ঈশ্বরচন্দ্রের পাকিস্তানিফিকেশন

    যখন কলকাতায় নাকতলায় থাকতুম তখন ঢাকা থেকে মাঝে-মাঝে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার’ সম্পাদক মীজানুর রহমান, কলকাতা শহরে এলে, অবশ্যই আমার তিন তলার ফ্ল্যাটে আসতেন, আশি বছর বয়সে, পুরোনো-কেতা বাড়ির তিন তলায়, সস্ত্রীক,  ঊঁচু-উঁচু সিঁড়ি ভেঙে ।

         মীজানুর সাহেব নিয়মিত আমার লেখা প্রকাশ করতেন ওনার পত্রিকায়, ছোটো ভাইয়ের মতন ভালোবেসে ফেলেছিলেন আমাকে । আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ ওনার পত্রিকাতেই ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল । শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনাকে শামসুর রাহমানের মাধ্যমে  ‘হাংরি কিংবদন্তি’র ধারাবাহিক প্রকাশনাটা বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন ; উনি বন্ধ তো করেনইনি, উলটে শক্তি আর সুনীলের কার্টুন ছেপেছিলেন। মীজানুর রহমান ওনাদের ইশারায় ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে একটা উপন্যাস দিতে বলেন, এবং আমার ‘নামগন্ধ’ ওনার পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । উনি ‘নামগন্ধ’ বই হিসাবেও বের করেছিলেন, অত্যন্ত উন্নতমানের কাগজ, প্রচ্ছদ এবং ছাপা, কলকাতা বইমেলায় যতোগুলো কপি পাঠিয়েছিলেন সবই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ।

         মীজানুর রহমানের পরিচিত এক যুবক, যিনি ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’ -এর  পরিচালক ছিলেন, নাম এক্ষুনি মনে পড়ছে না, তিনি নাকতলার বাড়িতে আসতেন, মীজানুর সাহেবের পত্রিকা নিয়ে এবং ওনার সোসায়টি কী কাজ করছে তা জানাবার জন্য, সঙ্গে ফোটো অ্যালবামও নিয়ে আসতেন, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ওনার সোসায়টির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ফোটো । উনি সিপিএম নেতাদের সঙ্গেও দেখা করতেন আলিমুদ্দিনে গিয়ে,  যাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন তাঁর সোসায়টিকে আর্থিক এবং সাংগঠিনিক সাহায্য করতে ।

          একবার এসে তিনি জানালেন যে তাঁকে ‘ইণ্ডিয়ার এজেন্ট’ এবং ‘হিন্দুদের দালাল’  বলা হচ্ছে, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন বলে, তাঁকে মারধরের হুমকিও দেয়া হয়েছে । তার কিছুকাল পর, তিনি আমার ফ্ল্যাটে আসা বন্ধ করে দেবার পর অনুমান করতে পারলুম যে তিনি নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছেন, কেননা ইতিমধ্যে হুমায়ুন আজাদ পাকিস্তানপন্হীদের রামদা আর কাটারির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মারা যান । একের পর এক প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্লগার যখন খুন হতে থাকলেন, তখন নিশ্চিত হলুম যে ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’-এর নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়া অনিবার্য ।

         মীজানুর রহমান যখন শেষবার আমার নাকতলার ফ্ল্যাটে আসেন তখন জানতে পারি যে পাকিস্তানপন্হী বাংলাদেশিদের হুমকির কারণে ‘বিদ্যাসাগর সোসায়টি অব বাংলাদেশ’ সংগঠনটি তুলে দেয়া হয়েছে । অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের পাকিস্তানিফিকেশান সম্পূর্ণ । পিএইচডি এম-ফিল ছাত্ররা পাকিস্তানপন্হীদের ভয়ে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আর গবেষণা করতে চান না । কে-ই বা বেঘোরে পপাণ দিতে চায় ।

         মীজানুর রহমান বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার, এপ্রিল-জুন মাসে । সেই সংখ্যায় গবেষক মোহম্মদ আবদুল হাই লিখেছিলেন যে, “পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে চিহ্ণিত করেছিল ‘ব্রিটিশপোষ্য’ বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতায়ন’ করার প্রধান পুরোধা হিসাবে । তিনি লিখেছিলেন যে, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় নতুন কোনো মাত্রালাভ করেননি । লেখক গবেষক শিক্ষার্থিদেরও বিদ্যাসগরকে নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই । বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বিগত ছাব্বিশ বছরে এম-ফিল পি-এইচডি পর্যায়ে যতোগুলি গবেষণামূলক কাজ হয়েছে তাতে বিদ্যাসাগর স্হান লাভ করেননি । ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র, সাহিত্য সংকলন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ইত্যাদি কাঙ্খিত ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না । তিনি আরও বলেছেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে, ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বিদ্যাসাগর কদাচিৎ স্হান লাভ করেছেন । বাংলাদেশর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়, সংকলন কর্তারা বিদ্যাসাগরকে স্বাধীনতা-পূর্বকালের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে সক্ষম হননি ।”

          এক কথায় বলতে গেলে বিদ্যাসাগর আর পড়ানো হয় না বাংলাদেশে, তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণাও হয় না, তাঁকে স্মরণ করা হয় না, পাকিস্তানি আমলের চেয়েও বেশি বিদ্যাসাগর-বিরোধী হয়ে গেছে বাংলাদেশের এসট্যাবলিশমেন্ট, প্রধানত রাজনৈতিক মৌলবাদীদের চাপে, যখন কিনা একুশে ফেব্রুয়ারির লড়াইটা বিদ্যাসাগরের গড়ে দেয়া বাংলা ভাষার লড়াই ছিল, সেই ভাষার লড়াইটা ছিল বাঙালির নবজাগরণের প্রসার, যে নবজাগরণের হোতাদের অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । বস্তুত বিদ্যাসাগরের অবদান ছাড়া একুশে ফ্রেব্রুয়ারি সম্ভব হতো কিনা বিতর্কের বিষয় ।

         স্কুল ও কলেজপাঠ্য পুরোনো বইগুলোয় তাঁর রচনা অন্তর্ভুক্ত হলেও, সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হন না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । বাংলাদেশে সম্প্রতি আরও লেখক-কবিদের বাদ দেয়ার কাজ চলছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে মৌলবাদী চিন্তাধারা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে । এর প্রতিবাদে হাইকোর্টে জনস্বার্থ রিট দায়ের করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন ও পাঠ্যপুস্তক বিশেষজ্ঞ মমতাজ জাহান । সেই আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছে কেন এই পরিবর্তন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না । রিটের পক্ষের আইনজীবিরা জানিয়েছেন, কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কিছু প্রখ্যাত লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে । সেই তালিকায় বাদ পড়েছেন খোদ লালন শাহ, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, উপেন্দ্রকিশোর, সঞ্জীবচন্দ্র প্রমুখ ।

         বিদ্যাসাগর আগে থাকতেই বাদ গিয়েছিলেন ।

         পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বাদ দেবার একটা যুক্তি আছে । তা হলো ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানে এবং তারপর স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে বহু প্রবন্ধকার, ঔপন্যাসিক ও কবি আবির্ভূত হয়েছেন । স্কুল ও কলেজে তাঁদের কবিতা ও গদ্য অন্তর্ভুক্ত করার একটা চাপ তৈরি হয়ে থাকবে । তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকজনের লেখা সরিয়ে ফেলতে হবে । কিন্তু তা করতে গিয়ে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলামের দাবির কাছে বাংলাদেশি এসট্যাবলিশমেন্ট আত্মসমর্পণ কেন করবে সেটা বুঝে ওঠা তেমন কিছু কঠিন নয় । ভারতে আসামে ২০১৭ সাল থেকে স্কুলগুলোয় রবীন্দ্রজয়ন্তীর ছুটি তুলে দেয়া হয়েছে । উত্তরপ্রদেশে স্কুল ও কলেজে ইংরেজি সিলেবাসে ব্রিটেনের কবিদের বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে ।

          ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং সেই সময়ের অন্যান্য হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি আলোচকদের অভিযোগ যে তাঁরা বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন করে দিয়েছেন এবং তা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের মুক্তি প্রয়োজন ; সেই মুক্তির জন্য বাংলা ভাষাকে আরব তুর্কি ফারসি শব্দ দিয়ে ঐশ্বর্যময় করে তুলতে হবে, এমনকি ক্রমে অক্ষরগুলোকেও নাস্তালিক স্ক্রিপ্টে লেখার আয়োজন করতে হবে। পাকিস্তান যদি সমগ্র দেশে ভারতীয় মোহাজিরদের ভাষা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে পারে, নাস্তালিক উর্দু স্ক্রিপ্টকে পেশোয়ার ও বালুচিস্তানেও গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে পারে,  তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন , মনে করেন হেফাজতে ইসলামির আশরাফ নেতারা ।

          ভারতের মতোই, বাংলদেশের সমাজে একটি বিভাজন ঘটে চলেছে মৌলবাদী ও উদারপন্হী লেখক-রাজনেতা-সুশীল সমাজের সদস্যদের মাঝে । সউদি আরব বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য করছে প্রতিটি গ্রামে একটি করে মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য । সরকারের ধারণা যে সেগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং সরকার তাদের প্রভাবিত করতে পারবে । আসলে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা চান যে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশ সম্পর্ণ মুক্ত হয়ে যাক, এই ভাবে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে ভারতীয় জওয়ানরা প্রাণ দিয়েছিল, কলকাতা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের যে ব্যবস্হা করেছিল, ১৯৭১ সালে খানসেনাদের অত্যাচারে এই পারে পালিয়ে-আসা লক্ষ-লক্ষ মানুষ যশোর রোডের দুই পারে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দুবেলার খাবার পেয়েছিল, তার স্মৃতি এবং ঋণভার থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে আনা যাবে। পশ্চিমবাংলার ভাষা থেকে বেরিয়ে যাবার অহরহ প্রয়াস করে চলেছেন সেই গোষ্ঠীর মানুষ ; বিদ্যাসাগরকে বাংলাদেশের কৌমস্মৃতি থেকে মুছে ফেলা তাই জরুরি ।

          পাকিস্তানি আমলে, পাকিস্তানি বলতে উর্দুভাষীদের কথা বলছি না, পাকিস্তানপন্হী বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এবং প্রশসনিক কর্তাদের কথা বলছি, যাঁরা বাংলাভাষী বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্মের কারণে বেশ কূপিত ছিলেন, এবং পাকিস্তানের প্রতি সমর্পিত ছিলেন, তাঁরা ‘ইণ্ডিয়া’ নামের ভূখণ্ডের অনেককে ঘৃণার চোখে দেখতেন, অর্থাৎ ঈর্ষা করতেন, তাঁরা বিদ্যাসগরের কাজকর্মে খুঁত আবিষ্কার করা আরম্ভ করেন । তাঁদের অভিযোগগুলো আমি নিজের জীবনযাপন দিয়ে ভালো করে অনুধাবন করতে পারি, তার কারণ আমার শৈশব কেটেছে একটি অন্ত্যজ বিহারি ও অত্যন্ত গরিব শিয়া মুসলমান পাড়ায়, ইমলিতলায় ।

         বস্তুত ইমলিতলা পাড়ায় থাকার সময়ে আমি জানতুমই না যে শিয়া আর সুন্নি নামে মুসলমানদের বিভাজন আছে, তাদের মসজিদ আলাদা, নামাজ পড়াতেও যৎসামান্য পার্থক্য আছে  । মহরমের সময়ে আঘাতে নিজেদের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করেন শিয়ারা, যা সুন্নিরা ভালো চোখে দেখেন না । আমার অনুমান বাংলাদেশে শিয়া মুসলমান একেবারেই নেই। বলা হয় যে সুফিদের প্রভাবে অন্ত্যজ হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ; এখন সেই সুফিদের স্মৃতি বাংলাদেশে মুছে ফেলার প্রয়াস চলছে, আর পাকিস্তানে তাদের মাজারগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে । ললন সাঁইকে বাংলাদেশে আর শ্রদ্ধা করা হয় না । হাছন রাজা এই পারে যতো শ্রদ্ধেয়, বাংলাদেশে ততোটা নন ।

         আমি মুসলমান পাড়ায় বসবাস করে, মুসলমান প্রতিবেশির বাড়িতে অহরহ যাওয়া-আসার মাধ্যমে যে জীবনধারা সম্পূর্ণ জানতে পারিনি, তা কেমন করেই বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জানবেন, যিনি মুসলমানদের সমাজে বসবাস করেননি, কেবল বীরসিংহ গ্রামের মুসলমান চাষিদের দেখে থাকবেন । পাঁচ বছর বয়সে তিনি পাঠশালায় ভর্তি হন, এবং আমি নিশ্চিত যে তাঁর কোনো মুসলমান সহপাঠী ছিল না । তাঁর সময়ে কলকাতায় যে বৈভবশালী মুসলমানরা থাকতেন তাঁরা প্রায় সকলেই উর্দুভাষী ।

         বিদ্যাসাগর শিয়া-সুন্নি বিভাজনের কথা কি জানতেন ?  পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর আমরা আহমেদিয়া, মোমিন ইত্যাদি মুসলমানের কথা জানতে পারছি । শৈশবে আমি শিয়াদের মসজিদে লুকোতুম লুকোচুরি খেলার সময়ে, ইমাম সাহেব আপত্তি করতেন না । আমি নিঃসন্দেহ যে বিদ্যাসগর কখনও কোনো মসজিদে প্রবেশ করেননি । এখনকার বহু হিন্দু যুবকও প্রবেশ করেননি বলেই অনুমান করি ।

         কৈশোরে ইমলিতলা পাড়া ছেড়ে দরিয়াপুর পাড়ায় বাবা-মা আর দাদার সঙ্গে থাকতে চলে যাই, বাবা নতুন বাড়ি তৈরি করার পর ; পাড়াটা আরও গরিব সুন্নি মুসলমানদের । এই পাড়ায় মুসলমান প্রতিবেশিদের সঙ্গে পরিচয় হলেও কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিতেন না ; মসজিদের ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না, মসজিদের ভেতরে যদি উঁকি মারতুম দেখার জন্য যে ইমলিতলার মসজিদের সঙ্গে এর ভেতরটা আলাদা কিনা, তাহলে কেউ একজন বেরিয়ে এসে ধমকানি দিয়ে বলতো, ‘কি রে জুতো চুরি করতে এসেছিস?’ বুঝলুম যে, সব মুসলমানরা একইরকম নয় । বিদ্যাসাগরের পক্ষে এই ব্যাপারটা জানা কি সম্ভব ছিল ? দরিয়াপুর  পাড়ার এক মুসলমান চুড়িঅলার কাছ থেকে আমার মা মুর্গির মাংস রাঁধতে শিখেছিলেন, তাকে আমাদের রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয়া হয়েছিল, কারণ ইমলিতলায় মুর্গি আর মুর্গির ডিম খাওয়া বারণ ছিল ।

        লখনউতে যখন চাকুরিসূত্রে পোস্টিং হলো তখন বাংলোবাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আবদুল করিম নামে এক অবিবাহিত সহকর্মী অফিসারের বাড়িতে ছিলুম প্রায় মাসতিনেক ; সে অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মাম জেলার সুন্নি চাষি পরিবারের, বিশাল আমবাগান আছে ওদের, যদিও ওদের বংশে আবদুল করিমই প্রথম শিক্ষিত প্রজন্ম । ধর্মের ব্যাপারে করিম বেশ গোঁড়া ছিল, রান্নার আগে পাঁঠার মাংস ঘণ্টাখানেক জলে ভিজিয়ে রাখতো, যাতে সব রক্ত বেরিয়ে যায়, মুর্গি আস্ত ছাড়িয়ে উনুনের ওপর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে রক্ত শুকিয়ে নিতো । ওর বিয়ে হলো হায়দ্রাবাদের শিক্ষিত ধনী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে যে,  মেয়েটি করিমের এই ধরণের গোঁড়ামিতে বিরক্ত হতো এবং কালক্রমে সেসব পাট চুকিয়ে ফেললো । বিদ্যাসাগর কি এই ধরণের মুসলমান পরিবারে থেকেছেন ? থাকলে তাঁর জাত চলে যেতো । আমিও ব্রাহ্মণ পরিবারের, কিন্তু আমার জাত আছে না গেছে তা নিয়ে আমার বাবা-মাও চিন্তা করতেন না । অর্থাৎ দেড়-দুশো বছরে সবকিছু পালটে গেছে ।

         করিমের বিয়েতে গায়েহলুদের মতন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি, ইমলিতলায় কুলসুম আপাদের বাড়িতে কারোর বিয়েতে গায়েহলুদ অনুষ্ঠান হয়নি, যা আমি নাকতলায় এসে প্রথম দেখলুম বাংলা ভাষার গল্প লেখক মুর্শিদ এ. এম-এর মেয়ের বিয়েতে । বুঝলুম যে মুসলমানদের মাঝেও জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু নিয়ে আচার-বিচারের পার্থক্য আছে । বিদ্যাসাগর কি জানতেন যে মুসমানদের কোথাও গায়েহলুদ হয় আর কোথাও হয় না ?

         এতক্ষণ যাবত আমি এই কথাগুলো এই জন্যে বললুম যে কোনো সমাজ সম্প্রদায় এবং সেই সমাজ সম্প্রদায়ের চরিত্র ও আচার-আচরণ  সম্পর্কে লিখতে হলে তাদের সম্পর্কে জানাটা জরুরি । বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজ সম্প্রদায় আর তাদের শাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্হ কোরান, হাদিস এবং শরিয়া সম্পর্কে বিশেষ জানতেন না বলেই মনে হয় । কলকাতায় আমি এই বইগুলোর বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলুম, কিন্তু সে অনুবাদের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি, এতো বাজে অনুবাদ ছিল ; এখনই যদি এই অবস্হা, তাহলে বিদ্যাসাগরের সময়ে কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয় ।

         আমার গল্প-উপন্যাসে যে মুসলমান চরিত্রদের এনেছি, সেগুলো আমার পরিচিত পারিপার্শ্বিক থেকে সংগ্রহ করা । বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগে মুসলমানের উল্লেখ নেই বলে বাংলাদেশে কেউ-কেউ বিদ্যাসগরকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেগে দিয়েছেন । “মূলধারা” ২৩ আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় এস এম রেজাউল করিম আক্ষেপ করেছেন, “১৮৫৫ থেকে পরের একশো বছর বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়াই বাংলা ভাষার শিশু শিক্ষা শুরু হইছে । এই শিশুরা কী শিখলো ? রাম ওইটা করে, সুরেন্দ্র সেইটা করে, গোপাল সুবোধ ছেলে, যাদব মায়ের আদেশ মানে ; করিম তো ছিল না । ফলে রাস্তায় যেই করিমের সাথে দেখা হইলো, সেই করিম উটকো ।”

         আমি এবং আমার দাদা ও জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরা সকলেই শৈশবে বিদ্যাসগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ দিয়েই পড়াশুনা শুরু করেছি । আমাদের সকলেরই মুসলমান ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল, কিন্তু কাউকে রাস্তায় দেখে কখনও উটকো মনে হয়নি । বস্তুত বিদ্যাসাগরকে সাম্প্রদায়িক প্রতিপন্ন করে এবং তাঁকে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক জগত থেকে নির্বাসন দেবার  জন্য জনাব এস. এম. রেজাউল করিম তাঁর অভিজ্ঞতা-জগতের বাইরে গিয়ে তত্ব ফেঁদেছেন, এই ব্যাপারটাকেই আমি বলছি বিদ্যাসাগরের পাকিস্তানিফিকেশান ।

         এখানে উল্লেখ করি যে আমার জাঠতুতো দিদির ছোটো মেয়ে এক মুসলমান যুবককে বিয়ে করেছে, সংসার পেতেছে, এবং সেও শৈশবে ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েছিল, কই যুবকটিকে তার উটকো মনে হয়নি তো । বস্তুত যে মনোবীজের দরুণ স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৭৫ সালে আধুনিক শিক্ষার জন্য  ‘মোহামেডান অ্যাংলো অরিয়েন্টাল কলেজ’ স্হাপন করেছিলেন, যা পরে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি হলো, অবিভক্ত বঙ্গদেশে সেরকম কলেজ স্হাপনা হলো না কেন, মানে একজন মুসলমান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্ভব হলো না কেন, যখন কিনা ধনী মুসলমান বঙ্গদেশে বেশ কয়েকজন ছিলেন ! বলা বাহুল্য যে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ ছিল না, বাঙালি মুসলমানদের আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ তাঁদের ছিল না ।

         এনটিভি অনলাইনের ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই সংখ্যায় আলী নইম লিখেছেন, “১৯৯১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবর্ষে হায়াৎ মামুদ লিখেছিলেন, ‘কি দুঃখ কি লজ্জা যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবার্ষিকীর দিনটি প্রায় অলক্ষ্যে এসে চলে গেল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গসাহিত্যের অধ্যাপক কেন্দ্রিক একটি সারস্বত গোষ্ঠীর ঘরোয়া আলোচনাসভা এবং একটি দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মেয়েদের পাতায় ও ড. আনিসুজ্জমানের একটি রচনাতে ছাড়া তাঁকে আর কেউ আর কোথাও স্মরণ করেছেন বলে আমার জানা নেই ।” আলী নইম  কটাক্ষ করেছেন, “হায়াৎ মামুদ এখনও বেঁচে আছেন । আজ তিনি কী লিখবেন জানি না ।” এই যে শেষের বাক্যটা, “আজ তিনি কী লিখবেন জানি না”, স্পষ্ট করে তোলে যে ঈশ্বরচন্দ্রের এমন পাকিস্তানিফিকেশন ঘটে গেছে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক জগতে যে, মৌলবাদীরা চেপে বসেছে বিদ্বজ্জনদের ওপরে, সুশীল সমাজের বৌদ্ধিক শক্তির অবসান ঘটেছে ।

         একজন ভাবুক ও লেখককে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি । ইস্ট ইনডিয়া কোমপানির কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকার এদেশের দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেবার পরে জানতে পারে যে তখনও বঙ্গদেশে ১৬০০ সংস্কৃত টোল রয়েছে । সুতরাং বাল্য বিবাহ বন্ধ, সতীদাহ বন্ধ থেকে বিধবা বিবাহ চালু করার সমর্থনে প্রতিটি সমাজ সংস্কারের কাজে তাঁকে সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে সমর্থন সংগ্রহ করতে হয়েছে । সেই সময়ের সমাজকর্তাদের নিজের দিকে টানার জন্য অন্য কোনো উপায় ছিল না । বাঙালির নবজাগরণের হোতা হিসাবে বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন যাকে রেনেসাঁস বলা হয়, সেই বঙ্গসমাজ ছিল বাঙালি হিন্দুর উচ্চবর্ণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।

         বিদ্যাসাগর কেন মুসলমান সমাজে বাল্যবিবাহ বন্ধ, বহুবিবাহ বন্ধ করার কথা ভাবলেন না, এরকম কুতর্ক যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অন্তত এটুকু মনে রাখা উচিত যে ইসলামি শাস্ত্রাদির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের গভীর পরিচয় ছিল না । তাছাড়া হিন্দু সমাজে পরিবর্তন আনতেই তাঁর প্রচুর সময় লাগছিল এবং কুলীন ব্রাহ্মণদের কোপের মুখে পড়তে হচ্ছিল, সেই অবস্হায় তিনি আগ বাড়িয়ে মুসলমান সমাজের সংস্কারের কথা ভাববেন, এরকম চিন্তাই মূর্খতা ।

          এই অভিযোগও করা হয় যে সংস্কৃত কলেজের কারিকুলাম বিদ্যাসাগর সংস্কৃত বই দিয়ে ভরে দিয়েছিলেন ; তখন পর্যন্ত তো বাংলায় বই লেখা সেভাবে আরম্ভই হয়নি, তো বাংলা বই কোথা থেকে পেতেন ! আরেকটা অভিযোগ হলো যে সংস্কৃত কলেজে হিন্দুদের সব বর্ণের ছাত্র ভর্তি হতে পারতো না । সংস্কৃত কলেজে পারতো না ঠিকই, তার পঞ্চাশ বছর পরও রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা সংস্হায় বর্ণপ্রথা প্রথম দিকে বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন । তবে বিদ্যাসাগর হিন্দু কলেজে সব বর্ণের ছাত্রের ভর্তি হবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন ।

         বিদ্যাসাগরের হিন্দুত্ব নিয়েও আক্রমণাত্মক লেখালিখি নজরে পড়ে বাংলাদেশের কোনো-কোনো সাইটে, এমনকি কম বয়সে তাঁর টাক পড়ে যাওয়া সত্বেও তাঁরা দাবি করেন যে বিদ্যাসাগর টিকি রাখতেন । বিদ্যাসাগর আস্তিক ছিলেন না নাস্তিক, ঈশ্বরে বা দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করতেন কিনা, অজ্ঞাবাদী ছিলেন কিনা, সেই তর্ক এখনও ফুরোয়নি । ড. আহমদ শরিফ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রমিত্র মনে করেন যে বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন ।

         কর্মজীবনের প্রথম দিকেই বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের এবং কলকাতার হিন্দু উচ্চবর্ণের নেতাদের থেকে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছিলেন, কেননা তাঁর মনে হয়েছিল যে ব্রাহ্মসমাজের নেতারা বেশ গোঁড়া, এবং হিন্দুনেতারা অনমনীয়, যাদের সঙ্গে একসাথে কাজ করা কঠিন । তাই সামাজিক পরিবর্তনের কাজ তিনি শিক্ষার প্রসার ও আইনের মাধ্যমে করতে চাইলেন । তাছাড়া নিজের ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মাচরণ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সংযতবাক ছিলেন, কাউকে স্পষ্টভাবে কিছুই বলতেন না । বিধবা বিবাহ, সতীপ্রথা নির্মূল, বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারীর শিক্ষা, অব্রাহ্মণদের শিক্ষিত করে তোলা ইত্যাদির জন্য যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন তা উচ্চবর্ণের এসট্যাবলিশমেন্টের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছিল, সেক্ষেত্রে ধর্ম সম্পর্কে নিজের মনের কথা চাউর করা ছিল বিপজ্জনক ।

         অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় “বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন” রচনায় বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের  বাকসংযমকে দায়ি করেছেন, এই নির্ণয়ে পৌঁছোতে যে তিনি নাস্তিক ছিলেন, না আস্তিক না অজ্ঞাবাদী । কুলীন ব্রাহ্মণরা সেসময়ে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল যে তিনি গোপনে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস করেন । কুলীন ব্রাহ্মণ এসট্যাবলিশমেন্ট  তাঁর সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্ণয়ে পৌঁছোতে পারতো না কেননা তিনি উপবীত পরতেন এবং বাংলায় চিঠি লেখার সময়ে সেকালের প্রথা অনুযায়ী চিঠির ওপরে ঈশ্বর চিহ্ণ দিতেন বা দুর্গাশরণং লিখতেন । অর্থাৎ এই ব্রাহ্মণসমাজের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বিদ্যাসগর নিজের তীর আর তুণীর তৈরি করে ফেলেছিলেন । সেই সময়ের সামাজিক আবহে একজন লোক একা যে লড়াইটা লড়ছেন তার জন্য বাইরে তাঁকে এই ধরণের পাঁচিল তুলে ফেলতে হয়েছিল ।

        অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে সুনির্দিষ্ট নির্ণয়ে পৌঁছোবার মতো তথ্য প্রায় নেই, যাও বা আছে সেগুলো হয় ভাসাভাসা নয় পরস্পরবিরোধী । তিনি লিখেছেন যে যদিও বঙ্কিমের হিন্দু পুনরুথ্থান, ব্রাহ্মসমাজের তিন গোষ্ঠীর ধর্মমত অথবা খ্রিস্টধর্ম কোনোটিই বিদ্যাসাগরকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, একথা স্বীকার করতে হবে যে বিদ্যাসাগর ধর্মপ্রচারের বিরোধী ছিলেন, খ্রিস্টধর্মী যাযকদের উপদেশাবলীরও বিরোধী ছিলেন তিনি, কিন্তু ঠাহর করা দুষ্কর যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতেন কিনা । রামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন বলেছিলেন যে কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটবে তখন বিদ্যাসাগর কেবল মৃদু হেসেছিলেন, কোনো উত্তর দেননি । রামকৃষ্ণই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় করতে গিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর যাননি।

         প্রাথমিকের শিক্ষার্থিদের জন্য বিদ্যাসাগর যখন ‘বোধোদয়, লিখলেন, যেমনটা ইংল্যাণ্ডে ছিল ‘চেম্বার্স রুডিমেন্টস অফ নলেজ’, সেই বইতে বিদ্যাসগর ধর্ম নিয়ে কোনো পর্ব রাখেননি । পরবর্তীকালে গুণগ্রাহী, বন্ধু এবং আলোচকদের অনুরোধে তিনি  বলেন যে ঈশ্বর ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’, যার সঙ্গে ইসলামি ভাবনার মিল আছে, তাঁদের আরাধ্য ঈশ্বরকেও তা-ই বলা যায়, যিনি নিরাকার। বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামি গোষ্ঠী এই বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেননি, তাঁরা বিদ্যাসাগরকে বাংলাদেশে পাকিস্তানিফাই করতে বদ্ধপরিকর ।

         বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মোহনদাস করমচন্দ গান্ধি লিখেছেন, He was a Hindu and a Brahmin too. But to him, Brahmin and Sudra, Hindu and Muslim were all alike. Himself he led a very simple life. His dress consisted of a coarse dhoti, a shawl of similar kind to cover his body, and slippers. In that dress he used to call on Governors, and in the same dress he greeted the poor. He was really a fakir, a sannyasi or a yogi. বিদ্যাসাগরকে তাঁর জন্মসূত্র অনুযায়ী হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ উল্লেখ করলেও, গান্ধি বলেননি যে বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন না আস্তিক । তার কারণ গান্ধি জানতেন যে বিদ্যাসাগর কোনো মন্দিরে যেতেন না, বিগ্রহের আরাধনা করতেন না ;  সেসময়ের কুলীন ব্রাহ্মণদের ইষ্টদেবতা বা পারিবারিক দেবতার মতো তাঁর কোনো আরাধ্য বিগ্রহ ছিল না । তাছাড়া তিনি সাংখ্য ও বেদান্তকেও স্বীকৃতি দেননি ।

         রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ রচনায় লিখেছিলেন , “বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ, যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে — করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গয়াছিলেন, আমি যদি অদ্য তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়।” রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর কোনো বিশেষ সম্প্রদায়, অর্থাৎ কেবল হিন্দুদের জন্যই কাজ করেননি, তিনি সবায়ের জন্য আত্মনিয়োজিত ছিলেন ।

        বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামি গোষ্ঠীর রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত কথাগুলো পছন্দ হবে না জানি, কেননা তাঁরা রবীন্দ্রনাথেরও পাকিস্তানিফিকেশান করতে চাইছেন, তাঁরা দাবি করছেন যে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলা হোক । আমরা অপেক্ষায় আছি সেই দিনটির, বাংলাদেশের মৌলবাদী না উদারবাদী, দুই পক্ষের কারা জেতেন দেখার জন্য ।

[ রচনাকাল : এপ্রিল – মে, ২০১৭ ]

About কিছু লেখাপত্র

পড়ুন এবং পড়ান ।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

1 Responses to ঈশ্বরচন্দ্রের পাকিস্তানিফিকেশন

  1. পিংব্যাকঃ বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে বাঙালী মুসলমান – সুষুপ্ত পাঠক-এর ব্লগ

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান