকোর্ট আমার মামলা এক দিনেই সেরে ফেলেছিল, ২৬ জুলাই ১৯৬৭ তারিখে, আমার দণ্ডাদেশ নাকচ করে । তাই হয়তো কেউ-কেউ মনে করেন যে হাংরিরা ১৯৬৭-পরবর্তী কালখণ্ডকে নকশালদের হ্যাণ্ডওভার করে দিয়েছিল । সময়-পরিসরকে হ্যাণ্ডওভার করার প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই ব্রিটিশ-বিরোধিতার সময় থেকে। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ওনার ‘মার্জিনাল মেন’ বইতে লিখেছিলেন যে দেশভাগের পর বহু তরুণ লুম্পেন প্রলেতারিয়েত হয়ে ওঠে এবং তাদের থেকেই পশ্চিমবঙ্গে মাস্তানদের জন্ম । বস্তুত মাস্তানরও সময়-পরিসরকে ক্রমশ হ্যাণ্ডওভার করে চলেছে এখনকার জিঙ্গোবাদী রাজনীতিকদের করকমলে ।

ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে স্বদেশি আন্দোলনের যে রেশ আরম্ভ হয়েছিল, সেই রেশ নানা বাঁক নিয়ে যখন দেশভাগের ঘুর্ণিতে পড়ল তখন তার চরিত্র পালটে গেল, তার আগে সেই রেশে তেমন অ্যাড্রেনালিন ছিল না বলা চলে । এই রেশটাই হাংরি আন্দোলনের উৎসভূমি । এই রেশকে প্রথমে কৃষক নেতারা এবং পরে তরুণ সমাজ নিয়ে যান নকশাল আন্দোলনে এবং এই রেশকেই কেন্দ্র করে বামপন্হীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন। এই রেশই নন্দীগ্রামে পৌঁছোবার পর বামপন্হীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন আর তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে । রেশটা থাকে জনগণের মাঝে । আমার মনে হয়, সব সময়েই থাকে,চিরকাল থাকে । 

হাংরি আন্দোলনের পরে-পরেই নকশাল আন্দোলন ঘটেছিল অথচ যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশের কাছে নালিশ করেছিলেন তাঁরা কেন আসন্ন উথালপাথাল টের পাননি ? হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যজগতের মূল্যবোধ-মালিক ও প্রকাশক-বাজারের জোতদারদের উৎখাত করতে চেয়েছিল, জন্তুজানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে বিদ্যায়তনিক জোতদারদের টপলেস অর্থাৎ গলা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, সাহিত্যিক ক্ষমতাকে দখল করে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাঝে, জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়ে এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজকে ছোটোগল্প নামে বাজারি কাগজে জমা দিয়ে সাহিত্যিক জোতদারদের দলিদস্তাবেজ বেদখল করতে চেয়েছিল । এগুলো কোনোরকমের ইয়ার্কি বা প্র্যাঙ্ক ছিল না।

যাঁরা নালিশ ঠুকেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরাও ছিলেন যাঁদের হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠানো কার্ডে FUCK THE BASTARDS OF GANGSHALIK SCHOOL OF POETRY ঘোষণা পড়ে অপমানবোধ হয়েছিল, জানোয়ার ও দানবের মুখোশ পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । অথচ তার কয়েক বছর পরেই নকশাল তরুণরা শিক্ষকদের গলা কাটা আরম্ভ করলেন, জোতদারদের বাড়ি লুঠ করে দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেন, জমি দখল করে বিলিয়ে দিলেন ভাগচাষিদের । নকশাল আন্দোলনকারীরা জোতদারদের বেদখল করার সময়ে, বাড়িতে-খামারে আগুন ধরিয়ে দেবার সময়ে FUCK THE BASTARDS -এর পরিবর্তে বাংলা ও চোস্ত হিন্দি গালাগাল দিয়েছিল, জোতদার আর ভূস্বামীদের মুখোশ চামড়াসুদ্দু ছিঁড়ে উপড়ে নিয়েছিল । 

নকশাল তরুণরা এসে দেখিয়ে দিল যে হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কাজগুলো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রক্রিয়া । জোতদারদের বিরুদ্ধে যে ইতর বুলি কথাবার্তায় প্রয়োগ করে ক্ষান্ত থেকেছিলেন নকশালরা, তা নিজেদের লেখায় নিয়ে এসেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা যাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিদ্যায়তনিক ও গ্লসি পত্রিকার চাকুরে আলোচনাকারীরা বলে এসেছেন অশ্লীল ও অশোভন । আলোচকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে ছোটোলোকদের ভাষা অমনই হয়। নকশাল আন্দোলনের কবিতা  কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষার আওতার বাইরে বেরোতে পারেনি বলেই মনে হয় । 

যেমন কৃষ্ণ ধর-এর ‘একদিন সত্তর দশকে’ কবিতাটি :-

শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে

অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি

শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা

সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল

যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে

তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে

বধ্যভূমিতে গিয়েছিল

একদিন সত্তর দশকে।”

স্বপন চক্রবর্তী লিখেছিলেন :-

‘আমরা সাহায্য চাইনি’

আমরা সাহায্য চাইনি

কারণ আমরা বদল চেয়েছি।

চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।

.কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।

এখন সময়

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।

আমরা বদল চেয়েছি

চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।”

নির্মল ঘোষ তার ‘নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অনস্বীকার্য, নকশালপন্থী কাব্যচর্চায় আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর এর ফলে বক্তব্যে বহুক্ষেত্রেই আবেগের প্রাধান্য দেখা গেল, যা শেষপর্যন্ত পাঠক মানসকে প্রায়শ প্রভাবিত বা প্রাণিত করতে সমর্থ হয়নি।’ পক্ষান্তরে, কবিতার শৈল্পিক মানের এ বিতর্কে অর্জুন গোস্বামী নকশালবাদী কবিতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন, ‘এটা সত্তরের দশক। এই দশক প্রত্যক্ষ করেছে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতশ্রেণীর লড়াই। এই দশকেই প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে উপরে উপরে যতই শক্তিশালী বলে মনে হোক না কেন আসলে তারা হলো কাগুজে বাঘ। স্বভাবতই এই দশকের মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি। আমরা এমন কোন কবিতা পড়তে চাই না যাতে আছে হতাশা, আছে যন্ত্রণার গোঙানি। আমরা এমন কবিতা পড়তে চাই যাতে ধরা পড়বে শোষণের আসল স্বরূপ, যে কবিতা পড়ে অনুপ্রেরণা পাবেন লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ এবং যে কবিতা প্রকৃতই হবে শোষিতশ্রেণীর সংগ্রামী হাতিয়ার। আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা ঠিক স্লোগান নয়। আমাদের বক্তব্য হলো কবিতার বিষয় ও কবিতার আঙ্গিক এই দুটোর মধ্যে আগে বিষয়, পরে আঙ্গিক। বক্তব্যকে সাধারণের উপযোগী করে বলার জন্য কবিতা যদি কারুর কাছে স্লোগান বলে মনে হয় তবে সেই স্লোগানই হলো সত্তরের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’

হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমিও বলেছিলুম,  “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়-বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয় ; উন্মাদের মতন চিৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্ট-যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না ।” বাসব রায়কে দেয়া ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে মলয়ের কবিতায় অত্যধিক অব্যয় থাকে, চিৎকার থাকে । এই প্রেক্ষিতে নকশালদের সঙ্গে হাংরিদের তুলনা করা চলে, যেমন ত্রিদিব মিত্রের বিখ্যাত কবিতা ‘হত্যাকাণ্ড’ । হাওড়া স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ‘হত্যাকাণ্ড’ কবিতাটা পড়ে ভিড় জমিয়ে ফেলেছিল ত্রিদিব মিত্র ।

হাংরি আন্দোলনের গ্রন্হ রিভিউ করতে গিয়ে শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।” শৈলেন সরকার যে বইটি আলোচনা করেছেন তাতে কোনো কারণে সম্পাদকমশায় হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো অন্তর্ভুক্ত করেননি । করলে স্পষ্ট হতো যে হাংরি আন্দোলন অরাজনৈতিক ছিল না ।

প্রবুদ্ধ ঘোষ হাংরি আন্দোলন ও নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে বলেছেন, “বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁদের কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য!” একটু আগে আমি যেকথা বলেছি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান-সাহিত্যের জোতদারদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছিল হাংরি আন্দোলনকারীরা, তাদের কাজের দ্বারা, লেখার দ্বারা, ড্রইং দ্বারা, সেকথাই বলেছেন প্রবুদ্ধবাবু । তবে প্রবুদ্ধবাবু একটা কথা ভুল বলেছেন, যে হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল আত্মবীক্ষণ ও আত্মআবিষ্কারে আলো ফেলতে চেয়েছেন। হাংরি আন্দোলনকরীরা যদি তাই করতেন তাহলে যে কাজগুলোকে মধ্যবিত্ত আলোচকরা ‘অসাহিত্যিক’ ব্যাপার বলে তকমা দেগে দেন তা তাঁরা করতেন না, বিভিন্ন বিষয়ে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতেন না । নকশালরা যে মূর্তির গলা কেটে প্রতীকিস্তরে বিশেষ মূল্যবোধকে আক্রমণ করেছিল, শিক্ষকদের খুন করেছিল, তার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ-খুনের আক্রমণাত্মক কাজগুলো তুলনীয় ।

সুবিমল বসাকের একটা কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি, যা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল :-

‘হাবিজাবি’

আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে

চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে

ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা

অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়

আমি নিজের ডাকাইতে্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি

কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না

আমি সুপসাপ থাকি

ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না

২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে

১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়

ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন

আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না

বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।

(হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন “হাংরিদের ‘ক্ষুধা’ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত ছিল ; এই ক্ষুধা আসলে নিজেকে দগ্ধ করে সত্য আবিষ্কারের ক্ষুধা। সত্য, যা ক্রমাগতঃ এমনকি নিজেকেও ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মোচিত করে চলে। তাকাই ফাল্গুনী রায়ের কবিতায়, “আমার বুকের ভিতর লোভ অথচ হৃদয় খুঁজতে গিয়ে বুকের ভিতরে/ রক্তমাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেবল”। আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তাহলে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবে না বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে।” 

প্রবুদ্ধবাবু আরও বলেছেন, “পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে, কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে, হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৯০ র দশকের পরে যে বীভৎস হাঁ-তে ঢুকে যেতে থাকবে ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রাম-মফস্বল।”

১৯৬৮ সালে বিনয় ঘোষ ‘কলকাতার তরুণের মন’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন- “গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের মতো তাঁদের হাত-পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানাশ্রেণীর ব্যুরোক্র্যাট টেকনোক্র্যাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস-প্রমোটার বা ‘অ্যাড-মেন’- যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শতকৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগস্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।”। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য বলে,  ‘আপনার গোলাম, আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির… একটি সিগারেট। …একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] 

বোর্দ্রিয়ারের মতে, উত্তর-আধুনিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ আর শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকছে না, বরং তা এখন নির্ভর করছে ভোগের ওপর। কে কোন পণ্য ভোগ করছে, তার ‘ব্র্যাণ্ড’ এবং দামের ওপর নির্ভর করছে তার শ্রেণিঅবস্থান। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, পণ্যকৌশলে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া দেশকাল-ইতিহাস আর, এমনকি প্রকৃত যৌনতা, সামাজিকতা, সবকিছুরই মৃত্যু ঘটছে- তখনই অধিবাস্তব টেনে নিয়ে চলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে, এই সত্য তো হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে! বস্তুতঃ, তাঁদের লেখায় তাঁরা এটাকেই আক্রমণ শানাতে চেয়েছেন। আজকের মানুষের পরিসর-মাফিক রূপবদলের কথা আমি লিখেছি আমার ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ নামের অধিবাস্তব গল্পে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ফাঁসিয়েছি ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ নামের অধিবাস্তব কাহিনিতে — যা কিনা সময়-পরিসরের সঙ্গে অ্যাড্রেনালিনের রেশ এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ।

হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা করে তাদের বিক্ষিপ্ত করে দেবার পর, প্রতিষ্ঠানের লেখকরা লেখালিখি করে দেখাতে চাইলেন, নকশাল আন্দোলন মধ্যবিত্ত রোম্যাণ্টিকতা ও কাঁচা প্রেমের মতো, বামপন্থা মানেই তা ভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় এবং আসলে নিরাজনীতিই মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে! হাংরিদের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধতাকারী পঞ্চাশের ও পরবর্তী সাহিত্যিকরা এহেন ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠানের  মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন । প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন “আশির দশকের বাংলা সাহিত্য থেকেই আর, ’৯০ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক ও ‘এলিট’ পত্রিকার সাহিত্যগুলি কিছু অবয়ববাদী বা স্ট্রাক্‌চারালিস্ট ধাঁচা (স্টিরিওটাইপ) এনে ফেলল। যেমন, নকশাল ছেলেটি লেখাপড়ায় মারাত্মক ব্রিলিয়াণ্ট ছিল, ‘ভুল’ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে গ্রামে গেল রাজনীতি শিখতে ও ডি-ক্লাস্‌ড হতে, তার প্রেমিকা উচ্চবিত্ত ঘরের এবং যৌনসম্পর্কের বিশদ অনর্থক বর্ণনা, পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে পঙ্গু হল, আদতে লড়াইটা এবং মতাদর্শটা ব্যর্থ হল এবং অ্যাপলিটিক্সের ওপরে সমাজসেবার ওপরে ভরসা রাখল ব্যর্থ নায়ক! এই অবয়ববাদী ধাঁচায় ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলি বিক্রি বাড়াতে লাগল তাদের সাহিত্যের। আর, তার সাথেই ক্রমে ‘সক্রিয় রাজনীতি’ ও বামপন্থা থেকে বিমুখ করে দিতে লাগল বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্মকে। 

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। 

আসলে মুক্তসূচনা এবং মুক্তসমাপ্তির জনক হলেন জীবনানন্দ দাশ । ‘মাল্যবান’ যেভাবে শেষ না হয়েও শেষ হয়েছে, তা থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় । এই শৈলী প্রয়োগে পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় কবির বা লেখকের নয়। প্রবুদ্ধবাবুকে অবশ্য একথা বলার যে, নকশাল আন্দোলন বা ফিদেল কাস্ত্রোর আন্দোলনও ছিল মুক্তসমাপ্তির, আন্দোলনের পরে কি ঘটবে তা আগাম পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল না । নকশাল আন্দোলনকারীরা জানতেন নিশ্চয়ই যে পশ্চিমবঙ্গ বলতে ভারতবর্ষ বোঝায় না । চারু মজুমদার কি জানতেন না যে চীন আদপে তিব্বত দখল করার পর মাও-এর সাম্রাজ্যবদী দিকটাকে ফাঁস করে দিয়েছে ? এখন চীন যা করছে তার ভিত তো মাও-এর গড়ে দেয়া। 

প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “নবারুণ কবিতার সংজ্ঞাও একপ্রকার নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে হাংরি-রা তাদের কবিতার ধারণা স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন । নবারুণের কবিতা চিরাচরিত চাঁদ-ফুল-তারার রোম্যাণ্টিকতা অস্বীকার করে। কবিতা যে ‘লেখার’ নয়, বরং কবিতা ‘হয়ে ওঠার’ বিষয়, তা স্পষ্টতর হয় অস্থির সময়ে- “কবিতা এখনই লেখার সময়/ ইস্তাহারে দেওয়ালে স্টেনসিলে/ নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে/ এখনই কবিতা লেখা যায়…”। কবিতার আসন্ন সম্ভাবনাও লিখে রাখেন শেষ পংক্তিগুলিতে। “কবিতার জ্বলন্ত মশাল/ কবিতার মলোটভ ককটেল/ কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা/ এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক”। হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম বলেছিল যে কবিতা চাঁদ-ফুল-তারা ইত্যাদির ব্যাপার নয় । আমি আমার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে এ-কথা ষাটের দশকেই বলেছিলুম ।

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “এখানেই কবিতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়ার ভাবনার সাথে মিল পাওয়া যায় হাংরি-দের। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। আর, এখানেই মনে পড়ে মারাঠি কবি নামদেও ধাসালের লেখা। দলিত জীবনের আখ্যান এবং প্রতিটি পংক্তিতে উল্লেখযোগ্য ঘৃণা; এই ঘৃণাই আসলে জীবন, এখান থেকে ভালবাসার জন্ম।” 

এখানে উল্লেখ্য যে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের, কলকাতার সংস্কৃতি জগতের মানুষ । অপরপক্ষে হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় এসেছিলেন চাষি পরিবার থেকে; এমনকি কলকাতার সাহিত্যিকদের টিটকিরি প্রতিহত করার জন্য তিনি পতৃদত্ত নাম হারাধন ধাড়া বর্জন করতে বাধ্য হন।  সুবিমল বসাক এসেছিলেন তাঁতি পরিবার থেকে যাঁর বাবা স্যাকরার কাজ করতে বাধ্য হন এবং মোরারজি দেশাইয়ের গোল্ড কনট্রোলের দরুন দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন । অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, বাড়ি ফিরে কলকাতার রাস্তায় হকারি করতেন, ঠেলায় করে কয়লা বেচতেন, ফুটপাতে ছিট কাপড় বেচতেন । এই ধরণের জীবনে জড়িয়ে হাংরি-দের লেখায় পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে আত্ম-কে আবিষ্কার জরুরি হয়ে ওঠে , জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে, নাটককে,  ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর উপলব্ধিকে ঔপনিষদীয় বলা ভুল হবে না ।

রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ অর্থাৎ’অপর’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা রাজনিতিতে , তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো ও রাজনীতিগুলো । হাংরি আন্দোলনকারীদের যেভাবে জেলে পোরার চক্রান্ত হয়েছিল, একইভাবে প্রতিষ্ঠানের আরও বৃহত্তর চক্রান্তে একের পর এক হত্যা করে নিশ্চিহ্ণ করা হয়েছিল নকশালদের, সমাজকে ‘শুদ্ধ’ করে তোলার জন্য। 

অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ‘অপর : তত্ব ও তথ্য’ বইতে সমীর রায়চৌধুরী লিখেছেন, “নিজেদের রয়ালিস্ট, প্রকৃত খ্রিস্টিয়, প্রগতিবাদী ইত্যাদি নির্দিষ্টাত্মক বিশেষণের খপ্পরের ছাঁচে ফেলে দেওয়ার তোড়জোড়ে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্ববোধসম্পন্ন লেখকরা, ফলে তাঁদের টেক্সটে আশ্রিত হয়েছে চরম অপরত্ব-বোধ । দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক জে. এম. কোয়েতসে তাঁর ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস’ গ্রন্হে দেখিয়েছেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অপরায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরী করে । এই প্রক্রিয়া তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, এগিয়ে থাকা, সভ্যতাকে শ্রেয় এবং অপরের অসত্বিত্বকে হেয় করতে সাহয্য করে । কেবল টেক্সটে নয়, জীবনের সব এলাকাতে এভাবে স্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে ওঠে ।” বলা বাহুল্য যে হাংরি আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ‘অপর’ তকমা দিয়ে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, যেমন আফ্রিকার আদিনিবাসদের মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইউরোপের শাসক-সমাজ ।

নারায়ণ সান্যালের বিবরণীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার এক অজানা কথা উঠে আসে। “কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর-মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয় তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিএম (এম. এল) দলের এক নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়েছিল! ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচকপ্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙ্গেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেন্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।”

অধিকাংশ আলোচক বলেন হাংরি আন্দোলন এবং নকশাল আন্দোলন দুটিই ব্যর্থ্য এবং তাদের ব্যর্থতার কারণও এক : প্রথমত, প্রশাসনিক আক্রমণ ; দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ; তৃতীয়ত, আন্দোনের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন ; চতুর্থত, তাঁদের কার্যকলাপ । আমি শুধু বলতে চাই যে দুটি আন্দোলনই বাংলার বৌদ্ধিক সমাজে ছাপ ফেলেছে এবং তা ‘ব্যর্থ্য’ তকমা দিয়ে চাপা দেয়া যায় না ।

পাঁচ

হাংরি আন্দোলনকারীদের মত পরাবাস্তব আন্দোলনকারীদের মাঝেও ভাঙন ঘটত, সে কথাও জানিয়েছেন অভিজিৎ পাল ।

১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।

পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 

আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ,  ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন।

পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো শিল্প । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির শিল্পচর্চা প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন- কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্য। ডাডাবাদী শিল্পীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল।

যুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রগতিবাদীদের মধ্যেই ডাডার শিকড় লুকিয়ে ছিল। শিল্পের সংজ্ঞায় পড়েনা এমন সব সৃষ্টিকর্মকে চিহ্নিত করার জন্য ১৯১৩ সালে “প্রতি-শিল্প” শব্দটি চালু করেছিলেন মার্সেল দ্যুশঁ । কিউবিজম এবং কোলাজ ও বিমূর্ত শিল্পের অগ্রগতিই হয়তো ডাডা আন্দোলনকে বাস্তবতার গন্ডী থেকে বিচ্যুত হতে উদ্বুদ্ধ করে। আর শব্দ ও অর্থের প্রথানুগত সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করতে ডাডাকে প্রভাবিত করে ইতালীয় ভবিষ্যতবাদী এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টগণ । আলফ্রেড জ্যারির উবু রোই (১৮৯৬) এবং এরিক স্যাটির প্যারেড (১৯১৬-১৭) প্রভৃতি লেখাগুলোকে ডাডাবাদী রচনার আদিরূপ বলা যেতে পারে।  ডাডা আন্দোলনের মূলনীতিগুলো প্রথম সংকলিত হয় ১৯১৬ সালে হুগো বলের ডাডা ম্যানিফেস্টোতে। এই ম্যানিফেস্টোর প্রভাবে পরবর্তিকালে ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখতে অনুপপ্রাণিত হন — এই কথা শুনতে ব্রেতঁ’র ভালো লাগত না এবং সেকারণে তিনি বহু সঙ্গীকে এক-এক করে আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট ।

ডাডা আন্দোলনে ছিল জনসমাবেশ, মিছিল ও সাহিত্য সাময়িকীর প্রকাশনা; বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্প, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো। আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছিলেন হুগো বল, মার্সেল দ্যুশঁ, এমি হেনিংস, হানস আর্প, রাউল হাউসম্যান, হানা হৌক, জোহান বাডার, ত্রিস্তঁ জারা, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, জর্জ গ্রোস, জন হার্টফিল্ড, ম্যান রে, বিয়াট্রিস উড, কার্ট শ্যুইটার্স, হানস রিখটার এবং ম্যাক্স আর্নেস্ট। অন্যান্য  আন্দোলন, শহরতলীর গান এসবের পাশাপাশি পরাবাস্তববাদ, নব্য বাস্তবতা, পপ শিল্প এবং ফ্লক্সেস প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোও ডাডা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের অনেকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ।

পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা। 

সুররিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতেহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজমের দ্বিতীয় ইশতেহারটি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতেহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর নেতৃত্বে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডাইজম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। অবশ্য ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতঁ এই আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্য-রেশারেশিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের শিল্প ও সাহিত্যধারা ছিল একই । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ । জিয়োর্জিও দে চিরোকো এবং পাবলো পিকাসো অনেক সময়ে গোষ্ঠির কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন, তবে আন্দোলনের ঘোষিত সদস্য ছিলেন না।

সুররিয়ালিজম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাইজম থেকে নিলেও এই মতবাদটি, যে,  ‘শিল্পের উৎস ও উপকরণ’ বিবেচনায় একটি অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ফরাসি কবি আঁদ্রে ব্রেতঁ। তিনি শিল্প রচনায় ‘অচেতন মনের ওপর গুরুত্ব’ দেওয়ার জন্যে শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, ‘অচেতন মন হতে পারে কল্পনার অশেষ উৎস।’ তিনি অচেতন মনের ধারণাটি নিঃসন্দেহে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে ‘অচেতন’ মনের ধারণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসে অচেতন মনের উৎস থেকে শিল্প রচনার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং সফলতাও লাভ করেন।

আঁদ্রে ব্রেতঁ মনে করতেন, ‘যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর’। অচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বসবাস। তার সন্ধান করাই সাহিত্যিক-শিল্পীর যথার্থ কাজ। অচেতন মনের কারণেই সুররিয়ালিজমের কবি-শিল্পীরা গভীর আত্মঅনুসন্ধানে নামেন। মনের গহীন থেকে স্বপ্নময় দৃশ্যগুলো হাতড়ে বের করতে এবং মনের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে চেতন ও অচেতনের মধ্যে শিল্পীরা বন্ধন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা অচেতন মনের সেই সব উপলব্ধিকে দৃশ্যে রূপ দিলেন যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। অচেতনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তব উপস্থাপনের কারণে খুব দ্রুতই এ মতবাদটি বিশ্ব শিল্পকলায় ‘অভিনবত্ব’ যোগ করতে সমর্থ হয়। এমনকী, পুঁজিবাদ-বিরোধী এই আন্দোলন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বিজ্ঞাপন কোম্পানি ।

সুররিয়ালিজমকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা একই ছাতার নিচে বসবাস করে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এ মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে ব্যাক্তিগত ভাবনা ভেবেছেন। ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’ ব্রেতোঁ বলতেন, ‘ভাবনার যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্যে সুররিয়ালিজম আবশ্যক।’ এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুররিয়ালিজমকে স্বপ্নবাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে।

সুররিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আছড়ে পড়ে। কবিতা, গান থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা পর্যন্ত সুররিয়ালিস্টদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সুররিয়ালিজম ধারায় অন্তত ছয়টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন জ্যাঁ আর্প, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আঁদ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। এ ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে আঁকা সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এটি কেবল এ ধারার মধ্যেই আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, এটি দালিরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’-তে দালি ‘সময়ের’ বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দি করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সুররিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেটের ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইজ নট এ পাইপ’, জর্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্য রেড টাওয়ার’, ম্যাক্স আর্নেস্টের ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’, ইভ তঁগির ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেমে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুররিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুররিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়।  ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো । মার্কসবাদের সঙ্গে আর্তুর র‌্যাঁবোর আত্মপরিবর্তনের ভাবনাকে একত্রিত করার উদ্দেশে ব্রেতঁ ১৯২৭ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । কিন্তু সাম্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি । সেখান থেকেও তিনি ১৯৩৩ সালে বিতাড়িত হন । পরাবাস্তববাদীদের “উন্মাদ প্রেম” তত্বটি ব্রেতঁর এবং “উন্মাদ প্রেম” করার জন্য বেশ কিছু তরুণী সুররিয়ালিস্টদের প্রতি আকৃষ্ট হন । যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতার ঢেউ ওঠে সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে ; পরাবাস্তববাদীদের নামের সঙ্গে একজন বা বেশি নারীর সম্পর্ক ঘটে এবং সেই নারীরা তাঁদের পুরুষ প্রেমিকদের নামেই খ্যাতি পেয়েছেন । 

তাঁর রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েলের, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু সুররিয়ালিস্ট গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে তাঁর মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হয়েছিল ; সেই থেকে তিনি সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন । আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন রাজনৈতিক মতভেদের কারণে, যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।

১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । এর ফলে পরাবাস্তববাদীদের ইনটারন্যাশানাল কংগ্রেস ফর দি ডেফেন্স অফ কালচার সংস্হা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করেন ।

১৯৩৮ সালে ব্রেতঁ মেকসিকো যাবার সুযোগ পান এবং লিও ট্রটস্কির সঙ্গে দেখা করেন । তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কালহো । ট্রটস্কি এবং ব্রেতঁ একটা যুক্ত ইশতাহার প্রকাশ করেছিলেন, “শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা” শিরোনামে । লুই আরাগঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না । ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ডাডাবাদীদের সঙ্গে আন্দোলন করার পর ১৯২৪ সালে আরাগঁ যোগ দেন পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে । অন্যান্য ফরাসী পরাবাস্তববাদীদের সঙ্গে তিনিও ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দ্যান এবং পার্টির পত্রিকায় কলাম ও রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন । আরাগঁর সঙ্গে ব্রেতঁর বিবাদের কারণ হল ব্রেতঁ চেয়েছিলেন ট্রটস্কির সঙ্গী ভিকতর সার্জকে সন্মানিত করতে । পরবর্তীকালে, ১৯৫৬ নাগাদ, সোভিয়েত রাষ্ট্র সম্পর্কে নিরাশ হন আরাগঁ, বিশেষ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ কংগ্রেসের পর যখন নিকিতা ক্রুশ্চভ আক্রমণ করেন জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিত্ববাদকে । তা সত্ত্বেও স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বিতাড়ন করেন ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই সুররিয়ালিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে ।

পরাবাস্তববাদই সম্ভবত প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যেখানে নারীকে দূরতম কোনো নক্ষত্রের আলোর মতো, প্রেরণা ও পরিত্রাণের মতো, কল্পনার দেবী প্রতিমার মতো পবিত্র এক অবস্থান দেওয়া হয়েছিল। নারী তাদের চোখে একই সঙ্গে পবিত্র কুমারী, দেবদূত আবার একই সঙ্গে মোহিনী জাদুকরী, ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ও নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোয় আদ্রেঁ ব্রেতঁ নারীকে এরকম একটি অপার্থিব অসীম স্বপ্নিল চোখে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুরুষ শিল্পীদের প্রেরণা, উদ্দীপনা ও কল্পনার সুদীর্ঘ সাম্পান হয়ে এগিয়ে আসবেন নারীরা। হয়ে উঠবেন পুরুষদের আরাধ্য ‘মিউজ’ আর একই সঙ্গে femme fatale। সুদৃশ্য উঁচু পূজার বেদি উদ্ভাসিত করে যেখানে বসে থাকবেন নারীরা। তাঁদের স্বর্গীয় প্রাসাদে আরো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে পুরুষ।

ব্রেতঁ ছিলেন সেই সময়ের কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। তাঁর সম্মোহক ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হননি তাঁর সান্নিধ্যে এসেও – এরকম কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। উজ্জ্বল, সাবলীল, মেধাবী, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নায়কসুলভ ব্রেতঁ একই সঙ্গে ছিলেন উদ্ধত, আক্রমণাত্মক ও অহমিকাপূর্ণ। নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে মাঝেমধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতেন। কিন্তু যদি তাঁর একবার মনে হতো যে কেউ তাঁর প্রভুত্বকে অগ্রাহ্য করছে, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতেন। নেতৃত্ব দেওয়ার সব গুণ প্রকৃতিগতভাবেই ছিল তাঁর মধ্যে। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল তরুণ প্রেমিকের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, অভিজাত ভাষা – এসবের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারিয়ে সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়া আর দুর্বোধ্য জটিল মানসিকতার জন্য পারতপক্ষে অনেকেই ঘাঁটাতে চাইতেন না তাঁকে।

নারী পরাবাস্তববাদীদের সংখ্যা কম ছিল না । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে স্হান পেয়েছে ।

নারীদের নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের এই স্বপ্নিল কাব্যময় উচ্ছ্বাস জোরালো একটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপে দ্রম্নত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির ভস্ম ও শোণিত স্নাত শোণিত আত্মশক্তিসম্পন্ন নারীরা তাঁদের ভারী বাস্তবতা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে আর বেরিয়ে এলো মেরুদ-সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিলো নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না। মৃত অ্যালবাট্রসের মতো এই বিমূর্ত আদর্শায়িত ধারণা নারী শিল্পীদের গলায় ঝুলে থেকেছে, যাকে ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য ছিল। সময় লেগেছে সাফল্য পেতে। কিন্তু দিনের শেষে হেসেছিলেন তাঁরাই। এমন নয় যে, পরাবাস্তবতার প্রধান মশালবাহক ব্রেতঁ চাইছিলেন যে পুরুষরাই হবেন এই আন্দোলনের ঋত্বিক আর দ্যুতিময় নারী শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কাজ হবে মুগ্ধ সাদা পালক ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া এবং আকর্ষণীয় ‘গুজব’ হিসেবে সুখী থাকা। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে নারী শিল্পীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুরুষ উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা থেকে তাঁদের ভাষা, স্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। নিজেদের ভারী অসিত্মত্ব, শরীরী উপস্থিতি জোরালোভাবে জায়গা পেল তাঁদের ছবিতে।

কিন্তু নারী শিল্পীদের কাছে আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠল একটি সশস্ত্র ভাষার মতো। নিজস্ব গোপন একটি সন্ত্রাসের মতো। এই আন্দোলনের মধ্যে নারীরা এমন এক পৃথিবীর ঝলক দেখলেন, যেখানে আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে সৃজনশীল থাকা যায়, দমচাপা প্রতিবাদের ইচ্ছেগুলোর উৎস থেকে পাথরের বাঁধ সরিয়ে দেওয়া যায়। নগ্ন ও উদ্দাম করা যায় কল্পনাকে। নোঙর নামানো জাহাজের মতো অনড় ও ঠাসবুনট একটি উপস্থিতি হয়ে ছবিতে নিজের মুখ তাঁদের কাছে হয়ে উঠল অন্যতম প্রধান আইকন। যে ছবি আত্মপ্রতিকৃতি নয়, সেখানেও বারবার আসতে থাকল শিল্পীর শরীরী প্রতিমা। ফ্রিদা কাহ্লোর (১৯০৭-৫৪) ক্যানভাস তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ শান্ত মুখশ্রী ধরে রাখল। মুখের বিশেষ কিছু চিহ্ন যা তাঁকে চেনায় – যেমন পাখির ডানার মতো ভুরু, আমন্ড আকারের চোখ ছবিতেও আনলেন তিনি। রিমেদিওস ভারোর (১৯০৮-৬৩) ছবিতে পানপাতার মতো মুখ, তীক্ষন নাক, দীর্ঘ মাথাভর্তি চুলের নারীর মধ্যে নির্ভুল চেনা গেল শিল্পীকে। আবার লিওনর ফিনির (১৯১৮-৯৬) আঁকা নারীরা তাদের বেড়ালের মতো কালো চোখ আর ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ নিয়ে হয়ে উঠল ফিনিরই চেনা মুখচ্ছবি। ১৯৩৯ সালের ‘The Alcove : An interior with three women’ ছবিতে ভারী  পর্দা টাঙানো ঘরে দুজন অর্ধশায়িত মহিলা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছেন। আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনজনেই যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছেন চাপা উদ্বিগ্ন মুখে। যে তিনজন নারীর ছবি, তাঁরা যে লিওনর ফিনি, লিওনারা ক্যারিংটন এবং ইলিন অগার – এটা ছবিটিকে একঝলক দেখেই চেনা যায়। এমনকি যখন অন্য কোনো নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাঁরা, সেখানেও তাঁদের বিদ্রোহের অস্বীকারের জোরালো পাঞ্জার ছাপ এই শিল্পীরা সেইসব নারীর মুখে ঘন লাল নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে খেয়োখেয়ি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে পরাবাস্তববাদ ১৯৪৭ সালে ভেঙে যায়, প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ ।

সুররিয়ালিজমের উদ্ভব সত্ত্বেও ডাডার প্রভাব কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি, তা প্রতিটি দশকে কবর থেকে লাফিয়ে ওঠে, যেমন আর্পের বিমূর্ততা, শুইটারের নির্মাণ, পিকাবিয়ার টারগেট ও স্ট্রাইপ এবং দ্যুশঁ’র রেডিমেড বস্তু বিশ শতকের শিল্পীদের কাজে ও আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ছিল । স্টুয়ার্ট ডেভিসের বিমূর্ততা থেকে অ্যান্ডি ওয়ারহলের পপ আর্ট, জাসপার জনসের টারগেট ও ফ্ল্যাগ থেকে রবার্ট রাউশেনবার্গের কোলাঝে — সমসাময়িক সাহিত্য ও শিল্পের যেদিকেই তাকানো হোক পাওয়া যাবে ডাডার প্রভাব, সুররিয়ালিজমের উপস্হিতি । ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি । ডাডা ও সুররিয়ালিজম আন্দোলনকারীদের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।

Posted in Uncategorized | Tagged | এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান